পুষ্প যা বলেঃ
তোমার নাম অপূর্ব, কাজ অপূর্ব, কথাবার্তা অপূর্ব, রঙ ঢঙ চেহারা অপূর্ব, সবচেয়ে তোমার সুফলা চাহনী। আমি অবাক হয়ে যাই যখন দেখি, সেই সুফলা চোখের চাহনী আগের মতই আছে, পরিবর্তন হয়েছে মনটা। তুমি হেসে হেসে চোখে বিদ্রুপ মাখানো মজা করে আমাকে বলতে-
“নাম তোমার পুষ্প রায়, রাশি তোমার সবসময় বায়।”
আরও কি খেয়ালে পড়ে তোমার, যখন তুমি আমার শরীর চষে বেড়াতে এবং বলতে-
জানো পুষ্প, তুমি বিশ্বের সবচেয়ে রহস্যবতী নারী যাকে এক জনম কেন হাজার হাজার জনমেও পুরোপুরি পড়া যাবে না। আমি আদৌ জানিনা আমি রহস্যবতী কিনা। আর যদি রহস্যবতী হয়েও থাকি তাতেও বা কি, তোমাকে বারবার আমার দু’চোখ ছুয়ে বলেছি, “তোমাকে ভালবাসী শতভাগ”। এর মধ্যে কোন কৃপ্টামি, কৃপণতা, সংকোচবোধ, দুর্বলতা কিংবা ভয় ছিল না। আমার সকল আনন্দ এবং দুঃখবোধ এক সুতোয় বাধা পড়ে কখন, জানো অপূর্ব? যখন নিজে নিজে উপলব্ধি করি, আমার মন, শিরা, উপশিরা, রক্ত-বিন্দু শুধু তোমাকে চায় এবং তোমার কথা কয়। আমি জানিনা প্রেম কি বুঝতাম না, বুঝি না, শুধু তোমাকে বুঝেছি আর শুধু এটুকু অনূভব হত তোমার স্পর্শ অন্যরকম সুন্দর। আরও সুন্দরের সংঙ্গাও দিতে পারবো না। আসলে বোঝাতেই পারব না, তুমি আমার কে, কতখানি, কেমন এক জন! অপূর্ব তুমি আমাকে একটি চিঠি দিয়েছিলে খুবই সাদামাটা যা এখনও আমার ব্যক্তিগত ট্রাঙ্ক এ শুয়ে আছে। অনেকদিন পর পর একবার পড়ি, দেখি, গন্ধ নিয়ে দেখি, কল্পনা করি, সেই বসন্তের কথা। সেই ভালবাসা বুকের মধ্যে সমস্ত চেতনার ভাললাগার ফেনার মত বুদবুদ করে ফুলে ফেপে ওঠে।
অপূর্ব তুমি কি শুধু তোমার কথার ছলেই কিংবা আমাকে খুশি করার জন্য বলে ছিলে, আমি রহস্যবতী। নাকি সিরিয়াসলিই বলেছিলে। যাই হোক, আমি আসলেই রহস্যবতী অন্তত এজন্য যে, অপূর্বর সাথে জড়িয়ে, শরীরে একাকার হয়ে আমিও অপূর্ব হয়ে উঠেছিলাম। তুমি সামাজিক এবং মানুষিক বিচার বুদ্ধিতে সমকালে আমার অনেক উর্দ্ধে। অনেক অনেক উচুতে তোমার স্থান। আমি তোমার স্বভাব, আচরণ, জ্ঞান এবং বড় হবার তীব্র আকাঙ্খা দেখেই বুঝে ছিলাম এবং তুমি একদিন এরকম বড় হবে, আমার কথায় ফুল চন্দন পড়েছে কিন্তু তোমার দেয়া কথা?
অপূর্ব তোমার হয়ত খেয়াল নেই অথবা থাকতেও পারে। অনেক সময় অনেক অনুল্লেখযোগ্য কথাও মনে থাকে, স্বাভাবিক জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে বলেছিলে-
তুমি কি রবী ঠাকুরের শেষের কবিতা পড়েছ অপূর্ব?
হ্যা, পড়েছি। হঠাৎ এ প্রসঙ্গ কেন?
সেখানে অনেক সহজভাবে লাবণ্য অমিতকে বলেছিল, তোমার দৌড়ে আমাকে এক সময় পিছিয়ে পড়া মনে হবে।
অপূর্ব তুমি তখন যৌবনের হাসি হেসে আমার কথাকে উড়িয়ে দিয়ে, বলেছিলে-
আমি যদি সমকথা তোমাকে ছুড়ে দেই তাহলে কি বলবে?
আমার কিছুই বলতে হয়নি। সময়ই সব বলে দিয়েছে। অপূর্ব তোমার হাত ধরে রমনায় হাটাহাটি, ঘুরে বেড়ানো, বসা যেন মহাকালের। এখনও কোন প্রেমা যুগলকে দেখলে সেই কথা মনে পড়ে। রমনায় কোন একদিন বাদাম খেতে খেতে তুমি বলেছিলে-
“পুষ্প, তুমি শয্যায়ও রানী আর বাইরেও রানী”।
কারণ কি তোমার সামনে কোন সুন্দরীকেই আর সুন্দর মনে হয় না। যেন গোলাপের পাশে গন্ধরাজ। আর শয্যায় তুমি একদম অন্যরকম। এত সুখ তুমি কিভাবে দাও, সেক্সি।
তোমার পাশে আমি গোলাপ নাকি গন্ধরাজ, তাতে খুব একটু আমার কৌতুহল ছিলনা। কৌতুহল এবং ভীরু সন্দেহ ছিল, অপূর্ব তোমার পাশে চিরকাল থাকতে পারবো কিনা। তুমি আমাকে গোলাপ না বলে গন্ধরাজ মনে করেও যদি পাশে পাশে রাখতে, তাতে অন্তত এ জনমটা আমার অপূর্ণ থেকে যেতনা। অপূর্ব তোমার সবকিছুই অপূর্ব, কারণ তোমার বাহির ভেতর যেটুকু জানি তাতে সুখি বলা চলে। আজ আমার চোখের জলের একটা প্রশ্নের উত্তর দাও না প্লিজ।
তুমি কি আসলেই সুখি?
তুমি আমার শরীরের প্রশংসা করতে, বারবার প্রশংসা করতে এবং আমার মাঝে ডুবে যেতে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমাকে দিয়েই তোমার শুরু। আর আমার সাথে এ্যাফেয়ার থাকাকালিন তুমি অন্য কারও সাথে শোওনি এবং তার আগেও না।
তুমি সেলিনা নামের একজন মুসলিম মেয়েকেও কাঁদিয়েছো। আমি তার প্রায় পুরো ব্যাপারটাই জানি। তোমাকে সেলিনাও হয়তো আমার মত করেই ভালবাসতো। মেয়েদের প্রেমাবেগ জাগাতে তুমি বিশ্বসেরা। হয়তোবা শ্রী কৃষ্ণের কাছাকাছি। এভাবে মেয়েদের প্রেমাবেগ জাগিয়ে তুমি কি লাভ পেতে, অপূর্ব?
আমার আজও বিশ্বাস করতে হচ্ছে হয় না, তুমি আমার সাথে তোমার চিরাচরিত অভ্যাসের প্রাকটিস করেছিলে। তোমার মাঝে এত রহস্য অপূর্ব! আর হয়তোবা তোমার সাথে নিবিড় করে কথা বলা হবে না। আর হয়তো জানাও হবে না, সেই অপূর্ব এবং এ অপূর্বর ব্যবধান কতখানি।
আমার স্বামী গো-বেচারা টাইপ। আমাকে প্রচন্ডরকম ভালবাসে এবং বিশ্বাস করে। আমি তাকে বিয়ের পর কোন কিছুতেই ঠকাইনি। খুব সহজ সরল, সাদামাটা এবং কালো, মাথায় মেঝো আকৃতির টাক, ঘন গোঁফ সমাজের আর পাচটা মানুষের মতই আচার আচরণ। টাকা গুনতে খুব পছন্দ করে আরও যা কিছুই পায় খুব কষ্টকরে পেতে হয়। আমার স্বামীটার জন্য আমার খুব রকম মায়া হয় কারণ ছেলেপেলেদের চেয়েও এখনও আমার প্রতি বেশি কেয়ার নেয়। আমার সাংসারিক কোন সুবিধা অসুবিধা দক্ষতার সাথে পর্যবেক্ষণ করে এবং ব্যবস্থা নেয় মনটা তো আর বোঝার ক্ষমতা ঐ গবেটের নেই।
জানো অপূর্ব! আমার ছেলের নামও রেখেছি অপূর্ব। আর অপূর্বর বয়স এখন বাইশ ছুই ছুই। আমি মনে প্রাণে চেয়েছিলাম এ অপূর্বর আচরণও তোমার মত হোক কিন্তু একদমই হয়নি, ওর বাবার মত হয়নি। আমার মতও হয়নি। হয়েছে আর এক জাতের, যে জাতটা আমি কখনও পছন্দ করতাম না। অপূর্ব অনেক পড়তে পারে। রাত ভোর করে দেয় কিন্তু সব ভুয়ে যায়। সবখানে ঠকে আসে। স্কুল জীবনে অনেক লাথি ঘুশি খেয়ে বাসায় এসেছে। দিতে পারেনি কাউকে। তুমি যেমন রবীন্দ্র সংগীত শুনতে পছন্দ করতে, আমার স্বামীর মধ্যে কোন প্রকার সংগীত প্রিয়তা নেই। রুচিবোধ নিচের সারীর। এত দিন ওর সঙ্গে কাটিয়ে দিলাম, ঘর করলাম, যা তোমার আমার সময়গুলোর থেকে ঢেড় বেশি। তারপরও তুমি কেন বারবার সবকিছুর মধ্যে চলে আসো অপূর্ব? আমি বুঝিনা তুমি কে। কি ঢুকিয়ে দিয়েছ আমার চেতনায়। ঢুকিয়ে দিয়ে খারাপ করনি, ভালই করেছ অপূর্ব। নইলে আমার জীবন এতটা বৈচিত্রময় হত না।
এপৃল মাসে তোমার আমার প্রথম জড়াজড়ি বল, মিলন বল, তাই হয়েছিল। তুমি এপৃলের কোন এক দিনে ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে একটি কথা বলেছিলে, খেয়ালে পড়ে তোমার? বলেছিলে-
পুষ্প এপৃলটাকে তুমি আমি কখনও ভুলতে পারব না। কারণ কি জানো? এপৃল মাসটা ইংরেজিতে AP দিয়ে শুরু যাতে হয় অপূর্ব পুষ্প। তোমার কি কি এপৃল আসলে একবারও আমার কথা মনে পড়ে না। তোমার বলা কথাগুলোও কি মনে পড়েনা। আমি কিন্তু আজও এপৃলের AP টাকে লাল মার্কার দিয়ে ঘুরিয়ে মার্ক করে রাখি। প্রতিদিন দেখি ক্যালেন্ডারের অপূর্ব পুষ্প কত কাছাকাছি। বাস্তবে ভিন্ন। জীবন নামের ক্যালেন্ডারে আজ আমরা কতদূরে তাই না, অপূর্ব?
এতগুলো এপৃল কেটে গেল এর মধ্যে, একবারও কি আমাকে মনে পড়েনি তোমার? আমাকে মনে না পড়–ক অন্তত তোমার বলা কথাগুলো তো মনে পড়া উচিৎ। আমি জানি তোমার বলা কথাও তোমার মনে পড়ে না। কারণ তুমি লেখক। তুমি লেখালেখি কর। গল্প, উপন্যাস, নাটকে সুন্দর চমৎকার কাহিনী সাজাও। কামারের কাজ যেমন দাঁ, বটি, কোদাল বানানো, ঠিক তেমনি তোমার কাজ হল চমৎকার বিশ্বাসযোগ্য করে লেখা ও সুন্দর করে কথা বলা। তুমি হয়ত সুন্দর করে বলে অথবা লিখে ভুলে যাও। কিন্তু কখনও জানবে না তোমার প্রতিটা কথার দাম আমার কাছে এত বেশি মূল্যবান যা পার্থিব কোন মূল্য দিয়ে পরিশোধ করা যাবে না এবং সম্ভবও না।
অপূর্ব! তুমি যখন তোমার স্ত্রীর সাথে নিবিড় যৌবিক খেলায় মেতে থাক তখনও কি আমাকে মনে পড়ে না। মনে পড়ে না আমার শরীর এবং সেই স্বর্গের দিনগুলোর কথা যেন ধুলির পৃথিবীতে এগুলো হতেই পারে না। অপূর্ব তুমি যদি এখনও একবার এসে আমাকে বলতে-
“পুষ্প, তোমার কথা হৃদয়ের সুন্দর জায়গায় ভেসে ওঠে।
তাহলে আমার চেয়ে সুখি এ পৃথিবীতে আর কেউ থাকত না”।
আমার খুব কান্না পায় অপূর্ব, বুকের সমস্ত চাপা কষ্টগুলো নাড়া দিয়ে ওঠে। তুমি বলতে-
“জান পুষ্প, স্বয়ং ভগবান যদি আমার সাথে দেখা দিতে চায় মানুষরূপে, আমি চাব তিনি যেন পুষ্প, তোমার মত। ঠিক তোমার মত আকৃতি নিয়ে আমার সামনে দাঁড়ায়।
এত ভালবাসার ভান তুমি কিভাবে করতে জানতে?
সূর্যের সাত রং কিংবা মিলিয়ন বিলিয়ন রংয়ের এ পৃথিবী তোমার রং কয়টা আমি আজও বুঝে উঠতে পারিনি। হয়ত কোনদিন বোঝাও হবে না।
আমার পরে তুমি সেলিনাকে কাঁদিয়েছ। কেন কাঁদিয়েছ অপূর্ব? তোমার ধর্ম কি কাঁদানো? জানি তুমি জবাব দিবে না, অথবা এমন সুন্দর করে ভেবে চিন্তে জবাব দিবে, সেটাও একটা চিরন্তণ বাণীর রূপ নিয়ে নিবে। আমাকে যেমন শেষের কবিতা গিফট করেছিলে, সেলিনাকেও করেছ। সেলিনাই আমাকে দেখিয়েছে। প্রচ্ছদ উল্টানোর পর প্রথম সাদাপাতায় সুন্দর করে সবুজ কালিতে লিখেছিলে-
“সেলিনা তোমার বুকের মধ্যে যেখানে মন, সেখানে আমার ঘর, বাড়ি, বাগান, পৃথিবী আর সেখানেই আমি বাস করি, তুমি কি টের পাওনা? তোমার বুকে কি আমার উপস্থিতিতে দুরু দুরু কাঁপন হয় না”?
কি চমৎকার তোমার লেখা। প্রশংসা এমনিতেই এসে যায়। তুমি তো জানো সেলিনা আমার মোটামুটি কাছের বান্ধবী। খুব রকম চাপা স্বভাবের। তোমার কথা সেলিনার কাছে জানতে চাইতাম। আর খুব ঈর্ষা নিয়ে দেখতাম আমার থেকে ওর মধ্যে এমন কি আছে যার মোহে তুমি সেলিনাকে ভালবাসলে।
সেলিনার বুক তোমার জন্য দুরু দুরু কেপেছে। এ আমি নিজেকে দিয়ে অনুভব করেছি। তোমার কি কেঁপেছে?
আমার মনে হয় না। সেলিনা বোরখা পরা মেয়ে। কি যাদু বলে তুমি ওর এত কাছাকাছি গেলে পুরো মন দখল করে নিলে। তুমি ওর মন তো দখল করেছই তার সাথে এক আধবার শরীরও। জানো অপূর্ব, আমার কাছে সেলিনা কখনও স্বীকার করেনি। তোমার ওর গোপন গোপন খেলার কথা। আমিও তো নারী!!! তোমার প্রসংগ যখন টেনে নিয়ে আসতাম, ওর চোখ দেখেই বুঝে নিয়েছি সবকিছু। সেলিনা একশত রাকআত নামাজ পড়েছিল তুমি ওকে ভালবাসো বলে। আমার সেলিনার জন্য মাঝে মাঝে কান্না পায়। যাক এসব কথা বলতে আমার ভাল্লাগছে না। যা তুমিই ভাল জান।
অপূর্ব আমার অনেক কথা তোমার কাছে অস্পষ্ট মনে হতে পারে। আমি আমার মনের কষ্ট তোমার কাছে প্রকাশ করে যাচ্ছি, যা সম্পূর্ণরূপে সত্য। আর আমি তোমার মত অত সুন্দর করে বলতেও পারি না। তুমি লেখক মানুষ। তুমি পার। লেখার মাধ্যমে তুমি ফুলের সৌন্দর্য-গন্ধ, ফলের স্বাদ, তুমি ছড়িয়ে দিতে পার। আমি পারি না। তারপরও আমি জানি, আমার শব্দ চয়নে বা বলার ভঙ্গিতে যতই অস্পষ্ট ভাব থাকুক না কেন তুমি ঠিকই বুঝতে পারবে। তুমি লেখক কত ক্যারেক্টার নিয়ে তোমার লেখা। কত মিল, অমিল দেখাও। তোমার হাতের পরশে কত মিথ্যার ফুলঝুরড়ি সত্যের মত হয়ে ওঠে।
এর মাঝে কি সুখ পাও অপূর্ব? আমার কিন্তু ভালোলাগেনা। যদি কেউ আমাকে বলত পৃথিবীর সব আনন্দ, হাসি, সুখ, ভাললাগা ভাব একদিকে আর অপূর্ব একদিকে কোনটি বেছে নিবে। আমি একশ্বাসে এখনও নির্ভয়ে নিঃসংকোচে বলতে পারি “অপূর্বকে পেলে আর কিছু চাই না”।
মাঝে মাঝে মনে হয় তুমি প্রচন্ড সার্থপর এবং দয়ামায়াহীন। বিজন দাকে তুমি কিভাবে ভুললে অপূর্ব? বিজনদা তোমর প্রাণের বন্ধু- ঐ স্বর্ণালী সময়ের দৃষ্টিতে। একসাথে চলতে, একসাথে রাস্তায় হাটতে। কত আঠালো বন্ধুত্ব তোমাদের। রমনায় তুমি একদিন খুব চমৎকার কালো সাদা মিলানো ছাপার ফুল হাতার শার্ট পরে আসলে। আমি বেঞ্চিতে বসা। দূর থেকে তোমায় কত চমৎকার লাগছিল বুঝাতে পারবো না। আর কাছে আসার পর তো কথাই নেই। সোজা এসে আমার সামনে হাটু গেড়ে বসলে। দু’হাত নমস্কারের ভঙ্গিতে তুললে। আমি বিরক্তি ভাব দেখিয়ে বললাম-
যত্তসব পাগলামী? সবাই কি ভাববে?
তুমি মিষ্টি হাসি হেসে ভ্র“ নাচিয়ে বললে-
দেবীকে তো এভাবেই প্রণাম করতে হয়। সবাই যা বলে বলুক।
আমি মিষ্টি হেসে বলেছিলাম-
বাহ! অপূর্ব তুমি কি জান? নীল হাফ হাতার শার্টের যুগ শেষ করে এই যে চমৎকার ছাপার ফুল হাতার শার্ট পরেছো। কি যে ভাল্লাগাছে তোমাকে। তোমার রুচিবোধ হল তাহলে! সত্যি খুব সুন্দর লাগছে। স্বয়ং কার্ত্তিকও এ শার্ট তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে গায়ে পরত, আর আমি এও সিওর তাকেও তোমার মত মানাতো না।
তুমি হেসে হেসে বললেঃ
থ্যাঙক য়্যু, তুমি শার্টের যত ইচ্ছে প্রশংসা করতে পার। তবে তার পুরোটা পাবে বিজন। ওই সকালে গিফট করেছে। তোমাকে বিজনদা অনেক হেল্প করেছে। তোমার অভাবী দিনে পাশে দাড়িয়েছে। টিউশনী যোগাড় করে দিয়েছে। তুমি বিজনদার সাথে কোন যোগাযোগ করলে না কেন?
বিজনদা একটুও চেঞ্জ হয়নি। পাড়ায় ছোট মুদির দোকান চালায়। শ্যাতশ্যাতে ঘরে থাকে। দাড়িপাল্লা, বাটখারা, খুচরো টাকা, বেচাকেনা, ধারদেনা এবং ছেলে মেয়েদের চিন্তায় দিন কেটে যাচ্ছে। তোমার কি তাকে পরিচয় দিতে লজ্জা হয় অপূর্ব? কিন্তু অবাক করার মত ব্যাপার হল, বিজনদার সাথে তোমার প্রসঙ্গ উঠলে; কখনও সে আফসোস কিংবা রাগ দেখায় না। পত্রিকায় তোমার সাক্ষাৎকার ছাপা হলে কেটে রেখে দেয়। কত সাধারণ এবং মহান সে। আর তোমাকে সবাই, তোমার ভক্তরা, পাঠকরা, কত অসাধারণ ভাবে। কিন্তু তুমি কি সত্যিই সত্যিই মহান?
আমার স্বামীর সাথে বিজনদার ভাল রকম মিল। দু’জনে মিলেও বেশ। কিছু কিছু মানুষ থাকে যাদের সাথে সবার মিল হয়। বিজনদা সেরকমই একজন। আর তুমি তাকে ভুলে গেলে?
আমি তোমাকে কোন ছকে বাঁধতে পারি না। তুমি আসলে কেমন তা আমার এখনও খটকা লাগে। কোনদিন হয়তো এ বোঝার শেষ হবে না। বুঝি বা না বুঝি আমি তোমাকে ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি।
আমাদের সামাজিক বিয়ে এ জনমে হয়নি। তুমি আমি শুধুমাত্র জীবনের কিছু ক্ষুদ্র সময় কাছাকাছি আসার, আলিঙ্গন করার, প্রেম প্রেম খেলার সময় পেয়েছি। প্রেম প্রেম খেলা তোমার দৃষ্টিকোন থেকে বলছি। আমার কাছে কিন্তু জীবনের বেস্ট সময়, বেস্ট বসন্ত, বেস্ট স্বর্গ। তাতেই কি ভালবাসা শেষ হয়ে গেল? তুমি কি আমার সামনে এসে একবারও দাড়াতে পারতে না?
হয়তো সমাজ খারাপ বলতো, তাতে কি যায় আসে “বড় ভালবাসার কাছে সমাজ খুব ক্ষুদ্র কীট”। তোমার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, অপূর্ব আমি তোমাতে বিভোর, আমার সংসার, ছেলে অপূর্বর জন্য মায়া নেই। আছে অপূর্ব আছে। দুটো দু’রকম। আমি কোনদিনও অস্বীকার করতে পারবোনা, তোমাকে ভালবাসতাম, ভালবাসি, ভালবাসবো। সব কিছু ছেড়ে এখনও তোমাতে ছুটে আসতে পারি। কিন্তু তুমি তো চেঞ্জ। অপূর্ব। ভালবাসা খুব অদ্ভুত অপূর্ব! ঠিক তোমার মত
তোমার নাম অপূর্ব, কাজ অপূর্ব, কথাবার্তা অপূর্ব, রঙ ঢঙ চেহারা অপূর্ব, সবচেয়ে তোমার সুফলা চাহনী। আমি অবাক হয়ে যাই যখন দেখি, সেই সুফলা চোখের চাহনী আগের মতই আছে, পরিবর্তন হয়েছে মনটা। তুমি হেসে হেসে চোখে বিদ্রুপ মাখানো মজা করে আমাকে বলতে-
“নাম তোমার পুষ্প রায়, রাশি তোমার সবসময় বায়।”
আরও কি খেয়ালে পড়ে তোমার, যখন তুমি আমার শরীর চষে বেড়াতে এবং বলতে,
জানো পুষ্প, তুমি বিশ্বের সবচেয়ে রহস্যবতী নারী যাকে এক জনম কেন হাজার হাজার জনমেও পুরোপুরি পড়া যাবে না। আমি আদৌ জানিনা আমি রহস্যবতী কিনা। আর যদি রহস্যবতী হয়েও থাকি তাতেও বা কি, তোমাকে বারবার আমার দু’চোখ ছুয়ে বলেছি, “তোমাকে ভালবাসী শতভাগ”। এর মধ্যে কোন কৃপ্টামি, কৃপণতা, সংকোচবোধ, দুর্বলতা কিংবা ভয় ছিল না। আমার সকল আনন্দ এবং দুঃখবোধ এক সুতোয় বাধা পড়ে কখন, জানো অপূর্ব? যখন নিজে নিজে উপলব্ধি করি, আমার মন, শিরা, উপশিরা, রক্ত-বিন্দু শুধু তোমাকে চায় এবং তোমার কথা কয়। আমি জানিনা প্রেম কি বুঝতাম না, বুঝি না, শুধু তোমাকে বুঝেছি আর শুধু এটুকু অনূভব হত তোমার স্পর্শ অন্যরকম সুন্দর। আরও সুন্দরের সংঙ্গাও দিতে পারবো না। আসলে বোঝাতেই পারব না, তুমি আমার কে, কতখানি, কেমন এক জন! অপূর্ব তুমি আমাকে একটি চিঠি দিয়েছিলে খুবই সাদামাটা যা এখনও আমার ব্যক্তিগত ট্রাঙ্ক এ শুয়ে আছে। অনেকদিন পর পর একবার পড়ি, দেখি, গন্ধ নিয়ে দেখি, কল্পনা করি, সেই বসন্তের কথা। সেই ভালবাসা বুকের মধ্যে সমস্ত চেতনার ভাললাগার ফেনার মত বুদবুদ করে ফুলে ফেপে ওঠে।
অপূর্ব তুমি কি শুধু তোমার কথার ছলেই কিংবা আমাকে খুশি করার জন্য বলে ছিলে, আমি রহস্যবতী। নাকি সিরিয়াসলিই বলেছিলে। যাই হোক, আমি আসলেই রহস্যবতী অন্তত এজন্য যে, অপূর্বর সাথে জড়িয়ে, শরীরে একাকার হয়ে আমিও অপূর্ব হয়ে উঠেছিলাম। তুমি সামাজিক এবং মানুষিক বিচার বুদ্ধিতে সমকালে আমার অনেক উর্দ্ধে। অনেক অনেক উচুতে তোমার স্থান। আমি তোমার স্বভাব, আচরণ, জ্ঞান এবং বড় হবার তীব্র আকাঙ্খা দেখেই বুঝে ছিলাম এবং তুমি একদিন এরকম বড় হবে, আমার কথায় ফুল চন্দন পড়েছে কিন্তু তোমার দেয়া কথা?
অপূর্ব তোমার হয়ত খেয়াল নেই অথবা থাকতেও পারে। অনেক সময় অনেক অনুল্লেখযোগ্য কথাও মনে থাকে, স্বাভাবিক জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে বলেছিলে-
তুমি কি রবী ঠাকুরের শেষের কবিতা পড়েছ অপূর্ব?
হ্যা, পড়েছি। হঠাৎ এ প্রসঙ্গ কেন?
সেখানে অনেক সহজভাবে লাবণ্য অমিতকে বলেছিল, তোমার দৌড়ে আমাকে এক সময় পিছিয়ে পড়া মনে হবে।
অপূর্ব তুমি তখন যৌবনের হাসি হেসে আমার কথাকে উড়িয়ে দিয়ে, বলেছিলে-
আমি যদি সমকথা তোমাকে ছুড়ে দেই তাহলে কি বলবে?
আমার কিছুই বলতে হয়নি। সময়ই সব বলে দিয়েছে। অপূর্ব তোমার হাত ধরে রমনায় হাটাহাটি, ঘুরে বেড়ানো, বসা যেন মহাকালের। এখনও কোন প্রেমা যুগলকে দেখলে সেই কথা মনে পড়ে। রমনায় কোন একদিন বাদাম খেতে খেতে তুমি বলেছিলে-
“পুষ্প, তুমি শয্যায়ও রানী আর বাইরেও রানী”।
কারণ কি তোমার সামনে কোন সুন্দরীকেই আর সুন্দর মনে হয় না। যেন গোলাপের পাশে গন্ধরাজ। আর শয্যায় তুমি একদম অন্যরকম। এত সুখ তুমি কিভাবে দাও, সেক্সি।
তোমার পাশে আমি গোলাপ নাকি গন্ধরাজ, তাতে খুব একটু আমার কৌতুহল ছিলনা। কৌতুহল এবং ভীরু সন্দেহ ছিল, অপূর্ব তোমার পাশে চিরকাল থাকতে পারবো কিনা। তুমি আমাকে গোলাপ না বলে গন্ধরাজ মনে করেও যদি পাশে পাশে রাখতে, তাতে অন্তত এ জনমটা আমার অপূর্ণ থেকে যেতনা। অপূর্ব তোমার সবকিছুই অপূর্ব, কারণ তোমার বাহির ভেতর যেটুকু জানি তাতে সুখি বলা চলে। আজ আমার চোখের জলের একটা প্রশ্নের উত্তর দাও না প্লিজ।
তুমি কি আসলেই সুখি?
তুমি আমার শরীরের প্রশংসা করতে, বারবার প্রশংসা করতে এবং আমার মাঝে ডুবে যেতে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমাকে দিয়েই তোমার শুরু। আর আমার সাথে এ্যাফেয়ার থাকাকালিন তুমি অন্য কারও সাথে শোওনি এবং তার আগেও না।
তুমি সেলিনা নামের একজন মুসলিম মেয়েকেও কাঁদিয়েছো। আমি তার প্রায় পুরো ব্যাপারটাই জানি। তোমাকে সেলিনাও হয়তো আমার মত করেই ভালবাসতো। মেয়েদের প্রেমাবেগ জাগাতে তুমি বিশ্বসেরা। হয়তোবা শ্রী কৃষ্ণের কাছাকাছি। এভাবে মেয়েদের প্রেমাবেগ জাগিয়ে তুমি কি লাভ পেতে, অপূর্ব?
আমার আজও বিশ্বাস করতে হচ্ছে হয় না, তুমি আমার সাথে তোমার চিরাচরিত অভ্যাসের প্রাকটিস করেছিলে। তোমার মাঝে এত রহস্য অপূর্ব! আর হয়তোবা তোমার সাথে নিবিড় করে কথা বলা হবে না। আর হয়তো জানাও হবে না, সেই অপূর্ব এবং এ অপূর্বর ব্যবধান কতখানি।
আমার স্বামী গো-বেচারা টাইপ। আমাকে প্রচন্ডরকম ভালবাসে এবং বিশ্বাস করে। আমি তাকে বিয়ের পর কোন কিছুতেই ঠকাইনি। খুব সহজ সরল, সাদামাটা এবং কালো, মাথায় মেঝো আকৃতির টাক, ঘন গোঁফ সমাজের আর পাচটা মানুষের মতই আচার আচরণ। টাকা গুনতে খুব পছন্দ করে আরও যা কিছুই পায় খুব কষ্টকরে পেতে হয়। আমার স্বামীটার জন্য আমার খুব রকম মায়া হয় কারণ ছেলেপেলেদের চেয়েও এখনও আমার প্রতি বেশি কেয়ার নেয়। আমার সাংসারিক কোন সুবিধা অসুবিধা দক্ষতার সাথে পর্যবেক্ষণ করে এবং ব্যবস্থা নেয় মনটা তো আর বোঝার ক্ষমতা ঐ গবেটের নেই।
জানো অপূর্ব! আমার ছেলের নামও রেখেছি অপূর্ব। আর অপূর্বর বয়স এখন বাইশ ছুই ছুই। আমি মনে প্রাণে চেয়েছিলাম এ অপূর্বর আচরণও তোমার মত হোক কিন্তু একদমই হয়নি, ওর বাবার মত হয়নি। আমার মতও হয়নি। হয়েছে আর এক জাতের, যে জাতটা আমি কখনও পছন্দ করতাম না। অপূর্ব অনেক পড়তে পারে। রাত ভোর করে দেয় কিন্তু সব ভুয়ে যায়। সবখানে ঠকে আসে। স্কুল জীবনে অনেক লাথি ঘুশি খেয়ে বাসায় এসেছে। দিতে পারেনি কাউকে। তুমি যেমন রবীন্দ্র সংগীত শুনতে পছন্দ করতে, আমার স্বামীর মধ্যে কোন প্রকার সংগীত প্রিয়তা নেই। রুচিবোধ নিচের সারীর। এত দিন ওর সঙ্গে কাটিয়ে দিলাম, ঘর করলাম, যা তোমার আমার সময়গুলোর থেকে ঢেড় বেশি। তারপরও তুমি কেন বারবার সবকিছুর মধ্যে চলে আসো অপূর্ব? আমি বুঝিনা তুমি কে। কি ঢুকিয়ে দিয়েছ আমার চেতনায়। ঢুকিয়ে দিয়ে খারাপ করনি, ভালই করেছ অপূর্ব। নইলে আমার জীবন এতটা বৈচিত্রময় হত না।
এপৃল মাসে তোমার আমার প্রথম জড়াজড়ি বল, মিলন বল, তাই হয়েছিল। তুমি এপৃলের কোন এক দিনে ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে একটি কথা বলেছিলে, খেয়ালে পড়ে তোমার? বলেছিলে-
পুষ্প এপৃলটাকে তুমি আমি কখনও ভুলতে পারব না। কারণ কি জানো? এপৃল মাসটা ইংরেজিতে AP দিয়ে শুরু যাতে হয় অপূর্ব পুষ্প। তোমার কি কি এপৃল আসলে একবারও আমার কথা মনে পড়ে না। তোমার বলা কথাগুলোও কি মনে পড়েনা। আমি কিন্তু আজও এপৃলের AP টাকে লাল মার্কার দিয়ে ঘুরিয়ে মার্ক করে রাখি। প্রতিদিন দেখি ক্যালেন্ডারের অপূর্ব পুষ্প কত কাছাকাছি। বাস্তবে ভিন্ন। জীবন নামের ক্যালেন্ডারে আজ আমরা কতদূরে তাই না, অপূর্ব?
এতগুলো এপৃল কেটে গেল এর মধ্যে, একবারও কি আমাকে মনে পড়েনি তোমার? আমাকে মনে না পড়–ক অন্তত তোমার বলা কথাগুলো তো মনে পড়া উচিৎ। আমি জানি তোমার বলা কথাও তোমার মনে পড়ে না। কারণ তুমি লেখক। তুমি লেখালেখি কর। গল্প, উপন্যাস, নাটকে সুন্দর চমৎকার কাহিনী সাজাও। কামারের কাজ যেমন দাঁ, বটি, কোদাল বানানো, ঠিক তেমনি তোমার কাজ হল চমৎকার বিশ্বাসযোগ্য করে লেখা ও সুন্দর করে কথা বলা। তুমি হয়ত সুন্দর করে বলে অথবা লিখে ভুলে যাও। কিন্তু কখনও জানবে না তোমার প্রতিটা কথার দাম আমার কাছে এত বেশি মূল্যবান যা পার্থিব কোন মূল্য দিয়ে পরিশোধ করা যাবে না এবং সম্ভবও না।
অপূর্ব! তুমি যখন তোমার স্ত্রীর সাথে নিবিড় যৌবিক খেলায় মেতে থাক তখনও কি আমাকে মনে পড়ে না। মনে পড়ে না আমার শরীর এবং সেই স্বর্গের দিনগুলোর কথা যেন ধুলির পৃথিবীতে এগুলো হতেই পারে না। অপূর্ব তুমি যদি এখনও একবার এসে আমাকে বলতে-
“পুষ্প, তোমার কথা হৃদয়ের সুন্দর জায়গায় ভেসে ওঠে।
তাহলে আমার চেয়ে সুখি এ পৃথিবীতে আর কেউ থাকত না”।
আমার খুব কান্না পায় অপূর্ব, বুকের সমস্ত চাপা কষ্টগুলো নাড়া দিয়ে ওঠে। তুমি বলতে-
“জান পুষ্প, স্বয়ং ভগবান যদি আমার সাথে দেখা দিতে চায় মানুষরূপে, আমি চাব তিনি যেন পুষ্প, তোমার মত। ঠিক তোমার মত আকৃতি নিয়ে আমার সামনে দাঁড়ায়।
এত ভালবাসার ভান তুমি কিভাবে করতে জানতে?
সূর্যের সাত রং কিংবা মিলিয়ন বিলিয়ন রংয়ের এ পৃথিবী তোমার রং কয়টা আমি আজও বুঝে উঠতে পারিনি। হয়ত কোনদিন বোঝাও হবে না।
আমার পরে তুমি সেলিনাকে কাঁদিয়েছ। কেন কাঁদিয়েছ অপূর্ব? তোমার ধর্ম কি কাঁদানো? জানি তুমি জবাব দিবে না, অথবা এমন সুন্দর করে ভেবে চিন্তে জবাব দিবে, সেটাও একটা চিরন্তণ বাণীর রূপ নিয়ে নিবে। আমাকে যেমন শেষের কবিতা গিফট করেছিলে, সেলিনাকেও করেছ। সেলিনাই আমাকে দেখিয়েছে। প্রচ্ছদ উল্টানোর পর প্রথম সাদাপাতায় সুন্দর করে সবুজ কালিতে লিখেছিলে-
“সেলিনা তোমার বুকের মধ্যে যেখানে মন, সেখানে আমার ঘর, বাড়ি, বাগান, পৃথিবী আর সেখানেই আমি বাস করি, তুমি কি টের পাওনা? তোমার বুকে কি আমার উপস্থিতিতে দুরু দুরু কাঁপন হয় না”?
কি চমৎকার তোমার লেখা। প্রশংসা এমনিতেই এসে যায়। তুমি তো জানো সেলিনা আমার মোটামুটি কাছের বান্ধবী। খুব রকম চাপা স্বভাবের। তোমার কথা সেলিনার কাছে জানতে চাইতাম। আর খুব ঈর্ষা নিয়ে দেখতাম আমার থেকে ওর মধ্যে এমন কি আছে যার মোহে তুমি সেলিনাকে ভালবাসলে।
সেলিনার বুক তোমার জন্য দুরু দুরু কেপেছে। এ আমি নিজেকে দিয়ে অনুভব করেছি। তোমার কি কেঁপেছে?
আমার মনে হয় না। সেলিনা বোরখা পরা মেয়ে। কি যাদু বলে তুমি ওর এত কাছাকাছি গেলে পুরো মন দখল করে নিলে। তুমি ওর মন তো দখল করেছই তার সাথে এক আধবার শরীরও। জানো অপূর্ব, আমার কাছে সেলিনা কখনও স্বীকার করেনি। তোমার ওর গোপন গোপন খেলার কথা। আমিও তো নারী!!! তোমার প্রসংগ যখন টেনে নিয়ে আসতাম, ওর চোখ দেখেই বুঝে নিয়েছি সবকিছু। সেলিনা একশত রাকআত নামাজ পড়েছিল তুমি ওকে ভালবাসো বলে। আমার সেলিনার জন্য মাঝে মাঝে কান্না পায়। যাক এসব কথা বলতে আমার ভাল্লাগছে না। যা তুমিই ভাল জান।
অপূর্ব আমার অনেক কথা তোমার কাছে অস্পষ্ট মনে হতে পারে। আমি আমার মনের কষ্ট তোমার কাছে প্রকাশ করে যাচ্ছি, যা সম্পূর্ণরূপে সত্য। আর আমি তোমার মত অত সুন্দর করে বলতেও পারি না। তুমি লেখক মানুষ। তুমি পার। লেখার মাধ্যমে তুমি ফুলের সৌন্দর্য-গন্ধ, ফলের স্বাদ, তুমি ছড়িয়ে দিতে পার। আমি পারি না। তারপরও আমি জানি, আমার শব্দ চয়নে বা বলার ভঙ্গিতে যতই অস্পষ্ট ভাব থাকুক না কেন তুমি ঠিকই বুঝতে পারবে। তুমি লেখক কত ক্যারেক্টার নিয়ে তোমার লেখা। কত মিল, অমিল দেখাও। তোমার হাতের পরশে কত মিথ্যার ফুলঝুরড়ি সত্যের মত হয়ে ওঠে।
এর মাঝে কি সুখ পাও অপূর্ব? আমার কিন্তু ভালোলাগেনা। যদি কেউ আমাকে বলত পৃথিবীর সব আনন্দ, হাসি, সুখ, ভাললাগা ভাব একদিকে আর অপূর্ব একদিকে কোনটি বেছে নিবে। আমি একশ্বাসে এখনও নির্ভয়ে নিঃসংকোচে বলতে পারি “অপূর্বকে পেলে আর কিছু চাই না”।
মাঝে মাঝে মনে হয় তুমি প্রচন্ড সার্থপর এবং দয়ামায়াহীন। বিজন দাকে তুমি কিভাবে ভুললে অপূর্ব? বিজনদা তোমর প্রাণের বন্ধু- ঐ স্বর্ণালী সময়ের দৃষ্টিতে। একসাথে চলতে, একসাথে রাস্তায় হাটতে। কত আঠালো বন্ধুত্ব তোমাদের। রমনায় তুমি একদিন খুব চমৎকার কালো সাদা মিলানো ছাপার ফুল হাতার শার্ট পরে আসলে। আমি বেঞ্চিতে বসা। দূর থেকে তোমায় কত চমৎকার লাগছিল বুঝাতে পারবো না। আর কাছে আসার পর তো কথাই নেই। সোজা এসে আমার সামনে হাটু গেড়ে বসলে। দু’হাত নমস্কারের ভঙ্গিতে তুললে। আমি বিরক্তি ভাব দেখিয়ে বললাম-
যত্তসব পাগলামী? সবাই কি ভাববে?
তুমি মিষ্টি হাসি হেসে ভ্র“ নাচিয়ে বললে-
দেবীকে তো এভাবেই প্রণাম করতে হয়। সবাই যা বলে বলুক।
আমি মিষ্টি হেসে বলেছিলাম-
বাহ! অপূর্ব তুমি কি জান? নীল হাফ হাতার শার্টের যুগ শেষ করে এই যে চমৎকার ছাপার ফুল হাতার শার্ট পরেছো। কি যে ভাল্লাগাছে তোমাকে। তোমার রুচিবোধ হল তাহলে! সত্যি খুব সুন্দর লাগছে। স্বয়ং কার্ত্তিকও এ শার্ট তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে গায়ে পরত, আর আমি এও সিওর তাকেও তোমার মত মানাতো না।
তুমি হেসে হেসে বললেঃ
থ্যাঙক য়্যু, তুমি শার্টের যত ইচ্ছে প্রশংসা করতে পার। তবে তার পুরোটা পাবে বিজন। ওই সকালে গিফট করেছে। তোমাকে বিজনদা অনেক হেল্প করেছে। তোমার অভাবী দিনে পাশে দাড়িয়েছে। টিউশনী যোগাড় করে দিয়েছে। তুমি বিজনদার সাথে কোন যোগাযোগ করলে না কেন?
বিজনদা একটুও চেঞ্জ হয়নি। পাড়ায় ছোট মুদির দোকান চালায়। শ্যাতশ্যাতে ঘরে থাকে। দাড়িপাল্লা, বাটখারা, খুচরো টাকা, বেচাকেনা, ধারদেনা এবং ছেলে মেয়েদের চিন্তায় দিন কেটে যাচ্ছে। তোমার কি তাকে পরিচয় দিতে লজ্জা হয় অপূর্ব? কিন্তু অবাক করার মত ব্যাপার হল, বিজনদার সাথে তোমার প্রসঙ্গ উঠলে; কখনও সে আফসোস কিংবা রাগ দেখায় না। পত্রিকায় তোমার সাক্ষাৎকার ছাপা হলে কেটে রেখে দেয়। কত সাধারণ এবং মহান সে। আর তোমাকে সবাই, তোমার ভক্তরা, পাঠকরা, কত অসাধারণ ভাবে। কিন্তু তুমি কি সত্যিই সত্যিই মহান?
আমার স্বামীর সাথে বিজনদার ভাল রকম মিল। দু’জনে মিলেও বেশ। কিছু কিছু মানুষ থাকে যাদের সাথে সবার মিল হয়। বিজনদা সেরকমই একজন। আর তুমি তাকে ভুলে গেলে?
আমি তোমাকে কোন ছকে বাঁধতে পারি না। তুমি আসলে কেমন তা আমার এখনও খটকা লাগে। কোনদিন হয়তো এ বোঝার শেষ হবে না। বুঝি বা না বুঝি আমি তোমাকে ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি।
আমাদের সামাজিক বিয়ে এ জনমে হয়নি। তুমি আমি শুধুমাত্র জীবনের কিছু ক্ষুদ্র সময় কাছাকাছি আসার, আলিঙ্গন করার, প্রেম প্রেম খেলার সময় পেয়েছি। প্রেম প্রেম খেলা তোমার দৃষ্টিকোন থেকে বলছি। আমার কাছে কিন্তু জীবনের বেস্ট সময়, বেস্ট বসন্ত, বেস্ট স্বর্গ। তাতেই কি ভালবাসা শেষ হয়ে গেল? তুমি কি আমার সামনে এসে একবারও দাঁড়াতে পারতে না?
হয়তো সমাজ খারাপ বলতো, তাতে কি যায় আসে “বড় ভালবাসার কাছে সমাজ খুব ক্ষুদ্র কীট”। তোমার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, অপূর্ব আমি তোমাতে বিভোর, আমার সংসার, ছেলে অপূর্বর জন্য মায়া নেই। আছে অপূর্ব আছে। দুটো দু’রকম। আমি কোনদিনও অস্বীকার করতে পারবোনা, তোমাকে ভালবাসতাম, ভালবাসি, ভালবাসবো। সব কিছু ছেড়ে এখনও তোমাতে ছুটে আসতে পারি। কিন্তু তুমি তো চেঞ্জ। অপূর্ব। ভালবাসা খুব অদ্ভুত অপূর্ব! ঠিক তোমার মত।
অপূর্ব যা বলেঃ
পুষ্প, আমার পুষ্প। হাসি ভরা পুষ্প। খুন কালার মাখানো পুষ্প। শ্যামলা মুখের ভেজা চুলের মিষ্টি গন্ধের পুষ্প। বড় বড় ছল ছল জ্বলে ওঠা চোখে ভালবাসা নিয়ে তাকানোর পুষ্প। সরল হাসির প্রতিমা পুষ্প। আমার যৌবনের দেবী পুষ্প। তোমাকে মনে পড়ে পুষ্প, খুব বেশি মনে পড়ে পুষ্প। এখন আমি শুধু তোমাকে ভাববো। চোখ বন্ধ করে তোমার সরল মুখের সরল নির্ভেজাল হাসি ফুটিয়ে তোলার দৃশ্য কল্পনা করবো। আমার পাশে ছুটে এসে, আমার পাশে বসে, তোমার বলা কথাগুলো কল্পনা করবো। আজ শুধু তোমাকে নিয়ে ভাবার দিন।
এখন আমি আমার অভিজাত বিল্ডিং এর ছাদে ইজি চেয়ারে একা, আধ শোয়া, অর্ধমাতাল। বন্ধু এ্যাডাম আমার জন্য প্যারিস থেকে স্পেশাল দামি রাম পাঠিয়েছে। মাত্র তিন পেগ খেয়েছি তাতেই বেসামাল। আসলে বুড়ো হয়ে যাচ্ছি তো! আগের মত আর পারি না।
বিশ্বাস করো পুষ্প! আমি একটুও বদলাই নি শুধু শরীর পরিবর্তন আর খ্যাতি, এই দুটোর জন্যই আমাকে অন্যরকম লাগে, এখন সময় রাত দু’টো। একটু পরে প্রভা আসবে। পুরো নাম প্রভাতী রানী। নিক নেইম প্রভা। আমার একমাত্র স্ত্রী। আদরের বধু। এই অভিজাত এলাকার দোতলা বাড়িটার নাম “অপূর্ব প্রভা”। ব্রঞ্জের উপর খোদাই করে, ঝকঝকে করে গেটের পাশে লেখা। বাড়ির নামটা অবশ্য প্রভারই দেয়া। যার নাম হয়তো “অপূর্ব পুষ্প” হতে পারতো। কিন্তু হয়নি। না হওয়ার জন্য তোমার বা আমার কারও কোন দোষ দিয়ে লাভ নেই। কতো কিছুই তো কি হাওয়ার পর্যায়ে যায়, হওয়ার কথা থাকে কিন্তু হয় না। তাতে দুঃখের কি আছে। দুঃখ করে লাভও বা কি হয়। কারণ জীবন তো একটাই।
পুষ্প তুমি নারী, প্রভাও নারী। এই বাইরে তোমাদের দু’জনের মধ্যে চিন্তা চেতনা কিংবা স্বভাবগত অনেক অমিল। তুমি শ্যামলা বর্ণের আর প্রভা ধবধবে ফর্সা। তুমি লম্বা ছিমছাম গঠনের আর প্রভা মাঝারী গোছের স্বাস্থ্যবতী। (তবে এখন তোমার গঠন কেমন হয়েছে জানি না) তুমি আবেগ প্রবন ও স্বপ্নচারিনী আর প্রভা বেশ রকম সংসারী এবং বাস্তববাদী। তুমি ক্লাসে ছিলে গবেট ধরনের ছাত্রী আর প্রভা ক্লাসে ফাস্ট গার্ল ছিল। তোমার আমার গভীর আলিঙ্গনের ক্ষণে তুমি একদম চুপ হয়ে যেতে আর প্রভা কাপা কাপা সুরে বিভিন্ন রকম কথা বলতে থাকে। তুমি ছিলে কৃষ্ণ ভক্ত আর প্রভা শিব ভক্ত। কিন্তু অদ্ভুত রহস্যভরা, ব্যাখ্যাতীত, হয়তোবার হাসির ও কথা কি জান? আমি তোমাদের দু’জনকেই ভালবাসী। প্রচন্ডভাবে হৃদয় উজাড় করে ভালবাসি।
পায়ের ঠক ঠক আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। প্রভাব আসছে বোধ হয়। এসেই দুচোখ আমার দিকে তাক করে বললোঃ
তুমি কি কিছু খাবে না?
না।
কেন। খিদে নেই?
খিদে আছে তবে খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। একটু ভাবাভাবি করছি।
কি ভাবছ? নতুন কোন গল্প বানাচ্ছ? নাকি নোভেল?
আমি সিরিয়ান ভঙ্গিতে বললামঃ
আরে ওসব কিছুনা। নিজের জীবন ড্রামা নিয়ে ভাবছি। জানো প্রভা আমি আজ পর্যন্ত আমাকে বুঝতে পারলাম না। আমি আসলে কি? কি চাই? কোথায় আমার গন্তব্য? কেন আমি লিখি? এসব।
প্রভা ভ্র“ নাচিয়ে হাসি মুখে বললোঃ
আরে! ওসব বাউলানী কথাবার্তা ছাড়ো। এ্যাডামের গিফট কাজ করেছে বোধ হয়।
আমারও তাই মনে হচ্ছে।
তুমি কি সুস্থ্য?
বেশি কি গিলে ফেলেছি? পুরোপুরি সেভেন্টি পারসেন্ট। অল্প খেয়েছি তবে এখন সুস্থ্য। কেটে গেছে। কেন জানি পুরনো কথা নাড়া দিয়ে জেগে উঠছে। এ্যাডামের গিফট তুমিও কি একটু চেখে দেখবে নাকি?
না অপূর্ব, আমার আর এসব ভাল লাগে না। কোন মজা পাই না। চলো চলো খেতে চলো খুব সুন্দর করে পাকা রাধুনীর মত ইলিশ পোলাও রেধেছি।
সাথে সরষে ইলিশও আছে। চল কুইক।
হরবর করে এবং দ্রুততার ভাব দেখিয়ে কথাগুলো বলল প্রভা।
একটা সত্যি কথা বলবে প্রভা?
বলো? আগে শুনি।
আমরা তো মেলাদিন সংসার পর্ব চালিয়ে যাচ্ছি। বাচ্চাও এখন বেশ বড়...........।
কি বলো না কেন? বলো বলো থামলে কেন?
তোমার কি খুব কৌতুহল হোচ্ছে শোনার জন্য প্রভা?
তেমন একটা না, চল খেতে চলো নইলে আবার গরম করতে হবে। প্রভা কথাগুলো বলল হেসে হেসে। প্রভার বড় গুণ সবসময় হাসি খুশি। প্রভা যা বলতে চেয়েছিলাম। তোমাকে খুব সুন্দর করে ও কঠিন করে বলতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তালগোল পেকে গেল।
আমাদের সংসার জীবনতো কম হলো না, কি বলো?
হ্যা। তবে হঠাৎ এ প্রসংগ কেন?
আমাকে একদম সত্যি করে নির্ভয়ে বলো। তোমার আমার সাংসারিক জীবনে আমি কি তোমাকে সুখি করতে পেরেছি? এমন কোন দুঃখ কি তোমার আছে যা শুধু আমাকে নিয়ে, যা তুমি প্রকাশ করতে পারছো না। থাকলে বল খুব শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে।
তুমি কিন্তু এখনও গুছিয়ে বলতে পারছো না। কি বলতে চাও স্পষ্ট করে বলো।
হাসি মুখে প্রভা কথাগুলো বলল এই মুহুর্তে খুব চমৎকার লাগছে প্রভাকে। কালো নাইটি পরা। এই বয়সে এক সুন্দর কাউকে লাগতে পারে, বিশ্বাস করার মত না। আমার মনেও হয় অত্যন্ত বুদ্ধিমতি সব বোঝে হয়তোবা। ধরা দেয় না। এজন্য প্রভাকে আমার মাঝে মাঝে খটকা লাগে। আমি আবারও একটু আবেগর এই প্রসঙ্গ টেনে বললামঃ
এবার তাহলে বলেই ফেলি। চিন্তা করে নেই, গুছিয়ে বলা যায় কিভাবে দাড়াও যাই বল।
তাড়াতাড়ি বল, রাত অনেক হয়ে যাচ্ছে।
প্রভা তুমি দাড়িয়ে আছ কেন? বসো।
বসবো? কোথায় বসবো? চেয়ারতো একটাই। তুমিতো ছাদে একটার বেশি চেয়ার রাখতে দাও না। এখন বসবো কোথায় বল? এরচেয়ে আর কথাবার্তা থাক। চল খাবে।
হ্যা প্রভা, রাতে ফাকা চেয়ার সাজানো থাকলে আমার মনে হয় এগুলো আসলে ফাকা নয়, অদৃশ্য কেউ বসে আছে। হাসাহাসি করছে। কথা বলছে। কিন্তু আমি হয়তো কিছুই দেখতে পারছি না। গুনতে পারছি না। এ ভাবনাটাকে তুমি পাগলামী টাইপের কিছু একটা ধরে নিতে পার।
মুচকি হাসি ও বিরক্তি ভাব নিয়ে প্রভা বললÑযত্তসব অদ্ভুত চিন্তা।
বুড়ো বয়সে ঢঙ কতো।
আমরা কি বুড়ো হয়ে গেলাম না কি প্রভা? সত্যি সত্যি? আমার কিন্তু মনে হয় না।
তোমাকে আমার এখনও নতুন বউ নতুন বউ হয় না। মনে হয় প্রভা নামের মেয়েটিকে আমি কখনও ছুইনি, ধরিনি। আদর করিনি। কিন্তু মন প্রাণ সপে ভালোবেসেছি।
ভ্র“ কুচকে ভেংচি কাটার মত করে প্রভা বললো-
তোমার আজ কি হয়েছে অপূর্ব?
বুঝতে পারছি না কি হয়েছে। এক্ষুণি আমার কোলে বসে পড়।
প্রভা সাথে সাথে আমার কোলে বসে পড়লো। আমি আলত করে প্রভাকে জড়িয়ে ধরলাম। বল্লাম, আমার দিকে তাকাও প্রভা।
প্রভা ঘাড় বাকা করে আমার দিকে তাকালো। চাদের মিষ্টি আলোতে ওর মুখ জ্বলজ্বল করছে। আমার মনে হচ্ছে এ যেন ধুলির পৃথিবী না, অন্য কোন নিরব সুন্দর গ্রহ। এ রকম সুন্দর মূহুর্ত খুব কম আসে। এই সুন্দর মূহুর্তে তোমাকেও মনে পড়ছে পুষ্প। আমি কোন রহস্য জালে বাস করি নিজেও বুঝি না পুষ্প। মানুষ আসলে কিছুই বোঝে না, আমরা আসলে বাধা পড়া জীব। সব কিছুই, এই প্রকৃতি, সব কিছুই কোথায় যেন বাধা পড়া। আকাশে অনেক তারা, তার মধ্যে চন্দ্ররাজ জোছনা ছড়াচ্ছে। আমার মন বলছে, আকাশের সমস্ত চাঁদ তারা যেন উপহাস করে বলছে।
এই যে তুই নিজেকে অনুভব করছিস, পুষ্পকে মনে মনে ভাবছিস, প্রভাকে আড়কোলে নিয়ে বসে আছিস। এ্যাডামের দেয়া রাম পানে অন্যরকম ঠেকছিস। এই যে যাকে তুই সুখ বলছিস কিংবা দুঃখ এর কি তুই কোন প্রকার ব্যাখ্যা দিতে পারবি। বুঝিয়ে বলতে পারবি তুই আসলে কি?
আমার এসব আর ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছে না। এ ভাবার শেষ নেই। এখন আমার পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা। শুকনা মরিচের সাথে রোশন মিশিয়ে বাটা ভর্তা দিয়ে গরম গরম ভাত খেতে ইচ্ছে হচ্ছে।
নরম গলার ঘুম ঘুম চোখে প্রভা বললোঃ
আর কতক্ষণ বসে থাকবো আমরা অপূর্ব। যাবে না?
প্রভা আমাকে তুমি কতখানি ভালবাস?
অনেক অনেক যার কোন শেষ নেই।
তাহলে গুণে গুণে দশবার ও I Love You
প্রভার খাওয়ানো তাড়া শেষ। ও এখন মনে মনে প্রথম বয়সে ফিরে গেছে। প্রথম বয়স বললে ভুল হবে। মানুষের মনের যে অংশে প্রেম ভালবাসা, ও কাছে পাওয়ার তীব্র আকাংখা থাকে এখন তা মাথাচাড়া দিয়ে জেগে উঠেছে। প্রভা শব্দ করে হেসে হেসে বলল
আমি তোমাকে I Love You বলা শুরু করলাম। তোমার যতক্ষণ ইচ্ছে, শুনতে থাক। I Love You, I Love You, I Love You, I Love You, I Love You.............. I Love You ।
প্রভা I Love You বলে যাচ্ছে, আর আমার মনে পড়ছে পুষ্প তোমাকে, পুষ্প তুমি একদিন রমনায় দাঁড়িয়ে সিনেমার নাইকাদের মত চিৎকার করে বলেছিলে, অপূর্ব আমি তোমাকে ভালবাসি। আশেপাশের সবাই তাকিয়ে দেখছিল। তবুও তুমি আরও জোড়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলেছিলে, “অপূর্ব তোমাকে ভালবাসি”।
আমার এখনও খুব ইচ্ছে করে সে সময়ে ফিরে যেতে। কিন্তু তা আর সম্ভব নয়। সময়ের কাজই হল ভাষিয়ে নেয়া। তোমাকে আমাকে ভাষিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে। আরও কোথায় নিয়ে যাবে কে জানে।
ছেলে মানুষি ও বিরক্তিভাব মিশিয়ে প্রভাকে বললামঃ
প্রভা, আমার ইলিশ পোলাও খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
তাহলে কি খেতে ইচ্ছে হচ্ছে?
রোশন দিয়ে শুকনো মরিচ ভর্তা সাথে গরম গরম ভাত।
আমি ব্যবস্থা করছি।
এত রাতে কিভাবে করবে? কষ্ট হবে না?
না অপূর্ব। তোমার জন্য হেসে হেসে জীবনও উৎসর্গ করা যায়। প্রভা কোল থেকে উঠে দাড়াল। আমি বললামঃ
আর শোন, সাথে পাতলা করে ডাল রাধবে। পারবে তো? প্রচন্ড উৎসাহের সাথে প্রভা বলে উঠলোঃ
কেনো পারবো না অপূর্ব?
ও নিচে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে খুব রকম আনন্দের কোন কাজ করতে যাচ্ছে। আমি পিছু ডাকলাম। খুব চমৎকার ভঙ্গিতে পিছু ফিরল। আমি এভাবে বললামঃ
প্রভা, ও প্রভা, আর একটা ইম্পরটেন্ট কথা শোনো।
প্রভা আমার সামনা সামনি দাড়াল। কোমরে দু’হাত দিয়ে মাথা নুইয়ে খুব আনকোরা ভঙ্গিতে ভ্র“ নাচিয়ে মুখে থোরাছা হাসির টান ফুটিয়ে বললো-
আবার কি অপূর্ব?
I Love You প্রভা। I Love You।
দূর ছাই! যাও আবেগী। বসে থাক সব রেডি করে আমি আসব। আবার যেন ঘুমের জগতে চলে যেওনা কিন্তু।
ঠিক আছে ম্যাম, ঘুমোব না।
পুষ্প আমার ছেলে বেলার ইতিহাস, খানিকটা তুমি জান। তোমার আমার প্রেমাবেগপূর্ণ কথপোকথনে এত বেশি প্রেমের ডায়ালগ এর ছড়াছড়ি থাকতো যে তুমি আমার ছেলেবেলার পুরোটা জান না। আমারও তেমন একটা বলার ইচ্ছে হয়নি, এখনও হয় না। তবুও বলি। আমার বাবা ছিলেন খুব সাধারণ একজন মানুষ। খেটে খাওয়া শরীরের ঘাম ঝরানো কৃষক। নিজের জমি বলতে ছিল না, বর্গা চাষ করতো। ছোট এক টুকরো ঘরে হোগলের বেড়ার ভিটেমাটি ছিল। যতদূর মনে পড়ে বাবার প্রতিটি পাজড়ের হাড় গোনা যেত। তার স্মৃতি আমার স্মরণে ভাষা ভাষা, ইংরেজিতে যাকে বলে “বার্ডস্ আই ভিউ”। আর আমার মা, মার চেহারাও আমার কাছে অস্পষ্ট। মাকে শুধু মনে পড়ে লাল গ্রামীণ চেক কাপড় জড়ানো গোলগাল মাঝারি আকৃতির। এর বেশি মার চেহারা, আকৃতি, স্বভাব সম্বন্ধে বলতে পারব না। হঠাৎ একদিন মা যতিন নামের একজন ভদ্রলোকের সাথে কোথায় যেন চলে গেলেন। গিয়েছিলেন রাতের আধারে কিংবা ভোররাতে। আমার বয়স তখন মাত্র আট কি দশ। জানো পুষ্প, আমার মায়ের চেহারা, আকৃতি আমার কাছে যতটা স্পষ্ট তারচেয়ে যতিন লোকটার ছবি বেশি স্পষ্ট ভাবে মনে ধরা দেয়। কালো, মাঝারী মোটাসোটা বড় বড় গোঁফ, গালে কালো আঁচিল, সেও ছিল বাবার মত খুন ঝরা খেটে খাওয়া লোক। আমাদের বাড়িতে এলে আমার জন্য লজেন্স, বুটভাজা, মনেক্কা নিয়ে আসতো। বাবার বন্ধু ছিল। একসাথে হোক্কা তামাক খেত। হাসির গল্প বলতো, বাবার সাথে সুখ দুঃখের গল্প জুড়ে দিত। আমার অবছা আবছা মনে আছে, কোনো এক রাতে মা আমার পাশেই শুয়েছিলন। সকালে উঠে দেখি মা নেই। সবাই বলাবলি করছে যতিন কেও নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। ঐদিন কত লোকের আনাগোনা হল আমাদের বাড়িতে। মেম্বার, চেয়ারম্যান, ঠাকুর, গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ আরও কত কে। বাবা খোলা বারান্দার বাশের খুঁটির কোনে হেলান দিয়ে নিরবে বসে ছিল। কারও কোন কথার উত্তর দেয়নি। মনে হয়েছিল যেন কথা বলতে ভুলে গেছে অথবা বোবা। কিন্তু বাবার চোখে টলমল জলের আনাগোনা। আমি সেদিন কিছুই বুঝিনি এবং আজও বুঝিনা কেন বাবার চোখে জল ছিল, “মাকে হারানোর দুঃখে নাকি নিজের অক্ষমতার উপর রাগ অভিমানে”। মা চলে যাওয়ার ঠিক তিনদিন পর বাবা চলে গেলেন। তিনদিন জল খাবার কিছুই মুখে তোলেননি। “মা”-তো চলে গিয়েছিলেন যতিনের হাত ধরে আর বাবা পরপারে। পরে শুনেছি গলায় দঁড়ি অর্থাৎ আত্মহত্যা। বাবার মুখে অগ্নি দিয়ে চিতায় ছাই বানিয়ে চলে এলাম জ্যাঠার কাছে। আমার জ্যাঠাকে তুমি ভালভাবেই জানো পুষ্প। নিমাই চন্দ্র, যে তোমাদের শাড়ী কাপড়, তোমার বাবার কোর্তা, ধুতি, তোমাদের শীতের চাদর ইস্ত্রি করে দিত। তোমাদের পাড়ার লন্ড্রি দোকানের নিমাই চন্দ্র। তুমি কি অবাক হচ্ছ পুষ্প? শুধু তুমি একা না সবাই জানে নিমাই চন্দ্রই আমার বাবা। আমাকে অনেক কষ্টকরে সে আমাকে লেখাপড়া করিয়েছে। তোমরা সবাই জান আমি নিমাই চন্দ্রের একমাত্র সন্তান। সত্যি কথা হল ভগবান তাকে পিতা হওয়ার ক্ষমতা দেননি। তাই আমি ওনার সন্তান হিসেবে ঠাঁই পেয়েছি। সেও পূর্ণ সন্তানরূপে আমাকে গ্রহণ করেছে। কিন্তু পুষ্প আত্মহত্যা করা গো-বেচারা টাইপের পাজরের হাড় বের করা লোকটাই আমার হতভাগ্য বাবা। পুষ্প আমি হয়তো বা সুখ দুঃখের উর্ধ্বে অথবা নিচে, তাই সইতে পারি। পুষ্প তুমিতো দুঃখ-কাঁটা সইতে পাড়বে না। তুমি শুনে হয়তো কাঁদছো। কেঁদে লাভ নেই পুষ্প, কোন লাভই নেই। কারণ জীবন তো একটাই।
তুমি বাবার (নিমাই চন্দ্র) দোকানে অনেকগুলো কাপড়-চোপড় দু’হাত ভরে হন্ হন্ করে নিয়ে আসতে। তখন থেকেই তোমাতে আমার দুর্বলতা, চেনাজানা হওয়ার তীব্র আকাংখা এবং ভাললাগা-ভালবাসার সৃষ্টি। যা আজ অবধি নিঃশেষ হয়নি। বিশ্বাস করো আমার হৃদয় মাঠের যে জায়গায় তুমি অবস্থান করে নিয়েছ, তা শুধুমাত্র আমিই অনুভব করতে পারি। কিন্তু বোঝানোর মধ্যে না। তোমাদের বাসায় থাকতেই তো বাবা মারা গেলে, হঠাৎ স্ট্রোক। তোমরাও এসেছিলে বাবার মরদেহ দেখতে। তোমার হয়তো মনে নেই অথবা থাকতেও পারে আমি সেদিন কিন্তু একবারও কাঁদিনি, মরদেহ দর্শনের সময়ও না, চিতায় বাবার মুখে আগুন দেয়ার সময়ও না। এত বড় শোকে জল আসেনি, কেন, তা ভেবেই দুঃখে চোখে জল আসেনি। অনেকে গভীর আক্ষেপে বলেছিলেন, ছেলেটার চোখে কি জল বলতে নেই। আবার অনেকে বলেছিল, অতি দুঃখে থম মেরে গেছে।
তোমার আমার প্রেমের শুরুটা কিন্তু অদ্ভুত ধরনের তাই না পুষ্প? সব মনে পড়ে পুষ্প, সব মনে পড়ে।
খেতে চল, আসো, তাড়াতাড়ি আসো, কি ভাবছ? এত উদাস ভাবে? মজার কিছু নিশ্চয়ই।
প্রভার আমার পিছনে দাড়িয়ে কথাগুলো বলে উঠল, কখন এসে দাড়িয়ে থেকেছে কে জানে, কত অদ্ভুত মানুষের মন, কত অদ্ভুত কত যুগের কত ব্যাপার আমার হৃদয় চোখের ভেতর ভেসে উঠছে। আর প্রভা ভাবছে মজার কিছু। স্বাভাবিক এবং সংগত কারণেই প্রভা এখন প্রেম প্রেম মুডে আছে। আমারও আর ভাবতে ভাল্লাগছে না তাই মুড পরিবর্তন করে প্রভার চোখে তাকিয়ে বললামঃ
কখন এসেছো?
এই তো, এক্ষুণই। কি ভাবছিলে?
দেখি তো তুমি গেইজ করতে পার কিনা। পরীক্ষা হোক তোমার। অনুমান শক্তি দেখব।
মনে মনে সুকান্তের ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় টাইপের কিছু আওড়াচ্ছিলে।
হয় নি। কারণ..........
আমাকে পুরো বলতে না দিয়ে। প্রভা হাত নাচিয়ে তর্ক করার মত ভঙ্গী করে বললোঃ
থাক, আর কারণ বর্ণনা করতে হবে না। আমি ইচ্ছে করেই মিথ্যে অনুমান বলেছি। তুমি যে কারণ বা যুক্তি দেখাবে তা হল, খাওয়ার চিন্তা তোমার মাথায় থাকলে আমার জন্য উদগ্রিব থাকতে। আসার সঙ্গে সঙ্গেই পায়ের শব্দে টের পেয়ে যেতে? ঠিক বলিনি বলো?
হু, আচ্ছা তোমাকে আর একটা সুযোগ দেয়া হল, দেখিতো এবার ভেবে চিন্তে বলো কি ভাবছিলাম।
প্রভা খানিকটা চিন্তা করে গলার স্বর নিচু করে বললঃ
ভাবছিলে প্রথম যৌবনের কথা অথবা ইন্দ্রিরার কথা দু’টো বললে তো হবে না একটা বলতে হবে।
একদম সিওর ইন্দ্রিরার কথা।
কোন ইন্দ্রিরা? ইন্দ্রিরা গান্ধী ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী?
নারে, ভুলে যাওয়া রোগী। ঐ ইন্দ্রিরা গান্ধী না, তুমি যে ইন্দ্রিরার কথা বলেছিলে।
মনে পড়ছে না, কোন ইন্দ্রিরা?
যাকে নিয়ে তুমি গল্প লিখতে চাও। কেমন যেন অদ্ভুত চাইপের, তুমিই তো ঐ দিন শুয়ে শুয়ে বলেছিলে। যেদিন গৌরব ফোন করেছিল। মনে নেই? একদম ভুলে গেলে?
ও করুণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে কথাগুলো বলছিল।
আমি উৎফল্ল ভঙ্গিতে বললামঃ
ও আচ্ছা আচ্ছা মনে পড়েছে। এসব ইন্দ্রিরা ফিন্দ্রিরা কে নিয়ে কিছুই লিখব না। শুধু ইন্দ্রিরাকে নিয়ে লিখতে হবে এমন কোন কথা নেই। আমরা সবাই অদ্ভুত, পাগলাটে ঝোক প্রধান, তাই নয় কি?
তাহলে কাকে নিয়ে লিখবে?
থাক ও প্রসংগ, আর আলাপ ভাল্লাগচ্ছে না।
ঈষৎ কৌতুক করা কণ্ঠে প্রভা বলে উঠল-
ভাত শুকনো মরিচ ভর্তা, ডাল খাওয়ার প্রসংগ কি থাকবে? নাকি চলে যাব?
প্রভার চমৎকার গুণ হল ক্ষণে ক্ষণে মুড পাল্টাতে পারে। ইন্দ্রিরার প্রসঙ্গ যেহেতু ইতি টেনে দিলাম, ও আর কখনও ভুলেও এ প্রসঙ্গ তুলবে না। আমার মনে হয় আমার অনেক ব্যাপারে ওর কৌতুহল আছে, তারপরও চেপে রাখে। জিজ্ঞাসা করে না। আবার আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও আগ্রহ দেখায় না। কোথায় যাই, কোথা থেকে আসি, কি করি আমি নিজে থেকে না বল্লে কখনও প্রশ্ন করে না। এমনকি বাসায় বসে কি করে কাজের বুয়াদের সাথে, সার্ভেন্টদের সাথে কি হল, কিছুই বলে না।
প্রভার মত লক্ষ্মী বধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। তবে গৌড়বের প্রসঙ্গে কথা বললে ওর আগ্রহের কমতি নেই। একমাত্র গৌরবের সংগেই ও অন্যরকম। যা চিরাচরিত মা ছেলের চেয়েও যেন বেশি। আমার ও প্রভার একমাত্র ছেলের নাম গৌরব, তাকি তুমি জান পুষ্প? বুঝলে, আমার মাঝে মাঝে খুব রকম আগ্রহ জাগে, আমার হাল জীবন সম্পর্কে তুমি কি কি জানো, কেমন জানো, বা আদৌ জানো কিনা। আমার সম্পর্কে তোমার বর্তমান ধারণা কেমন এসব। আবার নিমিষেই সকল আগ্রহ হাওয়া হয়ে যায়। মাঝে মাঝে মনে হয় আমার একার অনেকগুলো মন। এক একটা একেক রঙের, কোনটা কালো, কোনটা কমলা, আবার কোনটা হালকা ছাই রঙের এরকম একেক মন একেক কথা বলে। প্রভা আবার বলে উঠল-
খাবে চল।
না।
আমি কি চলে যাব। খুব ঘুম পাচ্ছে।
যাও, আমি সকাল হওয়া দেখব।
প্রভা চলে গেল। খুশি, রাগ, অভিমান কোনটাই বোঝা গেল না। বোঝার দরকারও নেই। ওর ঘুম পাচ্ছে ঘুমোক গিয়ে। আমি নিজমনে নির্ভয়ে নিজের সাথে সকাল হওয়া দেখব। আর তোমার কথা ভাববো পুষ্প। শুধু তোমার কথা।
মনটা খুব ঝরঝরা লাগছে, একদম ফ্রেস। কয়েক দিন ধরে অনেকগুলো কাজ করতে হয়েছিল। এখন বেশ ফৃ। পুরো এক সপ্তাহ নিজের ইচ্ছে মত কাটাবো। কোথাও বেড়াতে যেতে পারলে মন্দ হত না। পুষ্প, তোমার সাথে প্রভার চমৎকার মিল হল, তোমরা দুজনই ভ্রমন পছন্দ কর। গৌরবের কাছে গিয়ে ওর হালচাল জেনে আসা যায়। প্রভাকে গৌরবের ওখানে যাওয়ার প্রস্তাব দিলে প্রাণভরা খুশি হবে। কিন্তু যাবে না, কারণ ঢাকার মত ভ্যানকারিরটাও আমার কাছে খুব পরিচিত। গৌরব এক বছর যাবৎ কানাডার ভ্যানকভারিতে থাকে। গৌরবকে অন্য দেশে রেখে পড়ানো ও ভ্যানকভারিতে পাঠানোর উদ্দেশ্যে হল, “ভ্যানকভারি” সিটিটা আমার খুব পছন্দের। এমনিতেই ছেলে মানুষ তার উপর আবার ফাস্ট ওয়ার্ল্ড এ থাকে। কি করতে কি করে বসে কে জানে? যাই করুক ও নিয়ে ভাবার কিছু নেই। কি বল পুষ্প? পুষ্প তোমার বাচ্চা কয়টা, কেমন হয়েছে? তোমার স্বামী সংসার কেমন, মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে করে জানাটাও খুব বেশি কঠিন না। তোমার কাছে গেলেই হয়। কিন্তু বাস্তবে তোমার কাছে আর যাব না পুষ্প, তুমি আমার যৌবনের, লেখক আবেগ আসার সময়ের স্বপ্নরাণী। এখনও হয়তো স্বপ্নরাণী। তোমার এখনকার চেহারা দেখে ঐ সময়ের পুষ্পকে আমি আমার মনের কল্পনার বিকৃতি ঘটাতে চাই না। মনে পড়ে পুষ্প! তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম কত দেশ, বিদেশ, মহাদেশ, মহাসাগর ঘুরে বেড়াবো। তুমিও বলতে মাঝে মাঝে তোমার বেশি আগ্রহ ছিল গয়া, কাশি, কামরুক কামেক্ষা ও যেরুজালেম যাওয়ার, তখন আমার সামর্থ ছিল না। এখন সমর্থের ও স্বাদের ভান্ডার এক সাথে আমার কোলে জরসর হয়ে বসে আছে। আমি কিন্তু দেশ দেশান্তরে, ঘুরেছি, জেরু জালেম গেলে ওদের একটা অনুমতি দরকার হয়। তবুও যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল জেরুজালেম। গাজার রাস্তায় একা একা হেটে বেড়িয়েছি। নিরবে, সরবে, মনে-জ্ঞানে আমি শুধু তোমাকে অনুভব করেছি পুষ্প। মাঝে মাঝে আমি ভেবে পাই না, প্রথম জীবনের অনেক কথা মানুষের মনে থাকে না। তুমি মাঝে মাঝে হঠাৎ এত স্মরণে আস কেন? জেরুজালেম যাওয়ার পরেই আমার চোখ দু’টোতে যেন পুষ্পর দৃষ্টি লেগে গিয়েছিল। আমার দৃষ্টিতে জেরুজালেম দেখতে পারিনি, পুষ্প যা দেখেছি সব তোমার দৃষ্টিতে।
পুষ্প, বলধা গার্ডেনে তুমি আমি সকাল, বিকাল কত গিয়েছি। কত নিরবে দু’জন থেকেছি। তোমার আমার বাস্তব সাক্ষাত বন্ধ হওয়ার পর আর যাইনি। কোনদিন আর যাবও না। গেলে আমার সব ইন্দ্রিয় গুলোকে আর এক অচেনা ইন্দ্রিয় দখল করে নিতে পারে, আর আমি শুনতে পাব, তোমার হাসির শব্দ, হাটার শব্দ, তোমার শরীরের মিষ্টি গন্ধ। এ কারণে বলধায় যেতে ভয় লাগে। বলধার শত বছরের অর্কিড ক্যাকটাস আমাকে বলে উঠবে, “কিরে তোর পুষ্প কোথায়? বলো? আমি কি উত্তর দেব পুষ্প? হয়তো উত্তর দেব, “ক্যাকটাস অর্কিড বন্ধুরা, আমার পুষ্পকে নিয়ে তোমাদের দলেই হয়তো পরজন্মে ফিরে আসবো, ওয়েট কর”। আমার ও তোমার মত আবেগী হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। আমার কথার মধ্যে তুমি আবেগের গন্ধ খুঁজে পাচ্ছো, তাই না পুষ্প?
আমি এখন রাশেদের কাছে যাব। রাশেদকে তুমি দেখনি। আমার বন্ধু। বন্ধু বলাও ঠিক হবে না।তবুও সহোজ কথায় আমার বন্ধু। রাশেদ আমার বয়সী কিংবা দু’এক বছরের বড়ও হতে পারে। বিয়ে করেনি। সুপুরুষ, প্রাণবন্ত, খুব রকম আন্তরিক। মর্ডান চিন্তাধারার অধিকারী। দেখলে পুষ্প কত সহজে রাশেদের বর্ণনা দিয়ে ফেললাম, বলেছি, মডার্ণ চিন্তা ধারার অধিকারী। পুষ্প আমি আজ অবধি জানি না, মডার্ণ কাকে বলে। বলতেও পারব না, মডার্ণ এর প্রকৃত সংঙ্গা কি। রাশেদ একা এক ফ্লাটে থাকে। একা রাধে, একা খায়। একা থাকতেই ফ্রেস বোধ করে। পুষ্প বলেতো একা থাকলেই কি একা থাকা যায়? কল্পনা কি শুধু আত্মকেন্দ্রিক হতে পারে। কল্পনায়, ভাবনায়, স্বপ্নে, কত কিছু আসে, কত বাস্তব ও অবান্তর, চিন্তা, আগামাথাহীন কত কিছু। যখন লিখতাম না শুধু পড়তাম, তখন ভাবতাম লেখকরা কতকিছু ভাবে কত অন্যরকম তাদের চিন্তাধারা। সে হিসেবে রাশেদের প্রতি আমার খুব আগ্রহ ও কৌতুহল থাকার কথা, বিশেষ করে তার ব্যক্তি জীবন সম্পর্কে চিন্তা চেতনার ডায়মেনশন সম্পর্কে বিয়ে না করার কারণ সম্পর্কে। কেন যেন ওকে নিয়ে এভাবে ভাবা হয় না। তবে কোন এক অজানা কারণে রাশেদকে আমার ভালোলাগে, আর তুমি তো জানই কাউকে খুব বেশি ভাল না লাগলে তার সাথে আমি মিশি না। তুমি হয়ত আমার ব্যাপারে নিঃসার্থ বন্ধুত্বর প্রসঙ্গ তুলতে পারো। আর নিঃস্বার্থ বন্ধুত্ব? তাতো শুধু বিজনদেরই মানায়।
বিজন। আমার বন্ধু। তোমার বিজনদা। বাবা মারা যাওয়ার পর যখন কোথাও দাঁড়ানোর ঠাই নেই। কত কষ্টের জীবন খেয়ে থাকা, না খেয়ে থাকার জীবন, অনিশ্চয়তার জীবন, ভার্সিটি জীবন, যখন তোমার আমার চুটিয়ে প্রেম চলছে। অর্ধেক পাওরুটি খেয়ে এসেছি, অর্ধেক পাওরুটি খেয়ে তোমার সাথে রমনায় ডেটিং এ ব্যস্ত। অর্ধেক পাউরুটি বাসায় রেখে এসেছি, রাতে খাব বলে। এভাবে চলছিল, তুমি কিন্তু বুঝতে পারনি পুষ্প।
সহপাঠীরাও বোঝেনি। চেনাজানা কেউ বোঝেনি। সকালে বিজন ঠিকই বুঝতো। বিজনের আমার প্রতি ভালবাসাকে, আন্তরিকতাকে বন্ধুত্বকে করুণা ভেবে আমি এড়িয়ে যেতে চাইতাম। কিন্তু বিজনই চলে আসতো, বলতো-
কাল কি খেয়েছিস্?
আমি কিছু একটা বলতে যেতাম, ও কথার মাঝে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলতো-
চল- আয়।
কোথায়?
আলাউদ্দিন রোডে।
কেন?
বিরিয়ানী খাব।
কেন?
এত কেন কেন করছিস কেন? তুই মনে করিস, আমি কিছু বুঝি না। অনাহারে অর্ধাহারে কেউ ইচ্ছে করে থাকলে আমারতো কিছু করার নেই। তবে মাঝে মাঝে ভাল কিছু খেতে হয়। চল আমার সাথে দেখি কি পরিমাণ খেতে পারিস।
তুই কি বললি, ইচ্ছে করে মানে?
আমি বলেছিলাম কি?
খেয়াল নেই খিদে লাগলে আমার কাছে চলে আসবি। এসে বলার প্রয়োজন নেই। আমি তোর মুখ দেখেই বুঝে নেব। “বুঝলি অপূব! তুই আসলে কোন কাজেরই হলি না”।
নিঃশ্বাস ছেড়ে আক্ষেপ করে এমনভাবে বিজন কথাগুলো বলতো-
মনে হলো ওর আমি বন্ধু না। ছোট ভাই অথবা সন্তান।
পুষ্প, তোমার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, বিজনের কাছে আমি যাইনা কেন? সঙ্গ দেই না কেন? সঙ্গ নেই না কেন? উত্তর হলো, বিজন আমাকে পুরো জীবনের জন্য ওর কাছে ঋণী করে দিয়েছে। আমি ঋণী হয়েছি। যতটা ও আমাকে দিয়েছে আমি তার কিছুই দিতে পারিনি। অসম্ভব রকমের ঋণি আমি বিজনের কাছে। এ আমি দুর্গা মায়ের শপথ করে বলতে পাড়ি, প্রয়োজন বোধে বিজন আমার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে পারতো এখনও পারে কিনা জানিনা। তবুও ওর কাছে যাই না। যোগাযোগও করি না, বিজনও করে না হয়তো অভিমানে।
বিজন এবং তুমি, তোমরা আমার জীবনে এসেছ একই সময়ে। দু’জন আমাকে দু’ভাবে আগলে রেখেছিলে। বিজন বন্ধুত্ব ও অভিভাবক সুলভ আচরণ দিয়ে আর তুমি দৃঢ় ভালবাসা দিয়ে। বিজনকে দেখলে তোমাকে দেখার ইচ্ছে হবে। তোমার হিসেবে যুক্তিটা খুব ঠুমকো হতে পারে। কিন্তু আমি এই বুঝি।
রাশেদের কাছে যাওয়াটা বেশ ঝামেলার। শুধু রাশেদ না, আজকালকার এপার্টমেন্টগুলোই এরকম। গ্রান্ডফ্লোর থেকে দারোয়ান বা এ টাইপের কাউকে ফ্লাট নং ও নাম বলতে হয়। দারোয়ান টাইপের লোকটা ইন্টারকমে ইনফর্ম করবে। তারপরে যদি চেনাজানা হয় আসতে বলবে, এরপর ওপড়ে উঠা।
রাশেদের বাহারী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পরপর তিনবার কলিং বেলে চাপ দিলাম। লাউড ঢং ঢং করে ডিজিটাল মিউজিক বেজে উঠল।
পুষ্প, তোমাদের বাসার দরজা খোলার পর প্রায়ই তুমি এবং তোমার ঠাঁকুরমা দুজনকে একসাথে দেখা যেত। আমি এসেই বলতাম-
পুষ্প তোমার কাছে জরুরি কাজে এসেছি। খুবই ইম্পোর্টটেন্ট। ঠাঁকুরমা বড় বড় সন্দেহ প্রবণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো, হয়তো ঠাহড় করার চেষ্টা করতো জরুরি কথা কি হতে পারে। ঠাকুরমাকে আমার বেশ লাগত কারণ সে আর দশটা ঠাকুরমার মত না। ঠাঁকুরমারদের সঙ্গে সাধারণত সম্পর্ক থাকে হাসি কৌতুক মজার। কিন্তু সে পুরো অন্য টাইপের। আমি অবাক হয়ে ভাবতাম, ও আবার কেমন বুড়ি, কোন রকম রস-কষ বলতে নেই। তাকে একদিন আমার খুব ক্ষেপানোর ইচ্ছে হয়েছিল। একদিন বললে ভুল হবে মেলা দিন থেকেই। আমি তোমাদের ঘরের লোহার সেই গোল চেয়ারে বসা, তুমি গেলে চা খাবার আনতে। ঠাঁকুরমা তখন জানালায় উকি দিয়ে বাইরে কি যেন দেখার চেষ্টা করছিল। আমি মুড নিয়ে আনন্দলোক বা এই টাইপের পত্রিকা উল্টাতে ছিলাম। হঠাৎ একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর এ্যাডে চোখ পড়ে গেল। ঠাঁকুরমার উদ্দেশ্যে বললাম-
একটু এদিকে শুনুন।
খুব একটা কথা বলাবলি হতো না বলে খানিকটা মেপে তাকালো, আস্তে আস্তে হেটে আসল। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর এ্যাডটা খুব আকর্ষনীয় সেক্সি ধরনের, ব্রা পেন্টি পরা এক ইংলিশ রমনীকে আকর্ষনীয় করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
পত্রিকাটির ছবি দেখানোর উদ্দেশ্যে অনুরোধ এর স্বরে বললাম-
এটা একটু দেখেন না? কি চমৎকার!
ঠাকুরমা গম্ভীর ও গুরুত্বের ভাব দেখিয়ে বললো-
চশমা নিয়ে আসছি দাঁড়াও।
চশমা পরে বললোঃ
কৈ? কি দেখাবে?
এই যে ঠাকুরমা বলোতো মেয়েটিকে কেমন লাগছে?
ছবিটি দেখে, খুব বেশি রকম অবাক ও দুঃখে একাকার হয়ে গেল সে। হঠাৎ মাথায় স্ট্রং টাক খেলে মানুষের চেহারা যেমন হয়। সেরকম লাগছিল তাকে। কিছু একটা বলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো এর আগেই আমি বলে উঠলাম।
ঠাঁকুর মা, আপনি যদি এরকম ড্রেস পরেণ, দারুন লাগবে। একদম জোস্ ইয়ং এক্টরেস। আপনি বললে আমি আপনাকে এরকম ঠিক এরকম কালারের ড্রেস এনে দিতে পারি। লাগবে নাকি?
হাসি মুখে হরবড় করে কথাগুলো বললাম। এর মধ্যে তুমি চা নিযে চলে আসলে। আর ঠাকুরমা জাতি সাপের মত ফোস ফোস করতে করতে ভিতরে রুমের দিকে চলে গেলেন। তোমাকে বললামঃ
বুঝলে পুষ্প, আমি ঠাঁকুরমার প্রেমে পড়ে গেছি। আর তোমার ঠাঁকুরমা খুব মজার মানুষ। চেহারাটাও যা না।
মজার না ছাই। ইয়ার্কি ফাজলামো কিছু বোঝে না।
আমি ইচড়ে পাকা, বেশি কথা বলা বাচ্চা ছেলেদের মত তোমাকে বোঝানোর ভঙ্গিতে বললাম-
দেখ পুষ্প, “বেসরিকদের সাথে রসিকতা করাটাই আসল রসিকতা। আর রসিকরা তো মজার উপরই থাকে”।
তুমি ভুল বললে অপূর্ব।
ভুল বললাম? কি বলছো তুমি?
আমার চোখের দিকে সোজাসুজি চোখ রেখে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললে, না অপূর্ব না, তুমি কখনও কোনকিছুই ভুল বলনা কারণ তুমি আমার অপূর্ব, আমার কৃষ্ণ।
রাশেদ দরজা খুলে দিলো- অবাক, খুশি নাকি বেজার কোনটাই বোঝা গেল না। নীল চেক পাজামা, গোলগলার ঢিলেঢালা গেঞ্জি। চোখে পাওয়ারি চশমা। ইষৎ হাসি মুখে বলে উঠলঃ
প্লিজ দাদা দরজাটা লক করে ভিতরে আসুন, বলেই ভিতরে চলে গেলেন। আমার কাছে অবাক ঠেকলো প্রথমত দাদা বলার জন্য, দ্বিতীয়ত ব্যস্ততা দেখে। দরজা লক করে আমি ভিতরের রুমে ঢুকলাম। রাশেদ একা একা খুব মজা করে টেলিভিশন দেখছে।
আমি আপনাকে সাদরে সম্ভাষন জানাতে পারলাম না বলে ভেরি ভেরি সরি। আর দরজা কষ্ট করে লক করার জন্য থ্যাকস এ লট। আমি বসে পড়লাম। ও টেলিভিশনের দিকে দৃষ্টি রেখেই বললোঃ
স্পেশাল ম্যাচ হচ্ছে তো- খুবই মজার এবার একটা সিরিয়াস গেম হবে। দারুন মাইর মন দিয়ে দেখেন ভাল লাগবে।
কিসের স্পেশাল ম্যাচ?
রেসলিং। দেখেও বুঝতে পারছেন না? ভেরি ভেরি মজার।
আমি কথা বললাম না। চুপচাপ থাকলাম। বুঝতে পারছি ওর এখন মনযোগের পুরোটাই রেসলিং এ। দেখতে থাকলাম। স্বাস্থ্যবানদের দস্তাদস্তি। জাগিয়ে আছাড় মারা। ও একটু পর পর খেলোয়াড়দের সাথে আমাকে অতি উৎসাহের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। আমি চেহারায় হাসি ও আনন্দিত হওয়ার মতো করে রাখলাম। মূলত রাশেদকে খুশি করার উদ্দেশ্যেই। আমার জানামতে রেসলিং, বাচ্চা কিশোরদের আনন্দের উদ্দেশ্যেই দেখানো হয়। আমার মনে হচ্ছে রাশেদ এখন বাচ্চা হয়ে গেছে। পাজামা না পরে হাফ প্যান্ট পরা থাকলে ওকে পুরোপুরি বুড়ো বাচ্চাদের মত লাগত। আর বাচ্চারা খুশি হয় ওদের সাথে বাচ্চাদের মত করে মিশলে। আবার ওর গলা ফাটানো চিৎকারের মত করে মাঝারী ধরনের স্বরে বলে উঠল-
এবার জমবে, দ্যাখেন বিশাল দীর্ঘাদেহি মানুষটাকে কিভাবে ধরাশাই করা হয়।
আমি কোন উত্তর দিলাম না। হঠাৎ বিষন্ন হয়ে গেলাম, তোমাকে মনে পড়া শুরু করেছে। সেই যে ষ্টেডিয়ামে তোমাকে নিয়েই আবাহনী মোহামেডানের ফুলবল খেলা দেখতে গিয়েছিলাম। যা তোমার ইচ্ছেতেই। আবার তোমার খেলা ভাল লাগছিল না বলে হাফেনয়্যান আওয়ার পরই মাঠ থেকে বের হয়ে এলাম। অনেক ব্যাপারে, তুমি হঠাৎ হঠাৎ আগ্রহ দেখাতে আবার সকল আগ্রহ নিমিষেই হাওয়া করে দিতে। তোমার হঠাৎ এক সময় ইচ্ছে হল অনেক বই পড়ে ফেলবে অল্প কিছু দিনের ভেতর। আর আমার কাজ পড়লো তোমাকে বই সংগ্রহ করে দেয়া। তারাশংকর তোমার ফেবারিট রাইটার ছিল প্রধানত তার “কবি” বইটির জন্য। আমার তারাশংকরের লেখা তেমন একটা ভাল লাগত না। তুমি এভাবে বলতে, “অপূর্ব আমাকে তারাশংরের সবগুলো বই পড়তে হবে। তুমি সংগ্রহ করে দাও না প্লিজ।” তোমার আবার ইচ্ছে হল, তোমার নিজ হাতে খুটে খুটে খুব যত্ন করে জ্যাম্পার বুনে দিতে। তুমি জানতে না কিভাবে বুনতে হয়। ঝটপট তোমার মাসীমা-র কাছ থেকে শিখে নিলে। চমৎকার প্রশংসাযোগ্য হয়েছিল তোমার বুনন। নিজ হাতে আমাকে পরালে, পরতে হল, চমৎকার মানালো। সবাই প্রশংসা করতো। দার্জিলিং থেকে কোলকাতা আসার পথে। ট্রেনে ভুলে আমার লাগেজ ব্যাগেজ রেখে এসেছিলাম। ওর মধ্যে তোমার দেয়া নীলরঙ্গা জাম্পারটিও ছিল। হারিয়ে গেল; অনেক চেষ্টায়ও আর ফিরে পাইনি। জাম্পারটি হারিয়ে গেছে পাওয়া যায়নি। হারিয়েও যায়নি গেঁথে আছে, মনে গেথে আছে। “চমৎকার মানিয়েছে” কথাটার মত। তুমি ঠিকই আমার বর্তমান থেকে কাছাকাছি থেকে দূরে, তাই বলে কি হারিয়ে গেছো? বল? যায় না পুষ্প হারিয়ে গেলেই হারিয়ে যায় না। ঘুরে ফিরে সবই ফিরে আসে।
রাশেদের রেসলিং দেখা শেষ, ঠান্ডাভাবে ব্যথা পাওয়া সুরে বলে উঠল-
শেষ হয়ে গেলরে অপূর্ব দা। শেষটা একদম ভাল হয়নি। আমার প্রিয় রেসলাম বেদম পিটানি খেয়েছে। হেরে গেছে।
আমি ওর সঙ্গে তাল মিলাতে চেষ্টা করে সম্মতি তথা সান্তনা জানাতে একটু হাসলাম।
হাসলেন কেন অপূর্ব দা? আমার প্রিয় রেসলার হারলো আর আপনার মুখে হাসি। ভেরি সেড। সরি বলেন। পরপর তিনবার।
আমি হালকাভাবে মুখে কৌতুক ফুটিয়ে বললাম-
আসুন আপনি আমি রেসলিং করি, দেখি কে জেতে। হা-হা-হা...... আপনি আর আমি হা-হা-হা..........।
রাশেদের হাসিটা বাচ্চাদের মত ঝন ঝন করে উঠল। চমৎকার হাসি। এ বয়সে এরকম দিল-খোলা হাসি হাসা কষ্টকর। হাসি পর্ব শেষ করে একটু সিরিয়াস হয়ে বললো-
রেসলিং তো করা যেতে পাড়তো। তবে আমার যে এখন নামাজের ওয়াক্ত নইলে চলে যাবে।
কোথায় পড়বেন মসজিদে না ঘরে?
ঘরেই তো পড়ি। একটু বসুন আমি ঝটপট ওযু সেরে আসি।
রাশেদ যেভাবে একা একা থাকে তাতে ওর কালেকশনে প্রচুর বইপত্র থাকার কথা। দু’একটা পত্রিকা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাও আবার কয়েক মাস, কয়েক বছরের পুরানো। আমি পুরানো একটি পত্রিকা হাতে নিলাম। রাশেদ ওযু করে আসল। আমি যেন হঠাৎ কোন কারণ ছাড়াই বলে উঠলামঃ
রাশেদ সাহেব, আপনি দু-আ কুনুত বলতে পারবেন?
রাশেদ খানিকটা অবাক হল। অবাক হয়েই বলল-
আপনি দু-আ কুনুতের নাম শুনলেন কি করে? অবাক কথা বললেনতো ভাই আপনি।
বারে, অবাক হওয়ার কি আছে? দু-আ কুনুত তো মঙ্গল গ্রহের জিনিস না। সবখানেই পাওয়া যায় অন্তত যেখানে দু-আর বই আছে। দু-আর বইতে পেয়েছি।
আপনি দু-আর বই পড়েন?
রাশেদ এমনভাবে প্রশ্নটা আমার দিকে বড় চোখে ভ্র“ নাচিয়ে ছুড়ল, যেন মনে হচ্ছে দু-আর বই পড়া বড় ধরনের কোন অপরাধ। ওকে আরও অবাক করার উদ্দেশ্যে বললামঃ
আচ্ছা রাশেদ সাহেব, মুসলমান হতে হলে কি কি লাগে? কিভাবে মুসলমান হওয়া যায়?
আপনি খুব কঠিন জিনি জানতে চেয়েছেন অপূর্ব বাবু।
আপনাকে সহজে বলতে হলে কলেমা পড়ে মুসলমান হওয়া যায়, আইন টাইনের কিছু ব্যাপার আছে যেমন ধরুন নাম চেঞ্জ করা। উকিল টুকিল কাজে লাগিয়ে। আর জটিল করে বলতে গেলে অনেক কথা।
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ।
কি বললেন?
কলেমা তাইয়্যেবা। এখন কি আমি মুসলমান? না অর্ধেক মুসলমান?
বুঝতে পারছি না। হয়তোবা। না-না-না মনে পড়েছে। ঈমানের সহিত পূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে বলতে হবে। আপনি ঈমানের সহিত পূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে বলেছেন?
আমি ঈষৎ মুখের কোনে হাসি ফুটিয়ে বললামঃ
শুনেন রাশেদ সাহেব। আমার জানামতে হিন্দু ধর্মে কোথাও লেখা নেই অন্য ধর্মের কোন শ্লক পড়লেই ধর্ম পরিবর্তন হয়ে যাবে। বুঝতে পারলেন! আমি হিন্দু অবস্থায়ই কলেমা পড়েছি। সুতরাং, হিন্দুই আছি। তাতে আমার পরকালে বা পরজনমে কি শাস্তি হবে তা জানিনা। আর হলে হোক।
আপনি কলেমাকে শ্লক বললেন কেন?
আচ্ছা, যান শ্লক বলব না। কলেমা তাইয়্যেবা। ঠিক আছে?
বুঝলেন অপূর্ব বাবু ইসলাম যেমন সহজ তেমনি কঠিন।
আমার বুঝতে আর বাকি রইল না। স্পর্শকাতর ব্যাপার নিয়ে বেশিদূর না এগোনোই ভাল। পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত যত যুদ্ধ হয়েছে, দাঙ্গা হয়েছে, তার বেশির ভাগই ধর্ম-যুদ্ধ। এত এত খুন, ক্ষয়, এত জীবনের বিনিময়েও আজকে এই সভ্য জাতী বা আমরা সভ্য বলে দাবী করি। যুদ্ধ এর কোন সমাধান দিতে পারেনি। আর আমিইতো কথাকথিত সভ্যদেরই দলে, তাই বললামঃ
এ প্রসঙ্গ থাকুক। আপনি নামাজ পড়ে আসুন।
থাকবে কেন? বলুন। বলতে থাকুন। আর যদি নাই বলেন, পরে যদি আপনার শোনার মত সময় হয়, আর শোনার মন থাকে, চলে আসবেন। ইসলাম সম্পর্কে অনেক কথা বরে বুঝিয়ে দেব, ইসলাম কি। মন দিয়ে উপলব্ধি করলে বুঝবেন কতো শান্তির ধর্ম। বুঝলেন অপূর্ব বাবু?
আমার আর কিছু বলতে ইচ্ছে হলনা। বললামও না, রাশেদ নামাজ শুরু করল।
পুষ্প, ধর্ম সম্বন্ধে তোমার কথা খুব করে মনে পড়ে। কি মনে করে যেন, না যেন কোন ক্ষোভে, একদিন হঠাৎ তোমাকে বলে ফেলেছিলাম-
আমি খৃস্টান হয়ে যাব পুষ্প, ওদের অনেক সুবিধা।
তুমি ফালতু কথা অথবা ফাজলামো মনে করে মজা করে বললে-
তাহলে তো ভালই হয় অপূর্ব। তোমার গলার যিষুর ক্রুস দেখতে পাড়বো। গলায় কালো সুতোয় রূপালী ত্র“স পরলে তোমাকে চমৎকার মানাবে। বুক খোলা শার্টে ক্রস বের হওয়া থাকলে একদম লাভার বয়, লাভার বয় লাগবে। ভেরি নাইস।
আমি বিশ্বাসযোগ্য করে বলার উদ্দেশ্যে পুরোপুরি গম্ভীর হয়ে বললাম-
বিশ্বাস করছো না তুমি? সত্যি বলছি।
সত্যি না ছাই।
আমি খৃস্টান হয়ে যাবই কারণ.......
থাক আর কারণ বলতে হবে না।
আমি খৃষ্টান হলে তুমি কি করবে?
তুমি হঠাৎ চেঞ্জ হয়ে গেলে। আবেগীভাবে বললে-
স্বয়ং শ্রী কৃষ্ণ যদি ধর্ম পরিবর্তন করে, রাধা তাহলে কি করবে? বল? ধর্ম ছাড়া রাধার চলবে। কৃষ্ণ ছাড়া রাধার কি দাম বলো? রাধার তো শুধু কৃষ্ণ আছে। শ্রী কৃষ্ণ ভগবান।
তোমার এ সহজ সহজ প্রশ্নটায় আমাকে কাবু করে দিল। প্রচন্ড খারাপ লাগা শুরু করল। চোখে জল জল ভাব চলে এল যেন এক্ষুনই গড়িয়ে পড়বে, ভাবনা এলো, এই মেয়েটা আমাকে এত ভালবাসে কেন?
আমি কৃষ্ণই থাকতে চাই পুষ্প! তুমি আমার রাধা হলে আমি কৃষ্ণই থাকতে চাই। কোন ধর্ম দিয়ে আমার বাঁধতে পারবে না। আমি শুধু তোমার জন্যই কৃষ্ণ থাকব। আমার ধর্ম কৃষ্ণ ধর্ম। পুষ্পানন্দ, প্রেমানন্দ, সাদানন্দ, নৃত্যানন্দ শ্রী কৃষ্ণ!
এই কথা কয়টি বলার পড়েই মনে হয়েছে স্পর্শকাতর ব্যাপারে আলোচনা আর থাক। শুধু বললামঃ
পুষ্প আমি খৃস্টান হবো না। কিন্তু ক্রুস পরতে চাই। তুমি পরের দিন রমনার আসলে। দু’জন হাত ধরাধরি করে হাটলাম। তুমি চমৎকার করে গান শুনালে। বাদাম খাওয়া হল। হাসাহাসি হল। বর্তমান ভবিষ্যৎ নিয়ে দু’জন খুব ভাবাভাবি ভান করলাম। তোমার চলে যাওয়ার সময় হল। তুমি চলে যাওয়ার আগে ছোট একটা প্যাক আমার হাতে দিয়ে বললে
অপূর্ব তোমার জন্য আমার সামান্য গিফট। কালকে পরবে।
আমি দেখতে চাই তোমাকে কেমন মানায়। আর শোনো, আমি যাওয়ার পরে খুলবে।
তুমি চলে যাওয়ার মাত্রই খুলে দেখলাম রূপালী যীষু মুর্তির ক্রুস। যিষু মুরতি। খুব ভাল্লাগা ভাব হল। সাথে সাথেই গলায় পরলাম।
তুমি বলেছিলে আগামী দিন যেন তোমাকে গলায় ঝুলিয়ে দেখাই কিন্তু দেখাতে পারিনি। কারণ বিজন। সকালে ওর সাথে দেখা। আমার গলায় যিষু মূর্তি ওর নজরে গেল। মেজাজ বিগরে বললো ও এটা তুই গলায় কি ঝুলিয়েছিস? দিন দিন পাগল হয়ে যাচ্ছিস নাকি? লোকে কি বলবে?
বলেই টান দিয়ে খুলে ফেলে দিলো। আমি কিছুই বললাম না, মানাও করলাম না। বিজন খুলে আনন্দ পেলে পাক। যেহেতু পরার বিশেষ কোন কারণও ছিল না। পরেছিলাম পুষ্পর গিফট বলে। আর পুষ্পর বলা “চমৎকার মানাবে”। তাই চমৎকার মানাবার লোভে। বিজনের বললোঃ
লোক কি বলবে?
কথাটা আমাকে তেমন ভাবালো না। কারণ লোক তাদের নিজের দৃষ্টি ভঙ্গিতে কথা বলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শুধু সমালোচনা করার উদ্দেশ্যেই। তুমি খেয়ালই করনি গলায় যিষুর ক্রুস আছে কিনা, হয়তো ভুলে গিয়েছিলে বা ভুলে যাওয়ার ভান করেছিলে।
ঐ বছর দুর্গ পুজোয় বিজন আমাকে চমৎকার একটি ঘিয়ে রঙের ধুতি উপহার দিয়েছিল। তুমি দেখে বলেছিলে চমৎকার মানিয়েছে তোমাকে। জানো পুষ্প! ঐ দিনের পর আমি জীবনে মাত্র আর একবার ধুতি পরেছি। আর সেটা আমার বিয়েতে। সেদিন তুমি থাকলে বলতে পারতে কেমন মানিয়েছে। তুমি আমাকে এত খুটে খুটে দেখতে যা এখনও আমার খটকা লাগে। আবার মাঝে মাঝে ভীষণ বিরক্তও লাগতো আবার ভালও লাগত। এই ভেবে “জগতে শুধু একজন আছে যে আমার জন্য, শুধু আমার”। আসলে ও রকম করে এখন আর ভাবতে পারিনা। এখন ভাবার স্টাইলে অনেক পরিবর্তন এসেছে। লেখালেখি করার উছিলায়, অনেক কাল্পনিক ক্যারেক্টার নিয়ে ভাবতে হয়। মনে হয়, কে যেন আমার ভিতরে বসে ক্যারেক্টার সাজায়। আর আমার হাতের ছোয়ায় কলমের কালি তা ফুঁটিয়ে তোলে। তোমার ঐ সময়ের ভাঙ্গা ভাঙ্গা অনেক ছবি, কাহিনী আমার হৃদয়ের মন্দিরে সজতনে গাঁথা, তার মধ্যে যেমন ফালতু টাইপের আছে আবার মহাদামীও আছে।
রাশেদের নামাজ শেষ হল। হাসি গম্ভীরের মাঝামাঝি চেহারায় সরলতা ফুটিয়ে বললো-
আমরা কি নিয়ে যেন আলোচনা করতে ছিলাম?
ভুলে গেছি।
ইসলাম নিয়ে তাই না?
খানিকটা উত্তেজিতভাবে রাশেদ বললোঃ
আপনার যে স্মৃতি শক্তি তাতে একশ পারসেন্ট শিওর ভুলেন নি। কি ভুলেছেন?
না।
বুঝেছি আপনার আগ্রহ নেই। তো আর কি করা।
এবার খাবার দাবারের আয়োজন করা দরকার কি বলেন? তা মন্দ হয় না, করে ফেলেন।
অপূর্ব বাবু আপনার বসে থাকা চলবে না। আমাকে কিন্তু হেল্প করতে হবে।
কিভাবে? বলেন কি কি হেল্প করতে পারি?
আমি একা একা রাধবো আপনি বসে থাকবেন তাতো হয়না।
আমাকে পিয়াজগুলো কেটে দিলেই হবে।
আমি একটু হেলে বললামঃ
চোখে জল এসে যাবে যে, তখন কি করবো?
আসলে আসুক। আমার জানা মতে এমনিতেই তো কাঁদেন না। আজ না হয় পিয়াজের উছিলায় একটু কাঁদলেন। চোখে বেশি পানি আসলে চিন্তা নেই চোখের পানি মুছে ফেলার জন্য নতুন একটা ধবধবে রুমাল আপনাকে দেয়া হবে। অনেকের চোখের অসুখে পানি পড়ে তাতো আর কান্না না।
রাশেদ সাহেব, পিয়াজ কাটতে আমি রাজি, নিয়ে আসুন কেটে দেই।
দয়া করে রান্না ঘরে আসতে হবে।
দু’জনে অনেক খাটুনির পর যা দাঁড়াল তা হল ভুনা খিচুরি। অনেকদিন পরে তৃপ্তি মত খেলাম। রাশেদ যে এত চমৎকার রান্না জানে তা আগে জানতাম না। অনুমানও করতে পারিনি। রাশেদ ধন্যবাদ পাওয়ার উদ্দেশ্য করেই বললোঃ
কেমন হয়েছে রান্না?
চমৎকার, একদম দশের মধ্যে আট।
থ্যাঙ্ক য়্যু।
পুষ্প, কোন এক বৃষ্টি ভেজা দুপুরে তুমি আমাকে খিচুরি রেঁধে খাইয়েছিলে। বিজনের বাসায় বসে। খেয়ে মনে হয়েছিল ভিনগ্রহের খাবার। আমাদের থেকে উন্নত কোন জাতির লোভনীয় খাবার। যার স্বাদ যেন আমার জিহ্বায় এখনও লেগে আছে। আমার মাঝে মাঝে প্রচন্ড ক্ষুধা লাগলে, অথবা কোন রেস্টুরেন্ট এর সামনে খিচুরি লেখা দেখলে চোখ বন্ধ করে তোমার রান্নার স্বাদ অনুভব করার চেষ্টা করি। এ যেন স্বর্গ স্বাদ। স্বর্গসর্বা ইন্দ্রের খাবার।
রাশেদ খেতে খেতে বললোঃ
গৌরবের সাথে কথা হয়েছে সকালে। ফোন করেছিল। ভার্সিটিতে যাবে তো তাই বেশি কথা বলতে পারেনি। ও খুব ভাল একজন লিভ টুগেদার করার মত মেয়ে পেয়েছে। কৃস্টিনা নাম। ম্যাক্সিকান। মেয়েটি নাকি চমৎকার। এক রুমে থাকে। আপনাকে কে বলেছে?
গৌরব নিজে বলেছে?
গৌড়ব অল্প বলেছে বাকিটা বলেছে ড. জয়নাল আহমেদ।
ড. জয়নাল আহমেদ আবার কে?
আমার বাল্য বন্ধু। মেলা বছর কানাডায় থাকে।
ভেরি নাইস, সে গৌরবকে চেনে কিভাবে?
আমি গৌড়বকে ঠিকানা দিয়েছি। এখন দু’জন বেশ জমে। ড. জয়নাল ও রেসলিং ভক্ত। সাথে যোগ হয়েছে গৌরব ও কৃস্ট্রিনা। কৃস্টিনার চেহারা নাকি বাঙ্গালীদের মতই, ভালই হয়েছে, কি বলেন?
আমার কোন উত্তর দিতে ইচ্ছে হলো না। আর গৌরবের এই কান্ড আমাকে তেমন বিচলিতও করলো না। কারণটা স্বাভাবিক ফাস্ট ওয়ার্ল্ড এর কানট্রি। লিভ টুগেদার করতেই পারে। প্রভা বোধ হয় জানে না। জানলে খুব রাগ করতো, রাগের থেকেও দুঃখ বেশি পেতো।
আজ প্রভা এবং আমার পঁচিশতম বিবাহ বার্ষিকী। প্রতিবছরই আমার এই দিনটি মনে থাকে। আজও আছে। শাহবাগ থেকে অনেকগুলো ফুল নিয়ে এসেছি। শাহবাগে যত রকম ফুল ছিল তার সব পদের অল্প অল্প করে এনেছি, তাতেই ছোটখাট এক ফুলের রাজ্য গাড়িতে উঠাতে হয়েছে। মিরপুর থেকে কিনেছি দামী জামদানী। বাইতুল মোকাররম কয়েক পদের গহনা। আর শাখারী পট্টি থেকে রাধা কৃষ্ণের আনকোরা পোস্টার, সবই প্রভার জন্য।
প্রভাও হয়তো চমকে দেয়ার মত কোনকিছু গিফট কিনে রেখে দিয়েছে। ওর গিফট পেয়ে আমিও খুব অবাক হওয়ার ভান করবো।
আমার পর্যায়ের বেশিরভাগ লেখকের মেরিজ ডে হয় অনেককে ইনভাইট করে, পার্টি দিয়ে অথবা ঘরোয়া কোন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। আমাদেরটা পুরো ভিন্ন রকম। দু’জন দু’জনকে গিফট করি। আর রাতে দুজন প্রাইভেট কার-এ ইচ্ছে মত হারিয়ে যাই। প্রভার হাতে আমার গিফটগুলো দিয়ে বললাম-
হ্যাপি ম্যারিজ ডে প্রভাতী। হ্যাপি ম্যারিজ ডে গৌরবের মা। অর্থাৎ মহা গৌরব হ্যাপি ম্যারিজ ডে আমার প্রাণের বধু। হ্যাপি ম্যারিজ ডে।
প্রভা কিছুই বলছে না। শুধু মিটি মিটি হাসছে, আমি আর একটা গোলাপের কলি ওর হাতে দিয়ে বললাম, তোমার মত বউ পেয়ে আমি ধন্য। তোমার মত বউ পেয়ে আমি সুখ শান্তিতে বাস করছি। আই লাই য়্যু প্রভা।
ধন্যবাদ এবং আই লাভ য়্যু কোটি কোটি বার। গৌরব ফোন করেছিল। ম্যারিজডেতে দুজনকেই শুভেচ্ছা জানিয়েছে। ই-মেইলে চমৎকার একটি কার্ড পাঠিয়েছে। চলো দেখবে।
ভাল কথা। ফোনে কি বলেছে?
তেমন কিছু না। একা একা থাকে। একা রান্না করে। লেখাপড়া নিয়ে দারুন ব্যস্ত এসব।
আর কিছু?
হ্যা, তোমার সাথে ও কথা বলবে। ফোন করবে।
কখন করবে?
তা বলেনি পাগলটার ঠিক আছে। কখন করে- কে জানে?
আমার আর এসব ভাল লাগছে না। তাই বললামঃ
প্রভা, খুব গান শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে।
কি গান শুনতে চাও?
তোমার ইচ্ছে মত যে কোনো গান। চালিয়ে দাও হালকা সাউন্ড দিয়ে।
রবীন্দ্র সংগীত শুনবে?
বলেছি না তোমার যা খুশি চালাও।
প্রভা কম্পিউটারে গান চালিয়ে দিলো, রবীন্দ্র সংগীত। মিষ্টি কণ্ঠে হালকা সাউন্ডে বেজে উঠল। আমি প্রভাকে গম্ভীর ভাবে বললামঃ
বাঁতি অফ কর। অন্ধকারে রবীন্দ্র সংগীতের ইমেজ অন্যরকম। আর আমার পাশে বসো প্রভা, বসে শক্ত করে আমার হাত ধরে থাকো।
প্রভা তাই করলো। আমার পাশে বসল হাত ধরে নয়। আমার কোলে মাথা রেখলো। আমার হাত এমনিতেই ওর চুলে বিলি কাটতে থাকল। গান চলতে থাকলো-
“আমি তোমারও সঙ্গে বেধেছি আমার প্রাণ সুরেরো বাধনে,
আমি তোমারে পেয়েছি অজানা সাধনে।”
আমার মন প্রাণ গানের সঙ্গে একাকার হয়ে গেল। পুষ্প এই গানটা তোমারও খুব প্রিয় ছিল। তুমি খুব সুন্দর করে খালি গলায় গাইতেও পারতে। আমি আজও বুঝিনি এই গানটায় যে, “ তোমারি সঙ্গে ” বলা হয়েছে। এই “তুমি” আসলে কে? কার সঙ্গে প্রাণ বেধেছি, কাকে অজানা সাধনে পেয়েছি? আমি নিজেকে, পুষ্পকে, প্রভাকে নাকি ভগবান কে?
চিন্তা করে দেখ পুষ্প আমি এখনও কত অবুঝ। এখনও এই সহজ গানের উত্তরও খুঁজে পাইনি। একেক সময় একেকটা মনে হয়।
ফোন বেজে উঠল। প্রভা গান বন্ধ করে বাঁতি জ্বালিয়ে ফোন রিসিভ করেই বললঃ
গৌরব ফোন করেছে তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছে।
ফোনের ওপার থেকে গৌরবের আওয়াজ শোনা গেল।
বাবা তুমি কেমন আছ?
ভাল, তুই কেমন আছিস রে খোকা? কোন অসুবিধা হচ্ছে নাতো?
না বাবা, ভালই আছি, হ্যাপি ম্যারিজ ডে বাবা।
থ্যাঙ্ক য়্যু, একটু হোল্ড কর বাবা। লাইনে থাক।
প্রভা পাশেই দাঁড়ানো। গৌরবকে হোল্ড করতে বলার উদ্দেশ্য হল প্রভাকে এখান থেকে কতক্ষণের জন্য সরিয়ে দেয়া। কারণ গৌড়বের সাথে কিছু ইম্পর্টেটেন্ট কথা বলবো যা প্রভার শোনা একদমই উচিৎ না।
প্রভা তোমাকে বিশেষ এক অনুরোধ করব, বলো রাখবে?
তোমার কোন অনুরোধটা আমি রাখিনি, বলতে পারবে?
আজ এই বিশেষ দিনে, তোমাকে পঁচিশ বছর আগের মত করে দেখতে চাই।
প্রভা খুব অবাক হয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে বললোঃ
কিভাবে? এ ও কি সম্ভব?
হ্যাঁ সম্ভব, তুমি এক কাজ কর। ড্রেসিং রুমে গিয়ে বিয়ের শাড়ী পরে ফেলো, আর বিয়ের দিনের মত করে সাজো।
প্রভা ড্রেসিং রুমে চলে গেল। বউ সাজতে। আমি আবার রিসিভারটা কানে ধরলাম-
হ্যালো গৌরব, শুনতে পাচ্ছিস?
হ্যা বাবা বলো
সত্যি করে বলতো তোর দিন কেমন কাটছে?
মোটামুটি। একা একা থাকতে হয়। রান্না করতে হয়, আর এগুলো কি যে ঝামেলার কিভাবে বোঝাবো, বলো বাবা?
তাহলে কৃস্টিনা কি করে? ও কি মোটেও রান্না-বান্না জানে না?
কৃস্টিনার কথা তুমি কিভাবে জানলে বাবা?
তুই কি কৃস্টিনার সঙ্গে লিভ টুগেদার করছিস? মিথ্যে বলবি না। মিথ্যে বললে কষে একটা থাপ্পর দেব।
আমি অত্যন্ত রাগে বলেছি তো, বলার সময় খেয়ালই হয়নি ফোনে কাউকে থাপ্পর দেয়া যায় না।
হ্যা বাবা। ও খুব ভালো মেয়ে। এক সাথে পড়ি। মেক্সিকান।
তাহলে বললি কেনো? একা থাকিস?
সরি বাবা। ভয়ে কৃস্টিনার কথা বলিনি।
তুই কি আমাকে খুব ভয় পাস?
হ্যা বাবা, খুব ভয় পাই। কারণ ছোট বেলা..........
কেন ভয় পাস, তা আর বলার দরকার নেই। তোর মাকেও কি ভয় পাস?
না বাবা, মা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।
তাহলে প্রভাকে সত্যি কথা বললি না কেন? প্রতারণা শিখেছিস, কংস কোথাকার।
মা শুনলে খুব দুঃখ পাবে তাই বলিনি। মা আমাকে ওভাবে দেখতে চায় না। আমি কখনও মাকে দুঃখ দিতে পারবো না, বাবা।
তুই কি কৃস্টিনাকে বিয়ে করবি?
বাবা তুমি এত ফৃ ভাবে কথা বলছো কেন?
আগে আমার কথার উত্তর দে নইলে কষে থাপ্পর লাগাবো।
হ্যা বাবা, আমরা দু’জন দু’জনকে খুব ভালবাসি।
তোর মা যদি মেনে না নেয়? যেহেতু ভিনদেশী মেয়ে।
বাবা আমার খুব কান্না পাচ্ছে। আমি এত ভাবতে পারছি না।
শোন্ গৌরব! তুই প্রভাকে মিথ্যেই বলে যাবি। ভুলেও কৃস্টিনার কথা বলবি না। কেমন, মনে থাকবে?
হুঁ
তুই একটুও চিন্তা করিস না বাবা। আমি প্রভাকে ম্যানেজ করে ফেলব। তুই তোর মত করে থাক। সময় হোক সব ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা করবি না বাবা। তুই এবং কৃস্টিনা ভাল থাক। মন দিয়ে লেখা পড়া কর। যাতে দু’জনেরই রেজাল্ট ভাল হয়।
রিসিভার রেখে দিলাম। প্রায় সাথে সাথেই আবার ফোন বেজে উঠল। রিসিভ করে শুনলাম।
বাবা থ্যাংক য়্যূ। বাবা সত্যি একটা কথা বলবো। শুনবে?
বল।
য়্যু আর মাই ফেভারিট রাইটার। আই লাভ য়্যু পাপ্পা!
গুড বাই গৌরব। ভাল থাকিস।
ড্রেসিং রুমে গিয়ে দেখি, ড্রেসিং টেবিলে প্রভার সাজন পর্ব এখনও শেষ হয়নি।
তুমি যাও। আগে পুরো সেরে নেই। তারপর বলবে কেমন লাগছে।
প্রভা আর আমি প্রাইভেট কারে করে যাচ্ছি, চালাচ্ছে ড্রাইভার। ঢাকা থেকে গাজীপুর হাইওয়েতে সুপার স্পৃড এ চালানো হচ্ছে। বাইরের কোন শব্দই শোনা যাচ্ছে না এসি চলার কারণে। কাঁচগুলো আটকানো। হালকা টাইপের মিউজিক বাজছে। প্রভার গলায় আমার হাত, বিয়ের শাড়িতে প্রভাকে দারুন মানিয়েছে। একদম নতুন বউ নতুন বউ মনে হচ্ছে। মাথায় টিকলি। আমি পরেছি ধুতি ও খদ্দরের পাঞ্জাবী। প্রভার কানে বললামঃ
প্রভা তোমার কেমন লাগছে?
উল্লসিত ভঙ্গিতে প্রভা বললোঃ
দারুন অপূর্ব, দারুন।
প্রভাকে আমার ভাললাগে বা মনে ধরে বিজরী ঝটার মত হঠাৎ করে। ও আমি বাসে পাশাপাশি সিটে যাচ্ছিলাম, আমি ওর সঙ্গে আলাপ জমাবার চেষ্টা করলাম। প্রভা কোন পাত্তাই দিল না। ও যে বাস স্টপিজে নামল, আমিও একই বাস স্টপিজে নেমে গেলাম। ও একটু হেটে দরদাম করে রিকশা ঠিক করল। আমিও রিকশা করে ওর পিছু নিলাম। পিছু নিয়ে ওদের বাড়ি চিনে নিলাম। বাইরে থেকেই। তার কয়েকদিন পরে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালাম আলাউদ্দিন সাহেবকে দিয়ে। আলাউদ্দিন সাহেব ছিলেন আমার প্রথম বইয়ের প্রকাশক। প্রস্তাবে প্রভার বাবা সম্মতি দিলেন। ব্যাস বিয়ের আয়োজন ঝটপট হয়ে গেল। পুরহিত বিয়ে মন্ত্র পাঠ করলেনঃ
“যদেতৎ হৃদয়ং তব,
তদস্তু হৃদয়ং মর্ম
যদিদং হৃদয়ং মম,
তদস্তু হৃদয়ং তব”
অর্থাৎ “তোমার এই হৃদয় আমার হোক, আর আমার হৃদয় হোক তোমার।”
পুষ্প তখন আমার মনে হয়েছিল। আমার হৃদয় তো আর একজনের হয়েই আছে আর সে হল তুমি। প্রভার শাড়ির আচল যখন আমার সঙ্গে বেঁধে সাতপাক পর্ব চলছিল তখনই মনে হয়েছিল, এ তো প্রভা নয় এ যেন পুষ্প। আয়না দেখা দেখি পর্বেও প্রভার চেহারার মাঝে তোমাকে দেখতে পাচ্ছিলাম। যেন প্রভা পুষ্প একই, আবেগ ঝাটিয়ে তখন বিদেয় করে নিজ মনে বলছিলাম এত ভেবে কি হয়? কি লাভ? কারণ জীবন তো একটাই।
আজ খুব সকালে জাতীয় সংসদ ভবন এরিয়ায় হাটাহাটি করলাম। মেলাক্ষণ। সংসদের সিড়ি বেয়ে উপর-নিচ করেছি বহুবার। নিয়মিত এক্সারসাইজ করা হয়ে ওঠে না। আজ ইচ্ছে হল বলে করছি। এক মেয়েকে দেখলাম। ইয়ং, অল্প বয়স। বিবাহিত কিংবা অবিবাহিত দেখে কিছুই বোঝা গেল না। দেখতে অনেকটা সেলিনার মত। ঠিক সেলিনার মতো নাক, চোখ, ভ্রু। সেলিনার প্রসঙ্গ তেমন একটা মনে পড়ার মত না। তবুও বলি, সেলিনার আর আমার সম্পর্কটা ছিল পুরোপুরি সেক্সুয়াল তাও আবার একদিনের। এর বাইরে তেমন কিছু নয়। কালের প্রভাহে তুমি হয়তো এর বেশি আন্দাজ করতে নিতে পারো। আর সেলিনাকে তো তোমার বান্ধবী হিসেবেই চিনতাম। পুষ্প তোমাকে একদিন বলেছিলামঃ
পুষ্প আমরা চলো কলকাতা চলে যাই ওখানে আমি ছোটখাট কাজ করবো। পারলে লেখালেখির প্রাকটিসও চালিয়ে যাব।
তোমাকে রাজী হওয়ার জন্য দু’দিন সময় দিলাম। বললে দু’দিন ভেবে তারপর উত্তর দিবে। কালকাতা যাওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল বা ডিসিশন নিয়ে ছিলাম, তোমাকে চিরদিনের জন্য কাছে পাওয়ার উদ্দেশ্যেই। তখন সামাজিক দৃষ্টিতে আমি তোমার অনেক নিচে। টাকার ভরসা দিয়েছিল বিজন। অন্তত দু’মাসের টাকা দেওয়ার ওয়াদা করেছিল বিজন। তুমি না করে দিলে পুষ্প। বললেঃ
প্রতিষ্ঠিত হও আমি বাবা “মা”কে হারাতে পারব না। ভাসা ভাসা ভাবে ছেড়ে দিলে আমাকে। আমার মনে হয়, তোমার হৃদয়ে আমার যে চরণ পড়েছে, তার দাগ আজ অবধি থাকার কথা, আমাকে কি মনে আছে নাকি ভুলে গেছ পুষ্প? ভুলতে তো অবশ্যই পারনি, এ আমার পূর্ণ কনফিডেন্স।
তারপর তোমার উপর ভীষণ রকম ক্ষোভ হল। তুমি আমাকে কৃষ্ণ বানিয়ে নিজে রাধা হয়েছিলে। নাকি রাধার অভিনয় করেছিলে। তুমি আমাকে রাম মনে করে, নিজে সিতা হয়ে, কলকাতাকে বৃন্দাবন ভেবে যদি আমার হাত ধরে চলে আসতে তাহলে জীবনটা হয়তো অন্যরকম হত তাই না পুষ্প?
এটুকু অভিমানেই আমি তোমাকে ছেড়েছি। চির অভিমানও বলা যায়। তুমি তো জানতেই, আমার কাউকে উপহার দেয়ার দরকার হলে বেশি দিতাম শেষের কবিতা। সেলিনাকে বাসার পাশে ছোট্ট টুম্পার জন্মদিনে যাচ্ছিলাম হাতে ছিলো শেষের কবিতা। পথের মাঝই সেলিনার সাথে দেখা হল।
অপূর্বদা কোথায় যাচ্ছেন?
টুম্পার জন্মদিনে।
জরুরী কিছু কথা আছে অপূর্বদা।
বলে ফেল।
এখানে বলবো? আসুন না বাসায় টুম্পার অনুষ্ঠান পাঁচটায় এখন পৌনে চারটা শোয়া ঘন্টা বাকী। আসুন না প্লিজ!
ঢুকেই ড্রইং রুমে বসলাম। সেলিনা কণ্ঠে দরদী ভাবে অনুরোধের মত করে বললো।
ভিতরে আসুন না অপূর্বদা।
আসুনা না প্লিজ! বাসায় কেউ নেই, ঘর একদম খালি। সবাই গ্রামে গেছে। কাকা মারা গেছেতো তাই।
তুমি যাওনি?
আমি গেলে ঘর খালি হলে যায় না? সমস্যা নেই, রাতে খাদিজা ভাবি আমার সাথে থাকেন। কাল বাসা আবার ভরে যাচ্ছে।
আমি তাড়া দেখিয়ে বললামঃ
কি বলবে ঝটপট বলে ফেল।
পুষ্পর সাথে আপনার কিছু কি হয়েছে? কই নাতো
সেলিনা অন্যরকম ভাবে হেসে বললোঃ
আমি জানি।
সেলিনা হুমরি খেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললোঃ
অপূর্বদা আপনাকে আমি কোনদিন ছাড়বো না। আপনাকে ভালবাসি অপূর্বদা। আপনি আমাকে মেরে ফেলেন তবুও ফিরিয়ে দিয়েন না।
সেলিনার শক্ত করে জড়িয়ে ধরা এবং আউলা ঝাউলা কথা আমাকে ঐ মূহুর্তের জন্য, ঐ নিরব রুমে........... দেখতে দেখতে ছ’টা বেজে গেল।
জন্মদিনটা তো মিস করে ফেললেন অপূর্বদা। উপহারটা আমাকে দিন। প্লিজ অপূর্বদা।
নাও ধর, তোমাকে গিফট করলাম।
এভাবে গিফট করলে তো হবে না অপূর্বদা এই কলমটা ধরুন, যা খুশি উইশ করুন। প্লিজ অপূর্বদা!
কলম ধরে কি কি যেন লিখে উইশ করলাম। কি লিখেছিলাম ভুলে গেছি শুধু মনে পড়ে কলমের কালিটা ছিল সবুজ রঙের।
এরপর সেলিনার সঙ্গে বহুদিন দেখা হয়েছিল কিন্তু তেমন একটা কথাবার্তা হয়নি।
বুক পকেটে মোবাইল। কোনো রিং এর আওয়াজ হচ্ছে না। কারণ রিংটোন অফ করে ভাইব্রেশন সেট করা। বুক কেপে উঠছে ভাইব্রেশনের চোটে। রিসিভ করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। এত রাতে কল দেয়ার মানে ফালতু টাইপের লোকজন অথবা কোনো উদ্ভট ভক্তের জ্বালাতন। ভালই লাগছে হতে থাকুক ভাইব্রেশন। দেখিনা, কতক্ষণ রিসিভ না করলে ভক্ত চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারে। বুক পকেট থেকে মোবাইল বের করে রিসিভ করেই শুনতে পেলাম-
হ্যালো, অপূর্ব বাবু।
হ্যাঁ বলুন। কে বলছেন প্লিজ?
আমাকে চিনবেন না, কানাডার ভ্যানকভারি থেকে বলছি।
তো কি ব্যাপারে?
আমার নাম ড. জয়নাল আবেদিন।
আপনাকে চিনতে পেরেছি। রাশেদ বলেছিল আপনি রাশেদের বাল্য বন্ধু। আপনি কি রাশেদের বাল্যবন্ধু?
হ্যা বাল্যবন্ধু। গৌরব খুব অসুস্থ্য অপূর্ব বাবু। খুউব অসুস্থ্য!
বড় ধরনের কিছু? হ্যাঁ।
আমাকে কি আসতে হবে?
না।
জয়নাল সাহেব যা সত্য তাই বলুন। কি হয়েছে গৌরবের?
খুব বড় এক্সিডেন্ট।
কথা বাড়াবেন না। গৌরবের বড় ধরনের এক্সিডেন্ট মানে ওকি নেই? সত্য বলুন। আমি মোটেও বিচলিত হব না।
হ্যাঁ, গৌরব নেই। বলেই জয়নাল সাহেব শব্দ করে কেঁদে দিলেন। যা এপাশ থেকে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। কান্নায় কান ভারি হয়ে যাচ্ছে।
গৌরব কি সত্যিই নেই? সত্যি বলুন ড. জয়নাল।
খুব বড় ধরনের এক্সিডেন্ট। তিনদিন আগেই মারা গেছে। ফুড পয়জন জাতীয় কিছু খেয়েছে অথবা খাওয়ানো হয়েছে বলে এখানকার পুলিশ ধারনা করছে। ঘর বাহির থেকে তালাবন্ধ করা ছিল। দুর্গন্ধ আসছিল বলে গৌরবের রুম ভেঙ্গে.......।
কৃস্টিনা কোথায়?
আমি এত স্বাভাবিক কি করে আছি বুঝতে পারছি না। এ কেমন অনুভূতি। যেনো অবাক হচ্ছি না। শুধু এটুকু বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না যে, মৃত্যু অত্যন্ত স্বাভাবিক মেনে নেয়াই ভাল। সে গৌরবের বেলায় কিংবা অন্য যে কেউ। জয়নাল আবেদিন সাহেব উত্তর দিলেনঃ
কৃস্টিনার কাছে রুমের চাবি ছিলো। পুলিশ কৃস্টিনাকে খোঁজাখুঁজি করছে। মেক্সিমাম মানুষের ধারনা কৃস্টিনাই গৌরবকে কোন কারণে.......।
আমার আর শুনতে বা বলতে ভালোলাগছে না। কলটা কেঁটে দিলাম।
মোবাইল একদম অফ করে ইজি চেয়ার শুয়ে আছি। মানুষে জেগে থাকলে কিছু না কিছু ভাবতেই হয়। অন্ততঃ যতক্ষণ জেগে থাকি বা বেঁচে থাকি। গৌরবের ভাবনা চিন্তা পর্ব শেষ। আমার মগজে নতুন এক গল্পের প্লট এসেছে। চমৎকার গল্প।
কালকেই লিখে ফেলব। প্রভা এখনই হয়তো ছাদে চলে আসবে। ভাত খেতে ডাকবে। প্রভার এই মূহুর্তে না আসাই ভাল। প্রভা আসলে আমার ডিস্ট্রার্র্ব হবে। গল্পের প্লট এলোমেলো হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে।
অপূর্ব তুমি কি খাবে না? এভাবে বসে থাকবে।
প্রভা বেশ বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, এ রকম টাইপের কথাবার্তা তো প্রভা কম বলে। আমি বললামঃ
বসে থাকব।
রাশেদ সাহেব ফোন করেছেন। খুব নাকি গুরুত্বপূর্ণ। এখনই আসো।
আমার ফোনে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
ইচ্ছে না হলে রাশেদ সাহেব তোমাকে টেনে ফোনের কাছে নিয়ে যেতে বলেছেন অথবা মোবাইল অন করতে বলেছেন। কি কোনটা করবে?
রাশেদ কি লাইনে আছে। ফোন হোল্ড করা।
হ্যা। আসো খুব নাকি জরুরি। আর জরুরি না হলে এত রাতে কেউ ফোন করে। তুমি আসলে খুব বেশি খেয়ালি ধরনের মানুষ। এত খেয়ালি মানুষ ভাল না। বুঝলে প্রাণ মশাই?
প্রভা অনেক বছর পর আমাকে প্রাণ মশাই বলাতে ভালই লাগছে। আমি বিরক্ত হয়ে ছুটলাম ফোনের কাছে। কণ্ঠে গাঢ় গম্ভীরতা ফুটিয়ে রাশেদকে বললামঃ
সব ড. জয়নুল আবেদিনের কাছে শুনেছি। যা বলার জলদি বলুন।
আপনি কি কাদছেন অপূর্ব বাবু?
না কেন? কি এমন হয়েছে?
গৌরবের রুহের মাগফেরাত কামনায় এতোক্ষণ খাস দিলে নফল নামাজ পড়েছি। দু-আ করেছি। আল্লাকে বলেছি আল্লাহ ওকে তুমি মাফ করে দিও। এই দুঃসময়ে আপনাকে সান্তনা দেবার মত ভাষা আমার নেই। আপনাকে কি আজ রাতের মধ্যে ভ্যানকভারি যাবার প্লেনের টিকিট ঠিক করে দেব? যাবেন? আবার লাশের সাথে ফিরে আসবেন।
না, কোথাও যাব না।
তাহলে লাশ দ্রুত আনার ব্যবস্থা করতে বলব?
শুনুনরাশেদ সাহেব! এই মূহুর্তে আপনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না, বুঝলেন? কারণ আমি এখন আমার বউয়ের পাশে আর ও আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
এই মিথ্যে কথা বলে ফোন রেখে দিলাম এবং সাথে সাথে ফোনের লাইনের কর্ডও খুলে রাখলাম। যাতে আর ফোন নামের দুঃসংবাদ না আসতে পারে। প্রভা আমার দিকে এতক্ষণ ডাগোর সুন্দর নয়নে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। আমরা কি বলেছি কিছুই বোঝেনি।
আজ কি রেঁধেছো প্রভা?
চিংড়ি ভর্তা, তাজা শিং মাছ, ডাল। আর কিছু রাঁধতে পারিনি। তোমার স্পেশাল কিছু খেতে ইচ্ছে হচ্ছে? ইচ্ছে হলে বলে ফেল।
কিছুই খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আচ্ছা প্রভা গৌরব সবচেয়ে বেশি কি খাবার খেতে পছন্দ করে?
প্রভা খুব উৎসাহিত ভঙ্গিতে হেসে হেসে গৌরবের প্রিয় খাবার, খাবারের ধরণ আচার আচরণ সম্পর্কে অনেক কিছু বলে যাচ্ছে কিন্তু আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। নিজেকে বধির মনে হল। নতুন গল্পের প্লট নিয়ে ভাবা শুরু করলাম।
মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে প্রভাকে বললামঃ
খুব বড় একটা শুভ সংবাদ আছে।
বলে ফেল। কি শুভ সংবাদ।
গৌড়ব দু’এক দিনের মধ্যেই এসে পড়বে।
ও-না সেদিন বললো দু’ মাস পর আসবে। এর আগে কোন ভাবেই আসা সম্ভব না। তোমাকে কে বলেছে দুই একদিনের মধ্যে গৌরব আসছে? গৌরব নাকি অন্য কেউ?
গৌরবই বলেছে। ওর ইচ্ছা তোমাকে সারপ্রাইজ দেয়া। আমাকে বলতে মানা করে দিয়েছে। তবুও তোমাকে জনালাম। শুধু তোমাকে খুশি করার জন্য, প্রভা এবার একটু হাসো। আর গুনে গুনে দশবার আই লাভ য়্যু বলো।
প্রভাকে প্রচন্ড উল্লাসিত লাগছে। খুব চমৎকার লাগছে। একদম মিষ্টি বাচ্চাদের মত। প্রভা হেসে দশবার I Love You বললো। আমার আরও শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে শুনতে পারলে মন্দ হতনা।
এসো খাবে।
আমি সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললামঃ
এখন খাবো না প্রভা।
ছাদে যাচ্ছি আমি আজও সকাল হওয়া দেখতে চাই। তুমি ঘুমিয়ে পরো। আর ঘুম না আসলে টিভি দেখো বা কিছু একটা করো।
ভুলেও ছাদে আসবে না বলে দিচ্ছি। আমি একা একা সকাল হওয়া দেখব।
সকালের খুব কাছাকাছি এসে পড়েছি। এই সময়ে তুমি পাশে থাকলে মন্দ হতো না পুষ্প। কাছে পেলে ইচ্ছে মতো আদর করতাম। আদর করি বা না করি জীবন তো কেটে যাচ্ছে ঠিকই। আর এই চার রঙ্গা ত্রিমাত্রিক জীবনটা তো শুধু একবারই ব্যবহার করা যায়। তাই না পুষ্প?