গত দুই তিন শত বছরের ইতিহাসে দেখা গেছে যে ভূখণ্ড নিয়ে আজকের এই বাংলাদেশ রাষ্ট্র সেখানে ও তার আশপাশ অঞ্চলে এবং পাশের বঙ্গোপসাগরে ছোট বড় অসংখ্য ভূমিকম্প হয়েছে। তাতে কমবেশি জানমালেরও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।আর এটে সিসমোলোজিস্টরা ধারণা করছেন ওই অঞ্চলের রিক্টার স্কেলে ৮ ৯ মাত্রার আরেকটা বড় ধরনের ভূমিকম্প যেকোনো সময় হানা দিতে পারে যার ধ্বংসলীলা থেকে বাংলাদেশ যে রেহাই পাবে তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। এ ব্যাপারে পত্রপত্রিকা ব্লগ এবং ওয়েব সাইটগুলোতে নিয়মিত লেখালেখিও হচ্ছে। ভূমিকম্পের প্রস্তুতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজে হাত দিয়েছে। কিন্তু জনগণ এখনো ভূমিকম্পের ব্যাপারে মূলত গাফেল আল্লাহ না করুন যদি অঘটন ঘটেই যায় তাহলে দুর্যোগ উত্তরণে প্রস্তুতি এখনো পুরো দেশেই সন্তোষজনকপর্যায়ের অনেক নিচে। সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে ভূমিকম্প সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির উপায় এবং কৌশল নিয়ে কিছু লেখার ইচ্ছে আছে। বাংলাদেশে ভূমিকম্পের আগাম প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন । বড় মাপের ভূমিকম্প একটা মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ যা প্রতি বছর পৃথিবীর কোথাও না কোথাও নিয়মত আঘাত হানছেই এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও ধ্বংসলীলার চিহ্ন রেখে যাচ্ছে। এর কবলে পড়লে দুর্ভোগ থেকে রেহাই পাওয়ার কোনো উপায় নেই। তবে সঠিক পূর্বপরিকল্পনা এবং ভালো প্রস্তুতি থাকলে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি এবং জনদুর্ভোগ অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
ভূমিকম্পের পূর্বপ্রস্তুতি দুই ধরনের হতে পারে। একটি প্রাতিষ্ঠানিক এবং রাষ্ট্রীয়পর্যায়ে সরকারি প্রস্তুতি ও আরেকটি ব্যক্তিগত এবং পারিবারিকপর্যায়ে সাধারণ জনগণের প্রস্তুতি। এখানে থাকছে পারিবারিকপর্যায়ে সাধারণ জনগণের প্রস্তুতির বিষয়টি। পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহে সাধারণ জনগণ ভূমিকম্পের প্রস্তুতি নিয়ে থাকে তিন স্তরে। প্রথম স্তরে থাকে ভূমিকম্প ঘটে যাওয়ার আগের করণীয় দ্বিতীয় স্তরে থাকে ভূমিকম্প চলাকালীন সাবধানতা এবং শেষ স্তরে থাকে ভূমিকম্পের পরে কী কী করতে হয় তার ফিরিস্তি। আজকের আলোচনা অবশ্য ভূমিকম্পের আগে কী করণীয় তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। পরিবারের সবাইকে জানিয়ে রাখা দরকার ভূমিকম্পের সময় যারা ঘরে থাকবে তারা কিভাবে ঘর থেকে বেরোবে এবং যারা ঘরের বাইরে অথবা অন্য কোথাও আটকা পড়বে তাদের সাথে পরিবারের অন্য সদস্যদের কোথায় ও কিভাবে যোগাযোগ হবে- তার সুষ্ঠু পরিকল্পনা করে পরিবারের সব সদস্যকে জানিয়ে রাখা প্রয়োজন। যেকোনো কারণে সরাসরি নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে না পারলে নিজ শহরের ভেতরে ও বাইরে এক বা একাধিক জায়গায় নির্দিষ্ট আত্মীয়স্বজন অথবা বন্ধুবান্ধবের সাথে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সবার যোগাযোগ করা উচিত। এতে পরিবারের সব সদস্য পরস্পরের অবস্থা আর অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবে।
যেসব সিঙ্গল ইউনিট বাড়িঘরে, অথবা বহুতল ভবনের ফ্ল্যাটে আপনি থাকেন, তাদের বাসস্থান উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পের জন্য কতটা নিরাপদ। দালানগুলো যদি নতুন হয় সেগুলো ভূমিকম্প কোড মেনে নির্মাণ হয়েছে কি না তার খোঁজ নেয়া উচিত। না হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাড়ির মালিকদের সংশ্লিষ্ট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি সংস্থার সাথে যোগাযোগ করা প্রয়োজন। দালানকোঠা যদি বেশি পুরনো হয় তা হলে তা ভেঙে ভূমিকম্প কোড মেনে নতুন ঘর বানানোর জন্য দেরি না করে দীর্ঘ অথবা মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। পুরান ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ বাড়িঘর ভেঙে ভূমিকম্প কোড মেনে নতুন বাড়ি বানানোর জন্য সরকারের উচিত, এখন থেকে নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা।
বাড়িঘর, আশপাশ এবং রাস্তাঘাট যতদূর সম্ভব পরিচ্ছন্ন ও জঞ্জালমুক্ত রাখা উচিত, যাতে দুর্যোগের অবস্থায় মানুষ এবং যানবাহন চলাচল সহজ হয়। ঘরে এবং কাজের জায়গায় নিরাপদ আশ্রয়স্থল দেখে রাখা প্রয়োজন। ঘরে এবং কাজের জায়গা থেকে জরুরি অবস্থায় দ্রুত নিরাপদে বেরোনোর পথ চিনে রাখা দরকার। ঘরের পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ লাইন বন্ধ করার সুইচ কোথায় কোথায় আছে এবং কিভাবে সেগুলো অন-অফ করতে হয় তা সবার জেনে রাখা উচিত। নিকটবর্তী থানা, ফায়ার স্টেশন, হাসপাতাল অথবা ক্লিনিক চিনে রাখা নিতান্তই প্রয়োজন।
ঘরের ভেতর জিনিসপত্র রাখার তাকগুলোয় দেয়ালের সাথে সেঁটে অথবা বেঁেধ রাখা প্রয়োজন। ভারী জিনিস নিচের তাকে আর কাচের বাসন নিরাপদ জায়গায় অথবা ক্যাবিনেটের ভেতর বন্ধ করে রাখা দরকার। দেয়ালের ছবি নিরাপদ দূরত্বে টানিয়ে রাখা উচিত। ছাদের লাইট এবং ফ্যান ফিক্সার সিকিউরড আছে কি না তা পরখ করা দরকার। ত্রুটিযুক্ত পানি, গ্যাস ও বিদ্যুতের লাইন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মেরামত করে ফেলা দরকার। ঘরের কোথাও ফাটল থাকলে তা মেরামত করতে দেরি করা উচিত নয়। প্রতিটি রুমে, ভূমিকম্পের সময় আশ্রয়ের জন্য, চৌকি, খাট অথবা মজবুত টেবিলের তলা পরিচ্ছন্ন থাকা উচিত। ঘরে বা গ্যারেজে দাহ্য পদার্থ থাকলে তাকে নিরাপদে রাখতে হবে, যাতে আগুন না লাগে।
যদি ঘর থেকে বেরোনো না যায় তাহলে নির্দেশাবলি শোনার জন্য বাড়তি ব্যাটারিসহ একটি ট্রেনজিস্টার দরকার। ঘরে আটকা পড়লে অন্তত কয়েক দিনের খাদ্য, পানীয়, ওষুধসহ অতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের একটা জরুরি বাক্স তৈরি করে পরিবারের সবাইকে জানিয়ে ঘরে নিরাপদ জায়গায় রাখা উচিত। এ জরুরি বাক্সে থাকবে। ডিসপোজেবল ভেজা টাওয়েল, তুলো, ব্যান্ড এইড, এন্টি সেপটিক ফ্লুইড, ব্যান্ডেজের জন্য গজ কাপড়, নিত্য ব্যবহারের পর্যাপ্ত অষুধ, জনপ্রতি পাঁচ গ্যালন করে বোতলের পানি, পানি বিশুদ্ধকরণ বড়ি, পাউডার দুধ, শুকনো খাবার, বাড়তি ব্যাটারিসহ টর্চ লাইট, পর্যাপ্ত টাকা, দিয়াশলাই, মোমবাতি, ফেস মাস্ক, ভারী গ্লাভস, সান গ্লাস, হাতুড়ি, পাইপ রেঞ্চ, প্লার্য়াস, সুঁই, সুতো, ছুরি, কাঁচি, আগুন নেভানোর যন্ত্র, আটকা পড়লে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য হুইসেল ইত্যাদি। ঘর থেকে বেরোতে পারলেও রাস্তায় দীর্ঘ পথ হাঁটার উপযোগী জুতো থাকা বাঞ্ছনীয়। প্রতিবেশীদের সাথে ভালো সম্পর্ক ও ভালো যোগাযোগ রাখা দরকার, যাতে বিপদের সময় একে অপরকে সাহায্য করতে পারে।
এসব প্রস্তুতির কথা মিডিয়া শিক্ষা এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, পেশাজীবী সভা-সমাবেশ, গণজমায়েত ও রাজনৈতিক সমাবেশের মাধ্যমে সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়া উচিত। একটা কথা মনে রাখা উচিত প্রচারণার মাধ্যমে একটি জীবনও যদি রক্ষা পায়, তাইবা কম কী? আল্লাহ্ তালা পবিত্র কুরআন শরিফে বলেননি? যে ব্যক্তি একটা জীবন বাঁচাল, সে যেন সমস্ত মানব জাতিকেই বাঁচাল...।’
তথঃ অনলাইন নিউজ
কৃতজ্ঞতাঃ এই লেখাটির লেখক অধ্যাপক, টেনেসি স্টেইট ইউনিভার্সিটি ।
এবং এডিটর জার্নাল অব ডেভলাপিং এরিয়াজ ।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০১৬ সকাল ১০:৫৩