আজ পহেলা বৈশাখ। তারেক সকালে পথে নেমেছিল। উদ্দেশ্য ঢাকা ভার্সিটির দিকে ঢু মারা। বাঙালীয়ানা প্রকাশের, নিজেকে বাঙালী হিসেবে জাহির করতে ওদিকেই সবাই এদিনে ভিড় করে। অনেক দিন পর দেশে ফেরা, তাই মনের মাঝে কিঞ্চিত বাঙালী হিসেবে পরিচিত হবার উত্তেজনা অনুভব করে তারেক। যৌবনের এই পড়ন্ত বেলাতেও ছাত্রজীবনের স্মৃতিগুলো মনে পড়ে যায়।
বাস থেকে শাহবাগ মোড়ে নেমে কিছুটা বিষম খেয়ে যায় তারেক। এত্ত মানুষ!!! গুটি গুটি পায়ে ভিড়ের মাঝে মিশে এগুতে থাকে সে। কিছু দূর এগিয়ে চারুকলার সামনে আসতেই কিছু ছেলে-মেয়ে ঘিরে ধরে, 'আসেন,আঙ্কেল, আপনার গালে আল্পনা এঁকে দেই।' এই বয়সে মুখে রং মাখলে কেমন দেখাবে, সেই চিন্তার অবকাশ পেল না তারেক, তার আগেই তাকে হিরহির করে টেনে পেতে রাখা একটি টুলে বসিয়ে দিল ছেলেগুলো। আশে-পাশে তাকিয়ে নিজ বয়সী অনেককে দেখে একটু স্বস্তি অনুভব করল মনে মনে। নাহ্, সে একা সঙ সাজছে না, বাসায় ফেরার পর গিন্নীর প্রশ্নবানে অন্ততঃ এই উত্তরটা তো দেওয়া যাবে! ইতিমধ্যে, একটি মেয়ে তার মুখে রং লাগানো শুরু করেছে। পাশের ভদ্রলোকের কাজ বোধহয় শেষ হয়ে গিয়েছিল, তিনি টুল ছেড়ে হাঁটা দিতেই একটা ষন্ডামার্কা ছেলে পথ আগলে দাঁড়ায়, "টাকা দিয়ে যান, আঙ্কল।" "টাকা!!! কিসের টাকা?" ভদ্রলোক অবাক। ছেলেটি উত্তর দেয়, "আল্পনা আঁকার টাকা।" "কিন্তু এটা তো তোমরা আগে বলনি। যাহোক কত দিব?" দাঁতালো হেসে ছেলেটি বলল, "বেশি না, রং-এর দাম যা বেড়েছে। তবু ১০০ টাকা দিলেই চলবে।" ভদ্রলোক এবারে বেশ অবাক হলেন। এতটুক আল্পনার জন্য ১০০টাকা!!! তারেক দেখল বিরস মুখে ভদ্রলোক মানিব্যাগ খুলে পাওনা মেটালেন। ইতিমধ্যে তার মুখে রং মাখানো শেষ হয়ে যাওয়ায় সে উঠে দাঁড়াল। সামনে দন্ডায়মান ছেলেটির হাতে তাড়াতাড়ি ১০০ টাকা গুঁজে দিয়ে সামনে পা বাড়ায়, বলা তো যায় না পান থেকে চুন খসলেই বেইজ্জতি হয়ে যেতে হবে শেষে। চারুকলা বলে কথা!!!
টি,এস,সি-র সামনে আসতেই দেখল একদল ছেলে-মেয়ে তুমুল নাচ লাগিয়েছে, সাথে গলা ছেড়ে গান "একদিন বাঙালী ছিলাম রে...।" তারেক খুব অবাক হয়। বাঙালী ছিলাম রে মানে!? মনে প্রশ্ন জাগে-এখন তাহলে কি!?! বুঝতে না পেরে পাশে দাড়ানো এক ভদ্রলোককে জিগ্যাসা করতেই বললেন, "আরে ভাই বুঝলেন না! জামানা বদলাইয়া গেছেগা। এখন হইতাছে 'ডিজুস' যুগ। ডিজুস কালচার যেমন আমাদের দেশে তৈরী না, তেমনি বত্তমান পোলাপাইনরেও আমার-আপনার মত বাঙালী কওন যায়না। তয়, এইগুলারে 'বাংলিন্দ' কইতে পারেন, বাংলা-ইংলিশ-হিন্দী জট পাকাইয়া জগাখিচুড়ি ধরনের হাইব্রিড জাতি। ঐ যে পোলা-মাইয়াগুলা নাচতাছে হেইগুলোর নাচের দিকে এট্টু নজর দিলেই বুঝতে পারবেন।" যে ছেলে-মেয়েগুলো নাচ-গান করছিল তাদের দিকে ফের দৃষ্টিপাত করতেই ভদ্রলোকের কথার মর্মার্থ বুঝল তারেক। গানের তালে তালে তারা যে তিড়িং-বিড়িং করে নাচ নামের কসরত করছিল, সেটাকে আর যা-ই হোক বাঙালী নাচ বলা যায় না। তবে অনেকটা হিন্দি চ্যানেলগুলোর সিরিয়ালগুলোতে দেখানো নাচের সাথে বেশ মিল চোখে পড়ল।
তাকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে পাশের লোকটি বললেন, "ভাইজান আপনি বোধহয় দেশে থাকেন না। তাই দেশ কোন দিকে যাইতাসে সে খবর পান না। এই যে এত্ত লোক আইছে এইখানে, এর কতজন কইতে পারব আইজ বাংলা কোন বসর শুরু হইলো, কয়জনে খবর রাখে বৈশাখ মাস কত দিনে হয়, বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য নামগুলার অর্থই বা কি। আমার কতা বুদঅয় আপনার বিশ্বাস হইতাসে না। এট্টু খাড়ান, ওখনই বিশ্বাস হইব।" এই বলে লোকটি তার হাত ধরে নাচ দেখছিল যেসব দর্শক তাদের কাছে নিয়ে গেলেন। একটা ছেলেকে পাকড়ে তারেকের দিকে ইশারা করে মধ্যবয়সী লোকটি জিগ্গাসা করে বসেনল,"বাবা,কিচু মনে লইও না। ঐ বিদেশী ভদ্দরলোক জানতে চাইতাসেন আইজ বাংলা কোন বসর, আমার তো মনে নাই... তুমি কইতে পারবা?" হঠাত এরকম কঠিন প্রশ্নে বেকয়দায় পড়ে যায় ছেলেটি। আকাশ-পাতাল ভেবে মাথা চুলকে আমতা আমতা করে উত্তর দেয়,"ইয়ে...মনে হয় ১৪১৫।" পাশে দাড়ানো ছেলেটির বন্ধুপ্রবরটি গলা বাড়িয়ে তাদের কথা শুনছিল। বন্ধুর উত্তর শুনে শুনে হা হা করে উঠল,"কি বলতেসস। আজকে তো ১৪১৭ সাল শুরু হলো।" এরইমধ্যে আরো ছেলে-মেয়ে এগিয়ে এলো কি হচ্ছে জানার জন্য। প্রশ্ন শুনে তাদের মাঝেও গোল বেধে গেল। কেউ বলে...১৪১৬, কেউবা ১৪১৭। আবার কেউ ১৪১৫-এর পক্ষে যুক্তি দিতে লাগল। সে কি তর্কের ঝড়!
পাঞ্জাবীর হাতায় টান লাগতেই তারেক পাশে মাঝবয়সী সেই লোকটিকে দেখতে পেল। জটলার মাঝ থেকে কোন ফাঁকে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, সে টের পায়নি। মুচকি হেসে ভদ্রলোক বললেন, "কিসু বুঝবার পারতাসেন ভাইজান, আপনার বাঙালী জাতির নতুন ছোকরাগুলার অবস্থা!!! গায়ে গ্রাম-বাংলার পুষাক, মুখে 'বাঙালী ছিলাম রে' কীর্তন, আর নাচের নামে ফাল পারে হিন্দি সিরিয়ালের। ওইদিকে কুন বাংলা বসর শুরু অইলো তা কইবার পারে না। একদিকে ১লা বৈশাখে পান্তা-শুটকি ভর্তা খাইয়া পেট খারাপ হইয়া হপ্তাহ খানেক টয়লেটে খাট পাতনের অবস্থা, কিন্তুক; বৈশাখ মাস ত্রিশা না একত্রিশা তা কইবার পারবো না। ঐ যে মাইয়াগুলা রে শাড়ি পইড়া ঢেং ঢেং কইরা নর্তন-কুর্দন করতে দেখতাসেন, কাইল একবার এইদিকে আইয়েন একবার........ পা-গুটানো স্কিন টাইট জিন্স আর গেঞ্জি পড়া মাইয়া দেইকা উষ্ঠা খাইয়া মাটিত পড়বেন এই ভাইবা যে 'আপনি বিলাতে আসেন না বাংলাদেশে?' যে পোলাগুলারে দেখতাছেন লুঙ্গি পইড়া এর দাম গরীব গো হাতের নাগালের বাইরে নিয়া যাইতে, বৎসরে কয়বার তারা লুঙ্গি পড়ে নিজেরাও কইতে পারব না।"
ভদ্রলোক একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে শুধালেন, "আমাগো বাংলা ভাষা দিবস কুন দিন কইতে পারবেন?" তারেক ক্ষীন স্বরে বলে,"২১শে ফেব্রুয়ারী।" ভদ্রলোক বিষাদ মাখা চোখে অনন্তের পানে চেয়ে ততোধিক ক্ষীণ স্বরে বললেন, "যে জাতি নিজেরে বাংলাভাষী জাতি বইলা পরিচয় দেয়, কিন্তু ভাষা দিবস পালন করে ইংলিশ মাসে, তাগো নতুন জেনারেশনের মইধ্যে এমুন বৈপিরিত্য দেখা যাইব না তো আর কুন জাতির মইধ্যে দেখা যাইব, কন তো?"
তারেক কিছু বলতে পারে না, লোকটির দিকে ফেল ফেল নয়নে তাকিয়ে থাকে।