জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সুন্দরবনের বিশাল এলাকাজুড়ে সমুদ্রের লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় দিন দিন সুন্দরবন তার প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। হারাচ্ছে সৌন্দর্যও। অন্যদিকে সিডর, আইলার আঘাতে সমতলের, উপকূলের জীবিকা হারানো মানুষগুলোর নির্ভরতা দিন দিন বাড়ছে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর। ফলে ধীরে ধীরে সম্পদহীন হয়ে পড়ছে সুন্দরবন।
সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের বিস্তারিত এলাকা ঘুরে লোকালয়ের কাছাকাছি বনে বড় আকারের কোনো গাছের দেখা পাওয়া যায়নি।
বড় ও দামি গাছ বলতে এখন সুন্দরবনে যা আছে তা একেবারেই গভীর জঙ্গলে। যেখারে বাঘের ভয়ে মানুষ যেতে পারে না।
স্থানীয়রাই জানালেন, গভীর বনে ঢুকতে সাহস হয় না বলেই সেখানকার ওইটুকু সম্পদ টিকে আছে।
বিশ্বের এক মাত্র বৃহত্তম এই ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের একমাত্র পাহারাদার এখন রয়েল বেঙ্গল টাইগার। এই প্রাণীটির ভয়েই বনজীবীদের করাল গ্রাস থেকে এখনো টিকে আছে বনটি। তবে জীবনের ঝুকি নিয়ে যারাও আবার বনে কাজকর্ম করে তাদেরও আবার ভাগ দিতে হয় বন বিভাগের কর্মকর্তাদের।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ না থাকায় যুগ যুগ ধরে এ এলাকার লাখ লাখ মানুষের জ্বালানির অন্যতম উৎস সুন্দরবন। সুন্দরবনের ভিতরে এবং বন সংলগ্ন সমুদ্র এলাকার মাছ, কাঁকড়া, শামুক প্রভৃতি ধরে জীবিকা নির্বাহ করে বিপুল সংখ্যক মানুষ।
সিডর ও আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলবাসীদের আয়ের অন্য উপায় তৈরি না হওয়ায় সুন্দরবনের ওপর আগের চেয়ে বেশী নির্ভরশীল।
জানা যায়, মাছ ধরা, কাঠ কাটা, মধু আহরণ করাসহ বিভিন্ন উদ্দেশ্যে প্রতিদিন সুন্দরবনে যায় ২৫-৩০ হাজার ট্রলার বা নৌকা।
বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে ঢোকার নিয়ম থাকলেও এ বিভাগের অবহেলা আর অনিয়মে পাস বা অনুমতিপত্র ছাড়াই বনজীবীরা সুন্দরবনে প্রবেশ করছে। অবাধে কাটছে গাছ।
আবার যারা বনবিভাগের অনুমতিপত্র বা পাস নিয়ে বনে ঢোকেন তারা একটি পণ্যের পাস নিয়ে বন থেকে ফেরেন বেশ কয়েক প্রকার পণ্য নিয়ে।
খবর নিয়ে জানা গেছে মাছ বা কাঁকড়া ধরতে কিংবা শামুক-ঝিনুকের খোঁজেও যারা যান তারা যে স্রেফ মাছ-কাঁকড়া-ঝিনুক নিয়ে ফেরেন তা নয়। পথে গাছ কেটে নৌকায় তুলে কিংবা নৌকার সঙ্গে বেধে ভাসিয়ে নিয়ে আসেন। আর সেগুলো কেনার জন্য ফড়িয়ারা থাকেন হাতের নাগালের মধ্যেই বনরক্ষীদের চোখের সামনে তৎপর।
সুন্দরবনের মাছ কাঁকড়া, ঝিনুক সংরক্ষণে নেই কোনো উদ্যোগ ফলে প্রজনন মৌসুমেও চলে অবাধ শিকার-সংগ্রহ। ফলে এগুলোর বংশবৃদ্ধি হচ্ছে কম। আর তাতে কমে যাচ্ছে মৎস সম্পদ।
হরিণ শিকারিরা সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় শত্রু। হরিণ শিকার করতে করতে বনে তার সংখ্যা কমে গেছে উল্লেখযোগ্য হারে। কুমির-কচ্ছপ-সরিসৃপ জাতীয় প্রাণীগুলোরও চলছে অবাধ শিকার।
কথা হয় শ্যামনগর উপজেলার কৈখালী গ্রামের বাসিন্দা জেলে আবুল হোসেনের সঙ্গে। তার সহজ স্বীকারোক্তি, “সত্যি কথা বলতে কি বনে মাছ ধরার পাস নিয়ে গেলেও শুধু মাছ ধরে বাড়ি আসলি পোষে না। সব সময় তো আর মাছ সমান পাওয়া যায় না। তাই মাছ ধরতি যাওয়ার পাস নিয়ে গিলিও সঙ্গে কাঠ বা গোলপাতা নিয়ে আসতি হয়। যেটুকুন আনতি পারি ওইটাই লাভ।”
এসব কাজ যে বন বিভাগের অগোচরে হচ্ছে তা নয়। সুন্দরবন রক্ষার মহান দায়িত্বে থাকা বন বিভাগের কর্মকর্তাদের চোখের সামনে এমনকি তাদের সহযোগিতায়ও চলে নানা ধরণের পাচারকাজ।
কৈখালী ইউনিয়নের জেলে আব্দুল আলিম বলেন, “পাস পাতি গিলি (গেলে) অতিরিক্ত কিছু খরচ লাগে। রেভিনিউ অনুযায়ী পাসের দামের চেয়েও বেশি দিয়ে ফরেস্ট অফিস থেকে পাস নিতি হয়। সেসব খরচও তো বন থেকে তুলে আনতি হয়। এজন্য মাছের পাসে শুধু মাছ আনলি আমাগো চলে না।”
পাতাখালি গ্রামের মনসুর আলীর সঙ্গে কথা হয় খোলপেটুয়া নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে। তিনি তখন সুন্দরবন থেকে ফিরে মাত্র নৌকা ভিড়িয়ে নামছেন। মাছের জালের সঙ্গে নৌকা থেকে কিছু গরাণ কাঠ নামাতে দেখে সেগুলোর পাস নিয়েছিলেন কিনা জানতে চাইলে তিনি জানান, শুধু মাছের পাস নিয়ে তিনি ছয় জন সঙ্গীসহ বনে গিয়েছিলেন। কিন্তু আসার পথে এই কাঠ কয়টা নিয়ে এসেছেন যেগুলোর ওজন আনুমানিক ২ মণ হবে।
আসার পথে বন বিভাগের কর্মকর্তারা কাঠগুলো আটক করেছিলেন স্বীকার করে মনসুর আরো বলেন, “জ্বালানির জন্য নিছি-একথা বলার পর ফরেস্ট অফিসাররা ১ প্রায় মণ কাঠ আর ৩০০ টাকা নিয়ে এগুলো ছেড়ে দেছে। বহুদিন থেকে বন করি। এভাবেই চলতিছে।”
পাস নয়, বিনা কাগজে অনুমতিপত্র দেওয়া বনকর্তাদের আরেক বাণিজ্য। রমজাননগর ইউনিয়নের কালিঞ্চি গ্রামের জেলে জিয়া জানান, পাস চাইলেও বন বিভাগ কর্মকর্তারা তা না দিয়ে কিছু টাকার বিনিময়ে বনে ঢোকার অনুমতি দেন। কারণ, এতে করে পুরো টাকাটাই তারা পান। আর পাস দিলে তা থেকে সরকারকে একটা অংশ দিতে হয়।
এ কারণে বন বিভাগ খাতা কলমে যে কয়জন লোক বনে ঢোকার হিসাব দেখায় তা সঠিক নয় বলেও মন্তব্য করেন জিয়া।
গাবুরা গ্রামের মৌয়াল ইব্রাহিম শেখ বলেন, “বনে ডাকাত আর ফরেস্ট অফিসারদের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করা যায়। ওরা কোন ব্যাপার না। কিন্তু কিছু মানতি চায় না বাঘ। তেনারা ধরলে জান না নিয়ে ছাড়েন না। বনে ভয় ওইটারই।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক মৌয়াল বলেন, “বাঘের ভয়ে জান হাতে নিয়ে মধু আনি আমরা। ৭/৮ জন একসপ্তাহ বনে থেকে ১০ ড্রাম মধু হলে আসার পথে ফরেস্ট অফিসে দিয়ে আসতে হয় ১ ড্রাম। সঙ্গে টাকাও। এজন্য সুন্দরবনে চুরি না করলি পেটে ভাত যায় না।”
তবে বাঘের ভয় বড় ভয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, “জানের মায়ায় মাঝে মাঝে মনে হয় বন করাই ছেড়ে দেবো।”
একাধিক এলাকাবাসী বলেন, এক অর্থে ফরেস্ট অফিসাররা থেকেও বনের কোনো লাভ নেই। বরং তাদেরকে এবং বনের ডাকাতদের খুশি করার টাকার জোগান দিতেই কাঠ সহ বনের বিভিন্ন সম্পদ চুরি করতে হয় বনজীবীদের।“
বন বিভাগ কর্তৃক ডাকাতদের দমন প্রসঙ্গে জেলেরা অভিযোগ করেন, “ওদের দমন করবে কি, বরং বন বিভাগের পরোক্ষ সহযোগিতায় ডাকাতরা বনে রাজত্ব করে বেড়ায়।“
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন বন কর্মকর্তারা। সাতক্ষীরা রেঞ্জের কৈখালী এলাকায় দায়িত্বরত বন কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, “এসব অভিযোগ সত্য নয়। কিছু বিরোধী লোক তাদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য বন বিভাগের বিরুদ্ধে নানারকম অপপ্রচার চালায়। আমরা সবসময় সুন্দরবন ও বনজীবীদের সেবা দেওয়ার চেষ্টা করি।”
সাতক্ষীরার সহকারি বন কর্মকর্তা তৌফিকুল ইসলাম বলেন, “জেলেদের কাছ থেকে বন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আমরা এ ধরনের কোন অভিযোগ পাইনি। পেলে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এখানকার এক কর্মচারি বলেন, “আমাদের যে নিরাপত্তা সরঞ্জাম আছে তা দিয়ে ডাকাত দমন সম্ভব নয়। উল্টে আমাদের ধরে ওরা যদি বলে আমাদের মাছ কুটে দিয়ে যা, তাও দিয়ে আসতে হবে জানের ভয়ে।”
তিনি আরো বলেন, “সব অনিয়ম বন্ধ হবে যদি বনে পাস দেওয়া বন্ধ করা হয়। সেইসঙ্গে বাঘের প্রতি যত্নবান হয়ে বনে বাঘের সংখ্যা বাড়ালে মানুষ বাঘের ভয়েই বন নষ্ট করবে না। বাঘই পারে ডাকাত আর জেলেদের হাত থেকে সুন্দরবনকে বাঁচাতে।