দু’জন নারীকে ভয়ানক পাগল করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ । একজন বাংলার রাধা। অন্যজন রাজস্থানের মীরাবাঈ (১৪৯৮/১৫৭৩)। বাংলার রাধা অবশ্যি কবি জয়দেব এর কল্পনাপ্রসূত কাল্পনিক সত্ত্বা । পক্ষান্তরে মীরাবাঈ ঐতিহাসিক নারী। তাঁর জন্ম ভারতবর্ষের রাজস্থানের এক প্রভাবশালী গোত্রে।
মীরাবাঈয়ের অন্যতম পরিচয় একজন মরমী কবি হিসেবে; কিংবা একজন কৃষ্ণভক্ত উন্মাদিনী রুপে। শ্রীকৃষ্ণকে উদ্দেশ্য করে প্রায় ৫ হাজারের মতন ভক্তিগীতি লিখেছেন মীরাবাঈ। আজও ভারতবর্ষের পথেপ্রান্তরে কৃষ্ণভক্তের কন্ঠে শোনা যায় সে সব আশ্চর্য গান । ৫ হাজার গানের মধ্যে অবশ্য মাত্র ৪০০র মতন গান জনপ্রিয় ও মীরাবাঈ এর লেখা বলে প্রমান মিলেছে।
রাজস্থানে মেরতা বলে একটি জায়গা আছে। মনে করা হয় ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে মীরাবাঈয়ের জন্ম মেরতায়। পিতামহের আশ্রয়ে প্রতিপালিত মীরা খুব সম্ভব মেয়েবেলায় মা-বাবাকে হারিয়েছিল । আট বছর বয়েসে মীরার একবার বিয়ে হয়েছিল মেওয়ারের রাজার সঙ্গে ... সে বিবাহের কারণটি ছিল রাজনৈতিক । যা হোক, সে বিয়ে অবশ্যি টেকেনি।
বালিকা বড় হতে থাকে।
কিশোরী বয়েসে পৌঁছোনোর অনেক আগেই ভারতবর্ষের মেয়েরা মথুরা-বৃন্দাবনের শ্রীকৃষ্ণের উপাখ্যানটি জেনে যায়। মীরাও জেনেছিল। তবে অনুমান করি, মীরার ব্রেইনওয়েভ ভিন্ন ধরনের। ওর মাথার ভিতরে মথুরা-বৃন্দাবনের শ্রীকৃষ্ণের উপাখ্যানটি বার বার বার বার ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছিল সম্ভবত। ধরে নিই যে মীরা ভীষণ মাত্রায় ইনট্রোভার্ট, অতিরিক্ত সংবেদনশীল, এক্সট্রিমিস্ট। ধরে নিই যে মীরা কর্কট রাশি, ৮ জুলাই। এ ভাবে লেখার কারণ? মীরা বাঈকে আমি বুঝতে চাইছি। কেন শ্রীকৃষ্ণর প্রতি ভালো লাগা পরিশেষে গভীর প্রেম ও উন্মাদনায় পরিনত হয়েছিল?
কাব্যচর্চার ক্ষমতা ছিল মীরার। নজরুলের মত করে কিশোরী মীরাও লিখল-
ওরে নীল যমুনার জল
বললে মোরে বল
কোথায় ঘনশ্যাম ।
কৃষ্ণর গাত্রবর্ণ কল্পনা করা হয়েছে শ্যামল। সে কারণেই ঘনশ্যাম বলা। কৃষ্ণর অন্য নাম হরি, গিরধর, শ্যাম। নজরুল তাঁর একটি গানে কৃষ্ণকে বলেছেন, ‘ কালো রাখাল’! বাংলার পথে প্রান্তরে কৃষ্ণবিষয়কএক দূর্দান্ত গান শোনা যায়-
শামরে তোমার সনে / শামরে তোমার সনে
একেলা পাইয়াছি রে আজ (!) এই নিঠুর বনে (এখানকার সুর বড় আবেগময়)
আজ পাশা খেলব রে শ্যাম ...
(এই গানটি যিনি রচেছেন, তাঁকে গভীর শ্রদ্ধা জানাই ...এই প্রতিভাবানরা বেঁচে থাকবার প্রেরণা যোগায়)
সে যাই হোক। আঠারো বছর বয়সে মীরা আবার বিয়ে হয়। স্বামী চিতরের রাজা ভোজরাজ । স্বামী ছিলেন কালীভক্ত। কাজেই মতাদর্শগত বিরোধ অনিবার্য হয়ে উঠতে থাকে। মীরা যৌনতার স্বাদ পেয়েছে, তাতে কবিতা বাঁক নেয়। পরিপূর্ন হয়ে উঠতে থাকে।
প্রাসাদে ভক্তিগীতির আসর বসাত। এতগান আসছিল আর এত সুর। আশেপাশের বাড়ির বউঝিরা এসে শুনত সে গান।
আমার ঘরে আমার প্রেম
পথ পানে চেয়ে রই বছরের পর বছর।
অথচ কখনও দেখিনা তাকে।
নিভিয়ে ফেলি প্রার্থনার প্রদীপ
রত্নাবলী ছুঁড়ে ফেলি দূরে।
এরপর সে সংবাদ পাঠাল
আমার কৃষ্ণপ্রেমিকটি নাকি এসেছেন।
আমার অঙ্গে অঙ্গে বয় সুখশিহরণ।
হরি এক বিশাল সমুদ্দুর-
আমার চোখ যাকে ছোঁয়।
আনন্দের সমুদ্রে ডুবতে ডুবতে মীরা
ওকে অভ্যন্তরে নেয়!
এই ইরোটিক দিকটি মীরার ভজনের (ভক্তিগীতির) এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
আনন্দের সমুদ্রে ডুবতে ডুবতে মীরা
ওকে অভ্যন্তরে নেয়!
এ অভ্যন্তরে নেওয়া মানসিক নয়, অঙ্গগত। অসম্ভব সত্যবাদী ছিলেন মীরা বাঈ। জীবনে যৌনতার ভূমিকা অস্বীকার করেননি, যৌনতাকে এড়িয়ে যাননি, যৌনতাকে এড়িয়ে তথাকথিত বিশুদ্ধ থাকবার ছল করেননি এই মহিয়সী নারী। মীরার আত্মরতিতে শ্রীকৃষ্ণের কাল্পনিক ভূমিকা ছিল গভীর । এভাবেই কাব্য/কল্পনা/ যৌনবোধ/ ঈশ্বরপ্রেম সব ... সব একাকার হয়ে গিয়েছে মীরার বিস্ময়কর ভজনে ।
রাতদিন আমি
তোমার ভাবনায়
আচ্ছন্ন।
এসব কারণেই ভারতবর্ষের আবেগময় মানবিক সংস্কৃতির প্রতি বিশ্বময় আত্মজিজ্ঞাসু মানুষের এত আগ্রহ।
২
রাজা ভোজরাজ, ঘরে গানের আসর না বসালেও তো পার মীরা ।
মীরা, আমি যে পারি না!
রাজা ভোজরাজ, মা ব্যাপারটা মোটেও পছন্দ করছেন না।
মীরা, আমি যে পারি না !
রাজা ভোজরাজ, কেন তোমার কালীকে ভালো লাগে না বলত?
মীরা, আমি যে পারি না !
রাজা ভোজরাজ, এসব টানা পোড়েন আমার আর ভাল্ লাগে না মীরা।
মীরা, আমি যে পারি না !
রাজা ভোজরাজ, সেদিন রানা বলছিল- বৌদি এসব কী শুরু করেছে দাদা। কৃষ্ণকে শ্রদ্ধা করে ভালো কথা, তাই বলে ভদ্রলোকের বউদের ঘরে ডেকে এনে আদিখ্যেতা করতে হবে। ছিঃ।
মীরা, আমি, যে পারি না!
৩
তারপর। রাজা ভোজরাজ মারা গেলেন।
মীরা বিধবা হলেন।
শোক খানিকটা স্তিমিত হয়ে এলে শাশুড়ি বললেন, আমরা মা কালীভক্ত মীরা। ওসব শ্রীকৃষ্ণকীর্তন লীলে বাদ দাও।
মীরা, আমি পারি না যে!
শাশুড়ি মুখ কালো করে চলে যায়। মীরা কাঁদতে কাঁদতে লিখতে থাকে -
মীরা নাচছে
পায়ে ঘুঙুর পরে
লোকে বলছে মীরা পাগল হয়ে গিয়েছে
বংশের সম্মান ধূলোয় গড়াচ্ছে বলে
ওর শাশুড়ি বিরক্ত
রাজা বিষের পাত্র পাঠিয়েছে
হাসতে হাসতে পান করে মীরা
ওই বিষমদ কৃষ্ণের সুন্দর মুখসম!
ও তো হরির চরণে
ওর শরীর মন সপেঁছে।
ও তার কল্পনার মধু করে পান
একমাত্র সেই তো
মীরার চরম রক্ষাকর্তা!
মীরার ওপর নির্যাতন শুরু হয়। নির্যাতন অব্যাহত থাকে। শাশুড়ি আর দেবর ষড়যন্ত্র করে বিষ দেয়। কাজ করেনি। কেন করেনি কে জানে! মীরা লিখলেন-
রানা, আমি জানি তুমি আমায় বিষ দিয়েছ
যদিও বেঁচে গেছি আমি
যেনবা অগ্নির কুন্ডের মাঝে স্বর্ণখন্ডসম।
একাধিক সূর্যর মতন উজ্জ্বল উত্থান
মতামত ও পরিবারের সুনাম
জলের মত ছুঁড়ে ফেলিনি কি?
পালিয়ে যাও, রানা,
আমি এক শক্তিহীন উন্মাদিনী
হৃদয়ে আমার কৃষ্ণের তীর
যার বিবেচনাবোধ শেষ
পবিত্র মানুষটি পদ্মচরণ জড়াই
এরপর ফুলের ঝুড়ির মধ্যে বিশাক্ত সাপ পাঠানো হল। লাভ হয়নি। পরে লৌহ শলাকায় ফেলে দেওয়া হল মীরাকে। না, মীরা মরেনি। কেবল গান করেছে-
কৃষ্ণজী কৃষ্ণজী কৃষ্ণজী
শাশুড়ি আর দেবরের নির্যাতন সইতে না পেরে মীরা প্রাসাদ ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। ষোড়শ শতকের ভারতবর্ষের পথে পথে দেখা গেল এক পাগলিনী সন্ন্যাসীনি কে। যে করে গান । যে গানের নাম কৃষ্ণসংগীত।
বহিছে উজান অশ্রু-যমুনায়
হৃদি-বৃন্দাবনে আনন্দ ডাকে আয়
বসুধা যশোদার স্নেহধাম উথলায়
কালো রাখাল নাচে তই তাথই
(নজরুল)
মীরা শ্রীকৃষ্ণজন্মধন্য মথুরা গেলেন। গেলেন মীরা শ্রীকৃষ্ণস্মৃতিবিজরিত বৃন্দাবনে । ওখানকার এক মন্দিরের কবির পদ গ্রহন করলেন। গান রচনা করেন। কৃষ্ণভক্ত নারীপুরুষ সে গান শুনে মুগ্ধ।
সারারাত ঘুমোতে পারিনি
আমি ঘুমাতে পারি না। সারারাত।
প্রাণপ্রিয়র প্রতীক্ষায় থাকি ।
বন্ধুদের প্রস্তাব
বিজ্ঞ বচন।
সব ফিরিয়ে দিই আমি ।
ওকে ছাড়া যে মনে শান্তি পাই না।
অথচ হৃদয় আমার মোটেও ক্রোধান্বিত নয়
আমার নিচের অঙ্গ অবশ
ঠোঁট আমার জপে তার নাম
বিচ্ছেদের এই যাতনা বোঝা কি যায়?
মেঘের প্রতীক্ষায় থাকা আমি এক চাতক পাখি;
আমি এক জলাকাঙ্খী মাছ
মীরা শেষ!
ওর চেতনা অবশ!
তারপর?
তারপর একদিন ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দ এল। মীরাবাঈয়ের মৃত্যুর বছর। মীরাবাঈয়ের নশ্বর দেহটি চিতার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। গানগুলি ভাসছিল বাতাসে। ভারতবর্ষীয় ভক্তেরা কন্ঠে তুলে নিল সে গান। কম তো নয়-প্রায় ৫ হাজার। ৫ হাজার গানের মধ্যে অবশ্য মাত্র ৪০০র মতন গান জনপ্রিয় ও মীরাবাঈ এর লেখা বলে প্রমান মিলেছে।
মীরাবাঈয়ের উতুঙ্গ জনপ্রিয়তার মূলে রাধাকৃষ্ণের লীলা। মীরাবাঈ কখনও বাংলায় কিংবা মনিপুরে এসেছিলেন কিনা জানা যায়নি। বাংলায় কিংবা মনিপুরে রাধাকৃষ্ণপ্রীতি প্রবল। এই দুটি দেশে রাধাকৃষ্ণ লীলা এক অলীক মাহাত্ব্য পেয়েছে; কাজেই আমার মনে হয়, মীরা বাঈ কখনও বাংলায় কিংবা মনিপুরে নিজস্ব জগৎটি খুঁজে পেতেন।
মীরা বাঈয়ের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ:
উইলিস ব্রানসটন এবং উষা নিলসন
তথ্যসূত্র:
উইলিস ব্রানসটন এবং টনি ব্রানসটন সম্পাদিত “লিটারেচারর্স অভ এশিয়া, আফ্রিকা অ্যান্ড লাতিন আমেরিকা” (ফ্রম অ্যান্টিকুইটি টু দ্য প্রেজেন্ট)
উৎসর্গ: কুঙ্গ থাঙ
মীরাবাঈ এর ভজনের ইউটিউব লিঙ্ক
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১:২৭