স্মরণ কালের মধ্যে এমন একটিও ছবির নাম বলতে পারব না, যেখানে ছবি দেখার immediate রিঅ্যাকশন টা এতখানি reacting , যে হল থেকে বেরোবার পরে প্রায় দিন তিনেক ধরেও সাদা কালো একটি ছবির প্রচন্ড অভিঘাত আপনাকে বিমুড়, লজ্জিত,ক্রুদ্ধ ও ব্যথিত করে। Multiplex এর ঠান্ডা ঘরে এ ছবি কে প্রয়োজনীয় ও গড়পরতা ফ্রেম এ আটকা রাখা যায় না , সুখী পপকর্ন এ ছবির অন্যতম অনুপান নয়। প্রেমিকা কে নিয়ে corner সিট যারা খুঁজছেন , তারা দয়া করে এ ছবি দেখে আপনাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। Kamaleshwar mukherjee নামটা যদিও বাংলা ফীচার এর জগতে খুব পরিচিত নয়, তবুও যদি একান্তই মনে করতে পারেন, উরচিঠি নামের একটি একটি আকর্ষনীয় পোস্টার এর অনাকর্ষণীয় বাংলা ছবি কিছুদিন আগে মুক্তি পেয়েছিল , সেখানেই আত্মপ্রকাশ কমলেশ্বর মুখার্জির।।।"মেঘে ঢাকা তারা" তার দ্বিতীয় ছবি , আর যদি শেষ ছবিও হত তাহলেও পিছনের সারি তে দাঁড়িয়ে তাকে কুর্নিশ করা ছাড়া আর উপায়ন্তর ছিল না , এতটাই পরিনত ও বুদ্ধিদীপ্ত এ ছবির প্রস্তুতি ও পরিবেশনা।
না, ঋত্বিক ঘটকের biopic যে এ ছবি নয়, সেটা হয়ত অনেকেই এতদিনে জেনে ফেলেছেন। এ ছবি নীলকন্ঠ বাগচীর ছবি , যার জীবনচরিত ঋত্বিক ঘটক -ইসম এ আশ্রিত । বহু পুরনো অনুসঙ্গ এ ছবিকে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছে অসামান্য ভাবে। কি অনায়াসে ফিরে আসে, পিপল'স থিয়েটার , কি অবলীলায় প্রাণ পায় IPTA , সলিল চৌধুরী , গণসঙ্গীত এর সাদা কালো ঘর্মাক্ত বিপলবের দিনগুলি। কি নিদারুন ভাবে দেশ ভাগ, তেভাগা আন্দোলন, দর্শকের চেতনায় আগুন জ্বালায় ।।।রক্তে জ্বালা ধরে, চোখে জল আসে অনিবার্য। ঋত্বিক ঠিক যেভাবে, ওনার ছবিকে কখনো শুধু সিনেমা প্রীতির জন্যই তৈরী করেন না, বরং, তাকে একটা যুদ্ধের একটা অস্ত্র হিসাবে দেখেন , এ ছবিও ঠিক সেই কথাটাই বলে। ঠিক সেই ভাবেই বলে। একটা মানুষ তার শিল্প , তার ক্রাফট এর প্রতি কতটা যত্নবান হলে, কতটা দায়িত্ববান হলে একটা গল্পের মধ্য দিয়ে,এতখানি সত্যিটা বলা যায় , কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে ভাবার বিষয়।
আবেগ বা অতি-আবেগ কোনটা প্রাধান্য পেয়েছে এ ছবির পরতে পরতে , সেটা আলোচনার বিষয়বস্তু হতে পারত বটে, কিন্তু মেলোড্রামা যার বার্থরাইট’, তাকে নিয়ে ছবি বানাতে হলে ঠিক ততটাই মেলোড্রামা প্রয়োজন, এ সত্যটা বোধহয় শিক্ষিত দর্শক বুঝবেন।
আলাদা করে cinematography , সাউন্ড, music অথবা অভিনয় নিয়ে কিছু বলার নেই, কারণ একটিই, আর সেটি হলো এ ছবির প্রাণ। এত বেশি সৎ প্রচেষ্টা , এই সমগ্র ইউনিট এর তরফ থেকে , যা বাংলা ছবিতে বিরল ও পথপ্রদর্শক । শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় এর অভিনয় নিয়ে বোধহয় তারিফ করার জন্য অভিধানে উপযুক্ত শব্দের সন্ধান করতে হবে , এতটাই সাবলীল, এতটাই মর্মন্তুদ , আর এতটাই রক্তমাংসের তার ঋত্বিক-সন্ধান। কিছু দৃশ্যে তার অভিনয় এর মধ্যে দিয়ে দর্শক literally transported হয় যান সেই সময়। ঘামের গন্ধ থেকে বিড়ির গন্ধ , বাংলা মদের এটল বেতল হাওয়াই খালাসিটোলা থেকে বার্দুয়ারী যার গন্তব্য সেই ঋত্বিক ধরা দেন এ ছবিতে ,তার ক্ষোভ, রাগ, স্পর্ধা আর রক্তের স্বাদ , ফুলমনীর কান্নার শব্দ প্রতিটা ফ্রেম কে জীবন্ত করে তোলে। অনন্যা চ্যাটার্জির দূর্গা বাংলা ছবিতে তার অমর সাক্ষর রাখল , এ কথা বলাই বাহুল্য । দর্শক আবীর চট্টোপাধ্যায়এর সাথেই গোটা ছবিতে ফিরে ফিরে যান সেই রক্তক্ষয়ের সময়ে। observe করেন কি অদ্ভুত করুন সময়ের দলিল ,এক নিপুন ডিটেল, যা এই ছবির গর্বিত সম্পদ। প্রাককথন যে কতটা নিপুন হাতে সামলানো যায়, কোথায় যে ফ্ল্যাশব্যাক আর ঘটমান বর্তমান এক বিপুল surreal শুদ্ধতায় একাকার হয়ে যায় , গোটা ছবি জুড়েই রেখেছে তার প্রভূত প্রমান। মেটাফোর এর পর মেটাফোর, সিনেমাটিক মোমেন্টস আর জীবনের এক করুন মন্তাজ। Masterpiece বললে খুব বেশি বলা হয় না ।খুব আফসোস লাগে যখন মনে হয় সত্যজিত, অথবা ঋতুপর্ণ ( জানিনা মৃনাল এই ছবি দেকেহ্ছেন কি না ) এই ছবি দেখে যেতে পারলেন না।।
তাই ছবির শেষে যখন নীলকন্ঠ auditorium ছেড়ে বঙ্গবালার হাত ধরে বেরিয়ে যান বাংলার নদী, মাঠ, ফুল ভরা অকৃত্রিম technicolor প্রেক্ষাপটে , তখনি পর্দায় ভেসে ওঠে আরেক stalwart শক্তি চট্টোপাধ্যায়'র মোক্ষম elegy ,"তুমি গেছ, স্পর্ধা গেছে, বিনয় এসেছে।" ।।এক মুহুর্তেই ছবি আঁকলেন এবং তুলির একটি আঁচরে আঁকলেন একটি বিস্ফোরক প্রতিভাকে , যার নাম, ঋত্বিক ঘটক।
তাই যখন নীলকন্ঠ বলেন, দুনিয়ায় টাকা থাকবে না দুগ্গা, কাজগুনো থেকে যাবে- সেই বক্তব্যের সাথে কোথাও না কোথাও দর্শক একমত হয়ে যান , প্রকৃতপক্ষেই কমলেশ্বর এর এই কাজ বাংলা সিনেমায় থেকে যাবে আজীবন।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুলাই, ২০১৩ দুপুর ২:১৭