অপরাজিত বন্দ্যোপাধ্যায়
বজ্রপাত। চলতি কথায় বাজ পড়া। বাজ নিয়ে আমাদের বিভিন্ন রকমের ভাবনা রয়েছে। কারণ যাই হোক না অনেকের কাছে বাজ পড়াটা দারুন অশুভ ব্যাপার। সাধারণের মধ্যে বাজ নিয়ে কুসংস্কার রয়েছে বিস্তর। প্রচন্ড রেগে অনেকেই মাথায় বাজ পরার শাপশাপান্তর করেন। বলে ওঠেন — ‘তোর মাথায় বাজ পড়ুক’।
বাজ পড়া মানে নির্ঘাত মৃত্যু। তাই ছোট থেকে বড় সকলের কাছেই বাজ নিয়ে একটা মনগড়া ভয় থেকেই যায়। তবে বাজ পড়াকে ঠেকাতে না পারলেও সামান্য একটু সচেতনা থাকলে মৃত্যুকে এড়ানো যায়। অত্যাধিক গরমে এবারে পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় বাজ পড়ার হার বেড়েছে। বিষয়টি অনেকেরই জানা। কিন্তু পরিস্থিতিটা যেকোন বছরের থেকে যে আলাদা তা আমেরিকার ন্যাশানাল ওসানিক অ্যান্ড অ্যাটমস্ফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (নোয়া) ওয়েবসাইটে রাজ্যের মৃতের তালিকা উঠে আসাতে আরো পরিষ্কার হয়ে যায়। গত দুই তিন মাসে রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় বাজ পড়ে মৃত্যুর সংখ্যা পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে। বিষয়টি যে ভয়াবহ তা কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্য সরকার যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছে। সংসদে এবিষয়ে প্রশ্ন রাখতে দেখা গেছে। সত্যিই পশ্চিমবঙ্গে বজ্রাঘাতে মৃত্যু যেন একটু বেশিই। রাজ্যে গরমের দাবদাহ দীর্ঘায়িত হওয়ার জন্যই বজ্রপাত বেশি হয়েছে বলে মত দিয়েছে আলিপুর আবহাওয়া দপ্তর।
বজ্রপাতের কারণ কী ? সকলেরই অল্পবিস্তর অভিজ্ঞতা রয়েছে বাজ পড়া নিয়ে। অনেকেই জানেন, ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে বাজ বেশি পড়ে। বৃষ্টি প্রবল হলে বাজ পড়ার আশঙ্কা অনেকটা কমে যায়। এর কারণ মেঘের প্রকৃতি।
আকাশে যখন কোন খন্ড মেঘ ভেসে বেড়ায় তখন তার ভিতরে প্রচুর পরিমাণে ধনাত্মক বা ঋণাত্মক তড়িৎ আধান তৈরি হয়। আবেশ আকর্ষণের সূত্র মেনেই ঐ মেঘের ভিতরের তড়িদাধান ভূপৃষ্ঠের বস্তুতে বিপরীত তড়িদাধান তৈরির চেষ্টা করে। তড়িৎ আকর্ষণের এটাই মূল সূত্র। সব সময় দূরবর্তী প্রান্তে বিপরীত আধান তৈরি হয়। ভেসে বেড়ানো মেঘেও শুরু হয় সেই প্রক্রিয়া। মেঘ খন্ডটি যদি ধনাত্মক তড়িতায়িত হয় তাহলে তা ভূপৃষ্ঠের ঋণাত্মক তড়িৎ আধান তৈরির চেষ্টা করবে। ধীরে ধীরে মেঘ আর ভূপৃষ্ঠের বস্তুর মধ্যে আধান শক্তির পার্থক্য শুরু হয়। একে বলে বিভব পার্থক্য।
আর বিভব পার্থক্য যত বাড়তে থাকে ততই মেঘের ভিতরে শক্তিশালী তড়িৎ স্ফূলিঙ্গ তৈরি হয়। স্ফূলিঙ্গ তৈরির সময় দেখা যায় বিদ্যুতের চমক। প্রথমে তড়িৎ স্ফূলিঙ্গের সৃষ্টি হয়। তারপর হুড়মুড় তা ধেয়ে আসে মাটির দিকে। এটাই বাজ। ভূপৃষ্ঠের বিভব শূণ্য। তাই এখানে এসেই আধানের যাবতীয় তড়িৎমোক্ষণ ঘটে যায়। ছুটে আসে কয়েক লক্ষ মেগাওয়াটের তড়িৎ স্ফূলিঙ্ক বাজ হয়ে। তড়িৎ স্ফূলিঙ্গ তৈরি থেকে তা আছড়ে পড়তে এক সেকেন্ডের কম সময় লাগে। অনেকের মনে এখন প্রশ্ন জাগতে পারে বজ্রপাতের সময় প্রচন্ড শব্দ হয় কেন ? এর কারণ বিভব পার্থক্য বাড়তে থাকলে বায়ুমন্ডলের ওপর একটা চাপ তৈরি হয়। যে মুহূর্তে বজ্রপাত ঘটে ঠিক সেই মূহুর্তে সংকুচিত বায়ুস্তম্ভ হঠাৎ প্রচন্ড বেগে বইতে শুরু করে। গম্ভীর ঐ গুরু গুরু শব্দটি আদপে বাতাসের।
সব সময় বাজ পড়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে উঁচু বাড়ি, দেওয়াল বা উঁচু গাছে। তারের জাল, টেলিফোনের পোস্টেও বাজ পড়তে দেখা যায়। বজ্রপাতে যেমন জীবনহানি ঘটে তেমনি বাতাসে তড়িৎ আধানের প্রাচুর্য হওয়ায় ইলেকট্রিক এবং ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতির ক্ষতি হয়। নষ্ট হয়ে যায়। বিদ্যুৎ ঝলকানি বাড়তে থাকলে ইলেকট্রিক প্ল্যাক খুলে দেওয়াটা উচিত। ইলেকট্রিকর বর্তনী বিচ্ছিন্ন করার সঙ্গে সঙ্গে টিভি অ্যান্টেনা বা কেবল সংযোগ খুলে দেওয়া ভালো। কারণ দূরে কোথাও বাজ পড়লে তারের মাধ্যমে অত্যন্ত উচ্চ তড়িতবাহী আধান প্রবাহিত হওয়ার একটি আশঙ্কা থেকে যায়।
বাজ পড়াটা হঠাৎ করে বাড়লো কেন ? বাজ পড়ে মৃত্যু বা বাজ পড়া নতুন কোনও ঘটনা নয়। কিন্তু এখন বাজ পড়ছে ঘন ঘন। কেন এতো বাজ পড়ছে তার একটা ব্যাখা দিয়েছিলেন আলিপুর আবহাওয়া দপ্তরের বিজ্ঞানীরা। তাদের মতে ঘূর্ণাবর্ত বা নিম্নচাপ অক্ষরেখা তৈরি হলে আবহাওয়া মন্ডলে অতিরিক্ত জলীয় বাষ্পের আগমন ঘটে। আকাশে পুঞ্জিভূত হতে থাকে কালো মেঘের সারি। গরমকালে এই মেঘ তৈরি হতে থাকলে তা গরম হাওয়ার সংস্পর্শে এসে অত্যন্ত গরম হয়ে দ্রুতগতিতে আবহমন্ডলের ওপরের দিকে উঠতে থাকে।
তারপরে ঐ গরম মেঘ উপরিস্তরে গিয়ে শীতল বায়ুর সংস্পর্শে এলে আয়নিত হয়ে পড়ে। ঐ আয়নিত মেঘ সেই সময় ‘নিউট্রাল’ বা প্রশমিত হওয়ার জন্য কোনও কোন এক পরিবাহীকে অবলম্বন করতে চায়। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গাকে বেছে নেয়। এবছর যেভাবে গ্রীষ্মের দাবদাহ প্রলম্বিত হয়েছে তাতেই গরমের হাওয়ার দাপট বেড়ে যাওয়াতেই হঠাৎ বাজ পড়ার প্রবণতা বেড়ে গেছে। অতিরিক্ত বাজ পড়া নিয়ে কিছু লোকের বক্তব্য একটু অন্যরকমের। তাঁদের দাবি আগেও বেশ বাজ পড়তো। তবে আগে জনসংখ্যা আর বহুতলের সংখ্যা বেশি না থাকার জন্য বাজ পড়া থেকে মৃত্যু সংখ্যা এতটা বাড়তো না।
বাজ পড়তে থাকলে প্রতিকার কী ? এখন আবহাওয়া দপ্তরের তরফে আগাম বজ্রগর্ভ মেঘের কথা ঘোষণা করা হয়। আগাম সতর্কবার্তার দিকে প্রথমেই নজর দেওয়া জরুরী। আকাশের মেঘের ঘনঘটা বা বিদ্যুৎ বেশি চমকালে নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নেওয়া উচিত। পাকা বাড়িতে ইলেকট্রিক ওয়ারিং করার সময় ‘আর্থিং’টা একটু যাচিয়ে নেওয়া উচিত। তবে পাকাপাকি নিরাপত্তার জন্য বজ্রবহ বানানোটা জরুরী। তা না হলে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন বাজের প্রভাব থেকে রক্ষা মেলে না।
বাজের হাত কী করে বাঁচা যায় ?
ক্ষণিকের বর্ষায় লোহার শিকের ছাতা ঠিক আছে। কিন্তু যখন বর্ষার সঙ্গে আকাশের বিদ্যুৎ গজরানোর চলছে তখন শিকের ছাতা ব্যবহার করাটা ঠিক নয়। কারণ এখন যেসব ছাতা বাজারে পাওয়া যায় তা মাথায় তীক্ষ্ম সরু। লোহার যেকোন সূচিমুখ বাজ পড়ার জন্য আদর্শ। কেননা সেই বিভব পার্থক্যের মাত্রা ছোট্ট একটি জায়গায় অত্যন্ত বেশি করে নেওয়াটা সহজতর। বেতের ছাতা হলে সেই সমস্যা নেই। আবার সূচিমুখ ছাতায় অবশ্য প্ল্যাস্টিকের টুপি পরিয়ে নেওয়া দরকার। এতে বাজ পড়ার আশঙ্কা কমে যায়। সেই সঙ্গে যে সমস্ত বাড়িতে বজ্রবহ রয়েছে সেখানে মেঘের গজরাণির সময় আশ্রয় নেওয়াটা অনেকাই নিরাপদ। মাটির সংলগ্ন ধাতব ছাদযুক্ত গাড়ি বা মোবাইল টাওয়ারের ধারে কিংবা রেলের সিগন্যালিংয়ের উচ্চ টাওয়ার পাশে থাকাটা অনেক নিরাপদ। কারণ এসব জায়গায় বর্জবহের সুন্দর ব্যবস্থা থাকে। চালাঘর এবং খড়ের চালাযুক্ত ঘরেও বাজ কম পড়ে। কিন্তু ফাঁকা মাঠ বা বড় গাছের তলায় দাঁড়ানোটা একদম উচিত নয়।
বজ্রপাতের হাত থেকে উঁচু বাড়ি ঘর বাঁচানোতে বিজ্ঞানীদের একটাই সমাধান বজ্রবহ। এতে সুরক্ষা বাড়ে। অনেকটা বিপদমুক্ত হওয়া যায়। বজ্রবহ আদপে একটি অবিচ্ছিন্ন পুরু তামার পাত। বাড়ির সবচেয়ে উঁচু জায়গা তা লাগানো হয়। প্রচন্ড তাপে যেন কোনভাবে তামার পাতটি গলে যায় না। বজ্রবহের তামার পাতটির মাথায় রাখা হয় সূচালো অনেকগুলো তামার শলাকা। বজ্রবহের অপর প্রান্ত মাটির গভীরে আর একটি তামার পাতের সঙ্গে পুঁতে দিতে হয়। একটি চওড়া তামার পাতের সঙ্গে ঝালাই করে দেওয়া হয়।
বাজ পড়ার আগেই বজ্রবহের কাজ শুরু হয়ে যায়। যখন মেঘ খন্ডের মধ্যে থেকে বিভব পার্থক্য বাড়ানোর চেষ্টা চলে তখন বজ্রবহ বিপরীত আধানকে দ্রুত মাটির নীচে পাঠিয়ে দেয়। ফলে উচ্চ বিভব প্রভেদ কখনো তৈরি হয় না। বজ্রপাতের আশঙ্কাও কমে। তবে আকস্মিক কোন ঘটনায় যদি বজ্রবহে তড়িৎ মোক্ষণ ঘটে যায় তাহলে উচ্চপরিবাহীর তামার তার সেই আধানকে দ্রুত মাটিতে পাঠিয়ে দেয়। বেঁচে যায় বড় বড় ইমারত। যাঁদের বুকে পেসমেকার রয়েছে তাঁদের বজ্রপাতের সময় সাবধান থাকাটা জরুরী। উচ্চ মাত্রার তড়িৎ প্রভাবের মধ্যে পড়ে গেলে পেসমেকার খারাপের আশঙ্কা থাকে। আকাশের বিদ্যুতের চমক দেখার সঙ্গে সঙ্গে জানালা বন্ধ করে ঘরে থাকাটা তাঁদের কাছে নিরাপদের। এখানে বলে রাখা ভালো শুধু কালো মেঘে নয়, নীল আকাশেও বজ্রপাত হতে দেখা গেছে।

আলোচিত ব্লগ
আমার ভাঙ্গা ল্যাপটপ
শুক্রবার রাতে আমার মনে হলো, আমি আমার ল্যাপটপে লিনাক্স ওএস সেটআপ দেব। যদিও আমি সারা জীবন উইন্ডোজ ব্যবহার করে এসেছি এবং লিনাক্স সম্পর্কে তেমন কিছুই জানি না। রাতে শুয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন
'মামলেট’ ‘ওমলেট’ ডিম ভাজা, ডিম পোচ, এগ ফ্রাই, এগ রোল আরও কতো কী .....
'মামলেট’ ‘ওমলেট’ ডিম ভাজা, ডিম পোচ, এগ ফ্রাই, এগ রোল আরও কতো কী .....
মাছে ভাতে বাঙালির আমিষ হেঁশেলে সেকেন্ড চয়েস গরুর গোসত আর মুরগি। কিন্তু ডিম? তাকে কি বাঙালি কখনও... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বৈপ্লবিক ছন্দ
বছর তিনেক আগে রাজু ভাস্কর্যের সামনে উড়ন্ত ভঙ্গিতে ছবি তুলেছিলো একটা মেয়ে। তার নাম ইরা।
ইরার ওই ছবিটাই হওয়া উচিত বাংলাদেশের মেয়েদের প্রতীক। আমাদের মেয়েদের মেধা আছে, অদম্য... ...বাকিটুকু পড়ুন
বাংলাদেশের ইসলামিক শাসন ব্যবস্থা কায়েম ও তার আসল বাস্তবতা
বাংলাদেশের ইসলামিক শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার নামে যে সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলো দেশের মানুষের সাথে ভন্ডামি করে বেড়াচ্ছে তাদের জন্য উপরের ছবিগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সমস্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন
কওমি সমস্যার সমাধান কি?
দেশে বিশ হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিপরীতে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা কত জানেন? অসংখ্য। এর নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা কেউ দিতে পারেনাই, নামে বেনামে নিবন্ধিত অনিবন্ধিত মাদ্রাসার সংখ্যা ২০ হাজারেরও বেশি, মার্কিন... ...বাকিটুকু পড়ুন