আমি হলাম বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। আমার বাবা মা দুজনেই ডাক্তার। ডাক্তার দম্পতির একমাত্র সন্তান হিসাবে আমার যেরকম হওয়ার কথা ছিল আমি তার ধারেকাছেও না । আমি হলাম অগোছালো,উদাসীন,খামখেয়ালি,বাউণ্ডুলে টাইপ একটা ছেলে। কোন কিছুতে মনোযোগ নেই,জীবন নিয়ে সিরিয়াস কোন ভাবনা নেই। আমার বাবার টাকা পয়সার দিক থেকে সচ্ছলতার ব্যাপারটা হয়ত আমার এরকম হওয়ার পিছনের কারণ হতে পারে। আমার এক খালার মধ্যস্থতায় রেবতীর সাথে আমার বিয়ে হয়। বিয়ের পর রেবতী সম্পর্কে আমার ধারনা ছিল যেহেতু সে আধুনিক সমাজে বেড়ে উঠা একটা শিক্ষিত মেয়ে, সেহেতু তার চলাফেরায় সেই ভাবটা পরিলক্ষিত হবে। কিন্তু যত দিন যেতে লাগল ততই আমার ধারনা ভুল প্রমাণ হতে লাগল। আস্তে আস্তে বুঝলাম সে একটা সহজ সরল বাঙালি বধূ টাইপ গুণবতী ও হাসিখুশি মেয়ে। তার সাথে কেউ কথা বলে চিন্তাই করতে পারবে না যে – সে ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স পাশ করা একটা মেয়ে ।
তরুণ ছেলেমেয়েদের মাঝে বিয়ে পরবর্তী জীবন নিয়ে কিছু স্বপ্ন থাকে – কিছু কল্পনা থাকে। কিন্তু কেন জানি আমার মাঝে সে ধরনের কিছু কখনই ছিল না। তবে আমার স্ত্রী রেবতীর মাঝে সেটা খুব প্রকটভাবে ছিল । কোথায় হানিমুনে যাব,প্রথম বিবাহ বার্ষিকীর কেকটা কি ধরনের হবে,তার জন্মদিনে কোথায় ক্যান্ডল লাইট ডিনার করব,আমার জন্মদিনে সে কি গিফট দিবে ,আমাদের প্রথম বাচ্চার নাম কি হবে,আমাদের ঘরের জানালার পর্দার রঙটা কি হবে ব্লাব্লাব্লা । তার এসব চিন্তাধারা আমার কাছে ছেলেমানুষি মনে হত। তাই সবসময়ই তার এসব ব্যাপার আমি এড়িয়ে যেতাম। আমার এই এড়িয়ে যাইয়াটা মাঝেমাঝে তাকে কষ্ট দিত, সেটাও আমি বোঝতে পারতাম। আমি তাকে বলতাম হিন্দি সিনেমা দেখা একটু কমাও, দেখবে তোমার এসব রোমান্টিকতা আর তোমার মাঝে থাকবে না। একসময় সে হিন্দি সিনেমা দেখা একেবারে ছেড়ে দিল কিন্তু তার মাঝে বাস করা রোমান্টিক চিন্তাধারাগুলো ঠিকি আগের মত করে রয়ে গেল ।
আমি যখন কাজ থেকে ফিরি কলিং বেল টিপবার আগেই সে দরজা খুলে দেয়। তার দরজা খোলা দেখেই বুঝতে পারি সে আমার জন্য অপেক্ষায় ছিল। আমার গোসলের জন্য বাথরুমে সবকিছু রেডি করে রাখে। গোসল করে এসে টেবিলে খাবার রেডি করা পাই। আমি যতক্ষণ খাবার খাই সে ততক্ষণ আমার পাশে বসে থাকে। আমার খাবার শেষ হলে সে খায়। তার দাদির কাছ থেকে সে জেনেছে স্বামীদের খাওয়ার পর নাকি স্ত্রীদের খেতে হয়। তা না হলে নাকি স্বামীর অমঙ্গল হয়। তার এই স্বামীর অমঙ্গল পদ্ধতিটা যে খুবই প্রাচীন কুসংস্কারে ঘেরা, সেটা আমি অজস্রবার বুঝিয়েও তাকে বুঝাতে ব্যর্থ হয়েছি। একবার আমার প্রচণ্ড কাশি হয়েছিল। কোন ঔষধে কাজ হচ্ছিল না। সে প্রতি নামাজের পর কোরান তেলাওয়াত করে আমার গলায় ফু দিত। তাকে কে নাকি বলেছে এইরকম ফু দিলে কাশি কমে যায়। তার এসব ব্যাপার আমার কাছে খুব হাস্যকর লাগত। তাকে অনেকবার বুঝিয়েও তার এই স্বভাবগুলো বদলাতে পারিনি। সে প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর তাকে আমি সপ্তাহে দুইদিন হসপিটালে নিয়ে যেতাম। একদিন হসপিটালের ক্যান্টিনে চা বিস্কুট খেয়ে বলেছিলাম বিস্কুটটা খুব মজার। এরপর থেকে সে যতবার হসপিটালে গেছে আমার জন্য এক প্যাকেট বিস্কুট নিয়ে এসেছে ।
আমার স্ত্রী রেবতী এখন ইনটেনসিভ কেয়ারে শুয়ে আছে। ডাক্তার বলেছে অতিরিক্ত ঠাণ্ডা লাগানো কারণে তার নিউমোনিয়াটা এখন চরম পর্যায়ে। তাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এন্টিবায়োটিক দেয়া জরুরী। কিন্তু বাচ্চা পেটে রেখে এন্টিবায়োটিক দেয়া সম্ভব নয়। তাই অপারেশন করে বাচ্চা বের করে নিতে হবে। এই অপারেশন করতে গিয়ে বাচ্চা বা মা যে কোন একজনকে বাঁচানো সম্ভব। কিন্তু তারা শিউর হয়ে বলতে পারছে না কাকে বাঁচানো যাবে। তবে তারা সর্বাত্তক চেষ্টা করছে কিভাবে দুইজনকে বাঁচানো যায়। রেবতীর একবার জ্ঞান ফিরেছিল। আমার দিকে তাকিয়ে একটা বাক্যই সে বলেছে-তোমার খাওয়া দাওয়া ঠিকমত হচ্ছেতো। আমি তাকে কিছুই বলতে পারিনি শুধু তার স্বাপ্নিক চোখে দেখেছি টলমল করছে তার সেই রোমান্টিক স্বপ্নগুলো। যে স্বপ্নগুলো আচানক এক সুখের তুলিতে পুরাপুরি আমাদের দুজনের জন্য আঁকা হয়েছিল ।
কিছুক্ষণ আগে একজন নার্স আমাকে বলে গেল -একটু পরেই রেবতীকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হবে।এক হাতে হসপিটাল ক্যান্টিনের সেই বিস্কুটের প্যাকেট আর অন্য হাতে বাচ্চাদের নামের একটা তালিকা নিয়ে আমি এখন হসপিটালের বারান্দায় বসে আছি। যে নামের তালিকাটি রেবতী বানিয়ে আমাকে দিয়ে বলেছিল – এখান থেকে একটা ছেলের আর একটা মেয়ের নাম বাচাই করে দিতে। কিন্তু রেবতীকে আমার কোন নাম পছন্দ করে দেয়া হয়নি। কোনদিন তাকে বলা হয়নি- আমার একটা ব্যক্তিগত নক্ষত্র আছে, যার নাম রেবতী।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ২:৫৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




