- আসাদ ভাই।
- হুম নিলু, বলো।
- খেতে আসুন। মা ভাত দিয়ছেন। আর হ্যাঁ কিছুহ্মণের মধ্যেই বাবা চলে আসবেন। তাই দয়া করে তাড়াতাড়ি আসবেন।
- আসছি।
- আমি যাচ্ছি। অপেহ্মা করতে পারব না। আর আপনি তো একা একা খেতেও পারেন না। তবে সেদিনের মতো যদি না আসেন তবে হোটেলে খাবার অভ্যেস করবেন। আমার পোড়া কপাল সে হ্মমতাও তো আপনার নেই।
কথাটা বলেই চুপ হয়ে যায় নিলু। আর কিছু বলতে পারে না ও। বলবেই বা কি? এত পছন্দ করে যে মানুষটাকে তাকেই এত বড় একটা কথা বলতে পারল।
নিলু কিছু না বলেই চলে যাচ্ছিল। আসাদ পেছন থেকে ডাক দিল-
- নিলু।
- হুম। পেছন ফিরে তাকায় নিলু।
- নীল শাড়িতে তোমায় একটুও ভালো লাগে না এটা কি তুমি জানো?
- না জানি না। আমি গেলাম। আর হ্যাঁ আজ আপনার খাওয়া বন্ধ।
ওর যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে আসাদ। বুকের মধ্যে শূন্যতা প্রকট হয়। এক ক্লান্তিকর ব্যাথা। যার বিরাম নেই কিন্তু ব্যাথার প্রতিটি অনুভূতিই আবেগের চাদরে মোড়ানো।
কিন্তু আসাদ জানে দারিদ্র যেখানে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে ভালোবাসা সেখানে ফানুস হয়ে উড়ে যায়।
বাবা মারা যাবার পর মা বোনকে গ্রামে রেখেই ঢাকা আসে আসাদ। কিন্তু সময়টা যে বড় খারাপ। দেশে আজ ছড়িয়ে পড়েছে আন্দোলনের আগ্নেয় আভা। মাতৃভাষা বাংলা চাই শ্লোগানে আসাদের মতো অনেকেই খুঁজে পায় আত্মিক প্রশান্তি। ভাষার জন্য জীবন দিতে যেন উন্মুখ এই তরুণ যুবারা। ভাবনায় ছেদ পড়ে আসাদের। হ্মুধার প্রচন্ডতায় ঝাপসা হয়ে ওঠে সব। টেবিল থেকে উঠে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায় আসাদ।
- আসাদ, কেমন আছো?
- জী, ভালো খালাম্মা।
- তোমার মা বোন কেমন আছে?
- ভালোই।
- টাকা পয়সা কিছু পাঠাইছো?
চুপ করে থাকে আসাদ। কি করে বলবে ও যে এই খাবারটুকু যদি না জুটতো তবে ওকে না খেয়েই থাকতে হতো। কি করে পাঠাবে টাকা। ভাষা আন্দোলনের ব্যানার প্ল্যাকার্ড লিখে তেমন কিছুই পাওয়া যায় না। আর এক মায়ের জন্য আর এক মাকে অর্থের জন্য ব্যবহার কি করে করবে ও। তাই অধিকাংশ ব্যানারই আসাদ করে বিনা পয়সায়। দিনশেষে তাই পকেট ভরে ওঠে দেশপ্রেমে। টাকার সেখানে জায়গা কোথায়।
আসাদকে চুপ করে থাকতে দেখে নিলুর মা আবার বলেন-
- কি হলো আসাদ টাকা পাঠাও নি?
- মা! তুমি কি তারে খেতে দেবে না। তখন থেকে বকবক করেই যাচ্ছ।
আসাদ ভাই, আপনি খান।
মাথা নিচু করে খেয়ে উঠে যায় আসাদ। হাত মুখ ধুয়েই দেখে নিলু তোয়ালে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তোয়ালেটা নিতেই নিলু বলে-
- বিকেলে একবার গলির মাথায় আসবেন। আমি থাকব।
আসাদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নিলু চলে যায়। আর আসাদ। আসাদ তাকিয়ে থাকে। সেই একি অনুভূতি। কিন্তু বেশ ভালোই লাগে আসাদের। ব্যাথাটাকে মনে হয় ভালোই বেসে ফেলেছে সে।
- আপনি কি হ্যাঁ!
- কেন?
- আমি কতহ্মণ হলো দাঁড়িয়ে আছি। আর এখন আপনার আসার সময় হলো।
- ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
- আসাদ ভাই!
- বলো নিলু।
- দেশের কি অবস্থা আসাদ ভাই।
- নিলু দেশ আর আগের মতো নেই। সকলের মধ্যে চাপা আক্রোশ। ওরা, ওরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে চায় না। আমরা সংখ্যায় অনেক বেশি। তারপরও উর্দুকেই ওরা চাপিয়ে দিতে চায় আমাদের উপর। হায়েনার দল ওরা। স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বিকিয়ে দিতে চায় আমাদের স্বকীয়তা।
- তাহলে কি হবে আসাদ ভাই?
-আমরা মেনে নেব না নিলু। প্রতিবাদ করবো। আমরণ আন্দোলন করবো যতদিন না ওরা বাংলা কে রাষ্ট্র ভাষা না করে। জানো উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিও ওরা নাকোচ করেছে।
- তাহলে?
- কি আবার। বাংলাই হবে আমার ভাষা, আমাদের ভাষা। ওদের মিথ্যে যত, কলুষতা যত, অপচেষ্টা যত সবই হার মানবে আমাদের কাছে।
- আসাদ ভাই।
- হুম নিলু।
- রফিক ভাই যেটা বলেছে তা কি সত্যি?
- কি বলেছে?
- ২১শে ফেব্রুয়ারি নাকি মিছিল ডেকেছে?
আক্রোশে জ্বলজ্বল করে ওঠে আসাদের চোখ ।
- হ্যাঁ নিলু। আমরা বিদ্রোহ করবো। হার মানবো না। যে কোন মূল্যেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করবো আমরা।
- ওদিন নাকি ১৪৪ ধারা জারি করেছে। যদি আপনার কিছু হয়। যদি ওরা আপনাকে ধরে নিয়ে যায়।
- মরে যাবো।
আসাদের মুখটা হাত দিয়ে চেপে ধরে নিলু। খবরদার এসব বলবেন না। আপনি এমন কেন? আমায় কি আপনি কি আমায় বুঝতে পারেন না?
- না নিলু।
নিলু তাকিয়ে থাকে আসাদের দিকে। কাঠিন্য ভর করেছে দেখানে। দুচোখ জোড়া স্বপ্ন। কিন্তু সেই স্বপ্নে নিলু নেই। আছে দেশপ্রেম। বাংলার প্রতি ভালোবাসা।
নিলু চলে যাচ্ছে। ধীরে কিন্তু প্রবলভাবে।
আসাদ তাকিয়ে আছে। দ্রোহী ঐ চোখে বিষন্নতার ছায়া। কিন্তু ছুটে যেতে পারে নি নিলুর কাছে। পারে নি নিজেকে স্বার্থপর তকমার আড়ালে ঢেকে দিতে।
চিঠিটা হাতে নিয়ে বসে আছে আসাদ। খামের উপর রূপার গোটাগোটা অহ্মরে লেখা ঠিকানাই যেন চিঠির মধ্যেকার সব কথা উগ্রে দিচ্ছে। মায়ের সেই চিরচেনা স্মৃতি গুলো। গন্ধ নেয় আসাদ। মায়ের শরীরের সেই তীব্র ভালো লাগার গন্ধ।
বোনের হাতের লেখাটায় পরম মমতায় হাত বোলায় আসাদ।
আর রাত জাগবে না। তাই শুয়ে পড়ে আসাদ। কাল ২১শে ফেব্রুয়ারি। আসাদ মিছিলে যাবে। যাবে বাংলাকে তার যোগ্য সম্মান পাইয়ে দিতে। যথাযথ আসনে তাকে অধিষ্ঠিত করতে। আসাদ জানে না সে ফিরবে কিনা। কিন্তু জানে নিলু তার জন্য অপেহ্মা করবে, অপেহ্মা করবে রূপা, মা।
ঘুমহীন আসাদ টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়। রাত ২:৪০। সময় ঘড়ি যেন স্থবির হয়ে আছে।
- আসাদ ভাই। আসাদ ভাই।
দরজা ঠেলতেই অবাক হয়ে যায় নিলু। এতো ভোরে লোকটা দরজা খুলে কোথায় গেলো।
ফিরতি পথ ধরতেই নিলুর চোখ এড়ালো না শিউলি ফুলের মালাটা। আনন্দাশ্রু যেন পবিত্র থেকে পবিত্রতর করে তুলছে হাতে ধরা ঐ শিউলি ফুলের গন্ধহীন বাসি মালাটা। নিলুর জন্য যেন অপেহ্মা করছিল আরো বড় বিস্ময়। চিঠি। আসাদের।
" ভালোবাসি বলতে পারি নি। পারি নি ঐ চোখে চোখ রেখে বলতে, চল যাই তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে। দুজন দুজানার মাঝে চল যাই হারিয়ে। শুধু এই যাবার বেলা একটাই কথা বলতে চাই, যদি ফিরে আসি প্রতিটি ভোরের শুরু, প্রতিটি তপ্ত দুপুর বেলা, পড়ন্ত বিকেলের প্রতিটি মুহূর্ত তোমার করে দেব। প্রতিদানে ঘুমহীন প্রতিটি রাত চেয়ে নেব তোমার কাছ থেকে।
ভালো থেকো নিলু।"
পরিশিষ্টঃ আসাদ ফেরে নি। তাই অপেহ্মায় থাকা সেই মা, বোন বা অতি প্রিয় নিলুরা শূন্যতাকেই প্রাপ্তির স্থান দিয়েছে। পাক সেনার নির্বিচার গুলি বর্ষণে ছিড়েকুটে যায় আসাদের দেহ। বুক পকেটে রাখা রূপার সেই চিঠির উত্তরো বাদ যায় নি সেই পশুদের আক্রমণ থেকে। লাল হয়ে যাওয়া বুকে থকথকে রক্তের ছোপ। চিঠিতে তার স্পষ্ট ছাপ।
রক্তের ছোপ। রয়ে যায়। থেকে যায় অনেকটা জুড়ে।
উৎসর্গঃ বাংলার জন্য, মাতৃভাষার জন্য আসাদের মতো অগণিত যুবা অকাতরে প্রাণ দিয়েছে। আজ আমরা স্বাধীন। আমাদের আনন্দ, কষ্টগুলো প্রকাশ করার মাধ্যম প্রিয় বাংলা ভাষা। তাই সেই সব ভাষাশহীদের শ্রদ্ধ্যার্ঘ আমার গল্প লেখার এই ব্যর্থ চেষ্টাটা।