রামদাস মুচির ভক্তিতে,
গঙ্গা এল চামকেটোতে।
সে রূপ সাধলো কত মহতে
লালন কূলে কূলে বায়।
অনুরাগ নইলে কি সাধন হয়...
সে তো শুধু মুখের কথা নয়।
লালন পদাবলীতে বেশ কয়েক জায়গায় এই রামদাস মুচী নামটি এসেছে। আমি জানিনা লালন কি অর্থে এই নামটির ব্যবহার করেছিলেন, এটা কি তার শুধুই জাত-পাতের একটা বিরুদ্ধাচরন ছিল নাকি অন্য কিছু, জানিনা। তবে এটুকু বুঝি যে রামদাস মুচি তার কাছে খুব গুরুত্বের একটা জায়গায় ছিলেন।
কুমিল্লা শহরের শাসনগাছায় রেল স্টেশনের পাশে, রেল লাইনের ধারে তেমনই এক ‘মুচি’ কমিউনিটির অবস্থান। কমিউনিটির নাম রবিদাস বাড়ি। মাত্র ৫০ শতক জায়গার উপরে ৫০/৬০ টা পরিবার গিজগিজ করে থাকে। ছোট ছোট ঘর গুলোতে গিজ গিজ করে পরিবারের সদস্যরা।
ছবিঃ রেল লাইনের পাশে রবিদাস বাড়ি
ছবিঃ রবিদাস বাড়ির ঘরগুলো
ছবিঃ রবিদাস বাড়ির ঘরগুলো
ছবিঃ বসতিতে যাওয়া আসার রাস্তা গুলোর একটি
ছবিঃ বসতি সংলগ্ন পেছনের অংশ
এখানে বসবাসকারী ‘মুচী’ সম্প্রদায়ের মানুষেরা, নিজেদেরকে রবিদাস বলে পরিচয় দিলেও এলাকার মানুষজন অনেকেই জানেও না যে এসব মানুষের আরেকটা ভাল নাম রয়েছে, যে নামে তারা পরিচিত হতে উষ্ণ অনুভব করে, যে নামে দাসত্ব কিংবা অবহেলার নামধারী জীবন যাপন করতে চায়না। রবিদাসেদের দাসত্ব আর অবহেলায় ভরা জীবন বুঝতে গেলে শুরু করতে হবে সুদূর অতীত হতে, মুঘল আমলের শেষের দিকে। আনুমানিক সতেরো শতকের শুরুর দিকে ভারতবর্ষ থেকে কিছু মানুষকে এই অঞ্চলে নিয়ে আসা হয় সুইপার, ঝাড়ুদার, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ, চামড়ার কাজ, শব দাহ করা ইত্যাদি কাজ করার জন্য। আর সেই থেকে আজ পর্যন্ত এটা তাদের বংশগত এবং ঐতিহ্যগত পেশা হয়ে যায়। যুগের পর যুগ সভ্য সমাজ, রাষ্ট্র, ব্যাক্তি তাদের জন্য এমন সব সিস্টেম তৈরি করে রাখে, যা থেকে আজ পর্যন্ত তাদের পরিত্রান হয় নি।
কুমিল্লা শহরে এইসব রবিদাসেরা পরিচিত ‘মুচি’ নামে আর তাদের কমিউনিটি ‘মুচি বাড়ি', একজন রবিদাস বলছেন তার নাম ‘রামপীরিত রবিদাস’ কিন্তু প্রতিনিধিত্বশীল সমাজ, ব্যাক্তি, রাষ্ট্রের কাছে সে ‘অফিসিয়ালি’ এবং ‘আন অফিসিয়ালি’ পরিচিত ‘রামপীরিত মুচি’ নামে। কুমিল্লা শহরে, এমনকি খোদ শাসনগাছাতে গিয়েও যদি কেউ রবিদাস বাড়ি অথবা রবিদাস বলে কারো খোঁজ করেন তাহলে অনেকেই বলতে পারবেনা আমি নিশ্চিত। কিন্তু কেউ যদি ‘মুচি’ নামে অথবা 'মুচি বাড়ি' বলে খোঁজ করে তাহলে সেটা সকলেই বলে দিবে। সকলেই জানে ‘মুচি’ কারা। কোনটা মুচি বাড়ি। তাহলে এখানে প্রশ্ন এসে যায়, এই রবিদাস নামে যদি তাদের খুজে পেতে, আইডেন্টিফাই করতে এত সমস্যা হয়, এরপরও তারা কেন এই নামটা গ্রহন করতে এত স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে?
এই রবিদাস নাম স্টাবলিস্ট করার মধ্য দিয়ে একভাবে, তাদেরকে নিয়ে সমাজের যে সামগ্রিক স্টাবলিস্টমেন্ট, তা খারিজ করে দিয়ে নতুন এক ধরনের স্টাবলিস্টমেন্টের দিকে যাওয়ার প্রবনতা তাদের যেখানে তারা মানুষের মর্যাদায় আসীন হবে। থাকবে নাম, যশ, খ্যাতি, সম্মান, নিরাপত্তা ও অধিকার। এটা এক ধরনের প্রতিরোধ। প্রতিরোধ, এই সমাজ, রাষ্ট্র তথা ব্যাক্তির তৈরি করে দেয়া সিস্টেমগুলোর প্রতি যেগুলো তাদেরকে যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী 'মুচি' করে রেখেছে। আর তারা ‘মুচি’ নয়, বরং এবার রবিদাস হতে চায়। হতে চায় দেশের আর দশটা সাধারন মানুষের মত। এ যেন তার অধিকার আদায়ের যুদ্ধের ক্ষুদ্র একটা পদক্ষেপ.................