দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল পোল্যান্ড থেকে। জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমন করার পর। পোল্যান্ডের একদিক দখল করে নেয় জার্মানি, অন্যদিক সোভিয়েত ইউনিয়ন। বলা হয় গোপন চুক্তি করেই দেশ দুটি পোলান্ড দখল করে নেয়। ছবির শুরু এখান থেকে।
বিনা যুদ্ধে পোল্যান্ড ছেড়ে দেয়নি পোলিশরা। ফলে যুদ্ধে হেরে সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতে বন্দী হয় বিশাল এক অংশ। সেনাবাহিনী ছাড়াও বন্দী হয় শিক্ষক, ডাক্তার, আইনজীবি, পুলিশ, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ। তাদের ধরে নিয়ে যায় রাশানরা। এর বড় অংশই আর শেষ পর্যন্ত ফিরে আসেনি। পুরো ছবিটা এগিয়েছে নারীদের চোখ দিয়ে। এর মধ্যে যারা আর ফিরে আসেনি তাদের স্ত্রী, বোন, মা, মেয়ে।
আন্দ্রেজ সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন। যুদ্ধবন্দী হিসেবে ধরে নিয়ে যায় সোভিয়েত আর্মি ১৯৩৯ সালে। অপোয় থাকে স্ত্রী আনা ও মেয়ে নিকা। আন্দ্রেজ আর ফিরে আসে না নিয়মিত ডায়েরি লিখতো আন্দ্রেজ। লেখা আছে বন্দী ক্যাম্পের অনেক ঘটনা। আন্দ্রেজকে যখন আলাদা করা হয় তখন তার বন্ধু জারজি ঠান্ডায় কাতর আন্দ্রেজকে নিজের সোয়েটারটা পড়তে দেয়। এরপরই ছবির কাহিনী শুরু হয় যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরের পোল্যান্ড থেকে।
পোল্যান্ডে তখন সোভিয়েত পন্থী কমিউনিস্ট শাসন। আবিস্কার হয়েছে কাতিন গণকবর। কাটেইন একটা গ্রাম, জঙ্গলও আছে। বিশ্বব্যাপী প্রচার যে নাজীদের হাতে মারা গেছে পোলিশ যুদ্ধবন্দীরা। তারাই কাতিন গ্রামে গণহত্যা চালিয়েছে। একথা প্রচার করা হচ্ছিল সরকারি তরফ থেকেই। গণকবরে ছবি দেখানো হয়েছে রাস্তার রাস্তার মোড়ে। দেওয়ালে নাজী বিরোধী পোস্টার। কিন্তু পোলিশরা জানে কাজটা সোভিয়েত ইউনিয়নের। তবে তা বলা যাবে না। সিভিতে সোভিয়েতদের হাতে বাবার মারা যাওয়ার কথা লেখা ছিল বলে ভর্তি হতে পারেনি একজন। পরে সোভিয়েত বিরোধী পোস্টার ছিড়ে ফেলতে গিয়ে মারা যায় সে। ভাইয়ের কবরে সোভিয়েতদের হাতে মারা গেছে লিখতে চেয়ে জেলে যেতে হয় একজন বোনকে।এভাবেই ছবিটা এগিয়ে চলে। সবশেষে আন্দ্রেজের ডাইরি হাতে পায় আনা। ১৯৪০ পর্যন্ত সব কথা লেখা ছিল তাতে। তখনও সে সোভিয়েতের হাতে বন্দী। তারপর কেবলই ফাঁকা পৃষ্ঠা। এর পর ছবিতে দেখানো হয় আন্দ্রেজদের শেষ পরিণতি।
প্রায় ২২ হাজার যুদ্ধবন্দীকে হত্যা করেছিল সোভিয়েতরা। এদের মধ্যে ছিলো আন্দ্রেজদের মতো মানুষরাই। ছবিতে দেখায় দুটি স্থানের হত্যাকান্ড। একটি এক গোপন ক, অন্যটি কাতিন জঙ্গল। গর্ত খুড়ে দাঁড় করায় একেকজনকে। পেছন থেকে মাথার খুলিতে একটা করে গুলি। এভাবে ২২ হাজার হত্যা। আন্দ্রেজ পড়ে থাকে গর্তে, একটা বুলডজার মাটি চাপা দেয়। ছবি শেষ।
ছবিটা দেখে স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম অনেকন। তারপর শুরু হয় ইন্টারনেট ঘাটাঘাটি। পুরো ইতিহাস পরে এবার আমি হতভম্ব।
১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯, জার্মান দখল করে পোল্যান্ডের একটি অংশ। আর ১৭ সেপ্টম্বর সোভিয়েত রেড আর্মি দখল করে নেয় পোল্যান্ডের পূর্বাংশ। ইতিহাস বলে এই দখলের জন্য জার্মানি ও সোভিয়েতের মধ্যে পারস্পরিক যোগসাজস ছিল। রেডআর্মি কিছুটা বাঁধার মুখে পড়েছিল। ফলে সাড়ে ৪ লাখ যুদ্ধবন্দী থাকলেও পরে ৪০ হাজার রেখে বাকিদের ছেড়ে দেওয়া হয়। সোভিয়েত ইন্টানন্যাল সিকিউরিটি সার্ভিস বা এনকেভিডির (আসলে সোভিয়েত গুপ্ত পুলিশ) হাতে যুদ্ধবন্দীদের ছেড়ে দেওয়া হয়। তাদের নেওয়া হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন জায়গায়। বন্দীদের তালিকায় সেনা সদস্য ছাড়াও ছিল শিক্ষক, ডাক্তার, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। অনেককে আবার আটক করা হয়েছিল সোভিয়েত বিরোধী কর্মকান্ডের জন্য। ১৯৩৯ এর অক্টোবর থেকে ১৯৪০ সালের ফেব্র“য়ারি পর্যন্ত দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদ চলে তাদের উপর। এর উদ্দেশ্য ছিল আসলে কে বাঁচবে আর কে মরবে সেটি নির্ধারণ করা। যাদের মধ্যে সামান্যতম সোভিয়েত বিরোধী মনোভাব পাওয়া গেছে তারাই তালিকাভূক্ত হয়।
পিপলস কমিশার ফর ইন্টারনাল অ্যাফেয়ার্স ও ফার্স্ট র্যাংক কমিশার অব স্টেট সিকিউরিটি ল্যাভরেনিটি বেরিয়া ১৯৪০ সালের ৫ মার্চ স্টালিনসগ সোভিয়েত পলিটব্যুরোর সব সদস্যের কাছে একটি নোট পাঠায়। তাতে যুদ্ধবন্দীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ ছিল। পলিটব্যুরো তাতে সম্মতি দেয়। ১৯৪০ সালের ৩ এপ্রিলের পর থেকে অল্প সময়ের মধ্যে ২২৪৩৬ জনকে মেরে ফেলা হয় ঠান্ডা মাথায়, আয়োজন করে। এর মধ্যে ছিলেন একজন এডমিরাল, দুইজন জেনারেল, ২৪ জন কর্ণেল, ৭৯ লে.কর্ণেল, ২৫৮ মেজর, ৬৫৪ ক্যাপ্টেন, ২০ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক, ৩০০ ডাক্তার, ২০০ বিমান চালক, ১শ লেখক-সাংবাদিক, ইত্যাদি। গুলি করা হয়েছিল জার্মানির তৈরি ওয়ালথার পিপিকে পিস্তল দিয়ে। তখন গুপ্ত পুলিশের চিফ এক্সিকিউশনার ভাসিলি মিখাইলোভিচ ব্লোখিন একাই গুলি করে মেরেছে ৬ হাজার পোলিশ বন্দীকে।
স্টালিনকে পাঠানো নোট। এখানেই হত্যার অনুমতি দেওয়া হয়।
মোট তিনটি স্থানে মারা হয়। যেমন কাতিন জঙ্গল এবং কালিনিন ও কার্কিভে গুপ্ত পুলিশের বন্দীশালায়। সকালে শুরু হতো, হত্যা উৎসব চলতো সন্ধ্যা পর্যন্ত। পদ্ধতি ছিল একই। মুখে কাপড় ঢেকে পিছন থেকে একটা গুলি। বন্দীশালায় এভাবে মেরে ট্রাকে করে জঙ্গলে গণকবর। একজন জেনারেলের মেয়েকেও এভাবে হত্যা করা হয়।
১৯৪১ সালে জার্মানি রাশিয়া আক্রতম করে। ১৯৪২ সালে কিছু পোলিশ রেলশ্রমিক কাটেইনে গনকবর আবিস্কার করলেও বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়া হয়। ১৯৪৩ সালের এপ্রিলে কাটেইন জার্মানের দখলে চলে গেলে তারাই গণকবর আবিস্কার করে। বার্লিন রেডিওতে ১৩ এপ্রিল এটি ব্যাপক ভাবে প্রচার করা হয়। জার্মানরা একটি কমিশন গঠন করে যাতে ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশের ফরেনসিক এক্সপার্টরা ছিলেন। তারা সবাই এ জন্য সোভিয়েতকে দায়ী করলেও সোভিয়েত তা অস্বীকার করে। তারা দাবি করে ১৯৪১ সালে জার্মানদের দখলে চলে যাওয়ার পর তারাই পোলিশ বন্দীদের হত্যা করেছে।
জার্মানরা এই পোস্টারটা বের করেছিল সে সময়। তথ্য অনুযায়ী এভাবেই হত্যা করা হয়।
পোলান্ডের প্রবাসী সরকার তখন লন্ডনে। এই সরকার ১৯৪৩ সালে বিষয়টি নিয়ে সোভিয়েত ব্যাখ্যা দাবি করলে স্টালিন পাল্টা দাবি করে যে পোলান্ডের এই সরকার নাজীদের সাথে হাত মিলিয়েছে। তারপর স্টালিন আরেকটি প্রবাসী সরকার (মস্কো ভিত্তিক) সমর্থন দেওয়া শুরু করে। সেসময় লন্ডন প্রবাসী পোলি প্রধানমন্ত্রী সিকোরসকি ইন্টারন্যাশনাল রেড ক্রসের মাধ্যমে তদন্ত চেয়েছিলেন। ১৯৪৩ সালের ৩ জুলাই এক বিমান দূর্ঘটনায় মেয়েসহ তিনি মারা যান। মনে করা হয় এর সঙ্গেও সোভিয়েতের হাত ছিল।
১৯৪৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর আবার কাতিন সোভিয়েতের দখলে চলে আসে। দখল পেয়েই শুরু হয় পুরো ঘটনা ভিন্নখাতে নিয়ে জার্মানির উপর চাপিয়ে দেওয়ার কাজ। একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে বাইরের কাউকে রাখা হয়নি। কমিটি তদন্ত করে জানিয়ে দেয় যে গণহত্যা জার্মানির কাজ, এবং সেটি হয় ১৯৪১ সালে। কাটেইন তখন জার্মানির দখলে। যুদ্ধের পর বিষয়টি আবারো ধামাচাপা দেওয়া হয়। নুরেমবার্গ ট্রায়ালে এটি প্রথমে স্থান পেলেও পরে তা বাতিল করা হয়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম ১৯৯০ সালে স্বীকার করে যে কাতিন হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী তারাই। গর্ভাচেভ তখন মতায়। জানানো হয় এটি ছিল সোভিয়েত গুপ্ত পুলিশের কাজ। ১৯৯০ সালের ১৩ এপ্রিল প্রথমবারের মতো দায় মেনে নিয়ে মা চায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। তবে বিষয়টির নিষ্পত্তি এখনো হয়নি। কে দায়ী সেটি সুনির্দিষ্ট ভাবে বলতে নারাজ রাশিয়া। এমনকি এটিকে গণহত্যা বলতেও রাজী না। পোলান্ড রাশিয়ায় এসে তদন্ত করতে চাইলেও তাতেও রাজী নয় তারা।
প্রশ্ন হচ্ছে কেন এই গণহত্যা। ইতিহাসবিদরা মনে করেন এর কারণ একটিই। আর সেটি হচ্ছে-পোল্যান্ড সোভিয়েতের সীমান্তের দেশ। তারা চায়নি সীমান্তে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে পোল্যান্ড টিকে থাকুক। যারাই পোল্যান্ডকে শক্তিশালী দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে তাদেরই মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়।
পুরো ছবিটা দেখে এবং মেরে ফেলার কারণ জেনে মনে পড়ে যায় বাংলাদেশে সংগঠিত গণহত্যার কথা। পাকিস্তান যখন দেখলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা অনিবার্য তখনই পরিকল্পনা হয় বুদ্ধিজীবি হত্যার, যাতে শক্তিশালী দেশ হিসেবে থাকতে না পারে বাংলাদেশ।
পোল্যান্ড আজও কাটেইন গণহত্যার বিচার চাইছে। আমরাও চাইছি। পোল্যান্ডের পে রাশিয়ার কিছু মানুষের বিচার করা হয়তো সহজ নয়। স্টালিনরা মৃত। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীরা বেঁচে আছে। কিছুদিন আগে তাদের একটি বড় অংশ গাড়িতে ফ্যাগ উড়িয়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছে। এবার তাদের বিচারের পালা। আওয়ামী লীগ প্রতিশ্র“তি দিয়েছে। এবার অঙ্গীকার বাস্তবায়নের পালা। আসুন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে সোচ্চার থাকি। জয় আমাদের হবেই। জয়ী হওয়ার এটাই সুযোগ।
কাটেইন গণকবর। মনে করিয়ে দেয় বাংলাদেশকে।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জানুয়ারি, ২০০৯ বিকাল ৪:২১