আমি বাইরে তাকালাম, ঝাউগাছের ফাঁক দিয়ে দেখা আকাশ জোড়া নীলচে সাদা; পুরানোকে যে বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়। আমার কামরাটা বাড়ির কোণে, বিশাল না হলেও চলনসই।
ঝাউগাছের ব্যাপারটা বলি, আমার বাবারই কান্ড; কোন এক বিচিত্র কারণে ঝাউগাছ ছিল তাঁর নির্ভেজাল আনন্দের উপকরণ, বিশাল বিশাল ঝাউগাছের দিকে তাকিয়ে থাকতে তার ভালোই লাগত। তিনি প্রায় একে বিশালতার প্রতীক সংজ্ঞা দিতেন আর তিনি যে কত ক্ষুদ্র তা উপলব্ধি করতেন। বাবা খেয়ালী মানুষ ছিলেন, আমি জানি। বসতবাড়িতে মানুষ ঝাউগাছ লাগায় না; আম, জাম ইত্যাদি ফলজ বৃক্ষ কিংবা কাঠফসলী বৃক্ষ লাগায়। কোন এক বিচিত্র কারণে আমাদের বাড়ির সাথে ঝাউগাছগুলো মানিয়ে গেছে, অসাধারণ লাগে; আপনার প্রথম দেখে মনে হবে এ বাড়িতে এগাছগুলো না থাকলে এটি ন্যাড়াতুল্য হত।
আমার পানি পিপাসা পেয়েছে। প্রায় হয়, কোষ্টকাঠিন্য না। পানি গড়িয়ে খেতে আমার বড়ই আলসে, আমি ভেতর বাড়ি গিয়ে কাউকে ডেকে পানি চাইতে পারি কিন্তু নিজে গড়িয়ে পান করার মত সুবোধ না।
আমার কামরার কিছু বিশেষ্যত্ব আছে; যেমন, জানালাটা খুললেই চোখে পড়বে টলটলে সোঁদা জলের আমাদের সরোবরটা, যেখানে সারাক্ষণই কিছু হাঁস জলকৈলি করছে। আর, সুনীলে আকাশ যেন হাত বাড়ালেই বন্ধুর মতন আলতো কার্নিস পেরিয়ে।
*****
রতনকুমার বিদ্যালয়ের মাঠে পাকিস্থানী সেনাদের অস্থায়ী আবাস গড়া হয়েছে। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের আহলাদী ঠাঁই হয়েছে মৌলভী গোলাম সারওয়ারের বাড়িতে। সারওয়ার মৌলভীকে ভীত মনে হচ্ছে না পাকিস্থানীদের দোযখী-আগমনে।
সে অবশ্য যুক্তির কথা বলছে। 'আমি যদি এদের অভ্যর্থনা না জানাতাম এরা গ্রাম জ্বালিয়ে দিত নিমিষেই, আমি তা হতে দিতে পারিনা।' শুধু আমাদের পরিবারের কেহ নয়, গ্রামের কারো এ যুক্তি বোধগম্য হলনা। সর্প বিষ নামাতে হয় কিংবা মেরে ফেলতে হয়, নতুবা দংশন অনস্বীকার্য এবং অবশ্যম্ভাবী; দুধ-কলা সরবরাহ করলে তার শক্তিই বাড়বে।
বাবা ঘর ত্যাগ করেছেন মাস তিনেক, শুনলাম তিনি প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধার। সারা বাড়িতে আমরা পাঁচটি প্রাণী মাত্তুর। আমি, মা, বুড়ি দাদী, ভাবী আর নিলীকা। আমার ভাই প্রবাসী আর নিলীকা আমার খালাতো-বোন। তাদের বাড়ি গ্রামেরই শেষ সীমানায়, যদিও তার অনেকটা সময় কাটে আমাদের ত্রিসীমানায়।
আমার মায়ের ক্ষীণ আশা আছে নিলীকার সাথে আমার বিয়ে দিবেন, আমি টের পাই। ক্ষীণ বলছি একারণেই, নিলীকা অপরূপা এ অনস্বীকার্য যদিও, তদাপি সে আমার মন দখল নিতে পারনি এখনো পর্যন্ত।
*****
আমার ঘুম ভাঙলো মায়ের চেঁচামেচিতে, এরকম প্রায় হয়। একবার হয়েছিল কি তা বলি, আমাদের গৃহপালিত হাঁসগুলোর একটা ডিম দেয়নি একদিন; তাতেই মায়ের সে কি প্রলাপ, আমায় স্বাপ্নিক ঘুম ভাঙিয়ে তিনি সে খবর দিয়েছিলেন! আরে বাপু, ওদের ও তো অবসরের প্রয়োজন আছে! কয়দিন একনাগাড়ে ডিম দেয়া যায়?
আজও এরকম কিছু হবে, আমি অনুমান করলাম। কিন্তু সে চিন্তা উবে গেল মায়ের থমথমে মুখ দেখে।
"কি হয়েছে, মা?" আমি শুধালাম।
"নিলীকাকে পাওয়া যাচ্ছে না।" মা শীতল গলায় বললেন।
এ আর এমন কি! নিলীকাকে ভরদুপুরে নিজ বাড়িতে পাওয়া অমবস্যার চাঁদ পাওয়ার মত। একবার তো সারা গাঁ খোঁজা হল, তার টিকি পাওয়া গেলনা, সে হাওয়া হয়ে গিয়েছিল যেন! অবশেষে তাকে পাওয়া গেল গাঁয়ের সীমানার কবরস্থানের কুল গাছের উপর, সেই কুল গাছের কুল নাকি বড়ই মিষ্টি, তৃপ্তিকর!
আমি আবার ঘুমতে যাবার আয়োজন করতে লাগলাম।
"তুই কি একটু খুঁজে দেখবি?" মাকে অনেক ক্লান্ত দেখাচ্ছে, কেন কে জানে।
"আমি কোথায় খুঁজব? দেখগে, পাড়া বেড়াচ্ছে....."
"নারে, সারা অঞ্চল খোঁজা হল, পাওয়া গেলনা।"আমাকে থামিয়ে দিয়ে মা বলল। "তুই কি মিলিটারী ক্যাম্পে গিয়ে দেখে আসবি?"
"ও ওখানে কি করবে?" আমি বালিশে মুখ গুঁজে দিলুম।
"যদি ধরে নিয়ে যায়!" মায়ের কন্ঠে একরাশ উদ্বেগ।
ভারী ঘুমে আমার চোখ লেগে এল। আমি মায়ের কথাগুলো শুনতে পেলাম না।
আমার ঘুম ভাঙলো বিকাল পেরিয়ে। নিলীকা তখনো নিরুদ্দেশ!
*****
দরজায় শব্দ হচ্ছে, আমি জবাব দিলুম না। এখন মাঝরাত্রি, এক চিলতে বিবাগী জোছনা। বাতাসে বেলীফুলের সুভাস আসছে, আমার মনে হল; কিন্তু আমাদের বাড়ির ত্রিসীমানায় কোন বেলীফুল গাছ নাই।
শব্দটা বাড়ছে, তবে জোরালো না। আমি ভিজে গলায় বললুম, 'কে?'
মিহি, এলোমেলো স্বর ভেসে এল বৈশাখী বাতাসে, 'আমি।'
নিলীকা! এত রাত্রে!
আমি দরজা খুললাম তাড়াতাড়ি, এক ঝটকায়।
নিলীকার শাড়ি এলোমেলো, মাথার চুল অগোছালো। কপালের বাঁ পাশটায় রক্ত।
"কি রে তোর কি হল?" আমি আশ্চর্য।
সে নিশ্চুপ।
"কথা বলছিস না কেন?"
সে ডুঁকরে কেঁদে উঠল। "আমার সব শেষ।"
আমার মনে হল কেউ আমাকে অতল কুয়ায় ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে। আমি টের পেলুম আমার হাত শক্ত হয়ে আসছে।
"তোকে......ধরে..।"
"হ্যাঁ।" তার দৃষ্টি মাটির দিকে।
আমার চোখ দুটি জ্বালে উঠল। অজানা কারণে।
"তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?"
আমি জানি ও কি জানতে চাইবে। বললাম, "হুঁ।"
"তুমি কি আমাকে কখনো ভালোবাসতে?"
আমি টের পেলুম নিলীকা আমার মুখের পানে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে, আমি মাটির দিকে তাকিয়ে। আমি মিথ্যা বললুম, "হ্যাঁ, অনেক।"
"আমাকে একটু কাছে টেনে নিবে? একটু আদর করে দিবে?" ওর কন্ঠ ভেঙে আসছে।
আমি নিশ্চুপ, ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছি।
"তুমি একটা কাপুরুষ।"
আমি শুনতে পেলুম নিলীকার পায়ের আওয়াজ, দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে।
রাত অনেক এখন। জোছনা আরো গাঢ় হয়েছে। আমার হাত মুঠো ধরা, আমার তীব্র ক্রোধ!
নিলীকার দেহখানি মিলিয়ে যাচ্ছে দৃষ্টি সীমানায়, চাঁদের আলোয় তার বিশাল ছায়া। সে ছায়া ঢেকে দিচ্ছে আমাকে।
---------------------------------------------------------------------------
এটি গল্প না ঠিক, একটা উপন্যাসের সারমর্মের খানিকটা। ভবিষ্যতে আরো বিস্তৃত করে লেখার ইচ্ছা আছে।
সবার বিশ্লেষণী মন্তব্য আশা করছি। ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা আগস্ট, ২০০৮ রাত ৩:৩৪