somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একদিন নলিনীকান্ত ভট্টশালী

০২ রা অক্টোবর, ২০১২ সকাল ৯:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৯২০ সনের এপ্রিল মাসের এক মধ্যাহ্নে কুমিল্লার গোমতী নদীর পাড়ের এক প্রত্যন্ত গ্রামে একটি বাদাম গাছের নীচে বসে দরদর করে ঘামছিলেন বত্রিশ বছরের শ্যামলবরণ যুবক নলিনীকান্ত ভট্টশালী। মাঝে মাঝে রুমাল দিয়ে ঘাড় আর মুখ মুছে নিচ্ছিলেন। তাঁর পাশে একটি মাটির ঘট। মাঝে মাঝে ঘট তুলে পানি খাচ্ছিলেন। তৃষ্ণা তবু মিটছিল না যেন । গাছতলায় বসে প্রচন্ড গরমে সিদ্ধ হচ্ছিলেন নলিনী। স্তব্দ, উষ্ণ দুপুর। বাদাম গাছের ডালে বসে তৃষ্ণায় দাঁড়কাক ডাকছিল। এক ফোঁটা বাতাস নেই। বাদাম গাছের পাতারা নড়ছিল না। ছাতার হাতল অবধি গরম হয়ে উঠেছে। বিবর্ণ আকাশের জ্বলন্ত সূর্যটা ধরনীতে কী এক আক্রোশে মাত্রাতিরিক্ত তাপ উগড়ে দিচ্ছিল ।

নলিনী এভাবে কত কত দিন নিদারুণ তাপদাহ সহ্য করে পূর্ব বাংলার পথে প্রান্তরে প্রত্নবস্তুর সন্ধানে ঘুরে বেড়িছেন। নলিনী ১৯১২ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এম.এ পাস করে কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে ইতিহাস পড়িয়েছে কিছুদিন। কুমিল্লা জেলার প্রাচীন নাম ছিল সমতট। শিক্ষকতার পাশাপাশি প্রাচীন সমতটের ইতিহাস সম্বন্ধে নিবিড় অনুসন্ধানে মগ্ন থেকেছেন। পাঠ করেছেন প্রাচীন পুথি, পান্ডুলিপি, ধর্মশাস্ত্র; সংগ্রহ করেছেন স্থানীয় লোককাহিনী । এভাবে এক নিঃসঙ্গ জ্ঞানসাধকের পথচলা আরম্ভ হয়েছিল। যে পথের শেষে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একটি ভবন। শাহবাগের ঢাকা কেন্দ্রীয় জাদুঘর ...


এই গ্রামটির নাম সাধুপুর।এই গ্রামেই নলিনীর ছাত্র কালীনাথ বসাক- এর বাড়ি। সে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ত । পুরাতত্ত্বে উৎসাহী কালীনাথ চিঠিপত্রের মাধ্যমে প্রিয় শিক্ষক নলিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে। কালীনাথ চৌদ্দগ্রামে একটা স্কুলে শিক্ষকতা করে। ঢাকা গেলে দেখা করে নলিনীর নিমতলীর বাড়িতে।

নলিনী ঢাকা জাদুঘরের কিউরেটর। জাদুঘরটি প্রথমে ছিল ঢাকার সচিবালয়ের ( পরবর্তীকালে যে ভবনটি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল) একটি কক্ষ। ১৯১৪ সালে জাদুঘরের উদ্বোধন হয় ।নলিনীর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে ঢাকার জাদুঘরটি পূর্ববঙ্গের সুধীসমাজের দৃষ্টি আকর্ষন করেছে। এদের অনেকের কাছেই প্রাচীন সামগ্রী ছিল। তারা সেসব জাদুঘরে উপহার দিয়েছেন। এসব কারণে সচিবালয়ের জাদুঘরটিতে ঠিক স্থান সঙ্কুলান হচ্ছিল না। ১৯১৫ সালের জুলাই মাসে নলিনী নিজস্ব প্রচেষ্টায় সচিবালয় থেকে নিমতলীর বারদুয়ারী ভবনে জাদুঘরটি সরিয়ে আনেন। জাদুঘরের কর্মচারী একজন দারোয়ান আর একজন চাপরাশি। আয়-ব্যয়ের হিসেব রাখেন একটি রেজিস্টার খাতায়।
নিমতলীর বারদুয়ারী ভবনের ঠিক ৫০ মিটার পশ্চিমে ছিল গাছগাছালি ঢাকা ছায়াময় একটি একতলা বাড়ি । সে বাড়ির নাম:‘বিনয়কুঠি’। নলিনী সেই বাড়িতেই থাকেন। এ বাড়িতেই তাঁর গ্রন্থাগার আর অফিসঘর। প্রত্নপাগল ওই মানুষটি সরকারি ছুটিছাঁটা নেন না। তিনি এখন উঠেছেন জাদুঘরের ২৪/৭ কর্মি এবং গবেষক।

কালীনাথ দিন কয়েক আগে নলিনীকে চিঠি লিখে জানাল: তার মায়ের অসুস্থতার কথা শুনে সে চৌদ্দগ্রাম থেকে সাধুপুরে আসে। এসে দেখে জলকষ্ট দূর করার জন্য কুমারপাড়ায় জমিদার শ্যামকৃষ্ণ রায়চৌধুরীর বদান্যতায় একটি পুস্করিণী কাটা হচ্ছে। পুকুরের মাটির স্তূপের মধ্যে খোঁজাখুঁজি করে সে একটি টেরাকোটা মূর্তির কান পেয়েছে। নলিনী চিঠি পাওয়া মাত্র কুমিল্লা রওনা হয়েছেন। যদিও ছোট ছেলেটি প্রবল জ্বরে আচ্ছন্ন। এনিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে খানিকটা মনোমালিন্যও হয়েছে। কালীনাথ অবশ্য এখন এই গ্রামে নেই। ওর কাকা যদুনাথ বসাক। তাঁরই জিম্মায় সে টেরাকোটা-কানটি রেখে গেছে। নলিনী যে সাধুপুর গ্রামে আসতে পারে সেটিও সে তার কাকাকে জানিয়ে রেখেছে।
নলিনী গোমতী নদীর পাড়ের এই সাধুপুর গ্রামে এসেছেন আজই। গতকাল রাত্রে কুমিল্লা শহরে কান্দিরপাড়ে ভিক্টোরিয়া কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক শ্রী অসিত মজুমদার এর- বাড়িতে ছিলেন। আজ ভোরে গরুর গাড়িতে যাত্রা করে সকাল এগারোটায় গোমতী পাড় হয়েছেন। নদীর পাড় থেকে মিনিট দশেক হাঁটলেই সাধুপুর । কালীনাথ- এর কাকা যদুনাথ বসাক-এর সঙ্গে দেখা করে কানটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছেন। নির্মাণকাল নবম শতক বলেই মনে হয়েছে। নলিনীর শরীরে তখন শিহরণ বয়ে যাচ্ছিল।
যে পুকুরটি কাটা হচ্ছে সেটি চতুস্কোন। এখনও পানি ওঠেনি। চারধারের পাড়ে কাদামাটির উঁচু স্তূপ। নলিনী নিজেও ঘন্টা কয়েক মাটি ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন। তেমন কিছু পাননি। এখন বাদাম গাছের তলায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন। সঙ্গে ঝোলায় চিঁড়া আর গুড় ছিল। তাই খেয়েছেন। যদুনাথ বসাক অবশ্য মধ্যাহ্নের আহারের নিমন্ত্রণ করেছিলেন। নলিনী সবিনয়ে প্রত্যাখান করেছেন। কখনও গাঁ-গঞ্জে পুরনো জিনিসের সন্ধানে বেরুলে তিনি কারও বাড়িতে কিছু খান না। বরং উপোস করেন ...
কখনও নির্জন অবকাশ পেলে নলিনী ইতিহাস-সংক্রান্ত গভীর ভাবনায় মগ্ন হন। তিনি এ মুহূর্তে রাজশাহীর কাছে একটি মাটির ঢিবি খুঁড়ে পাওয়া সুলতানি আমলের একটি মুদ্রা নিয়ে গভীরভাবে ভাবছিলেন। যদিও নলিনীর প্রধান গবেষনার বিষয় প্রাক-মুসলিম বৌদ্ধ-হিন্দু আমল। তবে সে আমলের ইতিহাসচর্চায় তিনি সীমাবদ্ধ নন। তিনি বাংলার মুসলিম ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়েও যথেষ্ট আগ্রহী । নলিনী দীর্ঘকাল ধরে সুলতানি আমলের মুদ্রা অসীম ধৈর্যের সঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। আসলে নলিনী মুসলিম মুদ্রাবিদ্যায় অসাধারণ পান্ডিত্য অর্জন করেছিলেন।

নলিনীকান্ত ভট্টশালীর ‘কয়েনস অ্যান্ড ক্রোনোলজি অভ দি আরলি ইন্ডিপেন্ডেন্ট সুলতানস অভ বেঙ্গল’ বইটি ১৯২২ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। এই বইটি আজও আকরগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত । ১৯৩৬ সালে ‘মুসলিম কয়েনস ইন দি ঢাকা মিউজিয়াম’ নামে একটি ক্যাটালগ প্রকাশ করেছিলেন নলিনী । মুসলিম আমলের মুদ্রার ওপর ভিত্তি করে তিনিই সর্বপ্রথম মুঘল-পূর্ব মুসলিম আমল সম্বন্ধে এক যৌক্তিক বর্ণনা উপস্থাপন করেন।


সুলতানী আমলের মুদ্রা ছাড়াও নলিনী এই নির্জনে বসে বাংলার স্বাধীন মুগলবিরোধী শাসক বারো ভুঁইয়াদের নিয়ে ভাবছিলেন।

‘বেঙ্গল পাস্ট অ্যান্ড প্রেজেন্ট’- এর ৩৫ তম খন্ডে নলিনীর লেখা ‘বেঙ্গল চিফস স্ট্রাগল ফর ইন্ডিপেন্ডেনস ইন দি রেইন অভ আখবার অ্যান্ড জাহাঙ্গীর’ নামে এক সুদীর্ঘ প্রবন্ধ বেরিয়েছিল । এই প্রবন্ধে তিনি বাংলার বারো ভুঁইয়াদের ওপর বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে-যা আজও বারো ভুঁইয়াদের ওপর আমাদের জ্ঞানের উৎস।

নলিনী গাছতলায় বসে বিশ্রাম নিলেও মাটি-কাটিয়েদের বিশ্রাম নেওয়ার ফুসরত নেই। এই খর রৌদ্রে ওরা পুকুরে নীচে মাটি কেটে যাচ্ছে। দিন আনি দিন খাই ওই মানুষগুলির পরনে খালি ছেঁড়া ময়লা ধুতি । তাদের কালো চকচকে পিঠ ঘামে পিচ্চিল। নলিনী ওদের বলে রেখেছেন মাটি খোঁড়ার সময় মাটির চারা বা পাথর পেলে যেন আলাদা করে রাখে। ওদের কিছু পয়সা দিলে ভালো হত। কিন্তু, সে উপায় নেই। নলিনীর মাসিক বেতন দুশো টাকা। অবশ্য হাতে পান আরও ৫ টাকা কম। তার মানে ১৯৫ টাকা। ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রের লালফিতার দ্যেরাত্ম আর কী! এই টাকায় সংসারের খরচ মেটাতে হয়। ছুটতে হয় পূর্ববাংলা এপ্রান্ত থেকে সে প্রান্তে। সংসারে টানাটানি লেগেই আছে। যার ফলে স্ত্রীর সঙ্গে মনোমালিন্য অনিবার্য হয়ে ওঠে।
নলিনী উদ্বেগ বোধ করেন। প্রবল জ্বরে আচ্ছন্ন ছোট ছেলেটির মুখটি বারবার মনে পড়ছে । অবিলম্বে ঢাকায় ফেরা দরকার। তাছাড়া জাদুঘরেও কাজ পড়ে রয়েছে। ঢাকা জাদুঘর আর নলিনীকান্ত ভট্টশালী যে অভিন্ন। গভীর মমতায় সদ্যজাত প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলছেন; আবিস্কৃত প্রত্নবস্তুর দীর্ঘ বিবরণ লিখে রাখছেন। জাদুঘরের গ্যালারিতে ডিসপ্লের জন্য লেবেল কিংবা ক্যাপশন তিনিই লিখেন। ছবিও নিজেই তুলেন। শোকেসের নকশার জন্য কোনও কাঠমিস্ত্রির কাছে ছুটে যাননি কখনও। শোকেস তিনিই বানান। সব সময় ভাবেন কীভাবে আরও আকর্ষণীয় করে প্রতœবস্তু উপস্থাপন করা যায়। জাদুঘরের শ্রীবৃদ্ধির জন্য প্রত্নবস্তুর সংগ্রহের উদ্দেশ্যে হন্যে হয়ে প্রত্যন্ত গ্রামেগঞ্জে ঘুরে বেড়ান ক্লান্তিহীন। সঙ্গে একটি ঝুলিতে চিঁড়ে, মুড়ি, আখের গুড়, কাগজ, ক্যামেরা, চর্টলাইট, বেতারযন্ত্র।

আজ থেকে একশ বছর আগে পথঘাট আজকের দিনের মতো ছিল না। পদ্মা-মেঘনা পেরুতে হত নৌকায়। আজ আমরা কত সহজে কুমিল্লার কোটবাড়ি যাই। শাহবন বিহারে ঘুরে বেড়াই। তখনকার দিনে কুমিল্লা শহর থেকে শালবন বিহারে গরুর গাড়ি কিংবা পালকি ছাড়া যাওয়ার উপায় ছিল না। তা সত্ত্বেও এই তরুণ প্রত্নপাগলটি দমে যান নি। শীতগ্রীষ্ম উপেক্ষা করে মাইলের পর মাইল হেঁটেছেন অচেনা গ্রাম্যপথে। তবে তাঁর এই প্রত্নগবেষনা কাজে বেতনের অর্থ ছিল অপর্যাপ্ত। তবে তিনি চাকরি ছাড়ার কথা ঘুনাক্ষরেও ভাবেননি।

পুকুর থেকে এক মাটি কাটিয়ে উঠে এল। এদিকেই আসছে সে। হাতে কী যেন। কাদা মাখা। সে নলিনীর কাছে এসে বলল, বাবু, এই লন।মাখি খুঁড়তে গিয়া পাইলাম।
জিনিসটা হাতে নিয়ে এক ঝলক দেখেই নলিনীর শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। কষ্টি পাথরের ধ্যানীবুদ্ধ মূর্তি। ছোট। মাত্র ছ’ইঞ্চি। এ ধরণের মূর্তি এই প্রথম দেখলেন নলিনী। তাঁর বুক কাঁপছে। হাতও কাঁপছিল।
নলিনী তন্ময় হয়ে ছিল। মুখ তুলে দেখেন গ্রামের লোকজন জড়ো হয়েছে। এদের মধ্যে কালিনাথ এর কাকা যদুনাথ বসাকও রয়েছেন। মাঝবয়েসি লোকটার গায়ের রং কুচকুচে কালো। সাদা রঙের ধুতি পরা। কাঁধে একটি উড়নি । তিনি বললেন, পুকুরে নাকি মূর্তি পাওয়া গেছে স্যার? কন্ঠস্বর কেমন ক্যানক্যানে।
হ্যাঁ।এই যে। বলে মূর্তিটা দেখালেন।
ভিড়ের মধ্যে চাপা গুঞ্জন উঠল।
স্যার, এরা মূর্তি চায়। যদুনাথ বসাক বলল।
কেন?
এরা পরতিমা পূজা করতে চায়। এগো কাছে পরতিমা হইল পবিত্র জিনিস।
নলিনী যা বোঝার বুঝলেন। তিনি লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, শোনেন, আমি একজন শিক্ষক। কুমিল্লা শহরের ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়াইতাম। আপনাদের গেরামের বসাকবাড়ির কালীনাথ বসাক আমার ছাত্র ছিল। কথাটা কালীনাথের কাকারে জিজ্ঞাসা করেন।
ক্যানক্যানে কন্ঠে যদুনাথ বসাক বললেন, হ। হ। ইনি হইলেন একজন পন্ডিত মানুষ। ইনার নাম নলিনীকান্ত ভট্টশালী। বাড়ি বিক্রমপুর। আমার ভাইপো কালীনাথে ইনার ছাত্র আছিল।
নলিনী বললেন, আমি এখন ঢাকা শহরে থাকি, বুঝলেন? ঢাকা শহরে যে জাদুঘর আছে, ... আপনারা জাদুঘর বুঝেন?
হ। হ। বুঝি। বুঝি। লোকগুলি একসঙ্গে বলল।
আমি সেই জাদুঘরের বড়বাবু। এই মূর্তিখান আমারে দেন। এই মূর্তি আমি যত্ন করে জাদুঘরে রাইখা দিব।
যদুনাথ বসাক বলল, স্যার,এরা গ্রামের লোক। পুরাতন মূর্তি পাইলে সিন্দুর লাগাইয়া পূজা দেয়। তারা সহজে এই মূর্তিডা গ্রামের বাইরে নিয়া যাইতে দিব না।
নলিনী মাথা নাড়েন।অলখে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। তিনি ব্যাপারটা জানেন। তাঁকে এর আগেও বহুবার এই রকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। তাঁর কপালে ভাঁজ পড়ে। ভুরু কুঞ্চিত হয়ে ওঠে। মূর্তির ব্যাপারটা ধর্মীয় বলেই ভারি সেনসেটিভ। কিন্তু কী করা যায়। ওদিকে বেলা পড়ে আসছে। আজই ঢাকায় ফিরে যেতে হবে। ছেলেটার কথাও মনে পড়ছে। তিনি অনেকটা মরিয়া হয়ে বললেন, আহা, এতো বুদ্ধমূর্তি। এরা বুদ্ধমূর্তি পূজা করে নাকি? এটা হিন্দু গ্রাম না?
যদুনাথ বসাক বলল, এরা অতশত বোঝে না স্যার। মূর্তিটা শিবের কৃষ্ণের না বুদ্ধের সেইটা আপনি বুঝবেন স্যার। আপনি হইলেন পন্ডিত মানুষ।
মাটির নীচ থেইকা মূর্তি বাহির হইলেই হইল-ব্যস। এরা সিন্ধুর লাগাইয়া পূজা করা শুরু করে।
নলিনী লোকগুলির দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক আছে। বুঝলাম, এই মূর্তি তোমাদের গ্রামে পাওয়া গেছে। তবে এইটা এখন সরকারি সম্পত্তি। দেশে তো আইন আছে না? আমি ইংরাজ সরকারের কর্মচারী। এই মূর্তি নিয়ে যাবার অধিকার আমার আছে।
ভিড়ের মধে গুঞ্জন উঠল। ব্রিটিশ সরকারকে এরা ভয় পায়। বাঘের মতন ডরায়। নলিনী বললেন, মূর্তিটা এখন ঢাকায় নিয়া জাদুঘরে রাখব। যেন সবাই দেখতে পায়। যেন সবাই পূজা করতে পারে।
লোকগুলি আর কথা বলছে না দেখে বুদ্ধমূর্তিটা ঝোলায় রেখে যদুনাথ বসাক- এর কাছে বিদায় নিল নলিনী। তারপর হন হন করে হাঁটতে লাগলেন। মনে হয় না আজ ঢাকায় রওনা হওয়া যাবে। আজ রাতটা কুমিল্লা শহরে থেকে কাল ভোরে ঢাকা রওনা হবেন ।
কুমারপাড়া পেরিয়ে ঘন বাঁশঝাড়। বাঁশঝাড়ের ভিতর দিয়ে ধুলা ভরতি মাটির সরু একটা পথ গোমতী নদী পর্যন্ত চলে গেছে। পায়ের তলায় ধুলা, শুকনো বাঁশপাতা। নলিনী অবশ্য খেয়াল করছেন না। আজ সাত রাজার ধন মিলেছে। ছ’ইঞ্চি বুদ্ধমূর্তি! ভাবা যায়? কারা এ মূর্তি তৈরি করেছে? এ উত্তর আমি দিতে পারলেও নিশ্চয়ই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কেউ পারবে।
ভবিষ্যতের মানুষ এ মূর্তি দেখবে ...

নলিনীর জানার কথা নয় ... ঢাকার ঢাকা কেন্দ্রীয় জাদুঘর নির্মিত হয়েছিল শাহবাগে । সেই জাদুঘরের উদ্বোধন হয়েছিল ১৯৮৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর। অবশ্য সেই ভবনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল ১৯৬৬ সালে । ১৯১৪ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের একটি কক্ষ যে জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এক প্রতœউন্মাদ মানুষটির অক্লান্ত প্রচেষ্টায়, তার প্রায় ৭০ বছর পর শাহবাগে সুবিশাল ঢাকা কেন্দ্রীয় জাদুঘরটির উদ্বোধন হয় । আমরা তো যাই শাহবাগের কেন্দ্রীয় জাদুঘরে। ঘুরে ঘুরে দেখি এর নানা কক্ষ। তখন আমাদের কি মনে পড়ে নলিনীকান্ত ভট্টশালী নামে একজন বাঙালি প্রত্নতাত্ত্বিক এর কথা? জাদুঘরকে সমৃদ্ধ করার জন্য যিনি দিনের পর দিন চিঁড়া-মুড়ি আর আখের গুড় নিয়ে বসে থাকতেন পূর্ববাংলার কোনও নিভৃত গ্রামের পুকুরের পাড়ে?


নলিনী তন্ময় হয়ে হাঁটছিল। হঠাৎ শীতল বাতাস বইতে শুরু করল। সম্বিৎ ফিরে এল তার। চেয়ে দেখলেন। রোদ মিইয়ে এসেছে। বাঁশবনে ঘন ছায়া ঘনিয়ে উঠেছে। কি ব্যাপার? আকাশে মেঘ জমল নাকি? বৈশাখ মাসের মাঝামাঝি। এ মাসে তেমন ঝড়বৃষ্টি হয়নি। প্রকৃতি দেবী কি ঝড়-ঝঞ্ছার জন্য আজকের দিনটিই বেছে নিলেন নাকি? নলিনী মুচকি হাসলেন। বুকে তাঁর অদম্য সাহস। বাংলার দামাল ছেলে তিনি।
গোমতী পাড়ে পৌঁছতেই দেখলেন সাদা রঙের বৃষ্টির চাদর ওপাড়ের তালতমাল গাছ ঢেকে দিয়ে এদিকে ছুটে আসছে। প্রবল বাতাস যেন নলিনীকে উড়িয়ে নেবে- এমন অবস্থা। আকাশ কালো। পিলে কাঁপানো শব্দ করে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। নদীর জলও কালো হয়ে উঠেছে। ঢেউও বিক্ষুব্ধ মনে হল।
ঘাটে একটি একটি কোষা নৌকা। দুটি ছইনৌকাও আছে। তবে কাউকে দেখা গেল না।ঝড়বৃষ্টি আসবে দেখে চলে গেছে? কোষা নৌকার গলুয়ে একজন মাঝি বসে আছে। মাঝিটি বয়েসে যুবক। গায়ের রং কালো। সবল স্বাস্থ। মাথায় লাল রঙের একটি গামছা পেঁচানো। পরনে ছেঁড়া গেঞ্জি আর লুঙ্গি। আশ্চর্য! তরুণ মাঝিটির সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের মুদ্রাবিদ এইচ.ই. স্ট্যপলটন এর মুখের গড়নের অদ্ভূত মিল! (বছর আটেক আগে ঢাকার সচিবালয়ে এইচ.ই. স্ট্যপলটন- এর সঙেগ দেখা করেছিলেন নলিনী )

এইচ.ই. স্ট্যপলটন ব্রিটিশ সরকারের কাছে ঢাকায় একটি জাদুঘরের স্থাপনের প্রস্তাব করেছিলেন। তাঁর প্রস্তাবের ফলে ব্রিটিশ সরকার ঢাকায় একটি জাদুঘর নির্মাণের গুরুত্ব উপলব্দি করতে পেরেছিলেন। অবশ্য ১৯১২ সালের ২৫ জুলাই পুরনো ঢাকার নর্থব্রুক হলে অনুষ্ঠিত এক সভায় নলিনী ছোট লাট লর্ড কারমাইকেলকে ঢাকায় একটি জাদুঘরের স্থাপনের গুরুত্ব বোঝাতে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছিলেন। পাশাপাশি সে সভায় নলিনী ঢাকার সুধীসমাজকে তাঁর সংগ্রহ করা প্রত্নবস্তু দেখিয়েছিলেন।লর্ড কারমাইকেল শিক্ষিত মানুষ। তিনি ২৬ বছর বয়েসি তরুণের আবেগে উজ্জ্বীবিত হয়েছিলেন। নলিনীকে ২০০০ টাকা দিয়েছিলেন।

নলিনী নৌকায় উঠতে যাবে- মাঝি বলল, নৌকায় উইঠেন না বাবু।
কেন?
দেখতেছেন না, কেমুন ঝড় আইতেছে।
একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে নলিনী বললেন, ভয় কী। তোমাদের সারাজীবন ঝড়জলের মধ্যেই তো কাটে।
মাঝি চুপ করে থাকে।
চল, ভয় কী। এই নদীর পাড়ে তোমার জন্ম না?
হ।
তাহলে? ঝড়তুফানকে ভয় পেলে চলে? এর আগে কখনও ঝড়ে পড়নি?
পড়ছি।
নৌকা ডুবেনি?
ডুবছে।
তাহলে?
মাঝির আঁতে ঘা লেগেছে। সে একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে বৈঠা তুলে নেয়। নৌকায় উঠে বসতেই নলিনীর মন দুলে উঠল। তার কারণ আছে। নলিনীর জন্ম বিক্রমপুরের নয়ানন্দ গ্রামের মাতুলালয়ে (২৪ জানুয়ারি, ১৮৮৮ সালে)। ছেলেবেলায় দামাল কিশোর খালে-বিলে ভরা নয়ানন্দ গ্রাম দাপিয়ে বেড়িয়েছে। আজও নদী-নৌকা দেখলে রক্তে কাঁপন ওঠে।
মাঝি নৌকা ছাড়ে। তবে বৈঠা বাইতে কষ্ট হয় তার । বাতাসের তোড়ে মনে হল নৌকা উলটে যাবে। বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়ছিল অন্ধকারের ভিতর। এত অন্ধকার যে মাঝির মুখ দেখা যায় না। কেবল শোঁ শোঁ বাতাস আর নদীর ওপর বৃষ্টি পড়ার তুমুল শব্দ। তুমুল ঝড় উঠেছে। নলিনী সাত রাজার ধন থাকা আঁকড়ে ধরে রেখেছেন সাত রাজার ধন ভরতি ঝোলাটি। প্রাণ গেলেও এটি হাতছাড়া করবে না। পারাপার গভীর অন্ধকারে ঢাকা। আকাশে কেবল বিদ্যুতের রূপালি রেখা চোখে পড়ে। বজ্রপাতের প্রচন্ড আওয়াজের ভিতর মাঝি চিৎকার করে উঠল। ঠিক তখনই নৌকা উলটে যায়। পানিতে নলিনী প্রথমে থই পায় না। তবে অনায়াসে ভেসে থাকতে পারল। উথালপাথাল ঢেউয়ে সাতাঁর কাটতে থাকে। পাড়ে শাহবাগের জাদুঘর। ওখানে যে করেই হোক বুদ্ধমূর্তিটি পৌঁছে দিতে হবে। তারপর সলিল সমাধি হলেও আক্ষেপ নেই!
এঁটেল মাটির আঠালো পাড়। পাড়ে উঠে তুমুল বৃষ্টির মধ্যে বসে থাকেন এক প্রতœপাগল যুবক। মাঝিটির জন্য তঁাঁর উদ্বেগ হয়। খানিক বাদে আবছা আঁধারে মাঝিকে পাড়ে উঠে আসতে দেখে নলিনী পাগলের মতন হাসতে থাকেন ... নলিনী মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন ... পরের মাসের বেতন থেকে কালীনাথের কাছে কুড়িটি টাকা পাঠাবেন । মাঝির নৌকা কেনার জন্য ...

তথসূত্র:

Click This Link

উৎসর্গ: রেজোওয়ানা
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই অক্টোবর, ২০১২ দুপুর ১:১৮
৯৭০ বার পঠিত
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক সিস্টেম কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখবে?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২০ শে নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের পতনের পর ড. ইউনূসের সরকার দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্কার কাজের প্রতিশ্রুতি দেন। নির্বাচন কমিশন ও ভোটের পদ্ধতি সংস্কারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

WW3 WARNING ☣️- ব্রিটেন, আমেরিকা,রাশিয়া,ইউক্রেন

লিখেছেন সরকার পায়েল, ২০ শে নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৩৮

এই প্রথম রাশিয়ায় ব্রিটেনের স্টর্ম শ্যাডো ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ ইউক্রেনের
এই প্রথমবারের মতো রাশিয়ার অভ্যন্তরে যুক্তরাজ্যের তৈরি দূরপাল্লার স্টর্ম শ্যাডো ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে ইউক্রেন। বুধবার (২০ নভেম্বর) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে আমি.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ২১ শে নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:১১

কে আমি?.....

Jean-Paul Charles Aymard Sartre (আমরা সংক্ষেপে বলি- জ্যা পল সাত্রে) নাম ভুলে যাওয়া একটা উপন্যাসে পড়েছিলাম, জার্মানীর অর্ধ অধিকৃত ফরাসীদের নিয়ে।

'হিটলারের সৈন্যরা প্যারিস দখল করে নিয়েছে। কয়েকশো মাইল দূরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বৈরাচারী দল আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হচ্ছে না!

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২১ শে নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:০৮


বেশ কয়েকদিন ধরেই বাংলাদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক আওয়ামী লীগ কে নিষিদ্ধ করার জন্য সমাজের একটি বৃহৎ অংশ দাবী জানিয়ে আসছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বিএনপি কে অনেকে দায়ী করছে কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পকে আধুনিকায়নের চেষ্টা

লিখেছেন জটিল ভাই, ২১ শে নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৭

♦أَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشِّيْطَانِ الرَّجِيْمِ (বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহ্'র নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি)
♦بِسْمِ ٱللَّٰهِ ٱلرَّحْمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ (পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহ্'র নামে)
♦ٱلسَّلَامُ عَلَيْكُمْ (আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক)


(ছবি নেট হতে)

বনের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×