টিপু সুলতানের নাম শোনেনি এমন মানুষ খুব কমই দেখা যাবে। যদিও আধুনিক ডোরেমন বাচ্চাদের কথা আলাদা। তবে আমাদের অগ্রজ যারা, নিশ্চিতভাবেই টিভিতে টিপু সুলতানের কাহিনী তাদের বিনোদিত করত।
আমি অবশ্য টিপু সুলতান সিরিজ দেখিনি, তখন ছোট ছিলাম। তবে এমন অনেকেই আছেন টিপু সুলতানের কাহিনী দেখে যারা স্বপ্নে টিপুর ভুমিকায় নিজেকে দেখতেন, নিজেকে টিপু সুলতান ভাবতেন। এই লেখাটা মহীশূর এর টিপু সুলতানকে নিয়ে লেখা।
Mauzaisse এর আকা টিপু সুলতান
টিপু সুলতান ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের মহীশূর (১৩৯৯খ্রিঃ-১৯৪৭খ্রিঃ) রাজ্যের শাসনকর্তা এবং একজন বীর যোদ্ধা। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তিনি অত্যন্ত্ শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। মুলতঃ তার মৃত্যুর পরেই মহীশূর ব্রিটিশদের দখলে চলে যায়।
প্রাচীর ভারতে সুলতানী,মোঘল, আফগান ও ব্রিটিশ শাসন এলাকাঃ
হাই রেজ্যুলেশনে দেখতে ও ডাউনলোড করতে
জন্মঃ
টিপু সুলতান ১৭৫০ সালের ২০ নভেম্বর বর্তমান ব্যাঙ্গালোর থেকে ৩৩ কি.মি দূরে "দিভানাহালি " নামক স্থানে জন্ম গ্রহন করেন।
নামঃ
টিপু সুলতানের নামকরন সম্পর্কে একটি মিথ চালু আছে। বলা হয় তার বাবা হায়দার আলী টিপু নামের এক দরবেশের দোয়ায় সন্তান লাভ করেন। এজন্য তিনি ঐ দরবেশের নামেই ছেলের নাম টিপু সুলতান রাখেন।
মহীশূর (বর্তমান কর্ণাটক) রাজ্যের স্থানীয় ভাষা (কানাড়ী ভাষা) অনুসারে টিপু অর্থ বাঘ। টিপু সুলতানকে অন্যান্য যে নামে ডাকা হতোঃ "টিপু সাহেব", "সুলতান ফতেহ আলী খান সাহেব", "বাহাদুর খান টিপু সুলতান", "ফতেহ আলী খান টিপু সুলতান বাহাদুর" এছাড়া তার শৌর্য-বীর্যের জন্য খোদ ইংরেজরাই তাকে "শের-ই-মহীশূর" বা "মহীশূরের বাঘ" উপাধি দেয়।
গুনাবলীঃ
Alexander Beatson এর Fourth Mysore War : View of the Origin and Conduct of the War with Tippoo Sultaun অনুসারে টিপু সুলতানের উচ্চতা ছিল প্রায় ৫'-৮" (পাচ ফুট আট ইঞ্চি), তার খাট গর্দান(ঘাড়) এবং চওড়া কাধ ছিল, তার হাত-পা খাট আকৃতির ছিল, ঈগলের ঠোটের মত বাকা নাক, চোখের উপর চিকন ভ্রু, তার গায়ের রং ফর্সা ছিল, বড় এবং পূর্ণাকৃতির চোখ ছিল। সর্বপরি তার চেহারায় আত্মমর্যাদা এবং ব্যক্তিত্বের ছাপ স্পষ্ট ছিল।
টিপু সুলতান শুধু একজন শাসকই ছিলেন না, একাধারে তিনি ছিলেন উদ্ভাবক, বহু ভাষাবিদ এবং কবি।
টিপু সুলতানের রাজপ্রাসাদঃ
ব্যাঘ্রপ্রীতিঃ
টিপু সুলতানের রাজ্যের প্রতীক ছিলো বাঘ। এই বাঘ ছিলো তাঁর অনুপ্রেরণার মতো। তাঁর রাজ্যের পতাকায় কানাড়ী ভাষায় লেখা ছিলো "বাঘই ঈশ্বর"।
"ভেড়া বা শিয়ালের মতো দু'শ বছর বাঁচার চেয়ে বাঘের মতো দু'দিন বেঁচে থাকাও ভালো"--টিপু সুলতান।
টিপু সুলতান পরবর্তী জীবনে তার নামের প্রমান রেখেছেন তার কাজের মাধ্যমে। তিনি ছিলেন বাঘের মতো সাহসী, ক্ষিপ্র এবং তেজী। এছাড়া বাঘের প্রতি তার ছিল অনেক ভালোবাসা। ছোটবেলায় বাবা হায়দার আলীর কাছে বাঘের গল্প শোনার জন্য টিপু বায়না করতেন। এমনকি কিশোর বয়সে টিপু একটি বাঘ পুষতে শুরু করেন। বাবার মৃত্যুর পরে টিপু নতুন সিংহাসন তৈরী করেন, যদিও সিংহাসনে সিংহ নয় বরং বাঘের প্রতিকৃতি ছিল। কাঠের ফ্রেমের উপর সোনার পাত বসিয়ে মণিমুক্তা ও রত্ন খচিত একটি সিংহাসন তৈরী করেন। এই সিংহাসনের মাঝে একটি সোনার তৈরী বাঘের মুর্তি ছিল। সিংহাসনের উচ্চতা ছিল আটফুট এবং এতে উঠার জন্য দুইধারে রুপার তৈরী সিড়ি ছিল। সিংহাসনের রেলিংয়ে নিরেট সোনার তৈরী দশটি বাঘের মাথা ছিল। আর এই সিংহাসনে বাঘের শরীরের মতো ডোরাকাটা নকশা করা ছিল। তাই অনেকে একে ব্যাঘ্রাসনও বলে থাকেন।
তার সমস্ত পোষাক ছিলো হলুদ-কালো রঙের আর বাঘের শরীরের মতো ডোরাকাটা।
তার তলোয়ারে বাঘের গায়ের ডোরাকাটা নকশা এবং হাতলে বাঘের প্রতিকৃতি খোদাই করা ছিল।
তিনি হলুদ-কালো ডোরাকাটা নকশার রুমাল ব্যবহার করতেন।তার সৈন্যদের পোষাক এবং ব্যবহার্য তলোয়ার, বল্লম, বন্দুকগুলোর নল, কুদো, হ্যামারেও আঁকা থাকতো বিভিন্ন আকারের বাঘের প্রতিরূপ কিংবা মূর্তি। এমনকি তিনি তাঁর রাজ্যের প্রধান প্রধান সড়কের পাশে, বাড়ির মালিকদেরকে বাড়ির দেয়ালে বাঘের ছবি আঁকার নির্দেশ জারি করেছিলেন। তখনও তাঁর বাঘ পোষার বাতিক যায়নি এবং রাজবাড়িতে বেশ কয়েকটি পোষা বাঘ ছিলো। তার কয়েকটি আবার তাঁর ঘরের দরজার সামনে বাঁধা থাকতো।
টিপু সুলতান বাঘ নিয়ে একটি মিউজিক্যাল খেলনা বানিয়েছিলেন, যা তখন পৃথিবী জোড়া খ্যাতি পায়। এই খেলনাকে "টিপুর বাঘ " (Tipus Tiger) বলা হত।
টিপুর বাঘঃ
১৭৮১ সালে ব্রিটিশ সেনাপতি হেক্টর মুনরো ২য় মহীশূরের যুদ্ধে টিপু সুলতান ও তার বাবা হায়দার আলীকে এবং তাদের রাজ্যকে চরমভাবে বিপর্যস্ত করেন। এই যুদ্ধে টিপু বাহিনীর বহু সৈন্য নিহত হয়, মহীশূড়ের অপূরনীয় ক্ষয়ক্ষতি হয়।
এদিকে এই মুনরোরই একমাত্র ছেলে সুন্দরবনে বাঘ শিকার করতে গিয়ে বাঘের হাতে মারা যায়। এই ঘটনা শুনেই টিপু সুলতান এর মাথায় দারুন বুদ্ধি খেলে যায়। তিনি ফরাসী প্রকৌশলীদের মাধ্যমে একটি খেলনা নির্মান করেন। যা "টিপু'স টাইগার" নামে দুনিয়াজোড়া খ্যাতি পায়।
খেলনাতে একজন ইংরেজ সেনার উপর বাঘের আক্রমনের দৃশ্য দেখা যায়। দম দিয়ে ছেড়ে দিলে বাঘটি মাথা নাড়তো এবং ইংরেজটি দুহাত দিয়ে বাঘের মাথাকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করত। খেলনাতে অর্গান ব্যবহৃত হয়েছিল। যার ভেতর থেকে বাঘের গর্জন এবং ইংরেজের কান্নার শব্দ এবং ব্যকগ্রাউন্ডে টিপুর প্রিয় গজলের শব্দ ভেসে আসত।
ব্রিটিশদের ব্যাখ্যা অনুসারে, টিপু সুলতান একবার তার ফরাসি বন্ধুর সাথে সুন্দরবনে শিকারে যান, একটি বাঘের সামনে পড়েন এবং তার বন্দুক কাজ করছিল না। তখন তিনি একটি ছোট্ট ছোড়া দিয়েই বাঘের উপর ঝাপিয়ে পড়েন এবং বাঘটিকে হত্যা করেন।
যদিও টিপুস টাইগারে কেন ইংরেজ সেনা ব্যবহার করা হয়েছে, তার কোন সদুত্তর ব্রিটিশরা দিতে পারেননি।
এই খেলনাটি বর্তমানে লন্ডনের ভিক্টোরিয়া এ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে।
পরিবারঃ
টিপু সুলতানের বাবা হায়দার আলী ছিলেন মহীশূরের সেনা কর্মকর্তা। হায়দার আলী এবং তার ২য় স্ত্রী ফাতিমা (ফকির-উন-নিসা) এর পুত্র টিপু সুলতান।
টিপু সুলতান এর চার স্ত্রী, ১৬ পুত্র এবং ৮ কন্যা ছিল। (কন্যাদের সঠিক সংখ্যা এবং নাম অজানা)।
টিপু সুলতানের পুত্রঃ
১। শাহজাদা হায়দার আলী সুলতান সাহেব (১৭৭১ - ৩০ জুলাই, ১৮১৫)
২। শাহজাদা আব্দুল খালিক সুলতান সাহেব (১৭৮২ - ১২ সেপ্টেম্বর, ১৮০৬)
৩। শাহজাদা মুহি-উদ-দীন সুলতান সাহেব (১৭৮২ - ৩০ সেপ্টেম্বর, ১৮১১)
৪। শাহজাদা মু'ইজ-উদ-দীন সুলতান সাহেব (১৭৮৩ - ৩০ মার্চ, ১৮১৮)
৫। শাহজাদা মি'রাজ-উদ-দীন সুলতান সাহেব (১৭৮৪ - ?)
৬। শাহজাদা মু'ইন-উদ-দীন সুলতান সাহেব (১৭৮৪ - ?)
৭। শাহজাদা মুহাম্মদ ইয়াসিন সুলতান সাহেব (১৭৮৪-১৫ মার্চ ১৮৪৯)
৮। শাহজাদা মুহাম্মদ সুবহান সুলতান সাহেব (১৭৮৫ - ২৭ সেপ্টেম্বর,
১৮৪৫)
৯। শাহজাদা মুহাম্মদ শুকরুল্লাহ সুলতান সাহেব (১৭৮৫ - ২৫ সেপ্টেম্বর, ১৮৩৭)
১০। শাহজাদা সারওয়ার-উদ-দীন সুলতান সাহেব (১৭৯০ - ১৮৩৩)
১১। শাহজাদা মুহাম্মদ নিজাম-উদ-দীন সুলতান সাহেব (১৭৯১ - ২০ অক্টোবর, ১৭৯১)
১২। শাহজাদা মুহাম্মদ জামাল-উদ-দীন সুলতান সাহেব (১৭৯৫ - ১৩ নভেম্বর, ১৮৪২)
১৩। শাহজাদা মুনির-উদ-দীন সুলতান সাহেব (১৭৯৫ - ১ ডিসেম্বর, ১৮৭৩)
১৪। মহামান্য শাহজাদা স্যার গুলাম মুহাম্মদ সুলতান সাহেব, কেসিএসআই (মার্চ, ১৭৯৫ - ১১ আগস্ট, ১৮৭২)
১৫। শাহজাদা গুলাম আহমদ সুলতান সাহেব ১৭৯৬ - ১১ এপ্রিল, ১৮২৪
১৬। শাহজাদা ______ সুলতান সাহেব (১৭৯৭ - ১৭৯৭)
টিপু সুলতানের মৃত্যুর পর তার পরিবারকে ব্রিটিশ শাসকেরা মহীশূর হতে কলকাতায় বিতারিত করে।
টিপু সুলতানের এক চাচার বংশধর "নূর এনায়েত খান " দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ Special Operations Executive Agent হিসেবে দায়িত্ব পালন কালে জার্মানির Dachau concentration camp এ জার্মানদের হাতে নিহত হন (১৯৪৪)।
সিংহাসনে আরোহনঃ
টিপুর কিশোর বয়সে তার বাবা হায়দার আলী মহীশূরের ক্ষমতা দখল করেন। হায়দার আলীর মৃত্যুর পর টিপু ৩২ বছর বয়সে (১৭৮২খ্রিঃ) সিংহাসনে বসেন এবং মহীশূরের শাসক হিসেবে নিজেকে নিয়োজিত করেন।
কুটনৈতিক সম্পর্কঃ
টিপু সুলতান মহীশূড়ের স্বাধন শাসক ছিলেন, তবে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের প্রতি তার আনুগত্য ছিল। তবে হায়দ্রাবাদের নিজামের সাথে মনোমালিন্যের জের ধরে দিল্লির সাথে তার দূরত্ব সৃষ্টি হয়, এবং তিনি তৎকালীন মুসলিম শাসকদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার দিকে জোড় দেন।
টিপু সুলতান ওমান, পারস্য, অটোমান এবং ফ্রান্সে নতুন দূতাবাস খোলেন এবং কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। তিনি অটোমানের সুলতান প্রথম আব্দুল হামিদ এর কাছে ব্রিটিশদের পরাজিত করতে সামরিক সাহায্য চান, কিন্তু অটোমান সম্রাজ্য তখন অস্ট্রো-অটোমান যুদ্ধে ব্যস্ত এবং নতুন করে রাশিয়ার সঙ্গেও তখন যুদ্ধাবস্থার সম্মুখিন হয়। তাই অটোমানরা টিপু সুলতানকে কোন সাহায্য দিতে পারেনি।
টিপু সুলতান ফরাসি বনিকদের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলেন এবং ফ্রান্সের নেপোলিয়ন এর সাথে ব্রিটিশবিরোধী বাহিনী গড়ার প্রস্তাব দেন। নেপোলিয়ন তখন ইজিপ্ট অভিযানে এবং তিনি কথা দেন ইজিপ্ট অভিযানের পর তার ১৫০০০ সেনা টিপু সুলতানের বাহিনীর সাথে মিলে ব্রিটিশদের উৎখাত করবে। যদিও শেষ পর্যন্ত সেটা সম্ভব হয়নি।
সেনা বাহিনীঃ
টিপু সুলতানের বন্দুক (ফরাসি প্রযুক্তির)
রকেটঃ
টিপু সুলতানের সু-প্রশিক্ষিত সেনা বাহিনী ছিল। তবে মহীশূড়ের রকেট সাইন্স এর জন্য এই সেনা বাহিনী অনেক এগিয়ে ছিল। টিপু সুলতানের বাবা হায়দার আলীর ১২০০ প্রশিক্ষিত রকেট সেনা ছিল, এরা গাণিতিক হিসাবের মাধ্যমে অত্যন্ত সুক্ষভাবে লক্ষ্যে আঘাত করতে পারত।
লর্ড কর্ণওয়ালিসের পরাজয় নিয়ে জেমস গিলরে এর পলিটিক্যাল কার্টুন
টিপু সিংহাসনে বসার পর এই রকেট বাহিনীকে আরও আধুনিক করে গড়ে তুলেন। তিনি রকেট ট্রুপস এর সংখ্যা ৫০০০+ এ উন্নীত করেন। তিনি রকেট লঞ্চারের টিউবে (থ্রাষ্টার) লোহা ব্যবহার করেন এবং রকেটের মাথায় ধারাল ধাতুর ফলক লাগিয়ে দেন। ফলে এই রকেট এর রেঞ্জ বেড়ে যায় এবং তা শত্রু বাহিনীর অনেক বেশী ক্ষতি করতে সক্ষম হয়।
ব্রিটিশদের সাথে চতুর্থ যুদ্ধে টিপুর কিছু রকেট ব্রিটিশরা কব্জা করতে সমর্থ হয়, এবং এই রকেটই পরবর্তীতে কনগ্রিভ রকেট আবিস্কারে ভুমিকা রাখে।
টিপু সুলতানের দুর্গ
স্যাটেলাইট থেকে
নৌবাহিনীঃ
১৭৮৬ সালে টিপু সুলতান ৭২ কামানের ২০ টি যুদ্ধ জাহাজ এবং ৬২ কামানের ২০টি রণতরী (frigates) দিয়ে তার নৌবাহীনিকে সুসজ্জিত করেন। ১৭৮৯ সালের ভেতরই টিপু সুলতানের প্রায় সকল জাহাজেই তামার পাটাতনে উন্নীত করা হয়। ১৭৯০ সালে তিনি কামালুদ্দিনকে তার "মীর বাহার" পদে নিযুক্ত করেন এবং জামালাবাদ এবং মাজিদাবাদে সুবিশাল ডকইয়ার্ড নির্মান করেন। কিছুদিন পরে টিপুর নৌবাহিনীতে ১১ জন কমান্ডার "মীর ইয়াম" (Mir Yam) এর দায়িত্ব গ্রহন করে। প্রত্যেক "মীর ইয়াম" ৩০ জন অ্যাডমিরালকে এবং প্রত্যেক অ্যাডমিরাল ২টি করে জাহাজকে পরিচালনা করতেন।
টিপু সুলতান ফরাসিদের সহায়তায় তার সেনাবাহিনীকে উচ্চতর প্রশিক্ষন দেন এবং আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহন করেন। টিপু সুলতান তার সেনাবাহিনীকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে শক্তিশালী এবং অত্যন্ত কার্যকরী হিসেবে গড়ে তোলেন।
টিপু সুলতান স্বরনে গুগলের ডুডল
অত্যাচারঃ
টিপু সুলতান মুসলমান ধর্মাবলম্বী ছিলেন। তার প্রজাদের ভেতর হিন্দু ধর্মাবলম্বীই বেশি ছিল। তিনি ইসলাম প্রচারের জন্য জোর করে হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করেন। তিনি ফার্সি এবং উর্দু ভাষা প্রনয়নে জোড় দেন। ইসলামী আদলে বিভিন্ন স্থানের পুনঃ নামকরন করেন।
১৭৮০ সালে টিপু সুলতান নিজেকে মহীশূড়ের বাদশাহ হিসেবে ঘোষনা করেন এবং মোঘল সম্রাটের মূদ্রা বাতিল করে নিজের নামে মূদ্রা প্রচলন করেন।
এইচ ডি শর্মার মতে, টিপু সুলতান ভারতকে ইসলামী সাম্রাজ্যে রুপান্তরের জন্য আফগান সম্রাট জামান শাহ এর সহায়তা চান এবং তাকে ভারত আক্রমনের আমন্ত্রন জানান।
ধর্মান্তরঃ
টিপু সুলতান হিন্দু এবং খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের জোর করে মুসলমান ধর্মে ধর্মান্তর করেন।
১৭৮৮ সালে কালিকট (বর্তমান ইসলামাবাদ) এর গভর্নর শের খানকে চিঠি দিয়ে হিন্দুদের মুসলমানে ধর্মান্তর করার নির্দেশ দেন।এবং সেই বছরের জুলাই মাসে ২০০ (+/-) ব্রাহ্মন কে জোর করে মুসলমান ধর্মে ধর্মান্তর করা হয় এবং গরুর মাংশ খাওয়ানো হয়।
১৭৯০ সালের ১৯ জানুয়ারি বেকাল (Bekal) এর গভর্নর "বুদরুজ জুমান খান" কে লেখা তার চিঠিতে তার মালাবার বিজয়ের এবং ৪ লক্ষ হিন্দুকে মুসলিম ধর্মে ধর্মান্তর করার সংবাদ দেন।
গির্জা ধ্বংসঃ
টিপু সুলতান ২৭টি ক্যাথলিক চার্চ ধ্বংস করার নির্দেশ দেন। এর ভেতর উল্লেখযোগ্য হচ্ছেঃ
ম্যাঙ্গালোরের Church of Nossa Senhora de Rosario Milagres, Fr Miranda's Seminary at Monte Mariano, ওমজুড় এর Church of Jesu Marie Jose, বোলার এর Chapel, উল্লাল এর Church of Merces, মুলকি'র Imaculata Conceiciao, পেরার এর San Jose, কিরেম এর Nossa Senhora dos Remedios, কর্কাল এর Sao Lawrence, বার্কুর Rosario, বাইর্নুর এর Immaculata Conceciao, হষ্পেট এর The Church of Holy Cross
.
পুনঃ নামকরনঃ
টিপু সুলতান ইসলামী আদলে রাজ্যগুলোর পুনঃ নামকরন করেন।
যেমনঃ দিভানহলি থেকে ইউসুফাবাদ, মহীশূর থেকে নাসারবাদ, চিত্রদূর্গা থেকে ফারুখিয়া হিসার, গট্টি থেকে ফয়েজ হিসার, ম্যাঙ্গালোর থেকে জালালাবাদ, কন্নড় থেকে কাশানাবাদ, বেপুর (ভৈপুরা) থেকে সুলতানপত্তম/ফারুকি, ধরওয়াদ/ধার্বাদ থেকে কার্শেদ সওয়ার, রত্নাগিরি থেকে মুস্তফাবাদ, ডিন্দিগুল থেকে খালিকাবাদ, এবং কালিকট থেকে ইসলামাবাদ।
ভাষা প্রচলনঃ
টিপু সুলতান তার রাজত্বে শিক্ষা ও সরকারি-ব্যবসায়িক কাজকর্মের জন্য ফার্সি এবং উর্দূ ভাষার প্রচলন করেন। যার ফলে এখনও দক্ষিন ভারতের কেরালা, তামিলনাড়ু এবং কর্ণাটকের মুসলমানেরা উর্দূ ভাষার চর্চা করে।
বিতর্কঃ
অনেক ইতিহাসবিদদের মতে টিপু সুলতান মোটেই স্বেরাচারী বা অত্যাচারী ছিলেন না। মুহিবুল হাসান, প্রফেসর শেখ আলি এর মত ইতিহাসবিদরা মনে করেন টিপু সুলতান হিন্দুদের এবং অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। ১৭৯১ সালে মারাঠার রঘুনাথ রাও পটবর্ধণ এর ঘোর সওয়ারেরা কন্নড় এর মন্দির গুলো ধ্বংস করে এবং অনেক পুরোহিতকে হত্যা ও আহত করে। তখন টিপু সুলতান মন্দিরসমূহ পুণঃ নির্মান এর জন্য যাবতীয় সহায়তা দেন এবং পুরোহিতদের ভরনপোষনের দায়িত্ব নেন।
তিনি ফরাসিদের সাথে বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরুপ বেশ কিছু গির্জাও নির্মান করেন।
হিন্দুদের কর্মসংস্থানঃ
বেশ কিছু ইতিহাসবিদরা মনে করেন টিপু সুলতান হিন্দুদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তিনি তার প্রশাসনেও হিন্দু কর্মকর্তা নিয়োগ করেছিলেন।
যেমনঃ হিসাবরক্ষক ছিলেন কৃষ্ণা রাও, ডাক এবং নিরাপত্তা মন্ত্রী স্বামী আইয়েঙ্গার , "মীর আসাফ" ছিলেন পূর্ণায়া, মোঘল সাম্রাজ্যে সুজন রায় এবং মুলচান্দ ছিলেন তার প্রধান প্রতিনিধি এবং তার পেশকার ছিলেন সুবা রাও।
১৭৯৩ সালে টিপু সুলতানের আত্নসমর্পণ, দুই পুত্রকে গ্রহন করছেন লর্ড কর্ণওয়ালিস
মৃত্যুঃ
১৭৯৯ সালের ৪ই মে ৪৮ বছর বয়সে টিপু সুলতান ব্রিটিশদের হাতে নিহত হন। মুলতঃ টিপু সুলতানের এক সেনাপতি "মীর সাদিক" বিশ্বাসঘাতকতা করেন, যার ফলে টিপু সুলতান নিহত হন।
টিপু সুলতানের মৃত্যুর পর দেহ এখানে পাওয়া যায়
টিপু সুলতানের মাজার
তরবারি এবং কর্নাভরনঃ
২০০৩ সালের নিলাম থেকে টিপু সুলতানের তরবারি ভারতের বিজয় মালিয়া ২০০ বছর পর ভারতে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন।
২০১০ সালের এপ্রিলে এই তরবারির দাম লন্ডনের একটি নিলামে ৫,০৫,২৫০ ব্রিটিশ পাউন্ডে উঠে, কিন্তু বিজয় মালিয়া এই তরবারি কখনো বিক্রয় করবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন।
কর্ণাভরনঃ
টিপু সুলতানের কর্ণাভরন (পেনড্যান্ট) প্রায় ১.৫ মিলিয়ন ইউএস ডলারে ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১১তে একটি নিলামে উঠে।
ইমেজঃ
টিপু সুলতানকে এই উপমহাদেশে দুই নজরে দেখা হয়, কেউ কেউ তাকে ধর্মরক্ষক বীর যোদ্ধা মনে করেন কেউবা অত্যাচারী স্বৈরশাসক বলে অভিহিত করেন। কেউ কেউ আবার টিপু সুলতানকে গাজী বা পীর বলেও মনে করেন।
কিন্তু বাস্তবতা হলো টিপু সুলতান অসীম সাহসী এক শাসক ও বীর যোদ্ধা ছিলেন। আর দশজন সুলতানের মতই। এর বেশি কিছু নয়।
আমার আগের পোষ্টটিও দেখতে পারেনঃ মানসা মুসা: অজানা ইতিহাসের বিখ্যাত সম্রাট
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই আগস্ট, ২০১২ ভোর ৫:৩০