কেন লেখেন?-- প্রতিটি লেখকই জীবনের কোনো-না-কোনো সময়ে এই অতি প্রচলিত প্রশ্নের মুখোমুখি হন। একটা কিছু উত্তরও দেন তাঁরা, আর এভাবে অনেক কথাই বলা হয়েছে। কিন্তু একজন লেখক লেখেন কেন,তার কোনো সর্বজনগ্রাহ্য সদুত্তর আজ পর্যন্ত যায়নি।
লেখালেখি ব্যাপারটি একজন লেখকের জন্য কঠিনতম শাস্তি (ভুলে যাচ্ছি না এটা তার জন্য এক গভীরতম আনন্দও বটে)-- লিখতে শুরু করার পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত, এমনকি মৃত্যুর পরও, অভিশাপের মতো এই শাস্তি তাকে বহন করে যেতে হয়।
কি রকম?
প্রথমেই আসে একটি লেখাকে 'লেখা'র মর্যাদায় নিয়ে যাওয়ার প্রশ্ন। যেনতেন প্রকারে হেনতেন কিছু একটা লিখলেই তো হলো না! লক্ষ-কোটি লেখার মধ্যে থেকে তার লেখাটি 'বিশেষ' হয়ে ওঠার ব্যাপার আছে এখানে! একজন তরুণ লেখকের কথা ভাবুন-- খামোখাই নিজের কাঁধে কী কঠিন দায়িত্ব তুলে নিয়েছে বেচারা! প্রশ্ন হচ্ছে-- কেউ তো তাকে বলেনি অমন একটি দায়িত্ব নিতে-- স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সে তা নিলো কেন? এখানেই শেষ হলেও না হয় কথা ছিলো, শেষ তো নয়ই, বলা যায় তার যন্ত্রণার শুরু হলো মাত্র। কারণ-- চাইলেই তো আর লেখা হয় না, লেখার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। অপেক্ষা না বলে সাধনাও বলা যায়! 'আমার সকল লয়ে বসে আছি'র মতো অপেক্ষা। এ-ও কি কম কষ্টের? পৃথিবীতে কত আনন্দদায়ক ঘটনা আছে, উজ্জ্বতম বস্তু আছে-- সেগুলোর জন্য অপেক্ষা করাও আনন্দের। অপেক্ষা করা ভালো প্রেমের জন্য, ভালো অর্থ-কীর্তি-স্বচ্ছলতার জন্য অপেক্ষা, সেসবের জন্য না করে কেউ কেউ কেন লেখার মতো একটি 'বিপন্ন বিস্ময়ের' জন্য অপেক্ষা করেন কে জানে! কিন্তু এখানেও শেষ নয়। ধরা যাক, লেখা এলো, লেখক তার সাধ্য-অনুযায়ী লিখেও ফেললেন-- তারপরই শুরু হয় লেখক স্বভাবের সঙ্গে যায় না এমন সব বিষয়ের উৎপাত। যেমন, লেখাটি প্রকাশ করা। একজন সত্যিকারের লেখকের জন্য সম্পাদকের মতো ভীতিকর প্রাণী আর কি হতে পারে? অথচ তাঁকে সেটিরও মুখোমুখি হতে হয়! আর যদি ভুলক্রমে একটি বই তাঁর প্রকাশিত হয়েই পড়ে, তাহলে নিয়তি-নির্ধারিত অভিশাপের মতো তার দায় তাঁকে সারাজীবন ধরে বহন করে যেতে হবে! বই হচ্ছে লেখকের জন্য একটা ফাঁদ-- সারাজীবন ধরে, এমনকি মৃত্যুর পরও, সমালোচিত হওয়ার জন্য একটা স্বেচ্ছাকৃত ব্যবস্থা। একজন লেখককে অনিবার্যভাবেই এক বা একাধিক গ্রন্থের জনক হতে হয়, আর একেকটি বইয়ের পেছনে থাকে তাঁর যন্ত্রণাদগ্ধ হবার ইতিহাস, থাকে অপেক্ষা ও সাধনার ইতিহাস, থাকে অবিরল রক্তক্ষরণের গল্প, কিন্তু তাঁর এতসব রক্তক্ষরণের খবরই নেয় না কেউ (এ-কি তাহলে অভিশাপ নয়?)। 'কিচ্ছু হয়নি' বলে খারিজ করে দেবার মতো বহু 'জ্ঞানী' লোক তাঁর আশেপাশেই ঘুরঘুর করে।
তারপরও মানুষ লেখে কেন? লেখকদের কথাবার্তা বিচার-বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়-- এঁদের প্রায় প্রত্যেকে ছোটবেলায় পড়ুয়া ছিলেন-- মানে বইয়ের পোকা ছিলেন। পড়তে পড়তেই তাঁরা একসময় লেখার তাগিদ অনুভব করেছেন। এ কথা সবাই জানেন, অভিজ্ঞতা দু-ধরনের-- প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা মানুষ অর্জন করে নিজের জীবন থেকেই। দৈনন্দিন জীবনযাপন, নানাধরনের সম্পর্ক, নিজের জীবনের বাইরেও অন্যান্য মানুষের জীবন, পরিপার্শ্বের ঘটনাবলী ইত্যাদি থেকে যেসব অভিজ্ঞতা মানুষ অর্জন করে-- সেগুলো প্রত্যক্ষ। আর পরোক্ষ অভিজ্ঞতা? সেটা অর্জিত হয় বইপত্র, নাটক-সিনেমা, সঙ্গীত, চিত্রকলা ইত্যাদি থেকে। কিন্তু পরোক্ষ অভিজ্ঞতার প্রধান অংশটি অর্জিত হয় বই পড়েই। এই অভিজ্ঞতা আবার একজন মানুষকে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভের ব্যাপারে গভীরভাবে সহায়তা করে। সেটা কি রকম? বই আসলে মানুষের ভেতরের চোখ, অর্থাৎ অন্তর্দৃষ্টি, খুলে দেয়। ফলে একটি ঘটমান ঘটনা দেখে একজন অ-পড়ুয়া মানুষ সেটাকে যেভাবে উপলব্ধি করে, গ্রহণ করে, বিশ্লেষণ করে--পড়ুয়া মানুষটির উপলব্ধি-গ্রহণ-বিশ্লেষণ হয় তার থেকে পৃথক। শুধু পৃথক বললে কম বলা হয়-- এই উপলব্ধি অনেক গভীর, অতলস্পর্শী। এই উপলব্ধি তিনি অন্য কারো সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন, না-ও করতে পারেন। কিন্তু অভিজ্ঞতা হিসেবে এটা তার ঝুলিতে জমা পড়ে। এইভাবে অভিজ্ঞতাগুলো জমতে জমতে একসময় তা এত ভারি হয়ে ওঠে যে, যে-কোনো মানুষের পক্ষেই সেই ভার বহন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। একমাত্র অন্য মানুষের সঙ্গে শেয়ার করার মাধ্যমেই এই ভার থেকে খানিকটা মুক্তি পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সেই মানুষ কোথায় যে বসে বসে আপনার এতসব অভিজ্ঞতার কথা শুনবে? এত সময় কোথায় তার, দায়ই-বা কি? ফলে অভিজ্ঞতালব্ধ মানুষটিকে অভিজ্ঞতার অকথ্য যন্ত্রণা পোহাতে হয়। অভিজ্ঞতার যে যন্ত্রণা আছে, যত বেশি অভিজ্ঞতা তত বেশি যন্ত্রণা-- একথা অভিজ্ঞতালব্ধ মানুষমাত্রই জানেন। এই যন্ত্রণার লাঘব ঘটানোর জন্যই এর প্রকাশ জরুরী হয়ে পড়ে-- আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকাশটা ঘটে লেখালেখির মাধ্যমে। অন্যান্য মাধ্যমে এটা প্রকাশ করার সুযোগ কম।
তবে কি শুধুমাত্র যন্ত্রণালাঘবের জন্যই লেখকরা লেখেন, অন্য কোনো প্রাপ্তি নেই তাঁদের? আছে। গভীরতম এক আনন্দ আছে। সৃষ্টির আনন্দ। পৃথিবীতে সৃষ্টির আনন্দের চেয়ে গভীর, তীব্র কোনো আনন্দ নেই। সৃষ্টির মুহূর্তের চেয়ে উজ্জ্বলতম কোনো মুহূর্ত নেই মানুষের জীবনে। কোনোকিছুর সঙ্গেই এর তুলনা চলে না। এই তীব্র আনন্দের লোভ একজন লেখককে দিয়ে লিখিয়ে নেয়।
কিন্তু যন্ত্রণা লাঘব আর তীব্র আনন্দ লাভ-- এ দুটোই হয়তো সব নয়। সব মানুষের মধ্যেই অমরত্বের তৃষ্ণা আছে। মানুষ নিজেকে প্রবাহিত দেখতে চায়, বাঁচিয়ে রাখতে চায় তার পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে দিয়ে। লেখকরাও নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে চান তাঁদের লেখার মধ্যে দিয়ে।
তাহলে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি, তীব্র আনন্দ লাভ আর অমরত্বের লোভই কি সব? সম্ভবত এগুলোই প্রধান। তবে এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে অর্থ, যশ, খ্যাতি ইত্যাদির লোভও। এগুলো অবশ্য মূল নয়, কেবল অর্থের জন্য, যশের জন্য, খ্যাতির জন্য কারো পক্ষে ক্রমাগত লিখে যাওয়া সম্ভব নয়। সত্যি বলতে কি, শুধু এগুলোর জন্য একজন মানুষের পক্ষে লেখকই হওয়া সম্ভব নয়।
কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির কথাই এখনো আমি বলিনি। মানুষ লেখে তার আত্নতৃপ্তির জন্য। শুধু লেখকরা কেন-- দৈনন্দিন জীবনযাপনের বাইরে যারা অন্য কিছু করেন-- লেখালেখি, আঁকাআঁকি, সঙ্গীত চর্চা, নৃত্যচর্চা, অভিনয়, চলচ্চিত্র পরিচালনা, এমনকি রাজনীতিও-- তা ওই আত্নতৃপ্তির জন্যই করেন। এই তৃপ্তি মূলত জীবনকে খানিকটা অর্থময় করে তোলার আনন্দ থেকে উদ্ভুত। এই ধরনের একজন মানুষ-- স্বীকার করুন আর না-ই করুন, নিশ্চয়ই জানেন এবং মনে মনে হলেও মানেন যে, জীবন খুবই অর্থহীন একটা ব্যাপার। যাপনের জন্য যে একটিমাত্র জীবন সে পায় মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সেই জীবনের যাবতীয় অর্জন ও আয়োজন শেষ হয়ে যায়; আর কোনোকিছুই পাবার থাকেনা তার। অমরত্বের তৃষ্ণা সব মানুষের মধ্যেই আছে-- এ কথা ঠিক, কিন্তু মৃত্যুর পর সে এই অমরত্ব পেলো কি পেলো না, তাতে তার কিছুই যায় আসে না। এই কথাটি একজন বুঝে গেলে তার কাছে জীবনটা খুব ভারি হয়ে ওঠে, জীবনটাকে যাপনযোগ্য করে তোলা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। যাপনযোগ্য করে তোলার জন্য তার সামনে তখন একটি পথই খোলা থাকে-- জীবন যে অর্থহীন এই কথাটি ভুলে থাকা। কিন্তু চাইলেই তো ব্যাপারটা ভুলে থাকা যায় না! ভুলে থাকার জন্য একটি ঘোরলাগা সময় চাই। আর লেখকরা থাকেন সেই ঘোরলাগা সময়ের মধ্যেই। আমি একেই বলছি ধ্যান, বলছি মগ্নতা। এই সময়গুলোতে সৃষ্টিশীলতার চিন্তাই প্রধান হয়ে ওঠে তাঁর কাছে, অন্য সব যন্ত্রণা থেকে মুক্তি মেলে, অন্যসব আয়োজনের কথা ভুলে থাকা যায়।
জীবন যে অর্থহীন এই কথাটা ভুলে থাকার চেষ্টা করাকে কেউ কেউ অবশ্য পলায়নপর মনোবৃত্তি হিসেবে চিহ্নিত করতে পারেন। সেক্ষেত্রে আরেকটি কাজ করা যায়-- কথাটা সত্যি জেনেও-- ভাবনাটাকে উল্টে দেয়া যায়। ভাবা যেতে পারে-- প্রতিটি জীবনই ইউনিক, অনন্য-- একটু এদিক ওদিক হলে এই জীবনটির সৃষ্টি হতো না। এত অনন্য একটি ঘটনা অর্থহীন হতে পারে না। এবং সেই অর্থটা কী, সে ব্যাপারে প্রকৃতির মধ্যেই আছে ইঙ্গিত ও ইশারা। আছে এই ইঙ্গিত যে, এই সময়ে এই সমাজে আমার একটি ভূমিকা আছে। সেই ভূমিকা সবার জন্য একরকম হবে না, বলাইবাহুল্য, কিন্তু কী হবে সেটা খুঁজে বের করতে হবে আমাকেই। মানুষ সেই ভূমিকা রাখার জায়গাটি খুঁজে পায় সৃজনশীলতার নানা অনুষঙ্গে, কেউ কেউ এমনকি রাজনীতিতেও। (আমি অবশ্যই অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতা আর হালুয়া-রুটি ভাগাভাগির যে রাজনীতি তার কথা বলছি না, বলছি সেই রাজনীতির কথা যা সমাজটাকে পাল্টে দেবার স্বপ্ন দেখায়, দেশ ও মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য অনুপ্রাণিত করে)। আমার এক বন্ধু প্রচলিত ও গতানুগতিক ধারার রাজনীতি করে বলে আমি তার খুব সমালোচনা করতাম। তো, একদিন সে বললো-- প্রতিটি জাতিরই একটি গন্তব্য থাকে, আর সেই গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য ওই জাতির অন্তর্গত প্রতিটি মানুষ কোনো না কোনো ভূমিকা রাখে -- কেউ কম, কেউ বেশি। আমি সারাজীবন ধরে যদি আমার জাতিটিকে ওই গন্তব্যের দিকে এক ইঞ্চিও এগিয়ে দিতে পারি-- মনে করবো আমার জীবনটা স্বার্থক হলো। আমার বন্ধুটি তার ভূমিকা রাখার জায়গা খুঁজে পেয়েছে ওইখানটায়, বুঝতেই পারছেন। এভাবেই একেকজন একেকটি জায়গা খুঁজে পায়। একসময় এদেশের বামপন্থি রাজনৈতিক কর্মীরা স্বপ্ন দেখতেন যে, বিপ্লব আসন্ন। এই বুঁদ হয়ে থাকাটাও ওই ঘোরের মধ্যে থাকারই নামান্তর। তবু তাঁদের স্বপ্ন ছিলো। কিন্তু এখন যারা বামপন্থি রাজনীতি করেন তারা প্রায় সবাই জানেন, বিপ্লব এত সহজে আসে না, দিবাস্বপ্নে ভোগার মতো বিশ্বপরিস্থিতি এখন আর নেই। এমনকি অনেকে এটাও মনে করেন-- এদেশে হয়তো কোনোদিনই বিপ্লব আসবে না, তবু তারা এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে একটি জীবন ব্যয় করে যাবার দুঃসাহস দেখান। কিভাবে সেটা সম্ভব হয়? এখানেও সেই আত্নতৃপ্তিরই ব্যাপার। আমি জানি আমার জীবদ্দশায় এদেশে বিপ্লব না-ও আসতে পারে, কিন্তু এ-ও জানি, যদি আসে তাহলে এ জাতির মুক্তি ঘটবে। আমি তাই আমার এই তুচ্ছ জীবনটি বিপ্লবের জন্যই ব্যয় করে যাচ্ছি। পৃথিবীর ক-জন লোকই বা তা পারে! এখানেই ওই বিপ্লবীর তৃপ্তি।
হ্যাঁ, সান্ত্বনা ওটুকুই, তৃপ্তিও। জীবনের কাছ থেকে কিছুই পাবার নেই জেনেও, জীবনটা নিছক অর্থহীন একটা ব্যাপার জেনেও, আমরা আমাদের কাজটুকু করে যাচ্ছি। ওই তৃপ্তি-- জীবনের অর্থহীনতা ভুলে থাকা অথবা জীবনকে অর্থময় করে তোলার জন্য চেষ্টার তৃপ্তিই-- মানুষকে তার দৈনন্দিন কাজগুলোর বাইরে নিয়ে আসে। আর এজন্যই হয়তো সে লেখালেখি করে, গান গায়, সুর তৈরি করে, নাটক-সিনেমা বানায়, ছবি আঁকে, কিংবা রাজনীতি করে।