সফির আজ অনেক দিন পর সকালে ঘুম হতে উঠেই মনটা খুসিতে ভরে রয়েছে। ভোর বেলাই মা আদর করে কপালে চুমু দিয়ে ঘুম হতে ডেকে তুলেছেন আর কথা দিয়েছেন আজ খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসবেন। বাড়ি ফিরে আসার সময় সফির জন্য খেলনা কিনে আনবেন। আজ সফির জন্মদিন। সফিকে পায়েস রান্না করে দিয়ে তার মা যূথী চলে গেলেন কাজ করতে। যূথী সাভারে রানা প্লাজায় গার্মেন্টসে সেলাইয়ের কাজ করেন। স্বামী একসময় রিক্সা চালাত। বছর দুই হল যৌতুকের তাড়নায় দ্বিতীয় বিবাহ করে চলে গেছে অন্যত্র। যূথী আর তার ছেলের কোন খোঁজ রাখার প্রয়োজন অনুভব করেনি সে। এই নিয়ে যূথীর মনে কোন ক্ষোভ নেই। মাঝে মাঝে শুধু তার পাঁচ বছরের ছেলেটির যখন বাবা কোথায় জানতে চেয়ে চোখের সীমানায় অঝরে অশ্রু নেমে আসে তখন যূথী শুধু তাকে গালে চড় দিয়ে মিছে শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করেন। আজ তার ব্যাতিক্রম ঘটাতে সফি আনন্দে মাকে বিদায় জানাল। মায়ের কপালেও চুমু দিতে ভুল হলনা আজ তার। মা চলে যাওয়ার পর খেলনার নেশা তাকে তার বাবার অভাব বোধ ভুলিয়ে রাখল। খুব প্রশান্তি নিয়ে আবারো ঘুমিয়ে পরল সে।
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সফি স্বপ্নে দেখল তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়েছে। তার কণ্ঠ চেপে ধরা হয়েছে। কোন রকম সাহায্য সে চাইতে পারছিল না। শুধু গোঙ্গাছিল !!! ঘুম ভেঙ্গে যায় বস্তিতে রাহেলা খালার আর্তনাদে। সফি টের পায় সে জীবিত আছে। তাহলে কি সে এতক্ষন জীবিত লাশ হিসেবে ছিল।
তার কানে শুধু ভেসে আসছে রাহেলা খালা বিলাপ করছেন রানা প্লাজায় যখন উদ্ধার কাজ চলছে তখন অদূরে দাড়িয়ে থাকা মানুষেরা বলছিলেন জীবিত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। সফির মনে অজানা এক শঙ্কা এসে বাসা বাধে। মুহূর্তেই তার মনের সকল আনন্দ সকল খুসি বিষাদে ভরে উঠে যেমনটা বিষাদময় হয়ে উঠেছিল বাবা চলে যাওয়ার পর। তার মাও সেখানে কাজ করেন। মুহূর্তের মধ্যে সফির দুই চোখে অশ্রু নেমে আসে। সে দৌড়ে রাহেলা খালার কাছে এসে তার মায়ের খোঁজ জানতে চায়। রাহেলা খালা তার আপন কেউ নন । বস্তিতে থাকেন ছোট একটা টং দোকান চালান। তার মা যখন কাজে চলে যান তখন এই খালাই তাকে দেখা শোনা করেন। খালা তাকে ভরসা দেয়ার চেষ্টা করেন যে তার মা ফিরে আসবেন। কিন্তু প্রায় এক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। এখনো সফির মায়ের কোন সন্ধান পাওয়া যায় নি। সফি তার খালার হাত ধরে মায়ের ছবি বুকে নিয়ে দাড়িয়ে আছে ধ্বংস স্তূপের উপর। কখন তার মাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা হবে। অনেক মানুষ জীবিত অথবা মৃত উদ্ধার হচ্ছে কারো আবার হাত-পা অথবা কারো চোখ কেটে গেছে, কারো আবার ভেঙ্গে গেছে মেরুদণ্ড। তারা কেউ যূথী নন। তারা সবাই হলেন যেন এক একটি জীবিত লাশ। আর মৃতদের ভিড়ে সফির কান্নার নোনা অশ্রু শুধুই যেন মিছে প্রলোভন।
সফির এখন খেলনা চাইনা। চাই তার মায়ের আঁচলের সেই আদর মাখা পরশ। চাই বেঁচে থাকার শেষ আশ্রয়টুকু। নাকি তাকেও এখন হতে বেঁচে থাকতে হবে জীবিত লাশ হয়ে আমরা যারা মৃত হয়ে ঘুমিয়ে থাকতে পছন্দ করি জীবনের বেঁচে থাকার মোহে ক্লান্তি নিয়ে। জীবনের গ্লানিটুকু কি আমরা মুছে দিতে পারিনা সফির মত জীবিত লাশদের জীবন থেকে।
টেলিভিশনে যখন কোন লাইভ খেলা সম্প্রচার হয় তখন অনেক চ্যানেলেই দেখা যায় যে উপরের এক কোনায় স্কোর দেখাতে থাকে। সাভার রানা প্লাজা ধ্বংসের পর দেখলাম ঠিক তেমনি দেখাচ্ছিল কতজন জীবিত আর কতজন মৃত লাশ উদ্ধার হচ্ছিল। কিন্তু আমি তখন শুধুই ভাবলাম এত কোন স্কোর নয় এ যেন এক একজন মৃত লাশের সংখ্যা বাড়ছে আর এক একটি সফির জীবনের অনিশ্চয়তার সংখ্যাই শুধু বাড়ছে। এইত কিছুদিন আগে আমার ছেলেটির জন্মদিন চলে গেল। আমি ওকে একটি খেলনা কিনে দিয়েছিলাম। আজ যখন লেখাটি লিখছি তখন হঠাৎ করেই মেঝেতে পরে থাকতে দেখলাম খেলনাটি। হাতে তুলে নিয়ে ভাবলাম আহারে কত সুখেইনা আছে আমার ছেলেটি। হয়ত কখনো সে জানবেনা তার বয়সী ছেলেটিও হয়ত এমন একটি খেলনার জন্য কি অদ্ভুত এক আশায় স্বপ্ন দেখে কাঁদছে। হয়ত যেদিন আমিও জীবিত লাশ হয়ে যাব সেদিন আমার ছেলেটিও খেলনা হাতে নিয়ে আমার প্রতিক্ষায় দুচোখে অশ্রু নিয়ে দরজায় অধীর প্রতিক্ষায় দাড়িয়ে থাকবে।
হাসপাতালের করিডোরে বসে কাঁদছে সাজু। হাতে একটি প্লাস্টিকের খেলনা মাছ। লাল, নীল, হলুদ বাহারি রঙের খেলনা মাছটির দিকে তাকিয়ে সাজু ভাবছে জীবনটা কেন এমন রঙিন হলনা। যদি তার এই সাদা কাল জীবনটা রঙিন মাছটির মতই হত তবে কতইনা ভাল হত। বাবা মা কেউ বেঁচে নেই। মায়ের কথা মনে আছে কিন্তু বাবার কথা তার আজ আর মনে পরেনা। দুটি বোন রিমি আর নিপার কাছেই তার বেড়ে ওঠা। দুই বোনের একমাত্র আদরের ছোট ভাইটিকে আজ আর আদর করে ভাত মুখে তুলে খাইয়ে দেয়ার কেউ রইল না। কখনো সাজুকে ভাত খাওয়ার জন্য ভিন্ন করে থালা নিতে হয়নি। দুই বোনের হাতে ভাত খেয়েই তার এত দিন জীবনের এতগুলো বছর পার হয়েছে। তাই অভ্যাসটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে। আর তাইত গত সাত দিন ধরে প্রায় না খেয়েই তার জীবনটাও যেন হয়ে গেছে একটি জীবিত লাশের মতই। এক বোন নিপা চলে গেছে না ফেরার দেশে চির বিদায় নিয়ে যাওয়ার আগে আদরের ছোট ভাইটিকে কপালে চুমু দিয়ে যেতে পারেনি। আর এক বোন রিমি মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙ্গে চির দিনের জন্য বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে রয়েছে। ডাক্তাররা বলেছেন এভাবেই হয়ত বাকিটা জীবন কেটে যাবে রিমির জীবিত লাশ হয়ে।
কিছুক্ষন বসে থেকে জীবনের অনেক হিসেব মেলাতে না পেরে অগ্যতা গায়ের জামা দিয়ে অশ্রু ভেজা দুই চোখ মুছে নিল সাজু পাছে বোনের কাছে ধরা খেয়ে যেন বোনকে মানসিক ভাবে দুর্বল না করে দেয়। না হলে যে তার কারনে তার এই একমাত্র বোনটিও চলে যাবে না ফেরার দেশে। না সেটা সাজু বেঁচে থাকতে হতে পারেনা। এক বোনকে সে ধরে রাখতে পারেনি কিন্তু তার এই বোনটিকে সে কিছুতেই হারাতে দিতে চায় না। তবু মনে সান্তনা নিল সে যে মৃত লাশ নয় জীবিত লাশ হয়েই বেঁচে থাকুক তার এই বোনটি। যে সাজু এতদিন বোনের হাতে ভাত খেয়ে বড় হয়েছে আজ তাকেই নিজে না খেলেও বোনের মুখে ভাত তুলে দিতে গিয়ে কখন যে চোখের কোনে অশ্রু নেমে এসেছে সাজু টের পায়নি। রিমি হাত দিয়ে ছোট ভাইটির চোখের অশ্রু মুছে দিয়ে নিজেও কেঁদে ফেলল। সে কান্না আমার মতন একজন অধম মানুষের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব হলেও মেনে নেয়া সম্ভব নয় সাজুর মত এক ছোট শিশুর পক্ষে যে কিনা নিজেও হয়ে গেছে এক জীবিত লাশ।
সাভারে ধসে পড়া ভবনে ধ্বংসস্তুপে এভাবেই ঝুলে আছে শত শত হাত পা মাথার খুলি। লাশগুলো পচে গলে ছিন্নভিন্ন হয়ে মিশে গেছে আবর্জনার মাঝে। লাশ গুম কেন করতে হবে? ধ্বংস্তুপের সাথে মিশিয়ে দিলেই তো হলো।
মিশেও গেছে অনেকের লাশ। কি চমৎকার তাই না!!!!