
শিখ ধর্মের পথিকৃৎ গুরু নানক (১৪৬৯-১৫৩৯) । নানক ১৫০৪ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় এসেছিলেন। তথ্যটি শিখদের একটি ওয়েভসাইট থেকে জানা গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুদোয়ারা নানকশাহী তাঁরই স্মৃতি বহন করছে। তৎকালীন সুজাতপুর মৌজায়, এখনকার নীলক্ষেত রোড, তিনি তাঁর জীবনদর্শন আলোচনা করেছিলেন-যার কিছুটা আগের একটি পোষ্টে আলোচনা করেছি। নানক একটি গুরুত্বপূর্ন কথা বলেছিলেন:"Realisation of Truth is higher than all else. Higher still is truthful living"... যে কারণে ভাবতে ভালো লাগে যে একজন একেশ্বরবাদী পাঞ্জাবী সাধু নানক এর পদধূলিতে ধন্য হয়েছিল আমাদের প্রিয় ঢাকা ...

ঢাকার পুরনো মানচিত্র। অবশ্য ষোড়শ শতকের নয়, পশ্চিমে দেখা যাচ্ছে ধানমন্ডি । এখানে প্রথম নৌকা থেকে নেমেছিলেন গুরু নানক ।
ষোড়শ শতকের (১৫০০) প্রারম্ভের কথা বলছি। সে সময় ঢাকার রায়ের বাজার আর ধানমন্ডির ছিল গ্রাম । সে গ্রামের নাম শিবপুর। বলাবাহুল্য, এই নামটি পরে বদলে যায়। শিবপুর গ্রামের দক্ষিণ পশ্চিমে বইত বুড়িগঙ্গা। একালে মতো কালো বিবর্ণ ছিল না নিশ্চয়ই-ছিল স্বচ্ছসলিলা, প্রশস্ত। শিবপুর ঘাটে ভিড়ত কত নৌকার । ঘাটে হাট-বাজার। দোকানপাট। লোকে ভিড়ে গমগম করত।

বাংলার চিরায়ত দৃশ্য। নানক এমনই দৃশ্য দেখেছিলেন শিবপুর গ্রামে ...
১৫০৪ সাল। শিবপুর ঘাটে নৌকা থেকে নামল ৩৫ বছরের এক পাঞ্জাবি যুবক। পাটল রঙের গোরুয়া পরা সে যুবকের নাম নানক দেব। যুবক তত্ত্বদর্শী। দেশ ভ্রমনে বেরিয়েছে-জেনে নিতে চায় একেশ্বরের নানা রূপ; জগতে কীভাবে একেশ্বর নিজেকে নানা বিভঙ্গে ছড়িয়ে রেখেছেন। যুবককে ঈষৎ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। কেননা সে মিথিলা, কান্তনগর (দিনাজপুর), কামরুপ এবং সিলেট হয়ে দীর্ঘপথ ভ্রমন করে ঢাকা এসেছে। যুবকের কয়েকজন সহচর ছিলেন। তারাও তত্ত্বদর্শী । তারাও চোখকান খুলে রেখে দেখে নিচ্ছে সব।

এই মানচিত্রটি খুঁটিয়ে দেখলে বুঝতে পারবেন সাধু নানক এর (নৌ) ভ্রমন পথটি কেমন ছিল।
নানক যখন ঢাকায় এলেন তখন বাংলাকে বলা হত ‘বাঙ্গালাহ।’ বাংলায় তখন হোসেনশাহী বংশের শাসন। (১৪৯৪-১৫১৯) ...অতএব ঢাকাও। কিন্তু, তার আগে? নবশ শতকে সেনদের অধীনে চলে যাওয়ার পূর্বে ঢাকা ছিল কামরুপের বৌদ্ধ রাজাদের নিয়ন্ত্রনে। ১২ শতকে বল্লাল সেন ঢাকেশ্বরী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ঢাকা নামটির উৎস সম্ভবত ওই ঢাকেশ্বরী শব্দটি। অনেকে আবার বলেন যে সেকালে ঢাকার আশেপাশে থরে থরে ঢাক ফুল (Butea frondosa) ফুটে থাকত বলেই ওই নাম।
Butea frondosa ফুল
সে যাই হোক। ১৬০৮ সালে মুগলরা আসার পূর্বে দিল্লী সুলতানশাহীর শাসন ছিল ঢাকা। সুলতানী আমলেই ঢাকা নগরকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে থাকে। লক্ষী বাজার, শাঁখারি বাজার, তাঁতী বাজার, পাটুয়াটুলী, কুমারটুলি, বানিয়া নগর-এসব এলাকা ধীরে ধীরে রুপ লাভ করে। পরে মুগল আমলে প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদা পেয়েছিল ঢাকা। ঢাকার সত্যিকারের প্রতিষ্ঠা তখন থেকেই।

ঢাকার মানচিত্র। পশ্চিমে ধানমন্ডি ...
নানক সম্ভবত কোনও উদার হৃদয়ের বাড়িতে উঠেছিলেন । বাঙালি অতিথি পরায়ণ। নানক সব লক্ষ করছিলেন। শিবপুর বর্ধিষ্ণু গ্রাম হলেও অধিকাংশ স্থানীয় জনগন স্বচ্ছল নয়। বিশুদ্ধ পানির বড় অভাব। দূষিত পানি রোগশোকের কারণ। নানক শিবপুর গ্রামের জাফরাবাদ এলাকায় পানীয় জলের অভাব দূর করতে একটি কূপ খনন করালেন । পরে নাকি সেখানে বিদেশি অতিথিদের স্নানের সুবিধার্থে এক স্থানীয় শাসক পুকুর খনন করিয়েছিলেন । লোকে বলত, সে পুকুরের জলে ছিল নাকি অলৌকিক ক্ষমতা। যা হোক। ১৯৫৯ অবধি সে কূপটি শিখরা দেখভাল করত। পরে আবাসন প্রকল্পের জন্য সরকার জমি বন্টন করে দেয় । নানক এর কুয়াটি বর্তমানে ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার ২৬ নং সড়কের ২৭৮ বাড়িতে অবস্থিত ।
ঢাকেশ্বরী মন্দিরের ছবি। নানক ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দিরে নাম শুনেছিলেন। শিষ্যদের নিয়ে সে মন্দিরে গেলেন একদিন। মন্দিরে পূজারীর ভিড়। দেবী মূর্তিটি সম্বন্ধে শুনলেন স্থানীয় প্রচলিত উপকথাটি। দেবী মূর্তিটি নাকি মাটির নিচে পাওয়া গিয়েছিল। তাই এর নামকরণ এরূপ, অর্থাৎ, ঢাকেশ্বরী। বাংলার প্রাচীন সেন রাজা রাজা বল্লাল সেন মূর্তিটি খুঁজে পান।
গুরু নানক।
এখন যেটা ঢাকার নীলক্ষেত, তখন ছিল সুজাতপুর মৌজা। নানক সেখানে একটি মাঞ্জি প্রতিষ্ঠা ধর্মীয় উপদেশ দিতে লাগলেন। মাঞ্জি শব্দটি পাঞ্জাবি ভাষার-এর অর্থ আধ্যাত্মিক আলোচনার কেন্দ্র । পরে এটাই হয়ে ওঠে নানকশাহী গুরুদোয়ারা। ব্রিটিশ আমলে রমনা অর্ন্তগত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। নানক কি জানতেন তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাঞ্জির পাশ ঘেঁষেই একদিন গড়ে উঠবে বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠটি?

ঢাকার নানকশাহী গুরুদোয়ারা। গুরু নানক এর স্মৃতি রক্ষার্থে এটি নির্মাণ করেছিলেন ভাই নাথ নামে এক ধনী শিখ। বাংলার মুগল সুবাহদার শায়েস্তা খানের (১৬৬৪-১৬৮৮) কন্যা পরীবিবির মাজারের অনুকরণে ভবনটি তৈরি হয়। ১৮৩০ সালে গুরুদোয়ারা নানকশাহীর নির্মান কাজ শেষ হয়।
নানক ঢাকা থেকে গিয়েছিলেন চট্টগ্রাম। সেখানে চক বাজারে একটি মাঞ্জি স্থাপন করেন। তারপর চট্টগ্রাম থেকে প্রথমে কলকাতা পরে উড়িষ্যার পুরী হয়ে পাঞ্জাব ফিরে গিয়েছিলেন সেই আধ্যাত্মিক যুবকটি।