মরনের পরেও নাকি একটি নতুন জীবন আছে। আমাদের পৃথিবীর এই জীবনই শেষ বেঁচে থাকা নয়। মরনের পর মানুষ তার নতুন জীবনে বেঁচে থাকবে অনন্তকাল ধরে। কিন্তু পৃথিবীতে যে জীবন যাপিত হয় নির্মম বাস্তবতার কষাঘাতে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে তার বেঁচে থাকার প্রেরনা তাকেই খুঁজে নিতে হয়। এই যেমন আমি বেঁচে আছি একটি ফ্যান্টাসির উপর নির্ভর করে। কিছু কিছু প্রেম-ভালোবাসা অনেক সময় ফ্যান্টাসি ব্যতীত আর কিছুই নয়। অনেকে আবার এ ধরনের ভালোবাসাকে নাম দিয়ে থাকেন কাল্পনিক ভালোবাসা বলে। আমার জীবনের এমনই এক কাল্পনিক ভালোবাসার কাহিনী এটি। একজন আছে যাকে আমি খুব খুব বেশী ভালোবাসি কিন্তু সে রয়ে যায় আমার ধরা ছোঁয়ার বাইরে। সে আমার বেঁচে থাকার অনুপ্রেরনা হয়ে থাকে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে যাপিত জীবনে। আমি তার নাম রেখেছি জলদেবী।
বিস্তীর্ণ ভুমিতে আমি দাড়িয়ে আছি ফাঁকা হৃদয় নিয়ে
আমাকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করার অবকাশ হবে না কখনো জানি
তবু তুমি নিছক স্বপ্ন হয়েই বেঁচে রবে আমার জীবনে প্রেমের কেয়া হয়ে
তুমি আমার অনন্ত স্বপ্নলোকে সাগরের জলধারার স্রোতে ভেসে থাকা জলদেবী
আজ অফিস হতে ফিরে কোন এক অজানা কারনে মনটা ভীষণ চঞ্চল হয়ে উঠল হঠাৎ করেই। আমি বাস হতে নেমে পরলাম মাঝ পথে। রাতের এ সময়টাতে পথ ঘাট কিছুটা ফাঁকা হয়ে যায়। গাড়ির সংখ্যা কম থাকে যেটা ঠিক ঢাকার ব্যাস্ততম পথের সাথে ঠিক মেলান সম্ভব নয়। ফুটপাথের উপর খোলা আকাশের নিচে ঘুমিয়ে থাকে ঘরহীন দরিদ্র মানুষগুলো। এই অসহায় পরিবারগুলোর প্রতি যেন কারো কোন মাথা ব্যাথা নেই। নেই কোন সহমর্মিতা। একটু সামনে এগুতেই দেখলাম একটি নগ্ন শিশু চিৎকার করে কাঁদছে খুধার যন্ত্রণায় আর শিশুটির মা শিশুটিকে মারছে আর বিলাপ করছে। প্রচণ্ড বাতাস বইছে সাথে ধুলি ঝড় উড়ছে। হয়ত এখুনি বৃষ্টি নামবে। এই খোলা আকাশে তাহলে এদের আশ্রয় নেয়ার কিছুই নেই। এই অবুঝ শিশুটি ভিজবে তার মায়ের আঁচলে আশ্রয় নিয়ে। যেসব মানুষ জীবনের অনিশ্চয়তা নিয়ে ঘুমিয়ে আছে তারাও ভিজবে। জীবন তাদের করেনি ক্ষমা মৃত্যুর নেশায় মাতাল করে। নিয়ন জ্বালা বাতিগুলো অন্যরকম এক পরিবেশের সৃষ্টি করেছে পুরো মুহূর্তটুকুকে ঘিরে। আমি হেটে চলছি ফুটপাথের সীমানা ধরে। আজ হকারগুলোকেও কোথাও বসতে দেখছিনা। মনে হয় ঝড়ের আভাস পেয়ে আগেই ব্যবসা গুটিয়ে চলে গেছে আজকের মতন। আবার জীবনের পসরা সাজিয়ে বসবে আগামীকাল। একটু সামনে এগুতেই চোখ পরল একটি মেয়ে একা দাড়িয়ে আছে । খুব চেনা চেনা লাগছে মেয়েটিকে। আরে এইত কেয়া। শেষ যেদিন কেয়াকে দেখেছিলাম সেদিনটির কথা মনে পরছেনা। শুধু খবর পেয়েছিলাম কেয়া বিয়ে করে সুখেই আছে। আমি অবশ্য তেমন একটা কথা কখনো বলিনি ওর সাথে। শুধু মনের মাঝে রয়ে গেছে অপলক দৃষ্টিতে কেয়ার অপরূপ মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে থেকে বোবা হয়ে যাওয়ার কিছু সুখের স্মৃতি। দাড়িয়ে থেকে আকাশে তাকিয়ে যেন কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করছে। কেয়াকে দেখে মনে হচ্ছে যেন বাতাস আজ বড়ই বেরসিক ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এমনিতেই পরনে পাতলা ফিনফিনে সিল্কের শাড়ি। একদিকে শাড়ির আঁচলের ছুটোছুটি আর চুলের এলোমেলো পাগলামি সব সামলাতে সামলাতে একাকার পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে কেয়ার জন্য। তবে মনে হচ্ছে যেন একটি নীল রঙের ময়ূর তার রূপের পসরা সাজিয়ে বসেছে নাচ দেখাবে বোলে আর আমাকে মাতাল করে তুলছে ক্রমেই একজন মদ্যপের মতই। একবার ভাবলাম কাছে যেয়ে আমার দুবাহুর বন্ধনে ওকে জড়িয়ে নেই বুকের খুব কাছে যেন দুজনার হৃদ ধ্বনি মিলে মিশে এক হয়ে সৃষ্টি করে নতুন এক হৃদ্যতা। সেই আবেগ আমার যেন মুহূর্তেই হারিয়ে গেল। একটি মোটর সাইকেলে করে একজন ভদ্র লোক এলেন। লোকটি দেখতে বাংলা সিনেমার কুৎসিত ভিলেনদের মতই। এই লোকটিই তাহলে কেয়ার স্বামী। পেটের ভুঁড়ির কারনে যেখানে মোটর সাইকেলে অনায়াসে দুইজন বসতে পারার কথা সেখানে দুইজনের বসতেই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তবে লোকটিকে দেখে খুব যে বেশী বয়স তা কিন্তু মনে হল না। কেয়া লোকটির কাঁধে হাত রেখে মোটর সাইকেলের পেছনে উঠে বসল। মোটর সাইকেল চলতে লাগল তার আপন গতিতে আর নীল শাড়ির আঁচল ও রেশমি চুলগুলো উড়তে লাগল আমার মনের মাঝে হাহাকার তুলে। আমার হৃদপিণ্ড খুব কাঁদছে আমি টের পেলাম। কিন্তু কি করে নিজেকে সান্তনা দেব সে ভাষা আমার জানা নেই শুধু ভাবছি স্রষ্টা জোড়া মেলানর ক্ষেত্রে বড়ই বেরসিক। এরই মাঝে নেমে এলো ঝুম বৃষ্টি অঝর ধারায়। প্রেম নয় ভালোবাসা নয় একধরনের মোহ কাজ করছে বলা যেতে পারে। বৃষ্টিতে ভেজার অনুভূতি অন্যরকম। মনে পরে গেলো অতীতের তেমনই এক বৃষ্টি ভেজা দিনের স্মৃতি। চোখের সামনে যখন কেয়াকে সেদিন ভিজতে দেখছিলাম কিন্তু তার কাছে যেতে পারছিলামনা, একটু জড়িয়ে ধরে বৃষ্টির ঘ্রাণ নিতে পারছিলামনা তখন আর শীতলতা ছিলনা সেটা শরীরে এক ধরনের জ্বালা তৈরি করেছিল। আমারও আজ তেমন জ্বালা করছে পুরো শরীরে। ভেজা শাড়িতে লেপটে থাকা সরু কোমরে হাত রেখে যদি সেই মুহূর্তে হাটা যেত সেই বৃষ্টি ভেজা পিচ্ছিল ঘাসের উপর দিয়ে কখনও পিছলে যাবার ভয়ে সাবধানী দুটি হাত খুব শক্ত করে যদি আমাকে জড়িয়ে ধরে হাঁটত সেদিন বৃষ্টির আবেশে কিইবা ক্ষতি হত। কিন্তু সব চাওয়া পাওয়া হয় না। সব ভালোবাসা পায়না পূর্ণতা। আমি আর বৃষ্টিতে ভেজার বিলাসিতা না করে সামনেই একটি বার পরাতে সেখানে ঢুকে পরলাম। বার থেকে একটি মদের বোতল কিনে নিয়ে আবারো পথে নেমে এলাম। বৃষ্টি এখনো থামেনি। বৃষ্টি হচ্ছে আমি মদ গিলে গিলে ভিজেই পথ চলছি গন্তব্য আমার নিজ আবাস স্থল। ঘরে ফিরে কম্পিউটার ছেরে লগইন করলাম আমার ফেসবুক একাউন্টটিতে। প্রফেসর হারডিং ইনবক্স করেছে। আমার বন্ধু, বড় ভাই, শুভাকাঙ্ক্ষী সবই বলা যেতে পারে তাকে। সিঙ্গাপুরে আছে গভীর সমুদ্রের প্রাণীদের নিয়ে রিসার্চ করার কাজে। আমাকে এই সপ্তাহের মধ্যেই সিঙ্গাপুর যেতে হবে তার ওখানে। না গেলেই সম্পর্কের ইতি টানবে। এত বড় থ্রেট পেয়ে আমি আর দেরী না করে প্রস্তুতি নিলাম সিঙ্গাপুরের জন্য। প্রফেসর মানুষ বোলেই এমন পাগলাটে সভাবের কিন্তু মানুষ হিসেবে চমৎকার। একদম সাদা সিধে মনের মানুষ। কেন যেন গভীর নীল সমুদ্র আমাকেও হাতছানি দিয়ে ডাকছে প্রতিনিয়ত।
এই সময়টাতে সমুদ্র সাধারনত শান্ত থাকে আর পেলামও তাই। হারডিং এর মন খুব চঞ্চল পেলাম। আমাকে দীর্ঘ দিন পর পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরবে খুসিতে আমি অন্তত তেমনই ভেবেছিলাম। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে একটি সিগারেট ধরিয়ে শুধু বলল এসেছ যাক ভালই করেছ ভেবেছিলাম আসবেনা। আমাকে কোন কথা বলতে না দিয়ে শুধু বলল চল দেরী করা যাবেনা আমাদের শিপ এখনই ছেরে দিবে। ছোট একটি শিপ। অনেকটা স্পীড বোটের মতই কিন্তু দোতালা। উপরের তালায় নাবিকের শিপ চালানোর কেবিন আর নিচের তালায় হারডিং ও আমার থাকার জন্য একটি কেবিন। কেবিনটিতে খাট, ডাইনিং টেবিল, পড়ার টেবিল তার উপরে রাখা ল্যাপটপ, ফ্রিজ জীবন ধারনের জন্য প্রয়োজনীয় সবই রয়েছে। শিপ ছেরে দিয়েছে অজানার উদ্দেশ্যে। আমি তাকিয়ে দেখছি হারডিং এর সিগারেট টানা। ধোঁয়ার মাঝে তার মুখটি মনে হচ্ছে স্বর্গীয় কোন দেব দূতের মতই। শিপ চলছে সমুদ্রের পানিকে দুই ভাগ করে দিয়ে। সেই স্রোত ধারায় সামনে সামনে এগিয়ে চলছে ডলফিন। মনে হচ্ছে ডলফিনগুলো হারডিং এর খুব চেনা বন্ধু। হারডিংও ওদের দেখছি নাম ধরে ডাকছে। এক একটির নাম সে নিজে রেখেছে। যখন যাকে ডাকছে সেই ডলফিন তার ডাকে তখন সারা দিয়ে পানিতে লাফিয়ে উঠছে। শান্ত সাদা মেঘের ভেসে যাওয়া আকাশে কিছু পাখি উড়ে যেতে দেখছি। আমাকে হারডিং বলল পাখিগুলোর সাদা বক। এগুলো আকাশে উড়তে থাকে শিকারের সন্ধানে এবং এদের দৃষ্টি খুব তীক্ষ্ণ হয়। যখনই কোন ছোট মাছ ভেসে উঠতে দেখে সমুদ্রের পানির উপর এক ছু মেরে ঠোঁটে করে নিয়ে আবার আকাশে উড়ে যায় বকগুলো। আমাকে সে বলল আমার হাতের সিগারেট ছুড়ে দিতে পানিতে। আমি তাই করলাম। কিন্তু সিগারেট পানিতে না পরতেই দেখি একটি বক উড়ে এসে আমার ছোরা সিগারেটটি মুখে দিয়ে ফেলল। হারডিং আমার অবাক হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে। যখন থেকে সিঙ্গাপুর এসেছি এই পুরো সময় ধরে এই পথম তাকে দেখছি প্রান খুলে হাসতে। আমি বোকার মত চুপ করে সেই হাসি দেখছি। আমাদের শিপ একটি দ্বীপে এসে থামল। সমুদ্রের ঠিক মাঝখানে দ্বীপটি অবস্থিত চারদিকে পানি আর পানি যতদূর দৃষ্টি যায় কোন সীমানা দেখা যায় না সমুদ্র আর আকাশ যেন দূরে যেয়ে একসাথে মিশেছে। আমি একটি সিগারেট ধরিয়ে বালুতে বসে আছি সেই আকাশ আর সমুদ্রের মিলন রেখায় তাকিয়ে। ভাবছি কেয়া আর আমার জীবনের প্রেম-ভালোবাসা ঠিক এমনই। কেয়ার ভালোবাসা বললে ভুল হবে বলা উচিত কেয়ার প্রতি আমার ভালোবাসা ঠিক এমনই। এখন প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। প্রফেসর আমাকে জানাল আমরা এখানে প্রায় এক মাস থাকব। আমি অবশ্য অফিস থেকে এক মাসেরই ছুটি নিয়ে এসেছি তাই আমার চকারিতে কোন রকম সমস্যা হবার কথা না। দ্বীপটির ভেতর উঁচু একটি ঢিবীর উপরে বাঁশ দিয়ে একটি ঘর তুলে রাখা আছে। বুঝলাম এটি প্রফেসরের তৈরি করা অস্মভব সুন্দর একটি সৃষ্টি যেন কল্পনার সব ভাবনাকে হার মানিয়েছে। ঘরে প্রবেশ করে দেয়ালে ঝুলান একটি ফ্রেম বন্দী ছবির দিকে প্রথমেই চোখ পরল। ক্যামেরা দিয়ে তোলা একটি মৎস্যকন্যার ছবি। আমার বুকের ভেতর কি যেন একটা দপ করে জ্বলে উঠল। এত দেখছি অবিকল কেয়ার ছবি কিন্তু এখানে এভাবে মৎস্যকন্যার রূপে কেয়া আসবে কিভাবে ! আমি চোখের ধাঁধাঁ ভেবে চোখ মুছে নিয়ে আবার ছবিটির দিকে তাকিয়ে দেখি না এটা কেয়ারই ছবি। আমি হারডিংকে জিজ্ঞাস করলাম ছবির এই মৎস্যকন্যা কে ? বন্ধু আমাকে বলল আরে এর ব্যাপারেই তোমাকে এখানে এত দূর কষ্ট করে আনিয়েছি। সবই জানতে পারব ধীরে ধীরে। এতদূর ভ্রমন করে এসে ক্লান্ত শরীর নিয়ে একটু ঘুমাব বোলে ভেবেছি কিন্তু মুহূর্তেই সব ক্লান্তি উবে গেল। আমি আর পুরো রাত ঘুমাতে পারলাম না শুধু ছবির এই কেয়ার দিকেই তাকিয়ে আছি। সকাল বেলা আমরা বের হলাম পুরো দ্বীপটি ঘুরে দেখব বোলে। দ্বীপের পেছনে একটু দূরে একটি ভাঙা মন্দির চোখে পরল। একটি বাফোমেটের মূর্তি বড় করে হা করে রয়েছে আর সেই হা করে থাকা মুখটিই হল মন্দিরের ভেতর প্রবেশ করার দরজা। আমরা মন্দিরের ভেতর প্রবেশ করলাম। ভেতরে একটি পাথরের তৈরি গোলাকার টেবিল দেখতে পেলাম। যতটুকু মনে হচ্ছে এর উপর দেবতাদের তুষ্টির জন্য একসময় বলী দেয়া হত। এখনো তার স্মৃতি চিহ্ন রয়েগেছে আসে পাশে কিছু মাথার খুলী পরে থেকে। হারডিং আমাকে তার অনুবাদ করা একটি ডায়রি পরতে দিল। আমি মন্দিরের বাইরে এসে একটি কলা গাছে নিচে বসে পরলাম অধীর আগ্রহ নিয়ে ডায়রিটি পড়ার জন্য। ডায়রিতে লেখা রয়েছে এই দ্বীপের আদি ইতিহাস।
একসময় এখানে উদং নামের একটি জাতির বসবাস ছিল। তারা ছিল শয়তানের পূজারী। শয়তান তাদের সরাসরি দেখা দিয়ে নানা রকম রীতি নীতির শিক্ষাদীক্ষা দিয়ে যেত। প্রায় প্রতিদিন তাদের মঙ্গলের জন্য শয়তানকে সন্তুষ্ট করার জন্য তারা তাদেরই সজাতিদের ধরে ধরে বলী দিত এই মন্দিরের ভেতর এনে। এরপর কিছু লেখা আমি আর বুঝলাম না প্রফেসর কে জিজ্ঞাস করেছি কিন্তু সেও সেগুলো বুঝতে পারেনি বোলে এভাবেই লিখে রেখে দিয়েছে। লেখাগুলো মন্দিরের দেয়ালেও লেখা রয়েছে দেখলাম। পুরো মন্দিরের দেয়ালে অনেক লেখা দেখলাম। এর প্রায় অনেক লেখাই অনুবাদ করা রয়েছে ডায়রিতে। অনেক কষ্ট করতে হয়েছে এজন্য তাকে। এমন কাজ শুধু মাত্র হারডিং এর পক্ষেই সম্ভব। একসময় এই দ্বীপটি ছিল ইংলা নামের একদল শয়তান জাতির বেদখলে যখন এখানকার উদং জাতিরা ছিল ঈশ্বর এর পূজারী। কিন্তু কালের বিবর্তনে ইংলা যারা ছিল প্রকাশ্য শয়তানের পূজারী তাদের অত্যাচারে তারাও পরে একসময় ইংলাদের ধর্মে দীক্ষিত হয়ে শয়তানের পূজারী হয়ে পরে। কিন্তু একটা সময় পর অত্যাচারের মাত্রা এমন অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে উদংরা ধীরে ধীরে বিদ্রোহী হয়ে উঠে। তারা একসময় দলবদ্ধ হয়ে আন্দোলন শুরু করে দেয়। তারই ধারায় ইংলারা এই দ্বীপ ছেরে যেতে বাধ্য হয় কিন্তু যাবার আগে পুরো দ্বীপটিকে দুটি জাতিতে ভাগ করে দিয়ে যায়। একটি ভাগের নাম হয় শিলং আর একটি ভাগের নাম হয় মং। পরে এই দুইভাগের একটি ভাগ আবার দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায় শয়তানের আদেশে। উত্তর মং আর দক্ষিন মং নামে দুটি নতুন ভাগ হয়। কিন্তু সেই দুটি ভাগ একই জাতি হিসেবে থাকে তাদের আচার অনুষ্ঠানের ভিত্তিতে বড় ভাগ শিলং থেকে দুই প্রান্তে। কিন্তু এটি পরবর্তীতে বড় ভাগ শিলং এর জন্য হুমকির কারন হতে পারে বোলে তারাও ষড়যন্ত্র করতে থাকে তাদের দুই পাশে গড়ে উঠা একই জাতিদের নিয়ে। ওদিকে শয়তান উত্তর পাশের মং জাতিদের উস্কে দিতে থাকে দক্ষিন পাশের স্বজাতিদের উপর অত্যাচার আর অনাচার করার জন্য আর তারা তা চালিয়ে যেতে থাকেও ঠিক তাই। একসময় বড় ভাগ শিলং এর সাহায্য নিয়ে দক্ষিন পাশের মং জাতিটি উত্তর পাশের মং জাতিটির সাথে যুদ্ধ করে পৃথক হয়ে যায়। আর ঠিক এই আলাদা হয়ে যাওয়াটাই চাচ্ছিল বড় ভাগ শিলং। কিন্তু কিছু সময় পর তাদের সেই আনন্দ মিলিয়ে যেতে থাকে যখন তাদের নিযুক্ত করা দলপতি তাফাং যার নেতৃত্বে একসময় দক্ষিন মং স্বাধীন হয়ে নতুন জাতি ওরাং হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল এর হত্যাকাণ্ড ঘটে এবং নতুন এক দলপতি এসে হাজির হয়ে তাদের সকল ষড়যন্ত্র রুখে দিতে থাকে একের পর এক। সেই দলপতির নাম ছিল যাবাং। আবারো সেই বড় ভাগ শিলং ষড়যন্ত্র শুরু করে দেয়। তারা লোক নিযুক্ত করে নতুন দলপতি যাবাং কে হত্যা করতে। কিন্তু তবু তাদের মনের আশা পুরন হয়না। কারন যাকে হত্যা করা হয় তার অনেক ভক্ত গড়ে উঠে ততদিনে এবং তাদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে সেই দলপতি যাবাং এর পরিবার তারপর তাদের জাতির হাল ধরে। এতে বড় জাতি শিলং আরও বেশী ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে এবং তাদের লেজুড় বৃত্তি করবে ওরাং জাতিটির মাঝে থেকেই এমন একটি দল নিযুক্ত করে দেয় কিংবা গড়ে তোলে। আর এভাবেই শুরু হয় একই জাতির ভেতর থেকেও দুটি দলের পারস্পরিক দন্দ। একটা সময় নিজেদের মধ্যেই দন্দ করতে করতে পুরো জাতিটি ধ্বংস হয়ে যায়। একসময় শুধু থেকে যায় বড় ভাগ শিলং। ধ্বংস হয়ে যায় উত্তর মং জাতিটি। পুরো উত্তর মং আর ওরাং আবারো গ্রাস করে নেয় শিলংরা। কিন্তু তাদের শয়তান তুষ্টির জন্য বলী প্রথা একসময় তাদের জন্য কাল হয়ে দাড়ায়। ক্রমাগত তাদের স্বজাতিদের ধরে ধরে প্রতিদিন বলী দেয়ার কারণে একসময় তাদের জাতিটি লোক শূন্য হয়ে পরতে থাকে। তাদের বোধদ্বয় হল। তাই তারা সিধ্যান্ত নিল যে আর নিজেদেরকে এভাবে বলী দেবেনা। এই সমুদ্রে ছিল মৎস্যকন্যাদের একটি জাতি। পরে তারা সমুদ্রের গভীর হতে সেইসব মৎস্যকন্যাদের ধরে ধরে এনে একের পর এক বলী দিতে থাকলে পুরো মৎস্যকন্যা জাতিটি একসময় বিলুপ্ত হয়ে যায়। শুধু কোন ক্রমে পালিয়ে বেঁচে থাকে কেয়া আর এরপর এই দ্বীপটি একসময় জনমানব শূন্য হয়ে যায়। তবে এখনো কেয়া একাই রয়ে গেছে এই সমুদ্রে তার স্বজাতিদের মৃত্যুর করুন নিষ্ঠুর কিছু স্মৃতি বুকের ভেতর লালন করে। মাঝে মাঝে সমুদ্র থেকে দ্বীপে উঠে আসে সে তার স্বজাতিদের জন্য শ্রদ্ধা জানিয়ে যেতে। আর এভাবেই একদিন এই দ্বীপে সমুদ্রের প্রাণীদের নিয়ে গবেষণা করতে এসে এই দ্বীপে এসে আমি প্রফেসর হারডিং আমার ক্ষণিকের ঘর বাঁধতে যেয়ে পরিচয় হয় কেয়ার সাথে। এই পর্যন্ত পড়েই আমার বুকের ভেতর দপ করে সেই আগুন আবার জ্বলে উঠল। আমি হারডিং এর কাছে কেয়ার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলাম। কিন্তু সে আমাকে জানাল ডায়রিতে লিপিবদ্ধ যে অংশটুকু আজও অনুবাদ করা সম্ভব হয়নি সেই অংশটুকুতেই খুব সম্ভবত কেয়ার সম্পর্কে কিছু তথ্য আছে যা সে কেয়ার কাছ থেকেও জানতে পারেনি। কারন যখন কেয়া পালিয়ে বেঁচেছিল তখন সে খুব ছোট ছিল যা এখন তার আর মনে নেই কিছুই। আমার কেয়ার সাথে দেখা করার ইচ্ছেটা প্রবল হতে লাগল। আমার মনের অভিব্যাক্তি টের পেয়ে হারডিং বলল আমাকে কেয়ার সাথে দেখা করতে হলে খুব ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করতে হবে আমাকে কয়েকটা দিন। আমি সেই ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করছি কেয়ার জন্য। আমার জলদেবীর জন্য যাকে নতুন করে আবার চিনতে ইচ্ছে করছে, ভালবাসতে ইচ্ছে করছে, আপন করে কাছে পেতে ইচ্ছে করছে খুব বেশী।
আমিত তোমারই বিহনে হতে চাই তোমারই পূজারী
হৃদয়ের হৃদ্যতা ও আমার ফিরে পাওয়া জলদেবী
দগ্ধ জীবনের দুদণ্ড শান্তি তুমি হতে পার আমার সঙ্গিনী
জানি তুমি তবু হয়ে রয়ে যাবে আমার অপারবাস্তবের রাগিণী
সপ্তাহ পার হয়ে গেল। আমি এক রাতে একাকী হাঁটছি বেলাভূমির তীর ধরে। বৃষ্টি হচ্ছে প্রবল ধারায়। আজ ভেজার আনন্দটাই একটু অন্যরকম। হঠাৎ সমুদ্রের স্রোত ধেয়ে আসল বেলাভূমির দিকে। সেই স্রোত থেকে উঠে এলো বহু প্রতীক্ষার আমার সেই জলদেবী। আমি মুগ্ধ চিত্তে তাকিয়ে থাকলাম তার অর্ধ নগ্ন মৎস্যরুপ শরীরে দিকে। সরু কোমর হতে মাছের লেজ বেয়ে নেমে গেছে আর উপরের অংশটুকু ঠিক যেন পাতলা ফিনফিনে সিল্কের নীল শাড়ি পরা আমার কেয়ার অবয়ব। আমি কাছে যেতেই লজ্জায় লাজুক হয়ে পরল সে। আমি এমন স্বর্গীয় রূপ এর আগে কখনো দেখিনি। পেছন হতে দৌরে হারডিং এসে জড়িয়ে ধরল কেয়াকে। আদর করে চুমু খেল ওরা দুজন দুজনাকে। অনেক্ষন ধরে চলল সেই ভেজা পরিবেশে দুটি ভিন্ন স্বত্বার প্রনয় লীলা। আমি বাধ্য হয়ে চলে এলাম সেখান থেকে ঘরের ভেতর। আর সিধ্যান্ত নিলাম কালই ফিরে যাব এখান থেকে ঢাকায়। সকাল বেলা হারডিং ফিরে এলো ঘরে। আমার গোছ গাছ দেখে হাসছে সে বলল শোন কাণ্ডারী অথর্ব তোমার যাওয়া এত শীঘ্রই হচ্ছেনা। আমি ভীষণ অসুস্থ হয়ত আর বেশী দিন বেঁচে থাকা হবেনা। আমাকে এক মরন ব্যাধিতে পেয়েছে। কিন্তু এই কেয়ার জন্য আমি মরে যাওয়ার আগে একটি গতি করে দিয়ে যেতে চাই। তুমি আমার খুব ভাল একজন বন্ধু। আমি জানি তুমি কেয়াকে ভালবাসবে আমার চেয়েও অনেক অনেক বেশী। তাই মৃত্যুর আগে আমি তোমার কাছে কেয়াকে তুলে দিয়ে যেতে চাই। কেয়ার জন্য না হোক অন্তত তোমার এই বন্ধুটির জন্য হলেও তুমি ওর সকল দায়িত্ব নাও তোমার কাছে মৃত্যুর আগে একজন বন্ধুর কাছে একজন বন্ধুর জীবনের শেষ চাওয়া। আমি বলছি হারডিং এটা তোমার পুরোপুরি পাগলামি । মানলাম আমি কেয়ার সকল দায়িত্ব নেব কিন্তু কিভাবে হবে সেটা। কেয়াকি আমার সাথে সমুদ্র ছেড়ে সভ্য পৃথিবীতে যেয়ে বাস করতে পারবে। হারডিং বলল না তাকিকরে হয় বরং তোমাকেই এখানে থেকে যেতে হবে। না সেটা কি করে সম্ভব। সম্ভব তোমার জন্য কেয়া বাইরে সমুদ্রের কাছে অপেক্ষা করছে যেয়ে দেখ ওই নিষ্পাপ মুখটির দিকে তাকিয়ে কি বলতে চাইছে সে তোমাকে। অসম্ভব হারডিং তোমার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। তুমি সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে গেছ। একজন মানুষ কখনো একজন মাছের সাথে তাও আবার অর্ধ মাছ আর অর্ধ মানুষের সাথে সম্পর্ক করতে পারেনা। এখানে প্রাকৃতিক জৈবিকতার সংমিশ্রণ সম্ভব নয়। এটা হবে জীবন যাপনের জন্য শুধুই ব্যাঞ্জনা। ধর আমি পানির নিচে থাকতে পারবনা বেঁচে থাকতে সেও পারবেনা ডাঙ্গায় উঠে এসে বেঁচে থাকতে। আমাদের খাবার ধারনের রুচি ভিন্ন। তারপর যৌনতার কোন ধরন সেখানে বিদ্যমান হবেনা। হারডিং এবার আমাকে পুরো চমকে দিয়ে যা বলল সেটার জন্য হয়ত পৃথিবীতে কোন ব্যাখ্যাই দ্বার করান সম্ভব হবেনা। আমি কেয়া নামের যে মেয়েটিকে এতদিন যাবত ভালোবেসে এসেছি । যাকে না পাওয়ার যন্ত্রণা আজীবন আমি বুকের ভেতর লালন করে আসছি যার ভালোবাসা পেলে আমি মরেও শান্তি পাব এমন রোজ রোজ বেঁচে থাকা জীবিত লাশেদের ভিড়ে সেই কেয়াই হচ্ছে এই মৎস্যকন্যা কেয়া। আর আমি যাকে ঢাকায় রাতে দেখে এসেছি সেটা আমার মনের একটা নিছক মরীচিকা একটা কল্পনা। আমার প্রফেসর হারডিং এর কথা বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু ততক্ষনে ধূপের ধোঁয়ায় আমি আচ্ছাদিত হয়ে পরলাম ধীরে ধীরে। যখন জ্ঞান ফিরে পেলাম নিজেকে আবিষ্কার করলাম গভীর সমুদ্রের ভেতর আমি শুয়ে আছি। আমি নিজেও হয়ে গেছি একজন মৎস্যপুরুষ। আমার চারদিকে ঘিরে রয়েছে উজ্জ্বল গোলাপি আলোয় জ্বল জ্বল করে জ্বলতে থাকা রশ্মি গাছের পাতা আর ফুলগুলো। আমার চারদিকে শুধু নীল রঙের পানি আর পানি আর আমার পাশেই বসে আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে অত্যন্ত যত্ন নিয়ে আমার ভালোবাসার কেয়া, আমার জলদেবী।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০১৫ রাত ১১:৫৯