ধর্ম নিয়ে রাজনীতি ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতির ধর্ম। ধর্ম বিশ্বাসের কারণে সাধারণ মানুষগুলো ধর্মের রাজনীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছে আর রাজনীতি করার কারণে রাজনীতিবিদরা ধর্মকে প্রশ্রয় দিয়েছে; সেটা অনুভূতি থেকে নয় ভন্ডামি থেকে। আমরা যদি সুদুর পেছনে তাকাই সেই 1228 সাল থেকে এযাবৎকাল পর্যন্ত যারা রাজনীতি করেছেন বা দেশের শাসনভার পেয়েছেন বা নিয়েছেন সর্বক্ষেত্রে ধর্মের বিরাট প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। একদিকে যারা ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলেছেন তাদেরকে নাস্তিকতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে কিছু রাজনৈকিতগোষ্ঠি বা ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে ধর্ম প্রচারের কথা বলে বা ধর্মীয় আগ্রাসী চালিয়ে সম্পদশালী হয়েছেন বা রাজনৈকিত ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়েছেন। যেমন- ১২০৬ সাল থেকে ১৫৯৬ সাল পর্যন্ত ভারতের পশ্চিমের প্রতিবেশী পারস্যে আরব অভিযানের পর সেই অঞ্চলের বাহিনী ভারত অভিযানে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ভারতের সমৃদ্ধ ধ্রুপদী সভ্যতা, বিকাশশীল বৈদেশিক বাণিজ্য এবং তৎকালীন বিশ্বের একমাত্র হিরের খনি তৎকালীন মুসলীমদের আকর্ষণ করে অতঃপর কয়েক শতাব্দী উত্তর ভারতীয় রাজন্যবর্গের বাধার সম্মুখীন হওয়ার পরও উপমহাদেশের উত্তরাঞ্চলে একাধিক স্বল্পকাল স্থায়ী ইসলামি সাম্রাজ্য বা সুলতানেৎ স্থাপিত করে। এইভাবেই আব্রাহামীয় মধ্যপ্রাচ্য ধর্মব্যবস্থা দক্ষিণ ভারতে বিদ্যমান রক্ষণশীল হিন্দু সমাজে বিস্তার লাভ করে। পরবর্তীকালে দক্ষিণ ভারতেই বাহমনি সুলতানি ও দাক্ষিণাত্য সুলতানির উন্মেষ ঘটে। দ্বাদশ শতক থেকে ষোড়ষ শতকের এই ঘটনাগুলো সফল ভাবেই প্রমাণ করে যে, তৎকালীন সময়েও ধর্ম প্রচারের দোহায় দিয়ে তথাকথীত ধর্মপ্রচারীগণ সম্পদশালী এবং ক্ষমতাশালী হয়েছে। যেহেতু সেই রক্তের জ্বিনগত ধারাবাহিকতায় এই উপমহাদেশে পরবর্তী শাসকগণ বা রাজনীতিবিদগণ পৃথিবীতে প্রাদূর্ভাবিত হয়েছেন সেহেতু ধর্ম ভিত্তিক ফায়দা হাসিলের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে উদারচিন্তাযুক্ত রাজনৈতিক আদর্শের সাথে নিজেদেরকে সংযুক্ত করতে পারেনি।
1947এর দেশ ভাগের পর জিন্নাহ, নেহেরু এবং বল্লবভাই প্যাটেল প্রমুখ বুঝতে ব্যর্থ হলেন যে, ‘বাংলাদেশ’ নামের একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রসহ ভারতবর্ষকে মোট ৩টি রাষ্ট্রে ভাগ করা হলে এই অঞ্চলের মানুষের সার্বিক মঙ্গল হবে। জিন্নাহ সাহেব কলকাতা থেকে দিল্লি ফিরে গিয়ে হিন্দি-উর্দু ভাই ভাই একজোট হয়ে বাংলাদেশের কথা ভুলে গেলেন। ফলে উপমহাদেশ মানবিক ও ভাষাগত চিন্তা ভূলণ্ঠিত হলো আবার সাম্প্রাদায়িকচেতনাদ্ভূত কল্পিত দ্বন্দ্বভিত্তিক দু’টি রাষ্ট্র গঠন হলো। দেশ ভাগের এক দশকের মধ্যেই ভ্রান্ত দেশ-ভাগ নীতির কারণেই ভাষার জন্য নির্মম ভাবে প্রাণ দিতে হলো বেশ কয়েকজন বাঙালীকে, পৃথিবীতে সূচিত হলো ইতিহাসের নির্মম আরেক নতুন এমন এক অধ্যায় যা পৃথিবীতে ইতিপূর্বে কোনদিন ঘটেনি ভবিষ্যতে ঘটবে বলেও মনে হয়না। আর সেটা কোন কিছু অর্জনের জন্য নয় জন্মসূত্রে পাওয়া মায়ের ভাষা রক্ষার জন্য জীবনোৎসর্গ। ধর্ম তত্ত্বের ভ্রান্ত নির্মম ফলোদয় এখানে শেষ নয় সূচনা মাত্র। অতঃপর পৃথিবী ব্যাপি দেখেছে পশ্চিম পাকিস্থান কত নির্লজ্জভাবে পূর্ব পাকিস্থানের সাথে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে। যেমন সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন অংশে সমগ্র বাহিনীর মাত্র ৫ শতাংশ অবদান ছিল এবং 1970 সালের ১২ই নভেম্বর ভোলার সাইক্লোন পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রবল জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি করে, সেই সাথে জোয়ারের কারণে প্রায় ৩,০০,০০০ থেকে ৫,০০,০০০ মানুষ প্রাণ হারায়। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক সরকার এমন ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরও জরুরি ত্রাণকার্য পরিচালনায় গড়িমসি করে এবং ঘূর্ণিঝড়ের পরও যারা বেঁচে ছিল তারা মারা যায় খাবার আর পানির অভাবে। যা ছিল ধর্ম ভিত্তিক দেশ-ভাগের সকরুণ নির্মমতা।আর হাজারো অর্থনৈতিক বৈষম্য তো রয়েছেই।
মুক্তিযুদ্ধে ব্যাপক জয়ের পরও, মাত্র স্বাধীনতার হাফ দশকের মধ্যেই স্বাধীনতার মহানায়ককে (যুদ্ধ ব্যতিত ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্যতম হত্যাকান্ড) হত্য করে। ধর্মীয় রাজনীতির কারণেই হত্যকারীর প্রায় সাড়ে তিন দশক বিচার বর্হিভূত ভাবে বা বিচারাধীন অবস্থায় বেঁচে ছিলেন।যা ছিল অনেকটাই ধর্মীয় রাজনীতির ফল কারণ ঐ নির্মম হত্যযজ্ঞের পর যে সকল রাষ্ট্র প্রধান ও সরকার প্রধান ঘৃণ্য হত্যাকারীদেরকে বিচারের আওতার বাইরে রেখেছিলেন তারা ধর্মীয় রাজনৈতিক ভিত্তি গড়েছিলেন কারণ তাদের কোন আদর্শিক চেতনা ছিলনা।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতির চরম নির্লজ্জতা এখানে শেষ নয়, যারা এই দেশের পরাধীন রাখার জন্য কোরান ছূঁয়ে শপৎ নিয়েছিল এই বলে যে, "I shall bear true allegiance to the constitution of Pakistan as framed by law and shall defend Pakistan, if necessary, with my life." অর্থাৎ, "আমি আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের সংবিধানের প্রতি সত্যিকার আনুগত্য প্রদর্শন করব এবং জীবন দিয়ে হলেও পাকিস্তানকে রক্ষা করব।শুধুমাত্র ধর্মীয় রাজনীতির কারণেই তারাই আবার স্বাধীনতার তিন দশক পর স্বাধীন এই দেশের লাল-সবুজ পতাকাবাহী সরকারী গাড়ীতে ঘুরে বেড়িয়েছেন, পতাকাকে করেছে চরম অপমান।যদিও তাদের এই অনাকাঙ্খিত ক্ষমতা প্রাপ্তির পেছনে স্বাধীনতার নের্তৃত্ব প্রদানকারী দলটির আদর্শচ্যূত রাজনীতিও কম দায়ী নয়। তখন মনে হতো-
নিশি কি হবেনা ভোর?
কাটিবেনাকি বিস্মরণের ঘোর?
মেঘলা গগণে জঞ্ঝাবর্ত স্বপ্ন বিহঙ্গী,
ভাঙিবে কি পাখা পাবেনাকি সঙ্গী?
আজকে মনে হয় গগনের সেই মেঘ কেটে গেছে, স্বপ্ন বিহঙ্গ ডানা মেলে উড়তে পারছে। যদিও যে মানুষগুলো প্রজন্ম চত্ত্বরে জেগে উঠেছে তাদেরকে নাস্তিক বলা হচ্ছে এবং এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলো প্রযুক্তির প্রগতিশীল মাধ্যম যেমন-সংবাদ মাধ্যম, ব্লগ ও অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করছে। আবার ক্ষমতাসীন জোট রাজনৈতিক ফায়দাও লুটতে চাইছে। বাংলাদেশের মানুষ আজ আওয়ামীপন্থী জোট ও বিএনপিপন্থী জোটের বিকল্প চিন্তা করতে শিখেছে, দেশের মানুষ আজ ধর্মকে বুকের মধ্যে লালন করে কিন্তু ধর্মভিত্তিক কপট রাজনীতিকে ভূলণ্ঠিত করতে শিখেছে। আজ প্রজন্মচত্ত্বরগুলোতে এদেশের যুব সমাজ জেগে উঠেছে, সঙ্গীতের মূর্ছনায় তারা ষোলকোটি মানুষকে জাগিয়ে রেখেছে। এখন আর কেউ ঘুমিয়ে নেই। কিন্তু শঙ্কাতো আছেই, 71-এর পরাজীতরা ধর্মের ভয় দেখিয়ে আবার ঘুম পাড়াতে চাইছে। নাস্তিকতার কাটা আলোর পথে ছড়াতে চাইছে কিন্তু মানুষতো সে কাটা দেখে পথ চলতে শিখেছে, তাই তাদেরকে আর ঘুম পাড়িয়ে রাখা যাবেনা বা ঘরে বন্দি রাখা যাবে না।
তাই এখন প্রাণ খুলে বলতে ইচ্ছা করছে-
জয়তু, বিয়াল্লিশে জয়তু তুমি জয়তি
তপস্য তব হেরিতে পনেরশ শর্বরী জাগি
করেছি বিরামহীন ক্রন্দন, লড়েছি অহর্নিশি
আজি আসিয়াছো দুয়ারে তুমি শোনাতে সুরের রাগি
ধন্যবাদ সবাইকে।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সকাল ১১:৪৪