প্রথমেই বলে নেই প্রথম আলোর নামটি এখানে এ জন্যই এনেছি যে বদলে যাওয়ার কথা বললেই কেমন জানি প্রথম আলোর বিতর্কিত হয়ে যাওয়া শ্লোগানটির কথা মনে পড়ে যায়। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে বা আক্রমণ করে লেখার পক্ষপাতী নই।
যাই হোক, শুরু করা যাক। আজকে তুরাগ বাসে চড়ে উত্তরা থেকে রাজলক্ষ্মী যাই। বাসে উঠার পর খিলগাঁও ফ্লাইওভার পেরোতেই কন্ডাকটর ভাড়া চাইলো। পকেট থেকে বিশ টাকার একটি নোট বের করে দিলাম। কন্ডাক্টর জিজ্ঞেস করলেন কোথায় যাবেন? আমি বললাম, ‘রাজলক্ষ্মী।’ লোকটি বললেন, “বাবা! আপনেও আবার কম দিবেন? ডাইরেক্ট যাত্রী পাইলাম একমাত্র আপনাকেই।” আমি কোন কথা না বলে পকেট থেকে আরো পাঁচ টাকা বের করে দিয়ে দিলাম। বলা আবশ্যক, লোকটির বয়স কিন্তু বেশি নয়। বড় জোর আমার থেকে মাত্র দুই তিন বছরের বড় হবে। অবশ্য আমার বয়স বোঝাটাও একটু কঠিন। দেখলে এখনো বালকসুলভ মনে হয়। যাই হোক, এমনিতে আমি জানি যে, বাসাবো থেকে উত্তরা রাজলক্ষ্মীর ভাড়া পঁচিশ টাকাই। কিন্তু বিশ টাকায়ও যাওয়া যায়। আমি আগে বিশটাকা দিয়ে গিয়েছি। ভাড়া দিলে তখন কোন আপত্তি করেনি। চুপচাপ রেখে দিয়েছে। আজকেও তাই দিতে চাইলাম। কিন্তু লোকটি এভাবে কথা বলায় আমি কোন ধরনের ইতস্ততা ছাড়াই অতিরিক্ত পাঁচ টাকা দিয়ে দিলাম। যদিও আমি খুব একটা স্বচ্ছল নই (খুব একটা না, মোটেও স্বচ্ছল নই)। বাস্তবতা হচ্ছে পাঁচ টাকাও আমার মত সীমিত আয়ের লোকের কাছে অনেক কিছু। তার মানে এই নয় যে আমি খুব ভাল মানুষ কিংবা অতীতে আমি ভাড়া নিয়ে কোন উচ্চ-বাচ্য করি নি। কিন্তু আজ বিনা বাক্য ব্যয়ে পাঁচ টাকা বাড়িয়ে দিলাম কেন? কারণ, তার আচরণ। তার আচরণ আমাকে দ্বিতীয় কথা বলার সুযোগ দেয় নি। ভাল কথা। বিমান বন্দর পেরিয়ে আমার মনে হলো পকেটেতো পাঁচশত টাকার নোট। এটি নিয়ে কোথাও ভাঙানো যাবে না। কন্ডাক্টরকে ডেকে বললাম, “মামা ভাঙতি হবে?” তিনি কোন কথা না বলে আমাকে ভাঙতি দিয়ে দিলেন। অন্য সময় হলে আমি নিশ্চিত- কিছু না বললেও একটু চেহারাটা কালো করতো বা রুক্ষভাবে ফিরিয়ে দিতো। কিন্তু এই লোকটি আমাকে ফেরাবে না সেটা তার চেহারা থেকে আমি আগেই পড়েছি। কারণ, সে আমাকে শুরু থেকেই খেয়াল করছিলো এবং অনেক সময় তারা ভুল করে দ্বিতীয় বার ভাড়া চেয়ে থাকে, কিন্তু আমার কাছে একবারও চায়নি। আমি নিশ্চিত সে ধরে নিয়েছে বাসের অন্যান্য লোকের চেয়ে আমি একটু আলাদা এবং ভালো (নিজের প্রশংসা হয়ে গেল বোধ হয়!)। কিন্তু এটি যে সঠিক তা প্রমাণিত হয়ে গেল যখন আমি বাস থেকে নামতে যাব তখন। কন্ডাক্টর আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আরেকদিন দেখা হলে আপনার কাছ থেকে বিশ টাকাই নেব।’ আমি অনেকটা বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। অপ্রস্তুত অবস্থায় বললাম, ‘না, না এ আর এমনি কি?’ লোকটার চেহারা আমার মনে গেঁথে রইলো। কিন্তু এমনও তো হতে পারত যে সে বাজখাই গলায় আমার কাছে আরো টাকা দাবি করতে পারতো যা অন্যরা করে থাকে। তখন আমিও নানা যুক্তি দিয়ে তাকে কম দিতে চাইতাম। এই নিয়ে দু চার কথা হতো। সেই তাকেও হয়তো আমি মনে রাখতাম, কিন্তু অন্যভাবে।
আবারো বলি, কেন এত হৃদ্যতা হয়েছে? কারণ সে আমার সাথে প্রথম ব্যবহারটি 'ভাল' দিয়ে শুরু করেছিল। তাই বলি, আমরা কি পারি না কারো সাথে সেই 'ভাল' দিয়ে শুরু করতে? যদি তা করি তাহলে কিন্তু অনেক সমস্যাই মিটে যায়।
আমি আজকে যে মুগ্ধতার কথা বলছি সেই আমিই যে অপমানিত হয়েছি, ভেতরে ভেতরে কষ্ট পেয়ে শিক্ষিত মানুষদেরকে ধিক্কার দেই নি তা নয়। সেই ঘটনাটাও বলি। একটি গ্রাম থেকে বাসে করে ফিরছিলাম। আমার আসন পড়েছিল বাসের একেবারে পেছনে। সে সিটটি অধিকাংশ সময় খালিই ছিল। তবে একেবারে বিপরীত দিকের জানালায় একজন লোক বসা ছিল। চেহারাটা একটু কৃশকায়। তার প্রতি আমার তেমন কোন আগ্রহ ছিল না। সাধারণ পর্যবেক্ষণটুকুই শুধুমাত্র।
গাউসিয়া পার হওয়ার পর আরো লোক উঠে সিটগুলো ভরে গেল। অল্প বিস্তর লোক দাঁড়িয়ে যেতেও বাধ্য হয়। তো আমার পাশে একজন লোক বসেছে। দেখতে একটি স্মার্ট। স্বাস্থ্য মোটামুটি ভাল। পেটানো শরীর। অন্যদিকে কৃশকায় লোকটির সাথে একটি বস্তা ছিল। পরে জেনেছি লোকটি ভাঙারি মালের ব্যবসা করে। হিরুইনচি হলেও হতে পারে। কিন্তু কোন মানুষ যাই হোক, যাই করুক আমি তাকে অসম্মান করতে পারি না। কেন পারি না তার একটা ব্যাখ্যা আমার কাছে আছে। তা না হয় শেয়ার নাই করলাম। যাই হোক, সেই কৃশকায় লোকটি একটি বড় আলপিন দিয়ে সিটে খোচাচ্ছিল। তো সেই স্বাস্থ্যবান লোকটি তাকে প্রশ্ন করা শুরু করলো, “এই ব্যাটা এমন করিস কেন? হাতে ওটা কেন, কি করিস ” ইত্যাদি ইত্যাদি। লোকটি যথাযথ জবাব দেওয়ার চেষ্টা করলো। বুঝলাম সে এই কাজটি ঠিক করছে না তা বুঝতে পেরেছে। কিন্তু স্বাস্থ্যবান ঐ লোকটি তাকে একেরপর এক প্রশ্ন করতে করতে জর্জরিত করে ফেলছে। কি করিস, কিছু খাস নাকি? সেও তখন কড়া ভাষায় জবাব দেওয়ার চেষ্টা করলো। এইবার প্রশ্ন, “তোর ব্যাগে কি, চেক করবো’’। পাল্টা জবাব এলা “করেন, চেক করেন”। প্রশ্নের সাথে যোগ দিল এবার পাশে বসা স্যুট-কোট পরা পাশে বসে থাকা কয়েকজন ভদ্র লোকও। কৃশকায় লোকটি প্রশ্নবানে জর্জরিত। এদিকে তার ব্যাগ চেকও করছে না আবার ছাড়ছেও না। এ নিয়ে বাসে এক ধরনের হট্টগোল শুরু হয়ে গেল। স্বাস্থ্যবান লোকটি কৃশকায় লোকটিকে মারতে উদ্যত হলো।
পুরো বিষয়টির আগা-গোড়া দেখে নিজেকে আর চুপ রাখতে পারলাম না। আমি স্বাস্থ্যবান লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বললাম, “কি দরকার এসবের? আপনার যদি চেক করার ইচ্ছে হয় তবে করুন না! এই রকম করার তো কোন মানে নেই।” এইবার লোকটি আমার উপর রেগে গেল। সরাসরি আমাকে তুই সম্বোধন করে বললো, “ওই তুই চেক কর”। আমি বললাম, “আমারতো চেক করার দরকার নেই।” এই বার সে আমার দিকে তেড়ে এল আমাকে মারতে। আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আমি এমন কি করেছি যে মারতে হবে! দেখলাম, স্যুট-টাই-কোট পরা ভদ্রলোকগুলো ঐ লোকটিকে নিবারণ করলো বটে, কিন্তু সে যে অন্যায় করছে সেটা ঘুনাক্ষরেও উচ্চারণ করলো না। উপরন্তু আমাকেই তিরস্কার করলো। আমি তখন বললাম, “কেন, আপনারা আমাকে দোষ দিচ্ছেন কেন? আমার দোষটা কোথায়? আমিতো শুধু অহেতুক বাক-বিতণ্ডা শেষ করার জন্য চেক করে শেষ করতে বলেছি। এটা কি আমার দোষ হতে পারে?”
যাই হোক আরো কিছু উচ্চ-বাচ্চ করে, চোখ বড় বড় চোখ করে লোকটি একটু সামনে চলে গেল। অর্থাৎ তার নেমে যাওয়ার সময় হয়েছে। কিন্তু ফোনে কাকে যেন ফোনে ডাকছে তারাবো বাসস্ট্যান্ডে আসতে। কৃশকায় লোকটিকে নামিয়ে শায়েস্তা করার হুমকি দিচ্ছে। একটু দূরে যেতেই এবার ভদ্রলোকেরা ঐ স্বাস্থ্যবান লোকটার দোষ তুলে ধরা শুরু করলো। তখন আমি বললাম, “আপনারা কেমন লোক বলুন তো! অন্যায় করেছে সেই লোকটি এবং তাকেই আপনারা তোষামোদ করলেন? স্থানটা যদি তার উল্টো পথে হতো তাহলে তো সে এমন করতে পারত না। কারণ, তার এলাকা দিয়ে বাস যাবে, এই কারণে তার গায়ে জোর হয়েছে। বিপরীত দিকের কারো সাথে হলে উল্টো সে মার খেত।” তখন লোকগুলো এবার আমতা আমতা করতে লাগলো। আমি সে দিন মনে মনে ভীষণ অপমানিত বোধ করেছিলাম। ভাবছিলাম এইভাবে অপমান সহ্য করে বেঁচে থাকতে আর ভাল লাগে না। অন্যায়ের প্রতিবাদ না করতে পারলে মরে যাওয়াই উত্তম। এই কাপুরুষতার জীবন পশুর মত।
দুটো দিকই আছে পৃথিবীতে। চরম খারাপ মানুষ। আবার ভাল মানুষও আছে। কিন্তু খারাপ লোকে দুনিয়াটা ভরে যাচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে ভাল লোকদের নিস্ক্রিয় আচরণ। খারাপ লোকদের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করলে আমরা যদি তার পাশে সাহস করে না দাঁড়াই তাহলে দিন দিন খারাপ লোকগুলো আরো বেপরোয়া হয়ে যাবে। এক সময় কোন মানুষই আর প্রতিবাদ করতে চাইবে না। অন্যায়কারীকেই সমর্থন দিয়ে যাবে যেমন দিয়েছেন আমাদের স্যুট-টাই-কোট পরিহিত ঐ তথাকথিত শিক্ষিত ভদ্রলোকগুলো। সুতরাং আসুন না আমরা আসলেই একটু বদলাই। আর বদলানোর শুরুটা আমাকে দিয়েই হোক। তখন অন্যরা উৎসাহ পাবে। কারণ এই পৃথিবীটাতো আমাদেরই। আর একে সুন্দর করার দায়িত্বটাও আমাদেরই।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১:৩৬