একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের সদস্যদের ধরে ধরে হত্যা করা হয়েছিল। সেসময় যে রাজাকার, আলবদর, আল শামস্ বাহিনী গঠন করা হয়েছিল, সেসব সংগঠনের সদস্যরা পাকবাহিনীকে সাহায্য করার পাশাপাশি ধারণা পোষণ করত দেশটা ভারত দখল করে নেবে। ইসলাম ধর্ম বেদখল হয়ে যাবে। ভারত ভেঙে পাকিস্তান যেহেতু দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগ হয়েছিল, পাকি মনোভাবাপন্ন লোকেরা এমনটা ভাববে; সেটাই স্বাভাবিক। তারা তো আওয়ামী লীগ করত না যে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে কথা বলবে।
মতাদর্শ যাই থাকুক না কেন, তারা যে পাকবাহিনীর দোসর ছিল, গণহত্যায় জড়িত ছিল এবং এসব যে অন্যায় ছিল সে কথা বলাই বাহুল্য। স্বাধীনতার পর তারা লেজ গুটিয়ে পালিয়েছিল। যে শাস্তি পাওয়া উচিত ছিল, সেটা তারা পায়নি। '৭৫ সালের পর আবার তারা পুরোদমে ফিরে আসে। এবং রাষ্ট্রীয় বড় বড় পদে আসীন হয়। যারা এ দেশটাই চায়নি, কী এক ট্রাজেডি; তারা এই দেশে দাপটের সাথে রাজনীতি করেছে। মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীও হয়েছে।
পূর্ব পাকিস্তানের লোকজন বেশিরভাগ মুসলিম ছিল, পশ্চিম পাকিস্তানের লোকজনও মুসলিম (যদিও এদেশের মুসলিমদের পাকবাহিনী মুসলিম ভাবত না।), তবুও পাকিস্তানি সামরিক জান্তা গণহত্যা চালাতে একবারও ভাবেনি। ন্যূনতম মানবিকতা দেখায়নি। নারী-শিশুদেরও ছাড় দেয়নি যারা কোনোভাবেই যুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত ছিল না।
এর পর ৫ দশক চলে গেছে। একাত্তরে গণহত্যার নেপথ্যে যে ধর্মের জুজু ছিল; এখনও ধর্মের বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়েছে। সেই যে রাজাকার, আলবদর, আল শামস্ ছিল তাদের বংশধরেরা এখন হা-হুতাশ করছে দেশে গণতন্ত্র নেই, বাক-স্বাধীনতা নেই বলে। তারা মুক্তিযুদ্ধকে স্ক্যাম বলে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তাদের কাছে অহেতুক মনে হয়। যুদ্ধে পরাজিত হলে পৃথিবীর কোনো দেশে পরাজিতরা লাফাতে পারে না, কিন্তু এদেশে পারে। কারণ কি শুধুই ধর্ম? নাকি পাকিস্তান ভাঙার জ্বলুনি এখনও কমেনি?
বাংলাদেশ এখন যে অবস্থায় আছে তা অবশ্যই পাকিস্তানের চেয়ে ভালো। আরও ভালো থাকতে পারত। কেন থাকা যায়নি সে নিয়ে কথা হতে পারে, ক্ষমতাসীনদের নিয়ে সমালোচনা করা যেতে পারে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকে তিরস্কার করার সাহস এরা কোথা থেকে পায়?
রাজাকারের বংশধরদের সাথে কিছু ধর্মান্ধ এমনভাবে মিশে গেছে, এরা মনে করে দেশকে গালি দিলে ধর্ম রক্ষাও হয়। অথচ পৃথিবীর কোনো দেশে এমন হয় বলে শোনা যায়নি। কোনো দেশে নিজের দেশের সাথে অন্য দেশের খেলা হলে নিজের দেশের পরাজয় কামনা করা হয় বলে মনে হয় না (সম্প্রতি ফিলিস্তিনের সাথে বাংলাদেশের খেলায় অনেককে দেখা গেল ফিলিস্তিনের সমর্থনে কথা বলতে।)।
একবার এক জাপানিকে বলা হয়েছিল, যদি স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ জাপান আক্রমণ করে, আপনারা কী করবেন? উনি বলেছিলেন, উনাকে হত্যা করে তারপর পূজা দেব। এমন মনোভাব যদ্দুর জানা যায় রাশিয়ানদেরও আছে। অথচ বাঙালি হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে আছে শুধু ধর্মীয় উন্মাদনা; এদের মধ্যে জাতীয়তাবাদ নেই, দেশপ্রেম নেই।
জাতীয়তাবাদের সাথে ধর্মের মিশ্রণ কেবল ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোই করে থাকে; এতে করে সাধারণ মানুষ দ্বিধায় পড়ে যায় কোনদিকে যাবে। ধর্ম থাকবে ধর্মের জায়গায় আর রাজনীতি রাজনীতির জায়গায়; এই সহজ হিসেব কষতেও অনেকের কষ্ট হয়ে যায়।
বাংলাদেশ নিশ্চয়ই ধর্মের ভিত্তিতে স্বাধীন হয়নি? স্বাধীনতার নেপথ্যে যেমন ছিল রাজনৈতিক মুক্তি, পাশাপাশি ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি। এসব কতটুকু অর্জন হলো সে আলোচনা বাদ দিয়ে এখন চলে 'দেশ স্বাধীন হয়ে কী লাভ হলো', 'মুক্তিযুদ্ধ ছিল স্ক্যাম'- এসব আলোচনা। এসব আলোচনাও মানা যেত যদি দেশপ্রেমিক কেউ এসব আলোচনা করতেন, কিন্তু এসব আলোচনা করে তারা যারা স্বাধীনতাই চায়নি। ব্যাপারটা গোলমেলে হয়ে যায় না?
যারা এসব আলোচনা করে, তাদের নেতারা যেহেতু স্বাধীনতার সরাসরি বিপক্ষে ছিল তারা এমন একজনকে আদর্শ হিসেবে সামনে হাজির করে যিনি আবার মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধার দলের লোকজন আবার রাজনৈতিক মিত্রতার বশবর্তী হয়ে হোক আর ধর্মের জোশে হোক স্বাধীনতার বিরোধীদের সাথে একাট্টা। একটি রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠাতা যদি মুক্তিযোদ্ধা হন, তার অনুসারীরা কেমনে স্বাধীনতাবিরোধী হন? ওই মুক্তিযোদ্ধা কি আসলেই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন? একজন সেক্টর কমান্ডার মুক্তিযুদ্ধের পর মুক্তিযুদ্ধ করা নিয়ে হতাশায় ভুগতেন। উনার মৃত্যুও হয়েছিল পাকিস্তানে। তাহলে কি ধরে নেব বিশেষ ওই মুক্তিযোদ্ধাও যুদ্ধ করা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে ছিলেন। ঘটনাক্রমে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন?
যদ্দুর জানা যায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনকে বাগে না পেয়ে আওয়ামী লীগের বিরোধী লোকজনকে নিয়ে উনি দল গঠন করেন। সাথে যুক্ত হয় রাজাকার-আলবদররাও। শুধু রাজনৈতিক সুবিধার্থে একজন মুক্তিযোদ্ধা তো এমন করার কথা না। তাহলে এর নেপথ্য কারণ কী? উনিও কি যুদ্ধ করা নিয়ে হতাশায় ছিলেন? সেটা ভাবাও অমূলক নয়। উনি দেশটাকে মোটামুটি পাকিস্তানি মতাদর্শে দাঁড় করিয়ে ফেলেছিলেন। উনার অনুসারীরা একই গান গেয়ে চলেছে।
যে দিন এসেছে, রাজনৈতিক ক্যাচালের পাশাপাশি ধর্মীয় ক্যাচালও উন্মাদনা ছড়াচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধাদের অবমূল্যায়ন এখন ডাল-ভাত। এসব পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কী। ক্ষমতাসীনরা দাবি করে তারা স্বাধীনতার ধারক ও বাহক। তো সামাজিক অবক্ষয় নিয়ে তাদের ভাবনা কী? জোর করে ক্ষমতায় থাকলে আদৌ কি পরিস্থিতি বদলাবে? স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে থামিয়ে সামনে এগোনোর ব্যাপারে তাদের পদক্ষেপ কী কী?
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৬