মনসা মঙ্গল কাব্য বাংলার প্রাচীনতম মঙ্গল-কাব্য। এ গুলিতে বর্ণনা আছে কিভাবে শিবের উপাসকদেরকে সাপের দেবী মনসা তার নিজের পূজারীতে রূপান্তরিত করে বাংলায় তার উপাসনা প্রতিষ্ঠিত করেন। মনসা একজন অনার্য দেবতা ছিলেন এবং তার পূজা বাংলার একটি প্রাচীনতম পূজা ছিল । এটা বিশ্বাস করা হয় তিনি দ্রাবিড়দের সাথে এসেছিলেন এবং তাঁর আশা ছিল যে তিনি সাপ ও সাপের অশুভ প্রভাব থেকে মানুষদেরকে রক্ষা করবেন । মনসা ছাড়াও এ সর্প দেবী বিষহরী , জাংগুলী ও পদ্মাবতী নামেও পরিচিত ছিলেন ।
মনসা মঙ্গল এর গল্প সর্প দেবতা মনসার সঙ্গে চন্দ্রধর বা চাঁদ সদাগর এর মধ্যে সংঘাত দিয়ে শুরু এবং শেষ পর্যন্ত চন্দ্রধরকে মনসার একজন একনিষ্ঠ ভক্তে পরিণত হওয়ার মধ্য দিয়ে গল্পের শেষ হয়। চন্দ্রধর শিবের উপাসনা করতেন , কিন্তু মনসার আশা ছিল চন্দ্রধর তার পূজা করবে, মনসা চন্ত্রধরের এর উপর জয়ী হবেন এবং চাঁদ শিবের পূজা বাদ দিয়ে তাঁর পূজা করবে।
এখানে উল্লখ্য যে, হিন্দু পৌরানিক বিবরণ অনুযায়ী শিব ঈশ্বরের পাঁচটি প্রাথমিক রূপ যথা বিষ্ণু, শীব, গণেশ, সুর্য ও দেবী তাদের মধ্যে একজন যার রয়েছে প্রচন্ড সৃস্টি ও ধ্বংসকারী ক্ষমতা। তাকে মুলত নিরাকার হিসাবে গন্য করা হয় তবে তাঁর অনেক হিতৈষী এবং ভয়ংকর রূপ আছে বলে বর্ণনা পাওয়া যায় । বেশ কিছু জনপ্রিয় নাম শিবের নামের সঙ্গে যুক্ত যথা মহাদেব, মহেশ্বর, শঙ্কর, শম্ভু, রুদ্র, ঋষীকেশা, (জ্ঞানী), হারা , ত্রিলোচন , দেবেন্দ্র (দেবতাদের প্রধান), নীলাকান্ত , শুভঙ্কর ও ত্রৈলোক্যনাথ (তিন রাজ্য পালনকর্তা ) ।অনেক ঐতিহাসিকের ( Vijay Nath,: "From 'Brahmanism' to 'Hinduism': Negotiating the Myth of the Great Tradition", Social Scientist 2001, pp. 19-50) লিখাতেও পাওয়া যায় যে বিষ্ণু ও শিব তাদের নিজেদের ভাঁজের মধ্যে অসংখ্য স্থানীয় রীতির এবং দেবদেবীর আরাধনাকে শোষিয়া নিতে শুরু করেন । ইন্দো অববাহিকায় তাদের ছিল সীমাহীন দৌরাত্ব ।
এমন একটি অবস্থায় , মনসাকে পূজা দেয়া তো দুরের কথা একজন দেবতা হিসেবেও তাকে স্বীকৃতি দিতে চন্দ্রধর অস্বীকার করেন। ফলে মনসা চাঁদের সাতটি জাহাজকে সমুদ্রে ডুবিয়ে দিয়ে এবং তার ছয় পুত্র-সন্তানদের মেরে চাঁদ এর উপর প্রতিশোধ নেয় । অবশেষে,চাঁদ এর কনিষ্ঠ পুত্র লখিন্দর এর নব-বিবাহীত স্ত্রী বেহুলা, তার , সীমাহীন সাহস এবং স্বামীর জন্য তার গভীর প্রেমময় পতি ভক্তির শক্তি দিয়ে মনসা দেবীকে বশীভুত করতে সমর্থ হয়।
বেহুলা চাঁদসদাগরের ছয় ছেলের জীবন ফিরিয়ে আনাসহ তাদের জাহাজ উদ্ধার কাজে সফল হয় , এ কাজ সফল হওয়ার পরই কেবল বেহুলা বাড়ি ফেরে । মনসা মঙ্গল মূলত নিপীড়িত মানবতার গল্প । চন্দ্রধর ও বেহুলা এমন একটি সময়ে দুটি শক্তিশালী ও প্রতিবাদী চরিত্রে আভির্ভুত হয়েছিলেন যখন মানবিকতা সর্বোতভাবে ছিল পরাভুত এবং লাঞ্ছিত ।
মনসা মঙ্গল কাব্যের ভাষানগুলি আর্য এবং অনার্য দ্বন্ধ খুঁজে বের করে এনেছে নিপুনভাবে , এগুলি সে সময়কার বর্ণ বিভাজন কে প্রকটভাবে প্রকাশ করেছে । সমাজে মানুষ ও দেব দেবী মধ্যে দ্বন্দ্ব, সামাজিক বৈষম্য, সেইসাথে আর্য এবং অ - আর্যদের মধ্যে দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয় মঙ্গল ভাষানে । শিব, যাকে চাঁদ পূজা করত তিনি মুলত আর্য দেবতা না হলেও আর্য দেবতায় পর্যবেশীত হয়েছিলেন , কিন্তু বিভিন্ন ঘুর্ণাবর্তে চাঁদ এর উপর মনসার জয় মূলত আর্য দেবতার উপর আদিবাসী বা অনার্য দেবতার বিজয়েরই সুচনা, যার সুফল ভোগ করে উপমহাদেশের এক বিশাল জনগোষ্টি বিভিন্নভাবে । একদিকে যেমন আর্য- অনার্য দ্বন্ধের অবসান হতে থাকে , তেমনি সাহিত্যও ক্রমান্বয়ে গণমুখী সাহিত্যের দিকে পা বাড়ায় । যার প্রকাশ দেখা যায় ১৫ শতকের শেষ ভাগে অনেক কালজয়ী সাহিত্য কর্মে উদাহরণস্বরূপ বলা যায় পুর্ব বঙ্গের ময়মনসিংহ গীতিকা ভুক্ত মহুয়া , মলুয়া , নদের চাঁদ , দস্যু কেনারামের পালা, দেওয়ান ভাবনা, কাজল রেখা প্রভৃতি লোক গাথায় । পঞ্চদশ শতকের বাংলার প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতী তাঁর বাংলায় প্রনীত রামায়নে রাম বন্দনা গীতের পাশাপাশী সীতার মহাত্বতা বর্ণনা বিশেষ পারদর্শীতার মাধ্যমে দেবতা নির্ভর সাহিত্যকে গণসাহিত্যে পর্যবসিত করার যে সাহসী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তা আজ সর্বমহলে স্বিকৃত ।
যাহোক, মঙ্গল কাব্যে দেখা যায় মনসা বেহুলার সাহসী কার্যক্রমের ফলে বশীভুত হয়। ভাষান কবিতাগুলী যে শুধুমাত্র আর্য দেবতা উপর অনার্য দেবতার বিজয়কেই বিবৃত করেছে তা নয় , এগুলি শক্তিশালী দেবীর উপর মানুষের বিজয়ের দিকটিও উম্মোক্ত করেছে । এছাড়াও মনসা মঙ্গলে বেহুলা তার চরিত্রাঙ্কন দ্বারা ভারতীয় নারীত্বের সেরা বৈশিষ্টগুলিকে বিশেষায়ীত করেছে , বিশেষত স্বামীর প্রতি বাঙালি নারীর ভক্তির দিকটি লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে মঙ্গল কাব্যের ভাষান গুলিতে ।
দেবদেবীর মহাত্ব গাথা অনেক ব্রতকথা পাঁচ ছয় শতাব্ধী পুর্ব হতেই লোকের মুখে মুখে গীত হয়ে আসছে সর্বদা । এগুলিকেই অপেক্ষাকৃত রুপকে পাঁচালী বলা হয় । ক্ষমতাবান কবিদের হাতে পড়ে এই পাঁচালীই মঙ্গল কাব্যে পরিণত হয়েছে । মঙ্গল কাব্যের দেবদেবীর মধ্যে মনসা, চন্ডী এবং ধর্মঠা কুবেরে প্রতিপত্তিই বেশী ।
মঙ্গল কাব্যের রচয়ীতাদের মধ্যে মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি কানা হরিদত্তের নাম চলে আসে সর্বাগ্র ( ১৩ শ শতক) কিন্তু তাঁর কাজ অস্তিত্বহীন এখন আর খুঁজে পাওয়া যায়না । মঙ্গল কাব্যের বিখ্যাত কবি বিজয়গুপ্ত এবং পুরুষোত্তম এর কর্মে তার নামের হদিস পাওয়া যায়। বিজয় গুপ্তের সময়কালীন নারায়ণদেব ( ১৫ শ শতক) নামক ময়মনসিংহের আদিবাসি আর একজন খ্যাতিমান কবির কাব্যের সন্ধান পাওয়া যায় । এ ছাড়া সে সময় বিপ্রদাস , গঙ্গাদাস সেন, দ্বিজ বংশীদাস, জগজ্জীবন ঘোষাল , ষষ্ঠীবর দত্ত , জীবন মৈত্র প্রভৃতি আরো অনেক কবি মনসার গান রচনা করেছেন । কিন্তু কবিত্বগুণে কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের( ১৭ শতক) মনসার ভাসান যে পরিমাণ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল আর কোন মনসা মঙ্গল সেরূপ পারেনি ।
এবার কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের কিঞ্চিত বিবরণ দিয়ে আমরা তাঁর রচিত মঙ্গল কাব্য সুধায় অবগাহন করব ।
কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের নামের প্রথম অংশ কেতকাদাস তাঁর পরিচয়জ্ঞাপক বিশেষণ । নাম ভনিতায় নীজেকে কেতকাদাস বলে উল্লেখ করেছেন । ক্ষেমানন্দ রাঢ়ের অধীবাসী ছিছেন । বঙ্গদেশের যে অংশটি গঙ্গার পশ্চিমতীরে অবস্থিত সে অংশটি প্রচীনকালে রাঢ় নামে পরিচিত ছিল । ক্ষেমানন্দের কাব্যটি সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগে রচিত হয়েছিল । সে হিসাবে এর ঐতিহাসিক মুল্য অনেক । তাঁর আত্ম পরিচয়ে জানা যায় তিনি জাতিতে কায়স্থ , পিতার নাম শঙ্কর মন্ডল । বিবিধ কারণে তারা গ্রামান্তরী হয়ে পলায়নপুর্বক রাজা বিঞ্চুপদের রাজ্যে উপনীত হন , স্থান পান বিঞ্চুপদের ভাই এর আলয়ে যেখানে কবির নীজ ভাষার বর্ণনায় দেখা যায় :
“ তিনি দিলেন ফুল পান , আর দিলেন তিনখানা গ্রাম
লিখাপড়া বসতির স্থান “
একদিন ক্ষেমানন্দ নীজ ভ্রাতা সনে জলাশয়ে ধরতে গিয়েছিলেন মাছ । মাছধরা ধরা শেষে ভ্রাতা গেলেন গৃহে ফিরে ক্ষেমানন্দ রইলেন পরে খড় কাটার তরে । কিন্তু হলনা তার খড় কাটা অকস্মাৎ আকাশ আধার হয়ে এল প্রবল ঝড় , সে সময় কবি অবাক হয়ে দেখলেন এক মূচিনী তাঁর সামনে দন্ডায়মানা ।
“ মূচিনীর বেশ ধরি বলেন দেবী বিষহরী
কাপড় কিনিতে আছে টাকা ?
কাপড় বেচাকেনার জন্য স্থানটিও যেমন উপযুক্ত , কালটি ও তেমনি ছিল অনুকুল । কবি হতবাক হয়ে নির্নিমেষে রয়েছিলেন চেয়ে এমনি সময়ে পিপিলিকা দংশনে যেই কবি দৃষ্টি নামালেন অমনি দেবী হলেন অন্তর্হিত । মুখ তুলে দেখেন শুন্য প্রান্তর কেহ কোথাও নেই ।
ক্ষেমানন্দ বিস্ময়ে ভাবতে ছিলেন কে এই মূচিনী ? তাঁর বিষ্ময়ে কতৌহলী হয়ে দেবী স্বরূপে আবির্ভুত হলেন । “ভুজঙ্গঠাটে বেষ্টিত” মনসার ভয়ংকরী মূর্তী দেখে কবির গলা যায় শুকিয়ে ।
দেবী বললেন যা দেখিলে তা কারো কাছে করবেনা প্রকাশ
তাহলে অকল্যাণ হবে । আরো বললেন
ওরে পুত্র ক্ষেমানন্দ কবিতা কর প্রবন্ধ
আমার মঙ্গল গায়্যা দোল ।
দেবীর আদেশ পেয়ে ক্ষেমানন্দ মনসামঙ্গল রচনায় হলেন প্রবৃত্ত ।
ক্ষেমানন্দের কাব্যপ্রতিভা সকলকে বিমুগ্ধ করে । করুন রসের চিত্রাঙ্কনে তাঁর দক্ষতা সমধিক প্রকাশ পায় । লোহার বাসরে পতিকে কোলে নিয়ে বেহুলার সেই যে ব্যকুল ক্রন্দন তা সহজেই আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করে । লোহার বাসর হতে পুত্রবধুর ক্রন্ধনধ্বনি শুনতে পেয়ে বেহুলার শাশুরী সনকার বুক কেঁপে উঠে । তিনি ছুটে গিয়ে দেখলেন
বেহুলা নাচনী বড় কান্দে উচ্চ:স্বরে
দুর্লভ লখাই মৈল লোহার বাসরে ।।
শুনিয়া বিদরে প্রাণ চক্ষে পড়ে পানি।
মরা পুত্র কোলে করে কান্দয়ে বেনেনী ।।
পুত্র শোকে পাগল হয়ে সনকা বেহুলাকেও দিলেন গালি । বললেন
বিভা দিনে খাইলি পতি না পোহাতে রাতি ।
হতভাগিনী, তোর সীমন্তের সিন্দুরে পড়িল না কালি
তোর পরিধান বস্র হলনা মলিন
তোর চরণের অলক্তকে লাগিল না ধুলি
হায় এই টুকু সময়ের মধ্যেই
তুই এমন সর্বনাশ করিলি
পুত্রহারা জননীর এই শোক স্বাভাবিক , এই শোক তাকে নিষ্ঠুর করে তুলেছে । যে হতভাগিণি স্বামী শোকে বিহ্বল তাকে তারই সর্বনাশের জন্য দায়ী করে শাশুরী যে গালি দিলেন বেহুলা তার প্রতিবাদ করলনা । সে শুনল কি শুনলনা তা বুঝা গেলনা । বেহুলার শোকার্ত হৃদয়ের এ অনুক্ত বর্ণনাই এ মঙ্গল কাব্যে এই অংশটুকুকে অশ্রুসিক্ত করে তুলেছে ।
পতিব্রতের প্রসঙ্গে সীতা সাবিত্রীর কথাই আমাদের সর্বাগ্রে মনে পড়ে । কিন্তু এই পৌরানিক রমনীর পাশে বেহুলাও সগর্বে স্থান লাভ করতে পারে । সীতা সাবিত্রী বিবাহের পর স্বামীসঙ্গ লাভ করেছিলেন কিন্তু বেহুলা বিবাহ রাতেই স্বামীকে হারিয়েছিলেন । তার পর হতেই মৃত স্বামীকে কোলে নিয়ে ছয় মাস ধরে নিষ্ঠুর নিয়তির সেই যে নিরন্তর সংগ্রাম সে তো সহজ কথা নয় । অবশ্য এ কথা মানতেই হয় , বেহুলা চরিত্রের এই অবিচলিত নিষ্ঠা এই অসহনীয় দৃঢ়তা পতির জীবন ফিরে পাওয়ার জন্য এই জীবনপন সাধনা –এর সব টুকুই কবির আপন সৃষ্ট নয় । পাঁচালীর গানে , প্রচলিত কাহিনীতে বেহুলার সতিত্বকথা পুর্ব হতেই গীত হয়ে আসছিল কিন্তু কবি স্বীয় প্রতিভার স্পর্শ দিয়ে বেহুলার লৌকিক কাহিনীকে অলৌকিক মহাত্মে মন্ডিত করেছেন ।
চাঁদ সদাগরের দুর্দমনীয় গৌরবের ছবিটিও কবির হাতে সমুজ্জল বর্ণে চিত্রিত হয়েছে ।
মনসার সহিত নিরন্তর বিবাদ করে তার বিপদের অন্ত নেই । দেবীর কোপে তার ছয় পুত্র মরিল , ধনরত্ন ভরা চৌদ্দ ডিংগা সাগরের জলে ডুবে বিনষ্ট হল । ঘরে পরে দেশ বিদেশে লাঞ্ছনার সীমা পরিসীমা থাকলনা । তথাপি মনসাকে তিনি দেবতা বলে স্বীকার করতে প্রস্তুত নন ।
মনস্তাপ পায় তবু না নোয়ায় মাথা ।
বলে চেঙ্মূড়ী বেটী কিসের দেবতা ।।
পুত্র বধু বেহুলার অনুরোধে বৃদ্ধ বয়সে চাঁদ সদাগরকে শেষ পর্যন্ত মনসার পদমূলে ফুল দিতে হয়েছিল সত্য এবং এর ফলে চন্দ্রধরের চরিত্র-গৌরব কিছুটা হ্রাস পেয়েছে এটাও না মানার উপায় নেই , কিন্তু সে আপরাধ কবির নয়। কবিকে যে পুরাতন কাহিনীর শৃঙখলে কিছুটা আবদ্ধ থাকতে হয়েছে এ কথা ভুললে চলবেনা ।
কেতকাদাসের মনসা মঙ্গল উষাহরণ, মখন, রাখালপূজা, ধম্বম্বরি ও বেহুলা লখিনন্দর নামক পাঁচটি পালায় বিভক্ত , কিন্তু কোন হস্তলিখিত পুঁথিতেই একত্র সব কটি পালা পাওয়া যায়নি । পাঁচটি পালার মধ্যে শেষেরটি বেহুলা লখিনন্দরই প্রধান । মনসা মঙ্গলের মুল আখ্যান চাঁদ সদাগরের বৃত্তান্ত এই পালার উপজিব্য । এই পালার আর এক নাম জাগরণ পালা । বেহুলা লখিন্দর বা জাগরণ পালাই ক্ষেমানন্দের কাব্যগ্রন্থের বিষয়বস্তু ।
কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের মনসা মঙ্গল কাব্যে বিভিন্ন শিরোনামে ৭৬ ভাষান রয়েছে । যার মধ্যে
চাঁদের নৌকা ডুবানুর জন্য মনসার মন্ত্রনা , চাঁদের নৌকা ডুবি এ সত্বেও তার দুর্জয় মনোবল, মনসার ছলনা, চাঁদসদাগরের ভিক্ষাবৃত্তি ও বনে গমন , চন্দ্রকেতুর সহিত মিলন, চন্দ্রকেতুর সহিত সদাগরের কথোপকথন, চাঁদ বেনের সহিত কাঠুরিয়ার সাক্ষাত, সনকার গর্ভ, লখিন্দরের জম্ম ও ললাটলিখন, বেহোলার জন্ম , লখিন্দরের বিবাহ সম্বন্ধ, বেহুলাকে মনসার ছলনা , বিশ্বকর্মাকে লোহার বাসর গড়ার আজ্ঞা ও বাসর ঘর নির্মাণ:
লখিন্দের বিবাহ , লখিন্দর ও বেহুলার বাসরে শয়ন , লখিন্দরের সর্পাঘাত, বেহুলার রোদন , সনকার ক্রন্দন , বেহুলার মান্দাসে( বেলায়) গমন লখিন্দরের মৃত্যু সংবাদ শুনে অমলার রোদন ও বেহুলার উদ্দেশ করতে সাধুর পুত্র দিগের গমন , বেহুলা সংকল্পে অটল। ভেলায় ভেসে উজান বেয়ে বিভিন্ন ঘাটায় গমন।
বেহুলার কাপড় কাচা , মনসার সখী নেতার সহিত বেহুলার দেব সভায় গমন ও নৃত্য , দেবসভায় মনসার আগমণ বেহুলার প্রার্থনা শ্রবণ , মনসা কতৃক লখিন্দরের প্রাণদান, মনসার যমালয়ে গমন ও সাধুর ছয়পুত্র ও তার ডিংগা উদ্ধারশেষে নীজ পিত্রালয় হয়ে শশুরালয়ে গমন , দেবীর আজ্ঞায় সর্পগনের বহিত্র বহন, চাঁদবেনের মনসা পূজা, পুজা নিতে মনসার গমন , অস্টমঙ্গল, কলির উপাক্ষান, লখিন্দর ও বেহুলার স্বর্গে গমন ইত্যাদি আখ্যানের মধ্য দিয়ে কাহিনীর যবনিকাপাত । এ রচনায় যে সমস্ত পুস্তকাদির সহায়তা নেয়া হয়েছে তা সুত্রাংশে দেয়া হয়েছে ।
লিখাটির এ পর্বে ১ টি ভাষান সন্নিবেশিত করা হয়েছে ।
আর্কাইভ হতে প্রাপ্ত রচনায় অনেক লিপী পাঠ অযোগ্য থাকায় কয়েক জায়গায় কিছু শব্দ ও বানান প্রমাদ হতে পারে , সে দায় এ অনুলিখকের ।
মনসা কতৃক চাঁদ সদাগরের সপ্তডিঙ্গা ডুবাইবার মন্ত্রনা দিয়া মনসা মঙ্গল কাব্য গ্রন্থের শুরু ।
১) মনসা কতৃক চাঁদ সদাগরের সপ্তডিঙ্গা ডুবাইবার মন্ত্রনা
চম্পক নগরে ঘর চাঁদ সদাগর
মনসা সহিত বাদ করে নিরন্তর।
দেবীর কোপেতে তার ছয় পুত্র মরে
তথাপি দেবতা বলে না মানে তাঁহারে ।।
মনস্তাপ পায় তবু না নোয়ায় মাথা
বলে চেঙ্মুড়ী বেটী কিসের দেবতা।।
হেতাল লইয়া হস্তে দিবানিশি ফেরে
মনসার অন্বেষণ করে ঘরে ঘরে । ।
বলে একবার যদি দেখা পাই তার ।
মারিব মাথায় বাড়ি না বাচিবে আর ।।
আপদ ঘুচিবে মম পাব অব্যাহতি ।
পরম কৌতুকে হবে রাজ্যেতে বসতি।।
এই রূপে কিছুদিন করিয়া যাপন।
বানিজ্যে চলিল শেষে দক্ষিন পাটন।।
শিব শিব বলি যাত্রা করে সদাগর ।
মনের কৌতুক চাপে ডিঙ্গার উপর।।
বাহ্ বাহ্ বলি ডাক দিল কর্ণধারে ।
সাবধান হয়ে যাও জলের উপরে । ।
চাঁদের আদেশ পা্ইয়া কান্ডারী চলিল ।
সাত ডিংগা লয়ে কালিদাহে উত্তরিল ।।
চাঁদ বেনের বিসস্বাদ মনসার সনে ।
কালীদহে সাধু দেবী জানিল ধেয়ানে ।।
নেতা লইয়া যুক্তি করে জয় বিষহরী ।।
মম সনে বাদ করে চাঁদ অধিকারী।।
নিরন্তর বলে মোরে কানী চেঙ্মুড়ী
বিপাকে উহারে আজি ভরা ডুবি করি ।।
তবে যদি মোর পূজা করে সদাগর।
অবিলম্বে ডাকিল ষতেক জলধর ।।
হনুমান বলবান পরাৎপর বীর।
কানীদহে কর গিয়ে প্রবল সমীর ।।
পুস্প পান দিয়া দেবী তার প্রতি বলে
চাঁদ বেনের সাত ডিংগা ডুবাইবে জলে ।।
দেবীর আদেশ পাইয়া কাদম্ববিনী ধায় ।
বিপাকে মজিল চাঁদ কেতকাতে গায় ।।
পরবর্তী পর্ব -২ দেখার আমন্ত্রন রইল ।
সুত্র ও গ্রন্থপঞ্জি:
১. কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ রচিত মনসা মঙ্গল, পরিবর্তিত দ্বিতীয় সংস্করণ, শ্রীযতীন্দ্রমোহন , এম এ , কলিকাতা বিশ্ব বিদ্যালয় ( সানফ্রানসিসকো ভিত্তিক ইন্টারনেট আর্কাইভ থেকে সংগৃহীত)
২. মনসার ভাসান অর্থাৎ চাঁদ সদাগরের সহিত মনসার বিবাদ এবং বেহুলা লখিনন্দরের জীবন-চরিত্র ও মনসাদেবীর মহিমা প্রকাশ ।( শ্রীকেতকানন্দ দাসের সহযোগিতায় শ্রীক্ষমতাদাস কতৃক বিবিধ ছন্দে বিরচিত ) চতুর্থ মুদ্রন , জেনারেল লাইব্রেরী কলিকাতা ৬ ।
৩ . বাঙ্গলা সাহিত্য়ের ইতিহাস । প্রথম খন্ড , প্রথম সংস্করণ । শ্রীসুকুমার সেন । মডার্ন বুক এজেন্সি । কলিকাতা ।
৪. বাংলা মঙ্গল কাব্যের ইতিহাস । তৃতীয় সংস্করণ । শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য , এ মুখার্জী এন্ড কোং প্রাইভেট লিমিটেড । কলিকাতা ।
ছবি : গুগল ইন্টারনেট ।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুলাই, ২০১৬ সকাল ৯:৩৮