জীবনানন্দ কি চুরুট খেতেন?
এই প্রশ্নের কারণ?
জীবনানন্দের "পথ হাঁটা" কবিতায় চুরুটের প্রসঙ্গটি আছে।
তখন অনেক রাত-তখন অনেক তারা মনুমেন্ট মিনারের মাথা
নির্জনে ঘিরেছে এসে;-মনে হয় কোনোদিন এর চেয়ে সহজ সম্ভব
আর কিছু দেখেছি কি: একরাশ তারা আর মনুমেন্ট ভরা কলকাতা?
চোখ নিচে নেমে যায়-চূরুট নীরবে জ্বলে-বাতাসে অনেক ধূলো খড়;
চোখ বুজে একপাশে সরে যাই-গাছ থেকে অনেক বাদামি জীর্ণ পাতা
উড়ে গেছে;
শুধু কবিতায় নয়। চুরুট খাওয়ার প্রসঙ্গটি জীবনানন্দের গল্পেও বারবার এসেছে। হ্যাঁ। জীবনানন্দ গল্পেও লিখতেন এবং সে ক্ষেত্রেও তিনি সফল। ‘জামরুলতলা’ গল্পে জীবনানন্দ লিখেছেন: ‘ কলকাতায় আজকালই চলে যাব আমি। না হলে ভবিষ্যৎটাই মাটি হয়ে যাবে যে। কিন্তু রাতের বেলা টেবিলের পাশে বসে চুরুট টানতে টানতে মনে হয়, কলকাতা গেলেই-
কতবার তো গেলাম আমি।
হ্যাঁ, এই চুরুট ; ত্রিশ টাকার মধ্যে চুরুটের বরাদ্দও রয়েছে। তবে বেশি চুরুট আমার লাগে না; চুরুট মাঝে -মাঝে বাইরে থেকেও আসে, চুরুটের দোকানে কিছু পয়সাও বাকি পড়ে থাকে বার মাস আমার।
আজকাল রাত জেগে আমি খুব জীবনানন্দর লেখা গল্প পড়ছি। পড়ছি আর অবাক হয়ে যাচ্ছি। পড়তে পড়তে মানুষ জীবনানন্দ কে আবিস্কার করছি। অন্য এক জীবনানন্দ কে চিনতে পারছি যেন। যে জীবনানন্দ কে কবিতায় তেমন করে পাওয়া যায় না। আমার বরাবরই মনে হয়েছে যে কবিতায় জীবনানন্দ ভূমিকা অনেকটা পর্যবেক্ষকের। যে পর্যবেক্ষকের শুধু দেখে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনও কাজ নেই। - যেমন ক্যাম্পে কবিতায়
জীবনানন্দ লিখেছেন -
এখানে বনের কাছে ক্যাম্প আমি ফেলিয়াছি;
সারারাত দখিনা বাতাসে
আকাশের চাঁদের আলোয়
এক ঘাইহরিণীর ডাকে শুনি -
কাহারে সে ডাকে!
কিংবা
এই সব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে;
বাইরে হয়তো শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা,
কিংবা প্যাঁচার গান; সেও শিশিরের মতো, হলুদ পাতার মতো।
এসব কবিতায় পর্যবেক্ষণনিষ্ট একজন কবিকে পাই; যাঁর বর্ননার ক্ষমতা বিস্ময়কর। তবে গল্পে সত্যিকারের মানুষ জীবনানন্দ কে যেন পাই। কবিকে অসুখি এক বেকার স্বামীর ভূমিকায় দেখি। শহরে বড় হওয়া স্ত্রীকে যিনি পূর্ববাংলার একটি নিভৃত গ্রামের গাছপালা চেনাচ্ছেন। কবি নিজে রয়েছেন বৃহৎ এক সংসারের মাঝে। সে কথা কবির লেখা গল্পে ফুটে ওঠে, ফুটে ওঠে কুড়ি শতকের পূর্ব বাংলার এক যৌথপরিবারের ঘনিষ্টনিবিড় চিত্র ...
‘পুব দিককার এই খড়ের ঘরটায় আমি একাই থাকি; মাস দুই আগেও সবাই ছিলেন; আরো কয়েক মাস আগে শোভনা, খুকি সবাই ছিল। বাড়িটা কম বড় নয়, এক সময় প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশজন লোক এই উঠানে বসে মজলিশ করত ; চাঁদনি রাতে তাকিয়া-ফরাস পেতে বসত, দাবার আড্ডা চলত, মেয়েরা মাদুর পেতে বিন্তি খেলতে বসত।’ (‘জামরুলতলা’)
কবিতায় এরকম ঘনিষ্ট বর্ননা কোথায়? তাহলে গল্পগুলি কি কবি আত্মজীবনের টুকরো টুকরো অংশ? কখনও কখনও কবির পরিবেশ-প্রতিবেশ কবির কবিতার পটভুমি হিসেবে কাজ করে বৈ কী। যেমন, মহাপৃথিবী কাব্যগ্রন্থের ‘নিরালোকে’ কবিতায় ঘোড়ার প্রসঙ্গ এসেছে।
কে যেন উঠিল হেঁচে-হামিদের মরকুটে কানা ঘোড়া বুঝি!
সারাদিন গাড়িটানা হ’ল ঢের ,-ছুটি পেয়ে জ্যোস্নায় নিজ মনে
খেয়ে যায় ঘাস;
‘জামরুলতলা’ গল্পে জীবনানন্দ লিখেছেন...‘অবাক হয়ে এক-একবার উঠানটার দিকে তাকিয়ে দেখি হরিচরণের আস্তাবলের দুটো মরকুটে ঘোড়া এসে ঘাস খাচ্ছে। ”
আর কবির পরিবেশের গাছপালাও যেন উঠে আসে কবিতায় ...
‘মাঠের উত্তর কিনারে কতকগুলো আমগাছ, মাঝামাঝি দুটো অশ্বত্থ গাছ, এখানে সেখানে সজনে, পেয়ারা, জামরুল , কৃষ্ণচূড়া , মাদার, হিজল, পলাশ, অর্জুন, আমলকি, ছাতিম গাছ।’
এবং ...
‘চারদিকে গরুর গেরো। তিন-চারটি বাড়ির ছাগল-গরুর সমাবেশ, আগাছার জঙ্গল, শুকনো ফুল ও পেয়ারা পাতার ওড়াউড়ি-গাঙশালিকের কিচিরমিচির।’
নিজের ক্লান্ত ভূমিকা-
‘উঠানটাকে পরিস্কার করতে ইচ্ছা হয়, এক-একদিন কাস্তে নিয়ে নামি ; কিন্তু কী লাভ; কাস্তেটা একটা লেবু গাছের ঝোপের ভিতর ছুঁড়ে ফেলে দিই। ’
আরেক জায়গায় কবি লিখেছেন...
‘টেবিল থেকে খানিকটা দূরে শোবার চৌকিটা; চৌকির ওপর সারাদিন মাদুর পাতা থাকে। রাতের বেলা কোনোদিন বিছানা পাতা হয়, কোনো-কোনোদিন মাদুরেই শোয়া যায় ...হাত-পা ছেড়ে চুপচাপ বসি, খানিকক্ষণ গেল। মনের সুন্দর ভাবটা কেমন নষ্ট হয়ে গেল। খাটে গিয়ে নির্জীবের মত শুয়ে পড়ি ...’
কবির গল্প পাঠে টের পাই কবির গাছগাছালিময় শ্যামল নির্জন পরিবেশই কবিকে হাত ধরে নিয়ে গেছে কবিতার দিকে ...
‘আমার জানালার সামনে-বাড়ির উঠানটা ঘুরে, একটা মস্ত বড় মাঠের সঙ্গে গিয়ে মিশেছে। এই মাঠটাও (এই সংসারের কর্তাদের), বাড়ির পুব দক্ষিণ উত্তর সীমানা ঘিরে অনেকখানি জায়গা জুড়ে বিস্তৃত হয়ে রয়েছে; সকালবেলা মাঠের মত মনে হয়, দুপুরবেলা প্রান্তরের গন্ধ পাই, জ্যোস্নারাতে তেপান্তরের আস্বাদ জেগে ওঠে।’
জীবনানন্দ জীবনভর ঢের গদ্য লিখেছেন। কখনও কখনও সে গদ্য যেন কবিতার মহিমা লাভ করেছে। পাঠ করা যাক।
‘কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে সমস্ত দুপুর একপাল ভেড়া বসে থাকে; মাঝে-মাঝে জ্যোস্নারাতেও ওগুলোকে দেখা যায়। পাশের কোনো এক বাড়ির ভেড়া হবে; হয়ত মজুমদারের। ওগুলোকে তাড়িয়ে দিতে একটুও ইচ্ছা করে না আমার; নিস্তব্ধ দুপুরবেলা ছায়া-উদাস ছাতিম-কৃষ্ণচূড়ার নীচে এদের এই নিরিবিলি জীবনধারণা, পরস্পরের এই নিকট সংসর্গ, বিচ্ছেদহীন নীলাভদিন মৃগনাভী (?) গন্ধময় রাত-তৃপ্তি, শান্তি, দেখতে -দেখতে আমার নিঃসঙ্গ জীবনের একটা কিনারা পাই যেন । (সমস্ত দুপুর ডালপালার ভিতর বাতাস উচ্ছলিত হয়ে ফেরে। মনে হয় যেন পাতা পল্লবের ভিতর মস্ত বড় একটা জনসমাজের কলরব চলছে চারিদিকে।) শালিকগুলো এক-একবার ভিড় পাকিয়ে আকাশ বাতাসের কাছে বিষম নালিশ জানিয়ে যায়; তীরের মত উর্ধ্বশ্বাসে আকাশের পথে ছুটতে- ছুটতে মাছরাঙা খেলা ছেড়ে চিৎকার করে ওঠে, আমার জানালার পাশে একটা মুহুরি গাছ ঘেরা। তেলাকুচার জঙ্গলের ভিতর দুর্গা টুনটুনির জীবন বেশ নরম; কিন্তু লতার গন্ধ-মমতার ছায়ায় কোকিল তৃপ্ত হয়ে পড়ে থাকে না। সে গাছের থেকে গাছে, ডালের থেকে ডালে, ছায়ায়, রোদে, না জানি কী খুঁজে মরে সে! শান্তি নাই! ‘চোখ গেল’-র একঘেয়ে ডাক কিছুক্ষণ পরে আর ভালো লাগে না, একটা ঢিল মেরে তাড়িয়ে দিতে পারলে বাঁচি। এক-একটা কোকিলও যখন জানলার কাছাকাছি ছাতিম গাছটার ডালে বসে নিঃসঙ্কোচে আত্মানুরঞ্জনে নির্বিবাদে ডাকতে থাকে তখন তাকে সম্প্রীতিকর অতিথি বলেই যেন মনে হয় বেশি। ”
পূর্ব বাংলা সঘন সবুজ পরিবেশ বাদে জীবনানন্দর গল্পের আরও দুটি বিষয় মানুষ ও দর্শন। ‘অঘ্রানের শীত’ গল্পে জীবনানন্দ লিখেছেন-
“ভালোবাসা মানে কোনো প্রণয়িনীর জন্য তিমির রজনী ভেঙে অভিসারই শুধু নয়, বার বার এই ছেলেটির (শিশুটির) কাছে ফিরে আসা। বাস্তবিক একে বাদ দিতে পারি না আমি। অনেক সময় বাদ দিতে চাই যদিও।”
গল্পটির আরও গভীরে যদি যাই তো দেখব ...
“...খোকা তার ঠাকুমার বিছানায় ঘুমিয়ে আছে। মশারি কেউ ফেলে দেয়নি। ছেলেটাকে মশায় কামড়াচ্ছে। ধীরে ধীরে বাতাস করে মশারি টেনে দিই। মাথাভরা কোঁকড়া কোঁকড়া চুল বালিশ ছেয়ে আছে, কপালে চুলে একটু হাত বুলোই।”
কিন্তু ...
“ ... চুমো দিই না। বাড়ির মেয়েরা, পাড়ার মেয়েরা যখন তখন এই শিশুর ঠোঁটে গালে চোখে মুখে অবিশ্রাম চুমা খেয়ে ফেরে। তারা একটু সাবধান হলে পারত।”
কবির এমন নিবিড় বোধ ও গভীর পর্যবেক্ষন! সত্যিই আশ্চর্য হয়ে যেতে হয় যে বাড়ির মেয়েরা, পাড়ার মেয়েরা ছোট শিশুটির ঠোঁটে গালে চোখে মুখে অবিশ্রাম চুমা খেলে কবির আপত্তি।
‘অঘ্রানের শীত’ গল্পটি পড়ে মানুষ ও প্রকৃতিবিষয়ক জীবনানন্দের চিন্তাধারা সম্বন্ধে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। সে ধারণা যেমন কাব্যিক তেমনি উদ্বেগজনক।
‘মস্তবড় উঁচু জাম, অশ্বত্থ গাছের ডালপালায় মাখা মাখা জোনাকির দল। এদের ভাষা ও গল্প জানবার জন্য সমস্ত জীবনটাকে উৎসর্গ করে ফেলতে ইচ্ছা করে। কয়েকটা শিশিরমাখা ঘাসের ওপর নেমে এসেছে, এদের আলোয় ঘাসের শিষ আবার মরকতের মতো সবুজ হয়ে উঠল। ঘাসের গোছার ভিতরে কোথায় শ্যামা পোকা ঘুমিয়ে রয়েছে, কিংবা শুক জমেছে, কিংবা ফসলের গুঁড়ি ছড়িয়ে আছে, কিংবা অন্য কোনো প্রেম বা স্বপ্ন জমে আছে জোনাকিরাই তা জানে। এদের নিস্তব্ধ জীবনের প্রবাহ শিল্প দেখি আমি, বড্ড স্নিগ্ধ ও সুন্দর। কোনো কোলাহল নেই, কাড়াকাড়ি নেই,রক্তাক্ততা নেই। ’
তার পরেই গল্পকার জীবনানন্দ লিখেছেন গা শিউরে ওঠা কথা...
“ ... একদিন রাতের পৃথিবী এদেরই (মানে জোনাকিদের) হবে। এদের আর ওই নিমগাছের লক্ষ্মীপেঁচার আর ওই গোয়ালের নীচের ইঁদুরের। মানুষের শেষ হাড়গোড় তখন ঝোপে জঙ্গলে বিস্তৃত। এই আমার মনে হয়। সে খুব সুন্দর দিন হবে তাহলে। তখন খুব নীরব ঠান্ডা, ঘন নিবিড় নারকোলের পাতায় নিবিড় জোনাকির মালায় মালায় ভরা সে খুব চমৎকার শান্তির রাত আসবে তখন। একদিন আসবেই। মানুষ তখন থাকবে না। ”
জীবনানন্দ কেন প্রকৃতির মাঝে মানুষকে চান না? কেন তিনি মানুষের বিনাশ কামনা করছেন? এ কোন্ জীবনানন্দ? জীবনানন্দকে ‘আমাদের সময়ের শ্রেষ্ঠ কবি ও দার্শনিক’ বলে অবহিত করা হয়েছে। একুশ শতকে আজ আমরা পরিবেশ বিপর্যয় রোধ করছে জলবায়ূ সম্মেলন করছি। অথচ বিংশ শতকের মাঝামাঝি এই প্রজ্ঞাবান কবি মানুষ বিনাশপ্রবণ রুপটি ঠিকই উপলব্ধি করেছিলেন । কবি ঠিকই জানতেন: মানুষের হা হা লোভের বলি হবে পৃথিবীর প্রকৃতি? সজল প্রকৃতির জরায়ূ ছিঁড়ে মানুষ বার করবে প্লাস্টিক-কার্বন? তাই তিনি লিখেছেন: “ ... একদিন রাতের পৃথিবী এদেরই (মানে জোনাকিদের) হবে। এদের আর ওই নিমগাছের লক্ষ্মীপেঁচার আর ওই গোয়ালের নীচের ইঁদুরের। মানুষের শেষ হাড়গোড় তখন ঝোপে জঙ্গলে বিস্তৃত। এই আমার মনে হয়। সে খুব সুন্দর দিন হবে তাহলে ...
বাঙালিমাত্রেই জীবনান্দপ্রেমী। কেননা তিনি লিখেছেন: "মস্তবড় উঁচু জাম, অশ্বত্থ গাছের ডালপালায় মাখা মাখা জোনাকির দল। এদের ভাষা ও গল্প জানবার জন্য সমস্ত জীবনটাকে উৎসর্গ করে ফেলতে ইচ্ছা করে।" ...তবে বাঙালির যা কিছু বন্দনা তাঁর কবিতা ঘিরে। রিচুয়ালটি অনাকাঙ্খিত নয় মোটেও, বরং কাম্য; তবে কথা হল: জীবনানন্দ তাঁর নিজের জীবনের নিরানন্দ ঘোচাতে প্রচুর গল্প-উপন্যাস লিখে গেছেন বাঙালির জন্য। এখন সে সব গল্প উপন্যাস পাঠ করে তা থেকে যথেষ্ট পরিমানে বিদ্যুৎ-শিহরন আরোহনের দায়িত্ব আমাদের। এবং জীবনানন্দের গল্প-উপন্যাসের প্রতি প্রত্যেক বাঙালির আগ্রহ ক্রমান্বয়ে তীব্র হোক -এই কামনা করছি।
‘জামরুলতলা’ ও ‘অঘ্রানের শীত’ গল্প দুটির উৎস: দেবেশ রায় সম্পাদিত ‘জীবনানন্দ সমগ্র’ শতবর্ষ সংস্করণ গল্প ১’; প্রতিক্ষণ পাবলিকেশনস্ প্রাইভেট লিমিটেড (কলকাতা ৭০০০১৩)
উৎসর্গ: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য ২।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৩:৩৭