সরকার ভারতীয় যে কোন ভাষার চলচ্চিত্র আমদানির অনুমতি দিয়েছেন। ফলে এখন থেকে বাংলাদেশের সিনেমা হলে ভারতীয় সিনেমা প্রদর্শনীর কোন বাধা থাকল না। কেবল শর্ত থাকবে ওই সিনেমায় বাংলা বা ইংরেজিতে সাব-টাইটেল ব্যবহার করতে হবে এবং সেন্সর বোর্ড থেকে সার্টিফিকেট গ্রহণ করতে হবে।
হল মালিক সমিতি এই আমদানির সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। নব্বই দশকে দেশে সিনেমা হল ছিল ১২শত। বর্তমানে চালু আছে মাত্র ৭৫০টি। দেশীয় সিনেমার নিম্নমান, অশ্লীল সিনেমা ও সিনেমা হলের পরিবেশের কারণে বহু আগেই এই দেশের সিনেমা দর্শক হারিয়েছে। ঢাকার ৪৪টি সিনেমা হলের মধ্যে এখন টিকে আছে ৩৩টি। ১১টি সিনেমা হল বিলুপ্ত হয়ে গেছে। গুলিস্তান হল ভেঙে গড়ে তোলা হয়েছে শপিংমল। শ্যামলী সিনেমা হলটি ভেঙে নির্মিত হচ্ছে ১৪ তলা শ্যামলী স্কয়ার। আনন্দ সিনেমা হলও ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। চলচ্চিত্র শিল্পে ধস নামার কারণে হল মালিকরা ব্যবসায়িক ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে ভিন্ন পথ ধরছেন। গত এক দশক জুড়ে চলচ্চিত্র শিল্পে স্থবিরতা বিরাজ করায় বন্ধ হয়ে গেছে অনেক প্রযোজক ও পরিবেশক প্রতিষ্ঠান।
হল মালিক সমিতির সভাপতি সাবেক মন্ত্রী কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘চলচ্চিত্র আমদানির এ সিদ্ধান্ত আরো আগে নেয়া উচিত ছিল। তাহলে দেশে সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে যেত না।’ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মিয়া আলাউদ্দিন জানান, চলচ্চিত্র শিল্পে বর্তমানে কোনো প্রতিযোগিতা নেই। আমদানি হলে এ শিল্পের বিকাশ ঘটবে।
অন্য দিকে এইভাবে চলচ্চিত্র আমদানির সিদ্ধান্তের প্রতি দ্বিমত পোষণ করেছেন অনেক পরিচালক, প্রযোজক ও শিল্পী। প্রযোজক সমিতির সভাপতি গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার এটাকে মরার উপর খাড়ার ঘা বলেছেন।
এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রণীত আমদানী নীতি আদেশ সংশোধন করে বিদেশী চলচ্চিত্র আমদানীর আদেশ স্থগিত রাখার আবেদন জানিয়েছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ঐক্য পরিষদ। আজ সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির ভিআইপি লাউঞ্জে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়। সংগঠনের সভাপতি মিজু আহম্মেদ, শাহ আলম কিরন, মাসুম পারভেজ রুবেল, আবদুল লতিফ বাচ্চু, খোরশেদ আলম খসরু সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনে জানানো হয়, ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদেশী চলচ্চিত্র আমদানীর আদেশ বাতিল করেছিলেন। দেশীয় চলচ্চিত্র রক্ষায় ওই বিষয়টিকে মাথায় রেখে বর্তমান সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ বিষয়ে তারা প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
আসলে কী করা দরকার ?
আমাদের দেশের চলচ্চিত্রের অবস্থা খুবই খারাপ। কারণ কী ?
০১) সেই মান্ধাত্মা আমলের ওস্তাদ ধরা পদ্ধতিতে চলচ্চিত্র কলাকুশলী তৈরি হয়। দেশে কোন সরকারী ফিল্ম ইনস্টিটিউট নাই। এফডিসিতে যারা কাজ করেন, তারা বেশির ভাগই চলচ্চিত্র বিষয়ে পড়াশোনা করেন না, জানেন না আধুনিক প্রযুক্তি।
তাই দরকার একটা সরকারী ফিল্ম ইনস্টিটিউট। একটা স্বাধীন জাতির জন্য মাত্র ১টা ফিল্ম ইনস্টিটিউট কি খুব বেশি বড় দাবি ? মাত্র ১টা ফিল্ম ইনস্টিটিউট বানাতে কত বছর লাগে ?
৩৮ বছর কাটল একটি ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের অপেক্ষায়
০২) আমাদের চলচ্চিত্রে নকল কাহিনীর ছড়াছড়ি। চিত্রনাট্যকারই নাই। চিত্রনাট্যকারের জন্য কোন বাজেট বরাদ্দ নাই। কোটি কোটি খরচ করে সিনেমা বানানো হয়, অথচ সেই সিনেমার কাহিনী লেখার জন্য হাজার টাকাও খরচ করতে রাজি না প্রযোজকরা। এ এক ভয়াবহ রোগ। ফলে পরিচালক মহাশয় ভারতীয় ছবি বা বিদেশী কোন ছবি বা দেশীয় কোন পুরোনো ছবি নকল করে কাহিনী বানান। এই কাহিনী আমরা দর্শকরা আগেই জানি। ফলে জানা কাহিনী দেখতে সিনেমা হলে দর্শক হয় না।
তাছাড়া নকল করা একটা অপরাধ। কপি রাইট আইনে নকল করা শাস্তিমূলক অপরাধও। এই আইন প্রয়োগ করা হোক সংশ্লিষ্টদের উপর।
তাই নকল কাহিনীর চলচ্চিত্র ও অশ্লীল চলচ্চিত্রের সেন্সর সনদ পাওয়া চিরতরে বন্ধ করা দরকার। নকল কাহিনী ও অশ্লীল সিনেমা কোনক্রমেই যেন সেন্সর সনদ পেতে না পারে।
০৩) সিনেমা হলে যারা অশ্লীল সিনেমা চালায় এবং সিনেমায় কাটপিস জুড়ে দেয়, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হোক। এ সব কাটপিস প্রদর্শনকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াসহ নির্মাণকারী ও কলাকুশলীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হোক। কাটপিস নির্মাণের সাথে জড়িত প্রতিটি ব্যক্তির শাস্তি দেয়া অবশ্য কর্তব্য।
০৪) এফডিসি থেকে বাটপার, বদমায়েশ, সন্ত্রাসী ও ধান্দাবাজদের বের করে দেয়া হোক। যারা কাজ জানে না, তারা কেবল ধান্দাবাজি করে এবং অন্য যারা কাজ জানে তাদের ক্ষতি করে। এদের বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নেয়া হোক।
০৫) এফডিসিতে নতুন প্রযুক্তি নাই। ডিজিটাল প্রযুক্তি অনেক সস্তা এবং কার্যকর। এফডিসি থেকে শুরু করে সিনেমা হল পর্যন্ত সব জায়গায় ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করার ব্যবস্থা করা হোক।
ডিজিটাল পদ্ধতিতে সিনেমা প্রদর্শনের ব্যবস্থা করার জন্য স্যাটেলাইট ব্যবহার করার প্রযুক্তি আনা হোক। ডিজিটাল পদ্ধতিতে সিনেমা প্রদর্শন করার ব্যবস্থা করা গেলে অনেক কম বাজেটে চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্ভব হবে।
০৬) নতুন নতুন মেধাবী লেখক, পরিচালক ও অভিনেতা খোঁজা দরকার। প্রতি বছর একটা আয়োজন করে নতুনদের ব্যাপক মাত্রায় সুযোগ দেয়া এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার। এই আয়োজনটা প্রতি বছর হওয়া দরকার।
০৭) জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার নিয়মিত করা হোক। এক বছরের পুরস্কার পেতে পেতে কয়েক বছর পেরিয়ে যাওয়ার বর্তমান পদ্ধতি সিনেমার প্রতি ও পুরস্কারের প্রতি সরকারের অবহেলাকেই তুলে ধরে। প্রতি বছরের পুরস্কার প্রতি বছর দেয়া হোক। তার পাশাপাশি পুরস্কারের অংকও বৃদ্ধি করা হোক। তাহলে ভালো সিনেমা নির্মাণে উৎসাহ বাড়বে।
০৮) সিনেমা নির্মাণে অনুদানের পরিমাণ বাড়ানো হোক। ১০০% সরকারী অনুদানে সিনেমা বানানো যায় কিনা সেটা ভাবা হোক। ভালো ভালো সিনেমায় সরকারী অনুদান থাকলে ভালো সিনেমা নির্মাণের পরিমাণ বাড়বে।
ভারতীয় সিনেমা আমদানির দরকার নাই। জানা গেছে , নতুন এ নীতিমালার অধীনে এরইমধ্যে ভারতের ৪টি সুপারহিট চলচ্চিত্র আমদানির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এগুলো হলো, হিন্দি সিনেমা ‘মাই নেম ইজ খান’, ‘দেবদাস’, ‘থ্রি ইডিয়টস’ এবং বাংলা সিনেমা ‘অন্তহীন’। শিগগিরই এগুলো হলে গিয়ে দর্শকরা দেখতে পারবেন। আমরা ভারতীয় সিনেমা স্যাটেলাইটের কল্যাণে ঘরে বসেই দেখতে পারি। আর বাজারে সিডি-ডিভিডির মাধ্যমে ভারতীয় সিনেমায় সয়লাব । যে সিনেমাগুলো আমদানি করে আনা হচ্ছে সেই সিনেমাগুলো আমরা ডিভিডিতে বা স্যালেটলাইট টিভিতে অনেক আগেই দেখে ফেলেছি। তাহলে কেন সেই একই সিনেমা হলে চালিয়ে চলচ্চিত্র প্রযোজক, পরিচালক ও শিল্পীদের পেটে লাথি মারার ব্যবস্থা করা হচ্ছে ?
ভারতীয় সিনেমার আমদানি বন্ধ করা হোক। যারা আমাদের স্যাটেলাইট টেলিভিশনই চালানোর অনুমতি দেয় না তাদের দেশে, তাদের সিনেমা আমদানি করে আমাদের দেশীয় সিনেমার বারোটা বাজানোর ব্যবস্থা কেন করছি ? খোলা বাজার অর্থনীতির আলোকে যদি আমদানি করতেই হয়, তবে শর্ত জুড়ে দেয়া হোক, ওদেরও আমাদের সিনেমা আমদানি করতে হবে। সেটা কি ওরা করবে ? কোন দিন ?
খবর সূত্র
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে এপ্রিল, ২০১০ সকাল ৯:৩০