যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপীলে সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডের পর সন্দেহ আর অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ছে বিএনপি-জামায়াত জোটে। দলীয় নায়েবে আমির সাঈদীর আমৃত্যু কারাদণ্ডের সাজা দেয়ার পর থেকে জোটবন্ধু বিএনপি ও তার নেতাদের আচরণে ক্ষুব্ধ জামায়াত-শিবির। বিএনপি নেতাদের আচরণে ক্ষুব্ধ জোটের জামায়াতপন্থী ইসলামী দলগুলোও। জামায়াত-শিবির ও তাদের মদদপুষ্ট দলগুলো বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে বলছে, জোটের শরিকদলগুলো ক্ষুব্ধ মনোভাব দেখালেও বিএনপির অবস্থান পরিষ্কার নয়। বরং রায়ের পর থেকে টিভি টকশোতে বিএনপির যারাই মুখ খুলেছেন তারাই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলেছেন, সাঈদীর রায় সরকারের সঙ্গে জামায়াতের আঁতাতের ফসল। জামায়াত নেতারা আরও বলছেন, বিএনপির মধ্যে থাকা জামায়াতবিরোধী কিছু নেতার চেষ্টাই হচ্ছে খালেদা জিয়ার কাছে প্রমাণ করা যে, সরকারের সঙ্গে জামায়াতের গোপন সমঝোতা আছে। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া যদি ‘ঘরের শত্রু বিভীষণদের’ কথা শুনেন তাহলে তাকে পস্তাতে হবে বলে অনেক জামায়াত নেতা মন্তব্য করেছেন।
সরকারের সঙ্গে জামায়াতের আঁতাত হয়েছে-ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিএনপির নেতাদের দেয়া এমন মনোভাব নিয়ে অসন্তোষ ক্রমেই বাড়ছে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের মধ্যে। জামায়াত ও শিবিরে অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে তাঁরা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। এসব নেতাকর্মীর দাবি, সরকারের সঙ্গে জামায়াতের কোন আঁতাত হয়নি, হবেও না। বরং বিএনপি নেতাদের কেউ কেউ আঁতাত করে গ্রেফতার এড়িয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রেখেছেন। তাই বিএনপি নেতাদের মুখে আঁতাতের কথা বলা মানায় না। গত বুধবার রায়পরবর্তী ২০ দলীয় জোটের শরিকদলগুলো কম বেশি ক্ষুব্ধ মনোভাব ও দুঃখপ্রকাশ করেছেন। বিএনপির নেতারা আনুষ্ঠানিকভাবে ছিলেন নো কমেন্টস অবস্থানে। তবে রায়ের দিন রাতেই বিভিন্ন টিভি টকশোতে বিএনপির যারাই মুখ খুলেছেন তারাই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলেছেন, সাঈদীর রায় সরকারের সঙ্গে জামায়াতের আঁতাতের ফসল। জোটমিত্র বিএনপি নেতাদের এমন মনোভাবে জামায়াত নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যেই তাদের ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন। বলছেন, এটি জোট ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র হতে পারে। জানা গেছে, রায়ের পর থেকেই জামায়াত-শিবিরের পক্ষ থেকে বিএনপির সকল পর্যায়ের নেতাদের বক্তব্য, বিবৃতির ওপর নজর রাখা হচ্ছে। বিশেষ করে শিবিরের পক্ষ থেকে নজর রাখা হচ্ছে টেলিভিশনগুলোর টক শোসহ অন্যান্য অনুষ্ঠানে বিএনপির কোন নেতা কি বলেন তার ওপর। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সাবেক এক সভাপতি বর্তমানে ঢাকা মহানগরের নেতা বলছিলেন তাদের ক্ষোভের কথা। বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা মীর নাসিরের বুধবার রাতে একটি টেলিভিশনের টকশোতে দেয়া বক্তব্যের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, বিএনপি চেয়ারপার্সনের ওই উপদেষ্টা বলেছেন, সরকার-জামায়াত সমঝোতা হয়ে থাকতে পারে। আরও কয়েক নেতা টকশোতে একই ধরনের মন্তব্য করেছেন। গণজাগরণ মঞ্চ থেকেও একই অভিযোগ করা হচ্ছে। সরকারের বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করতে গিয়ে বিএনপির অনেক নেতাই একই সুরে কথা বলছেন। জামায়াতের ওই নেতা আরও বলেন, বিএনপি চেয়ারপার্সনের আরেক উপদেষ্টা ওসমান ফারুক বলেছেন, জামায়াতের সঙ্গে সরকারের আঁতাত হয়েছে কিনা তা জানি না। এটা পরিষ্কার হবে আরও কিছুদিন পর। আর এটা হয়ে থাকলে সরকারের দুর্বলতা প্রকাশ পায়। আসলে এই উপদেষ্টা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জামায়াতের সমঝোতার কথা বলে জোটকে ক্ষতিগ্রস্ত করছেন।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্য ডা. রেদোওয়ান উল্লাহ শাহেদী বলেছেন, জামায়াত আঁতাতের রাজনীতি করে না। সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে দূরতম সম্পর্কও নেই। সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করলে এত ত্যাগ স্বীকার করতে হতো না, জামায়াত নেতাদের মিথ্যা মামলায় বিচারেই দাঁড় করানো হতো না। ছাত্রশিবিরের সভাপতি আব্দুল জব্বার ইতোমধ্যেই বলেছেন, ২০ দলীয় জোটের শরীকদলগুলোর অনেকে সাঈদী সাহেবের রায়ের পর নতুন করে জল্পনা-কল্পনা শুরু করলেন যে, নিশ্চয় জামায়াতের সঙ্গে সরকারের আঁতাত হয়েছে, নতুবা ফাঁসি থেকে আমৃত্যু কারাদ-! কি করে সম্ভব? তাদের সমালোচনায় মনে হয় এরাও ইসলামবিদ্বেষীদের দোসর।
শুক্রবার সন্ধ্যায় জামায়াতের একজন কর্মপরিষদ সদস্য সেলফোনে বলছিলেন, বিএনপির মধ্যে জামায়াতবিরোধী একটি লবি রয়েছে। যাদের চেষ্টাই হচ্ছে, খালেদা জিয়ার কাছে প্রমাণ করা যে সরকারের সঙ্গে জামায়াতের সমঝোতা আছে। কাদের মোল্লার ট্রাইব্যুনালের রায়ের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ওই সময়েও বিএনপির কয়েকজন নেতা গণজাগরণ মঞ্চের সুরে বলেছিলেন, আঁতাত করে মৃত্যুদ- ঠেকানো হয়েছে। জামায়াত-শিবিরের ৩০০ নেতাকর্মীকে সরকারের পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করতে হয়েছে আঁতাত ছিল না। তিনি অভিযোগ করেন, বিএনপির কয়েকজন নেতা জোট ভাঙ্গার জন্য এসব কথা বলেন। আসলে বিষয়টি নিয়ে বিএনপির অবস্থানই পরিষ্কার নয়। এতে করে জামায়াতের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ছে।
শিবিরের ফেসবুক পেজ ‘বাশের কেল্লা’সহ অন্যান্য মাধ্যমেও চলছে একই আলোচনা। নেতাকর্মীরা জামায়াতের পক্ষে সমঝোতা হয়নি দাবি করে ক্ষোভ ঝাড়ছেন বিএনপির নেতাদের ওপর। বলছেন, আসলে বিএনপি নেতাদের কেউ কেউ আঁতাত করে গ্রেফতার এড়িয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রেখেছেন। সিলেট জামায়াতের অফিসিয়াল পেজে লেখা হয়েছে, খালেদা জিয়াকে যখন বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়, তখন বিএনপি নেতারা পালিয়ে ছিলেন। আন্দোলন করেননি। তারা কি আঁতাত করেছিলেন? জামায়াত আঁতাত করলে হরতাল দিত না। নেতাকর্মীরাও হরতালে গ্রেফতার হতো না। আঁতাতের বিষয়ে ছাত্রশিবিরের ফেসবুক পেজ বাঁশেরকেল্লাই সক্রিয় বেশি। এদিকে ২০ দলীয় জোটের শরিক দল ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আব্দুল লতিফ নেজামী বলেছেন, আদালতের রায়ের পর বক্তব্য দেয়া আইনসিদ্ধ নয়। পক্ষে-বিপক্ষে মতামত দেয়ার বিষয়ে আমাদের দেশে একটি নেতিবাচক অভ্যাস গড়ে উঠেছে।
তিনি অবশ্য বলেন, তবে এটুকু বলা যেতে পারে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে প্রথম থেকেই আমরা বলে এসেছি। বিসমিল্লাতেই গলদ। জামায়াত নেতারা বিএনপির সমালোচনা করছে। উদাহরণ হিসেবে সামনে আনছেন অন্য শরিক দলের নেতাদের বক্তব্য। জামায়াত নেতারা বলছেন, বিএনপির অনেক নেতা যেখানে গণজাগরণ মঞ্চের ভাষায় কথা বলছেন সেখানে অন্য শরিকরা রায়ের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। শরিক ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ বলেন, আমি রায় প্রত্যাখ্যান করলাম। একজন নাগরিক হিসেবে প্রত্যাখ্যান করার অধিকার আমার আছে। আমি ব্যথিত, ক্ষুব্ধ, স্তম্ভিত। এ এক মহা অন্যায়। এটা উদোর পি-ি বুধোর ঘাড়ে দেয়ার মতো। ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত করা মহা অবিচার। জবাব দেবে বাংলাদেশ। শরিক নেতার এ বক্তব্য সামনে এনে জামায়াত-শিবিরের ওয়েভ পেজগুলোতে নেতাকর্মীরা বিএনপি নেতাদের তীব্র সমালোচনা করে বলছেন, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া যদি ‘ঘরের শক্র বিভীষণদের’ কথা শোনেন তাহলে পস্তাতে হবে।