সভ্যতার প্রারম্ভকাল থেকেই মানুষ তার শৈল্পিক মনের বিকাশ ঘটিয়ে চলেছে। পাহাড়ের গুহায় বসবাস করা মানুষ গুহার দেয়ালে খোদাই করে তাদের যাপিত জীবনকে স্মৃতি হিসেবে ধারণ করে রাখতো। সভ্যতার ক্রমবিকাশে লৌহ, ব্রোঞ্জ, তামা, স্বর্ণ, মাটি, বেলেপাথর, চুনাবালি, কাঠ ইত্যাদির ব্যবহারে মানুষ ঠিক একই ভাবে সভ্যতাকে ধারণ করে রাখতে সচেষ্ট থেকেছে। কালে কালে এই শিল্প রুপ নিয়েছে ভাস্কর্য শিল্পে। গ্রীক সভ্যতা থেকে শুরু করে রোমান, ইনকা, অ্যাজটেক, মিশরীয়, সিন্ধু, হরপ্পা, মহেঞ্জোদাড়ো ইত্যাদি প্রায় সকল সভ্যতার মানুষকেই দেখা গেছে এই ভাস্কর্য শিল্পের চর্চা করতে। কখনও দেব-দেবী, কখনও সমাজের গণ্যমান্য ব্যাক্তিবর্গ কিংবা কখনও প্রকৃতি ও প্রাণী জগত ধারণ করা হয়েছে ভাস্কর্য রুপে। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ইত্যাদি কোন কিছুই বাদ যায়নি ভাস্কর্য হিসেবে ধারণ করে রাখার প্রয়াস থেকে। কালে কালে ভাস্কর্য মানুষ গৃহস্থলির সৌখিন শিল্প সামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। হোক সেটা বিমূর্ত অথবা হোক কোন মনুষ্য মূর্তি কিংবা মৎস্যকন্যা মানুষের শৈল্পিক মন জুড়ে রয়েছে ভাস্কর্য শিল্প।
মানুষ যতই নানারকম ভাস্কর্য গড়ে তুলুক না কেন; আজ পর্যন্ত কারও পক্ষেই সম্ভব হয়নি এসব প্রাণহীন শিল্পকে প্রাণ দেয়ার। কিন্তু যদি প্রাণনাশ করে ভাস্কর্য গড়ে তোলা যায় তাহলে ব্যাপারটা কেমন হয় ? মানুষের অদম্য শৈল্পিক মনের তাগিদ এই অদ্ভুত কর্মটিও সাধন করেছে। রুপকথার গল্পে দেখা যেত শয়তান যাদুকর তার যাদুবলে মানুষকে পাথরের মূর্তি বানিয়ে ফেলতো। কিন্তু বাস্তবে মানুষকে পাথরের মূর্তি না বানালেও প্রাণীর অস্তিত্ব ধ্বংস করে মানুষ ভাস্কর্য নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছে। চমৎকার দৃষ্টিনন্দন অদ্ভুত এইসব বিমূর্ত শৈল্পিক ভাস্কর্য মানুষ ব্যবহার করছে সৌখিন সামগ্রী হিসেবে।
ভয়ানক নিষ্ঠুর এই ভাস্কর্য শিল্পের নাম অ্যালুমিনিয়াম ফায়ার অ্যান্ট কলোনি কাস্টিং। মূলত পিঁপড়ার জীবনের বিনিময়ে প্রস্তুত করা হয় এসব ধাতব ভাস্কর্য। এসব অদ্ভুত বিমূর্ত ভাস্কর্য তৈরি করা হয় মূলতঅ্যালুমিনিয়াম গলিয়ে। প্রথমে ধাতব অ্যালুমিনিয়াম খন্ড অত্যন্ত উচ্চতাপে গলানো হয়। এরপর তা ঢালা হয় মাটিতে গড়ে তোলা পিঁপড়ার ঢিবিতে যেখানে পিঁপড়ার বসবাস। গর্ত পূর্ণ হয়ে গেলে গলিত অ্যালুমিনিয়াম ঠাণ্ডা হয়ে জমাট বাঁধা পর্যন্ত অপেক্ষা করা হয়। পিঁপড়ার গর্তের প্রত্যেকটা অলিগলিতে উত্তপ্ত গলিত অ্যালুমিনিয়াম ঢুকে তৈরি হয় অদ্ভূত এক কোরালের মতো আকৃতি। যথেষ্ট শক্ত হয়ে গেলে চার পাশের মাটি খুঁড়ে পাওয়া বস্তুটি তুলে আনা হয়। এরপর এতে পানির ঝাপটা দিয়ে ধুয়ে ফেললেই বেরিয়ে আসে অসাধারণ ভাস্কর্য। পিঁপড়ার উপকারিতার দিকের চেয়ে ক্ষতিকারক হিসেবেই ধারনা করে মূলত এই ভাস্কর্য শিল্পের প্রচলন হয়। দেখা যায় পিঁপড়ার বসত ধ্বংসের জন্য জমিতে ক্ষতিকার রাসায়নিক কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়। অনেক সময়ই যা জমির উর্বরতা নষ্ট করে। কিন্তু প্রকৃতিতে যে কোন কিছুই অকারণে নয়। জীব বৈচিত্রের অংশ হিসেবে প্রকৃতিতে যে; সব কিছুই প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে চলে, এই ক্ষেত্রে এই জ্ঞান আর প্রযোজ্য হয়নি। পিঁপড়ারও প্রাণ থাকা স্বত্বেও মানুষের শিল্প সাধনার কাছে তাদের প্রাণও তুচ্ছ হয়ে ধরা দিয়েছে। যার বাজার মূল্য সর্বোচ্চ প্রায় ৩৭৫ ডলার।
সচিত্র অ্যালুমিনিয়াম ফায়ার অ্যান্ট কলোনি কাস্টিং প্রক্রিয়া
প্রথমে মাটিতে গড়ে তোলা একটি পিঁপড়ার ঢিবিতে উত্তপ্ত গলিত অ্যালুমিনিয়াম ঢেলে দেয়া হচ্ছে।
ঠাণ্ডা হয়ে জমাট বেঁধে যথেষ্ট শক্ত হয়ে যাওয়ার পর শুরু হলো মাটি খোঁড়া।
মাটির অনেক গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত পিঁপড়ার বসতের অ্যালুমিনিয়ামের ভাস্কর্যে রুপ লাভ।
এবার মাটির ভেতর থেকে তুলে এনে পানি দিয়ে মাটি পরিষ্কারের পালা।
পুরোপুরি পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার পর বাজারে বিক্রির জন্য প্রস্তুত ভাস্কর্য।
পিঁপড়ার প্রাণের মূল্য যাই হোক না কেন, মানুষের শৈল্পিক মন ঠিক একই প্রক্রিয়ায় এই অ্যালুমিনিয়ামের শিল্প কর্ম বিকশিত হয়েছে আরও নানা ভাবেই। এই শিল্প কর্ম দেখলে অবশ্য এটা মেনে নেয়া সম্ভব হয়না কিছুতেই যে, শুধুমাত্র পিঁপড়ার ক্ষতিকর দিকের কথা ভেবেই এমন ভাস্কর্যের সৃষ্টি। তরমুজ একটি সুস্বাদু খাবার হলেও তরমুজের বীচি দিয়েও তৈরি করা হচ্ছে এমন অদ্ভুত ভাস্কর্য। যার নামঅ্যালুমিনিয়াম ফায়ার ওয়াটারমেলন বা তরমুজ কাস্টিং। হয়তবা তরমুজের বীচি যেহেতু মানুষের খাদ্য নয়, তাই এর অপ্রয়োজনীয়তাকে প্রাধান্য দিয়েই তৈরি করা হচ্ছে এমন অদ্ভুত চমৎকার দৃষ্টিনন্দন বিমূর্ত শৈল্পিক সব ভাস্কর্য।
সচিত্র অ্যালুমিনিয়াম ফায়ার ওয়াটারমেলন বা তরমুজ কাস্টিং প্রক্রিয়া
প্রথমে একটি তরমুজের উপরাংশে শক্ত পাইপ দিয়ে গর্ত করে নেয়া হচ্ছে।
পোষা কুকুরকে দিয়ে তরমুজের স্বাদ পরীক্ষা করিয়ে নেয়া হচ্ছে।
এবার ধাতব অ্যালুমিনিয়াম উচ্চতাপে গলিয়ে তরমুজের ভেতর ঢালার পালা।
ঠাণ্ডা হয়ে এলে এবার তরমুজ কাটাকাটির পালা। তরমুজতো নয় যেন লোহার কোন বল কাটার কসরৎ চলছে।
তরমুজের ভেতর থেকে বের হয়ে আসা তরমুজের বীচির অ্যালুমিনিয়ামের ভাস্কর্যে রুপ লাভ।
এমনকি এই শিল্প সাধন থেকে বাদ যায়নি পেঁপেও
কতিপয় নান্দনিক নিষ্ঠুর ভাস্কর্য
রহস্যাবৃত এই পৃথিবীতে কত বিচিত্র মানুষ আর কতইনা বিচিত্র মানুষের শিল্প সাধন !!
তথ্যসূত্রঃ
www.anthillart.com
www.isciencetimes.com
www.buzzfeed.com
www.ebay.com