পাহাড়ি জমি দখলকে কেন্দ্র করে আবারও অশান্ত হয়ে উঠছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষে ১৭ এপ্রিল খাগড়াছড়িতে তিনজন মারা যাওয়ার ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির সুইমার থানার শনখোলা পাড়ায় আদিবাসী বাঙালি সংঘর্ষে বাঙালি মারা যাওয়ায় ৩টি পাহাড়ি গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ বাঙালিরা। প্রশাসন ঘটনাস্থলের কাছের মানিকছড়ি এবং রামগড় উপজেলায় ১৪৪ ধারা জারি করে। সেদিনের ঘটনায় নিহতরা হলেন আইয়ুব আলী, নবাব আলী এবং সুনীল সরকার। স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র জানায় একটি বিতর্কিত জমিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। জয়নাল পিসি নামের একজন সেটেলার বাঙালি ১০ একর একটি জায়গায় জঙ্গল পরিষ্কার করার সময় স্থানীয় আদিবাসীরা তাকে সে কাজে বিরত থাকতে অনুরোধ করে। ওই জায়গাটির মালিকানা দাবি করেন রুইহ্লা অং মারমা নামের এক আদিবাসী। জায়গাটি নিয়ে আগেও গণ্ডগোল হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত সালিশে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে কেউ ওই জায়গা দখল নিতে পারবে না। কিন্তু জয়নাল ঘটনার দিন আটজন লেবার নিয়ে জায়গাটির জঙ্গল পরিষ্কার করতে যায়। আদিবাসীদের বারণ না শুনলে একপর্যায়ে সংঘর্ষ শুরু হয়। বাঙালিরা দাবি করেন আদিবাসীরা সংঘবদ্ধ হয়ে লেবারদের ওপর হামলা চালায়। অন্যদিকে স্থানীয় আদিবাসীদের অভিযোগ, সংঘর্ষ শুরু করে বাঙালিরা।
ভূমি নিয়ে সংঘর্ষ নতুন নয়। বরং এই সংঘর্ষ আবার স্মরণ করিয়ে দিলো ভূমিই পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় সমস্যার মূল কারণ। এর ন্যয্য সমাধান না হওয়া পর্যন্ত নিশ্চিত করা যাবে না পাহাড়ের মানুষের অধিকার, আদিবাসী বাঙালির সহাবস্থান। খাগড়াছড়ির সাম্প্রতিক ঘটনা এও স্মরণ করিয়ে দেয় যে শান্তির অন্বেষায় ১৩ বছর আগে সশস্ত্র আন্দোলন বন্ধ হলেও শান্তি আসেনি পাহাড়ে। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি এবং তার পরবর্তীকালে পাহাড়ের নানা ঘটনা প্রবাহ ফিরে দেখা যাক।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পিছনে ফিরে দেখা
দীর্ঘ দু’দশকের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের অবসানে পার্বত্যবাসীর পক্ষে জনসংহতি সমিতি এবং বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭। চুক্তিটি চারটি ভাগে বিভক্ত: (ক) সাধারণ (খ) পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদসমূহ (গ) পাবর্ত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এবং (ঘ) পুনর্বাসন, সাধারণ ক্ষমা এবং অন্যান্য বিষয়। চুক্তিটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল যে পার্বত্য চট্টগ্রামকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া। চুক্তির ফলে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ’-এর মতো একটি প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়। এর মাধ্যমে জেলা পরিষদগুলোকে শক্তিশালী করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সৃষ্টি চুক্তির আরেক অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পাহাড়ে শান্তির ধারা ফিরিয়ে আনতে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা, উদ্বাস্তুদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা চুক্তিটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি দেশের অধিক সংখ্যক মানুষের সমর্থন পায়। পশ্চিমা কূটনীতিকরা একে ‘একটি বিরাট সাফল্য’ (ইত্তেফাক ৪ ডিসেম্বর ১৯৯৭) বলে অভিহিত করে। ‘শান্তিচুক্তি পূর্ণাঙ্গ নাহলেও গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে বলে বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট মন্তব্য করে। তবে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো চুক্তির তীব্র বিরোধিতা করে। চুক্তি হওয়ার আগেই ‘শান্তিচুক্তি হইলে হরতাল ছাড়াও কঠিন কর্মসূচি দিব’ ( ইত্তেফাক ১৬ নভেম্বর ১৯৯৭) বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। এই হুঁশয়ারির পথ ধরেই ৭ ডিসেম্বর (১৯৯৭) বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামসহ ৭টি সমমনা দল পাবর্ত্য চট্টগ্রাম চুক্তির প্রতিবাদে সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করে। ৩ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া চুক্তি গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় ২৮ দফা যুক্তি তুলে ধরেন। ‘এই-চুক্তির মাধ্যমে এই সরকার বাংলাদেশের এক দশমাংশ অঞ্চল হতে স্বাধীন সার্বভৌম এককেন্দ্রিক ক্ষমতা প্রত্যাহার করে দেশের সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দিয়েছে এবং স্বাধীনতার সংকট সৃষ্টি করেছে’ সংবাদ সম্মেলনে বলেন খালেদা জিয়া।
বর্তমানে পার্বত্য এলাকায় বাস করছে প্রায় ৩০ হাজার পরিবার। দেশের বিভিন্ন স্থানের নদীভাঙা পরিবারসহ ছিন্নমূল লোকজনকে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দেওয়ার জন্য তৎকালীন সরকার ১৯৮২-৮৩ সালে ২৬ হাজার ২২০ পরিবারকে চট্টগ্রামের তিন পার্বত্য জেলায় নিয়ে আসে। এর মধ্যে প্রায় ২০ হাজারেরও বেশি পরিবারকে খাগড়াছড়িতে পুনর্বাসন করা হয়। অবশিষ্ট পরিবারগুলোকে রাঙামাটি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলায় বাসস্থান করে দেওয়া হয়। বসতঘর ও ক্ষেতখামার করার জন্য সরকার তাদের প্রত্যেককে পাঁচ একর করে জায়গা বরাদ্দ দেয়। ফলে পাহাড়ি জমি দখল- বেদখল নিয়ে পাহাড়িদের সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয়। ১৯৮৬ সাল থেকে ‘শান্তিবাহিনী’র হামলার ঘটনা বাড়তে থাকলে সেখান থেকে লোকজন নিরাপদে সরে যেতে থাকে। প্রায় ১০ হাজার উপজাতীয় পরিবার সে সময় ভারতে চলে যায়। অন্যদিকে ২৬ হাজার পুনর্বাসিত বাঙালি পরিবারের সদস্যদের জীবন বাঁচাতে খাগড়াছড়ির বিভিন্ন সেনাক্যাম্প সংলগ্ন ৮১টি গুচ্ছগ্রামে অবস্থান নেয়। ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তি হওয়ার পর পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকে।
এদিকে বন্দোবস্ত পাওয়া সরকারি খাস জায়গায় গড়ে তোলা ঘরবাড়িসহ সহায়-সম্পত্তি ফেলে পুনর্বাসিত বাঙালি পরিবারগুলোকে গুচ্ছগ্রামে আনার পর তারা জীবনে বেঁচে গেলেও শুরু হয় আরেক কঠিন জীবন সংগ্রাম। গুচ্ছগ্রামে বরাদ্দ পাওয়া জায়গা ও ঘর খুবই ছোট হওয়ায় গাদাগাদি করে থাকতে হয় তাদের। পরিবারপ্রতি বরাদ্দ পাওয়া মাত্র পাঁচ শতক জায়গায় বসবাস করা এসব পরিবারের সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার পাহাড়ি ভূমি সোনামিয়া টিলায় ৮১২ পরিবারকে সরকার ১৯৮২ সালে পুনর্বাসনের করে। ’৮৬-এর ভয়ানক পরিস্থিতির কারণে তাদের সাময়িকভাবে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়। শান্তিচুক্তির পর ভারত থেকে শরণার্থীরা এলে দ্বিতীয় দফায় ঘরবাড়ি ছাড়তে হয় তাদের।
মূল বিরোধ যেখানে...
বাঙালিরা চাইছে নিজেদের জায়গায় ফিরে যেতে। সরকারিভাবে তাদের জন্য যে ভূমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তাতে তারা থাকতে চায়। অন্যদিকে পাহাড়িদের মতে, এ জমি তাদের। প্রথাগতভাবে পাহাড়ি ভূমি নিজেদের বলে সবসময় দাবি পাহাড়িদের। তারা পাহাড়ি ভূমি কাউকে দেবে না। ফলে ভূমি নিয়ে পাহাড়ি-বাঙালির পরস্পরবিরোধী অবস্থান বছরের পর বছর ধরে চলছে। এমন অবস্থানের কারণে বারবার ঘটছে সংঘর্ষের ঘটনা। গত ১০ বছরে পাহাড়ে বিবদমান দুটি গ্র“পের মাঝে প্রায় ১৯০টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসব সংঘর্ষে ৪৫০ পাহাড়ি-বাঙালি প্রাণ হারিয়েছে। অপহৃত হয়েছে সাড়ে আট শতাধিক। হাজারো ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আদালতের কাঠগড়ায় পার্বত্য চুক্তি
চুক্তির আলোকে ১৯৯৮ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন করা হয়। এছাড়া পার্বত্য জেলা কাউন্সিল আইন-১৯৮৯ তে সংশোধনী এনে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ সংশোধনী আইন ১৯৯৮ প্রণয়ন করা হয়। এই দুই আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০০০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাসিন্দা মো. বদিউজামান হাইকোর্টে রিট করেন। পরে ২০০৪ সালে শান্তিচুক্তির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সম্পূরক আবেদন করে রিট করেন মো. বদিউজামান। আদালত ২০০৪ সালের ১ আগস্ট রুল জারি করেন। সর্বশেষ ২০০৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তাজুল ইসলাম পার্বত্য চুক্তি নিয়ে হাইকোর্টে আরেকটি রিট করেন। ২৭ আগস্ট আদালত রুল জারি করেন। বছরের (২০১০) শুরুতে রিট দুটির রুলের ওপর শুনানি শুরু হয় এবং রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ১২ এপ্রিল আদালত রায় দেওয়া শুরু করেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য চুক্তি সম্পাদনকারী তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ৩ সদস্য বিশিষ্ট চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি তৈরি করে। পার্বত্য চুক্তির আলোকে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন গঠন করে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে একজন পাহাড়িকে নিয়োগ দেয়। এর আগ পর্যন্ত একজন উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা উন্নয়ন বোর্ড-এর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। উন্নয়ন বোর্ড এলাকার উন্নয়নে সর্ববৃহৎ উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে আসছে ১৯৮০’র দশক থেকে।
চুক্তির পরবর্তীকালে এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে সরকার এবং জনসংহতি সমিতির মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। এক পর্যায়ে জনসংহতি নেতা এবং আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার (সন্তু লারমা) সাথে চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়ে বাড়তে থাকে দূরত্ব। এর মধ্যে ২০০১-এর নির্বাচনে জেএসএস আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করে।
চারদলীয় জোট সরকারের আমলে পার্বত্য চুক্তি
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত হওয়ার প্রাক্কালে তৎকালীন বিএনপি মহাসচিব এক আলোচনা সভায় বলেছিলেন, ‘বিরোধী দলের মতামত না নিয়ে বিদেশে কোনো চুক্তি হয় না। আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় থাকবে না তখন এই চুক্তির কী হবে? (ভোরের কাগজ ৬ ডিসেম্বর ১৯৯৭) চুক্তির যে কোনো অগ্রগতি বিএনপি ক্ষমতায় এসে করবে না তার কথাতেই তখন স্পষ্ট ছিল। এবং কার্যত হয়ে ছিলোও তাই। কিন্তু মজার ঘটনা হলো, চুক্তি সম্পাদনের প্রাক্কালে ‘চুক্তি হলে দেশের সার্বভৌমত্ব ধ্বংস হয়ে যাবে’ বা ‘ক্ষমতায় গেলে চুক্তি বাতিল করব’ বলে হুঙ্কার দেখালেও ক্ষমতায় থাকার পাঁচ বছরে বিএনপি চুক্তি বাতিল করেনি। চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি-এর বিপরীতে বিএনপি ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত’ একটি কমিটি করে। এই কমিটি এবং ভূমি কমিশনের উল্লেখযোগ্য কোনো কর্মকাণ্ড বিএনপির ৫ বছরে চোখে পড়েনি। চুক্তি নিয়ে বিএনপির অবস্থান ছিল অদ্ভুত রকমের। চুক্তি বাতিলও নয় এবং বাস্তবায়ন নয়-এমন এক নীতি নেয় বিএনপি-জামায়াত। তারা একজন পাহাড়িকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী বানায়। আবার জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের উপমন্ত্রীর যে মর্যাদা ছিল, তা বাতিল করে।
বর্তমান সরকারের আমলে পার্বত্য চুক্তি
২০০৯-এর জানুয়ারিতে সরকার গঠনের পর পরই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন করতে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করে। যার মধ্যে প্রথমটি ছিল চুক্তি বাস্তবায়ন করতে ৩ সদস্যের কমিটি গঠন। দলটি সংসদের উপনেতা বেগম সাজেদা চৌধুরীকে প্রধান করে চুক্তি বাস্তবায়ন করতে জাতীয় কমিটি গঠন করে। কমিটির অন্য দু’জন সদস্য হলেন জোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা এবং আওয়ামী লীগ দলীয় সাংসদ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন কমিটির প্রধান জ্যোতিন্দ্র লাল ত্রিপুরা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার বর্তমান সরকারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আলোকে পাহাড়ি জনপদ থেকে পর্যায়ক্রমে সেনা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে একটি ব্রিগেড এবং ৩৫টি অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের ঘোষণা আসে ২৯ জুলাই (২০০৯) প্রধানমন্ত্রীর দফতরের সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের পক্ষ থেকে। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর এই প্রত্যাহারের ঘটনাকে ‘চুক্তির পরে সবচেয়ে বড় মাপের সেনা প্রত্যাহার’ বলে অভিহিত করে।
সরকারের ঘোষণার পর প্রথম ক্যাম্পটি প্রত্যাহার করা হয় ৭ আগস্ট (২০০৯) লক্ষ্মীছড়ি সেনা জোনের অধীন মানিকছড়ি থেকে। সেপ্টেম্বর (২০০৯)-এর মধ্যে প্রতিশ্র“তি অনুযায়ী সমস্ত ক্যাম্পই প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহারের এই ঘটনাকে আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমা ‘সাধারণভাবে ইতিবাচক’ বলে মন্তব্য করেন। তবে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সমস্ত অস্থায়ী সেনাক্যাম্প প্রত্যাহারের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা দাবি করেন। ইউপিডিএফ-নেতৃত্ব অবশ্য এই সেনাক্যাম্প প্রত্যাহারের ঘটনাকে ‘আই ওয়াশ’ হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং এই ক্যাম্প প্রত্যাহারের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘চলমান সামরিকায়নে’ কোনো পরিবর্তন আসবে না বলে মন্তব্য করে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি সেটেলাদের সংগঠনগুলো এই সেনাক্যাম্প প্রত্যাহারের তীব্র বিরোধিতা করে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট এই বিরোধিতায় শামিল হয়। সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী তাজুল ইসলাম গতবছরের ৯ আগস্ট হাইকোর্ট বিভাগে দুটি পিটিশন দায়ের করেন সেনাক্যাম্প প্রত্যাহারে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার জন্য। হাইকোর্ট ১৬ আগস্ট ক্যাম্প প্রত্যাহার প্রক্রিয়া ১৯ আগস্ট পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়। কিন্তু সরকারের প্রদত্ত নথি এবং যুক্তি শোনার পর হাইকোর্ট ওই পিটিশন দুটি পরিহার করে সরকারকে কাজ চালিয়ে যেতে নির্দেশ দেয়। বিএনপি সাংসদ ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ এবং জামায়াত নেতা আব্দুর রাজ্জাক পিটিশন দায়েরকারীর পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন।
ভূমি কমিশনের পুনর্গঠন এবং বিপত্তি
পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১’ জাতীয় সংসদে পাশ হয় এর আগের মেয়াদে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় ছিল তখন। দীর্ঘ নয় বছর ধরে বার কয়েক এর চেয়ারম্যান বদল হলেও এ-কমিশন কোনো কাজ করেনি। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর হাইকোর্ট বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি খাদেমুল ইসলাম চৌধুরীকে প্রধান করে ভূমি কমিটি পুনর্গঠন করে। কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন সার্কেল প্রধান, আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান অথবা তার প্রতিনিধি, বিভাগীয় কমিশনার এবং তিন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। কমিশনের কাজ নিয়ে শুরু থেকেই নানা আপত্তি তোলেন পাহাড়ি নেতৃবৃন্দ এবং সিভিল সোসাইটির অনেকে।
২০০৯-এর ৮ সেপ্টেম্বর কমিশন হঠাৎ করে ঘোষণা করে যে ১৫ অক্টোবর (২০০৯) থেকে পার্বত্য এলাকায় ভূমি জরিপ শুরু হবে এবং তা শেষ হবে মার্চ (২০১০)-এর মধ্যে। জনসংহতি সমিতি ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি এবং প্রত্যাগত শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের পরই আঞ্চলিক পরিষদের সাথে পরামর্শ করে ভূমি জরিপ হতে পারে বলে দাবি করেন। বর্তমান আইনের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ১৯টি ধারা আছে বলে পাহাড়ি নেতৃত্বের পক্ষ থেকে অভিযোগ আছে। এ প্রসঙ্গে চাকমা সার্কেল প্রধান ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বলেন, ‘আইনটিতে কিছু মৌলিক ত্র“টি এবং ১৯৯৭ সালের চুক্তির সাথে অসঙ্গতি রয়েছে। এর যথাযথ সংশোধনের জন্য সরকারের কাছে আঞ্চলিক পরিষদ পরামর্শ পাঠিয়েছে। এই পরামর্শ অনুযায়ী আইনটি সংশোধন করা অতি জরুরি। আমি আশা করি জরুরি ভিত্তিতে সংশোধনী করা হবে। তা না হলে কমিশন (ভূমি) তার কাক্সিক্ষত ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আমি মনে করি না।’ (প্রথম আলো-এর সঙ্গে সাক্ষাৎকার ১১ এপ্রিল ২০১০)।
পাহাড়ি নেতৃবৃন্দের বিরোধিতায় কমিশনের প্রস্তাবিত ভূমি জরিপ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বর্তমানে। ভূমি মন্ত্রণালয় ১১ মার্চ (২০১০) জরিপ কাজ শুরুর বিষয়ে কৌশল নির্ধারণে যে বৈঠক ডেকেছিল, তাতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং জিএসএস-এর কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না। ফলে সিদ্ধান্ত ছাড়াই ওই বৈঠক শেষ হয়।
ভূমি কমিশন সংক্রান্ত সর্বশেষ খবর হলো, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ভূমি কমিশন যে গণবিজ্ঞপ্তি দেয় গতবছরের মে মাসে, তাতে তেমন সাড়া মেলেনি আদিবাসীদের পক্ষ থেকে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, তিন পার্বত্য জেলায় দেড় লাখের বেশি ভূমি বিরোধ আছে। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পরিবারের রয়েছে এক লাখ ২৮ হাজার ৩৬৪। নয় হাজার ৭৮০ শরণার্থী পরিবার তাদের জায়গা জমি ফিরে না পাওয়ার দাবি করছে। কমপক্ষে আরও ১৫ হাজার পরিবারের ভূমি বিরোধ রয়েছে। ভূমি কমিশনের একটি সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত প্রায় এক হাজার আবেদন ভূমি কমিশনে জমা পড়েছে। এর মধ্যে আদিবাসীদের সংখ্যা দু’শর ঘর পেরোয়নি।
২০১০ সালের ১০ অক্টোবর রাঙামাটিতে ভূমি কমিশন আইন সংশোধন নিয়ে ভূমিমন্ত্রীর সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন সাংসদ, ভূমি প্রতিমন্ত্রী এবং ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও তিন সার্কেল প্রধান উপস্থিত ছিলেন। সভায় মতৈক্য হয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ আগে নিষ্পত্তি করা হবে। ভূমি বিরোধ হবে পরে। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির কাজ শুরু আগে সংশোধন করা হবে পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন ২০১১-এর ২৩টি বিরোধাত্মক ধারা। ভূমি কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যানকে অপসারণ করারও সুপারিশ করা হয়।
এ সভায় সিদ্ধান্তে পরিপ্রেক্ষিতে গতবছরের ১৯ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরী, ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরা, তিন এমপি ও জেলাপরিষদ চেয়ারম্যান দেখা করেন। সাক্ষাৎকালে আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান এবং তিন সার্কেল প্রধানকে নেওয়া হয়নি। প্রধানমন্ত্রী আশ্বস্ত করেন, পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী আগে ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি করা হবে। তারপর হবে ভূমি জরিপ। তিনি বলেন, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি হলেই পার্বত্য চুক্তির মূল বিষয়টি বাস্তবায়িত হয়ে যাবে। তাই বিষয়টিতে মনোনিবেশ করার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। (প্রথম আলো, ২২ অক্টোবর ২০১০)
কিন্তু এসব সত্ত্ব্ওে ভূমি কমিশন আইনের বিরোধাত্মক ধারাগুলো পুরোপুরি সংশোধন হয়নি। কমিশনের চেয়ারম্যানকে অপসারণ করার সিদ্ধান্ত থাকলেও আজও তিনি ওই পদেই বহাল আছেন।
অন্তর্বর্তী ও বহুধারার প্রশাসন
‘ঢাকা থেকে পাঠানো এক ফ্যাক্স বার্তার মাধ্যমে আমাকে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। তেমনি আর একটি ফ্যাক্স বার্তায় আমাকে অব্যাহতি দেয়া হয়,’ এক ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় কথাগুলো বলেন রাঙামাটি জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান চিং কিউ রোয়াজা। তিনি ১৯৯৮ সালে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত আঞ্চলিক পরিষদ এবং জেলা পরিষদ চুক্তি পরবর্তী সময় থেকে আজ পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে আজ অব্দি কোনো নির্বাচন হয়নি। এভাবে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান অগণতান্ত্রিক পন্থায় পরিচালনার পদ্ধতিকে অত্যন্ত ক্ষতিকর বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক এবং গবেষক ড. আমেনা মোহসিন। ‘দ্য চিটাগাং হিল ট্রাকস বাংলাদেশ : অন দ্য ডিফিকাল্ট রোড টুু পিস’ শীর্ষক তার বইতে অধ্যাপক আমেনা লিখেছেন ‘রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য গণতান্ত্রিক সংস্থার চর্চা জরুরি। পার্বত্য চট্টগ্রামে এই প্রক্রিয়া অনুপস্থিত। পার্বত্য চুক্তি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু হবার এক আশা তৈরি করেছিল। বিশেষত জেলা পরিষদগুলো সৃষ্টির মাধ্যমে। কিন্তু অনির্বাচিত এ প্রতিষ্ঠানগুলো সত্যিকার অর্থে সেই আশা বাস্তবায়িত করতে পারেনি।” (পৃ. ৬৪)। পাহাড়ে বর্তমানে মোট চার ধারার শাসন বিদ্যমান। প্রথমটি হলোÑ পাহাড়িদের প্রথাগত শাসনব্যবস্থা। সার্কেল প্রধান এবং হেডম্যান ও কারবারিদের পরিচালনায় চলমান এই প্রশাসনের দায়িত্ব মূলত ভূমি সংক্রান্ত। দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক সরকারের মতো প্রতিষ্ঠান। সরকারের সিভিল প্রশাসন রয়েছে এরপর। প্রথাগত এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর দূরত্ব অনেক। নানা বিষয়ে বিশেষত ভূমিসংক্রান্ত ব্যাপারে এই দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিরোধ লেগেই থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সবচেয়ে শক্তিধর প্রতিষ্ঠান হলো সেনাবাহিনী। ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামে সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ড আজো চলছে পাহাড়ি জনপদে। এই চার ধারার প্রশাসনের চাপে রয়েছে পাহাড়ের মানুষ ।
ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ
পার্বত্য চুক্তিকে অসম বলে মনে করেছিল পাহাড়িদের একটি গ্র“প, যাদের অধিকাংশ জনসংহতি সমিতির ছাত্র সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। এরাই পরে ইউপিডিএফ গঠন করে। জেএসএস নেতৃত্ব ইউপিডিএফ-এর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়। তাদেরকে পাহাড়ে শান্তির বিপক্ষের শক্তির সহায়তাদানকারী হিসেবেও জেএসএস নেতৃত্ব বিভিন্ন সময় আখ্যায়িত করে। অপরদিকে ইউপিডিএফ নেতৃত্ব চুক্তিকারীদের ‘আপসকামী’ এবং পাহাড়ি জনগণের সাথে প্রতারণাকারী হিসেবে চিহ্নিত করে। দু’পক্ষের চিন্তার ক্ষেত্রে এই দূরত্ব ক্রমশ বাড়তে থাকে। এবং তা এক পর্যায়ে বিভিন্ন স্থানে দু’দলের কর্মীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এই অবস্থা আজও চলছে। সংঘর্ষে অসংখ্য তরুণ নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন। এর সংখ্যা সরকারি কোনো দপ্তরে নেই। যথার্থ কোনো উৎস নেই সঠিক সংখ্যা জানবার। তবে সংখ্যা নিয়ে দু’দলের হিসাব আছে। ইউপিডিএপ-এর সভাপতি প্রসিত বিকাশ খীসা জানান, জনসংহতি সমিতির হামলায় তার দলের ২০০-এর বেশি নেতাকর্মী খুন হয়েছেন। অন্যদিকে জেএসএস-এর সাংগঠনিক সম্পাদক শক্তিপদ ত্রিপুরা জানান, ইউপিডিএফর হাতে নিহত হওয়া তাদের নেতাকর্মীদের সংখ্যা একশ’র কাছাকাছি।
উন্নয়ন কর্মকাণ্ড
পার্বত্য চুক্তির পরে পার্বত্য চট্টগ্রামে ২০০৩ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) তাদের কর্মকাণ্ড শুরু করে, পাহাড়ে শান্তি ও উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার লক্ষ্য নিয়ে। তাদের কর্মকাণ্ডের মঝে রয়েছে জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন, প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে আস্থ’া তৈরি । সম্প্রতি ‘প্রমোশন অফ ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কনফিডেন্স বিল্ডিং ইন দ্য টিচাগাং হিল ট্র্যাকস’ নামের চলমান প্রকল্পটি ইউএনডিপি এবং সরকারের সমঝোতার মাধ্যমে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১১০০ কোটি টাকা। ইউএনডিপি’র নিজস্ব তহবিল ছাড়াও এ প্রকল্পে যুক্ত আছে ইউরোপিয়ান কমিশন, কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কমিশন (সিডা), ডানিডা (ডেনমার্ক) ইউএসএইড (যুক্তরাষ্ট্র), নরওয়ে, অস্ট্রেলিয়া এবং জাপান। পার্বত্য এলাকার ২৫টি উপজেলার মধ্যে ১৬টিতে বর্তমানে এই প্রকল্পের আওতায় কাজ চলছে।
পার্বত্য এলাকায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের হালচাল নিয়ে কথা হলো এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)’র পরামর্শক এবং উন্নয়ন চিন্তাবিদ কীর্তি নিশান চাকমার সাথে। পার্বত্য এলাকায় ৩ ধারায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। একটি দাতাদের সহযোগিতায়, দ্বিতীয়টি সরকারের পরিচালনায় এবং তৃতীয় পর্যায়ে রয়েছে এনজিও কর্মকাণ্ড। কীর্তি নিশান বলেন, ‘এ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে দাতাদের কর্মকাণ্ড। দাতাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে আমি বলব, যতটুকু প্রত্যাশা করা হয়েছিল উন্নয়ন ততটুকু হয়নি। তবে কিছুই যে হয়নি তা নয়, কিন্তু যতটুকু হয়েছে তা আশানুরূপ নয়। আর সরকারের কর্মকাণ্ডের হিসাব সাধারণের নাগালের বাইরে। সার্বিক সমস্ত দিক বিবেচনা করে বলতে পারি উন্নয়নের গতি শ্লথ।’
ইউপিডিএফ ও সদকের অত্যাচার কবে থামবে?
জানা গেছে, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সরকার আমলে পাহাড়ি উপজাতীয়দের সঙ্গে সম্পাদিত শান্তিচুক্তির বিরোধিতাকারী সংগঠনের অত্যাচার ও দাপাদাপিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে সাধারণ পাহাড়ি ও বাঙালি জনগণ। তাদের সঙ্গে শান্তিচুক্তিকারী সংগঠন জেএসএসের ছত্রছায়ায় ‘সদক’ নামে ক্যাডার সংগঠন পাহাড়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে খাগড়াছড়িতে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) ও ‘সদক’ এ দুটি সংগঠনের ক্যাডাররা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। চাঁদা আদায়ে এলাকাভিত্তিক রয়েছে তাদের প্রতিনিধি। গোটা খাগড়াছড়ির লোকজন কে কী করে, কত টাকা আয় তার সবই ক্যাডারদের নখদর্পণে। মহালছড়ি, দীঘিনালাসহ অনেক এলাকায় চাকরিজীবীদের মাস শেষে বেতনের দুই শতাংশ টাকা তুলে দিতে হয় সন্ত্রাসীদের হাতে। এছাড়া ধানসহ মৌসুমের ফসল ঘরে উঠলেই একটি অংশ তাদের কাছে পৌঁছে দিতে হয়। এছাড়া অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, হত্যাকাণ্ড ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া তো রয়েছেই।
পাহাড়ে শান্তি আসবে কবে?
শান্তিচুক্তি নিয়েও বিরাজ করছে অস্থিরতা। পার্বত্য এলাকার মানুষের প্রধান প্রত্যাশিত বিষয় ‘শান্তি’। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বহুলভাবে পরিচিত ‘শান্তি চুক্তি’ হিসাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, চুক্তির ফলে দু’দশকের সংঘর্ষের অবসান হয়েছে ঠিকই, কিন্তু যুদ্ধের অবসান শান্তির নিশ্চয়তা দেয়নি। আত্মনিয়ন্ত্রণের যে দাবি পাহাড়িরা করেন, সেটি হঠাৎ চাওয়া কোনো দাবি নয়। উন্নয়নের নামে পাহাড়িদের জীবন ও প্রকৃতি বিরোধী কর্মকাণ্ড, মানুষের বিপর্যয়, সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টার প্রক্রিয়ার ফলেই পাহাড়ি মানুষ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার চেয়েছে। উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বলে, মানুষের গণতান্ত্রিক দাবির প্রতি শ্রদ্ধা না জানালে রাষ্ট্র বিরাট ধাক্কা খায় এবং এক পর্যায়ে দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। পাহাড়ের মানুষের ন্যায়সঙ্গত দাবির প্রতি শ্রদ্ধাই ওই অঞ্চলের শান্তির নিশ্চয়তা দিতে পারে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদন
বাংলাদেশের পার্বত্যভূমির এ সংকটময় পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের আদিবাসীবিষয়ক স্থায়ী ফোরাম (পার্মানেন্ট ফোরাম অন ইনডিজিনাস ইস্যুস) থেকে প্রকাশ করা হয়েছে একটি বিশেষ প্রতিবেদন। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ১৬ থেকে ২৭ মে অনুষ্ঠেয় ওই ফোরামের দশম অধিবেশনে এই প্রতিবেদনটি উপস্থাপিত করা হবে। প্রতিবেদনে পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন-পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে ওই অঞ্চলে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে সরকার, দাতাগোষ্ঠী, আন্তর্জাতিক এনজিও এবং জাতিসংঘের করণীয় সম্পর্কে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনের উল্লেখযোগ্য দিক এখানে তুলে ধরা হলো :
প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ
জাতিসংঘের এ প্রতিবেদনে পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্বাপর ইতিবৃত্ত বর্ণনা করে বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ওই অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি এক গেরিলা যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে শান্তি স্থাপনের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। কিন্তু ওই চুক্তি স্বাক্ষরের ১৩ বছর পর আজ একটি বিষয় স্পষ্ট যে, চুক্তির মৌলিক ও প্রধান অনুচ্ছেদগুলো বাস্তবায়ন করা হয়নি। এর উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, চুক্তি অনুযায়ী সেখানকার আঞ্চলিক ও স্থানীয় শাসনব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ আদিবাসী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়নি। সেখানকার ঐতিহ্যগত শাসনব্যবস্থা (রাজা, হেডম্যান, কার্বারি) কার্যত অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি, শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন ফেলে রাখা হয়েছে। ফলে এখন অবস্থা এমন যে সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের কথা বললেও কেউই তা বিশ্বাস করে না। এ নিয়ে পাহাড়ি জনগণের মনে হতাশা বাড়ছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অঞ্চলটি এখনো সেনাবাহিনী অধ্যুষিত। যদিও ১৯৯০ সালে অস্ত্রবিরতির পর থেকে সেখানে সশস্ত্র অনুপ্রবেশের কোনো ঘটনা ঘটেনি বা অভিযোগ পাওয়া যায়নি, তবু সেখানে ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামে সেনাবাহিনীর ‘কাউন্টার ইনসার্জেন্সি’ তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। তারা সাধারণ বেসামরিক বিষয়াদিতেও হস্তক্ষেপ করে বলে অভিযোগ রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে কত সংখ্যক সেনাসদস্য অবস্থান করছেন, তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে দেশের প্রায় এক-দশমাংশ এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ওই অঞ্চলে দেশের সেনাবাহিনীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মোতায়েন রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, যুদ্ধাবস্থা ছাড়া এটা কোনোভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি শুরু থেকেই পার্বত্য চুক্তির বিরোধিতা করে আসছে। তারা বিষয়টিকে ব্যবহার করে দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে নির্বাচনি ফায়দা লুটতেও দ্বিধা করে না। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগও চুক্তি বাস্তবায়নে দ্বিধাগ্রস্ত। পাশাপাশি মারাত্মক কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থার এই দেশে আমলাতন্ত্র দারুণ প্রভাবশালী। সরকারের যে কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে আমলাদের সব সময়ই বিশেষ ভূমিকা থাকে। এছাড়াও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকারের বিষয়টি খুব নাজুক। মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রধান শিকার আদিবাসী পাহাড়িরা। এসবের মধ্যে রয়েছে কথায় কথায় গ্রেপ্তার, নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, মানবাধিকার কর্মীদের হেনস্থা করা, যৌন নিপীড়ন প্রভৃতি। এসব ঘটনা থেকে অনেক বড় দুর্ঘটনা ঘটে, যেমন ঘটেছিল বাঘাইহাটে, ২০১০ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে। আর ওই ধরনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয় পাহাড়ি-বাঙালি দাঙ্গা। এর পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও সংঘাত-সংঘর্ষ বেড়ে চলেছে। চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় এ ধরনের সংঘাতের প্রেক্ষিত সৃষ্টি হয়েছে।
জাতিসংঘের সুপারিশ
১. পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের সময়সীমা নির্ধারিত করতে হবে।
২. চুক্তি বাস্তবায়নের রূপরেখা প্রণয়ন এবং চুক্তি বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পরিচয় নিশ্চিত করে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।
৩. ভূমি সংক্রান্ত জটিলতা সংশোধনী ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইন ২০১১ এর মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হবে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানীয় পরিষদের মাধ্যমে চুক্তির শর্ত ও সুপারিশসমূহ তুলে ধরতে হবে।
৪. অতিরিক্ত সেনাবহিনীর তৎপরতা কমানো ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বজায় রাখার জন্য অস্থায়ী সেনাবাহিনী ক্যাম্প প্রত্যাহার করতে হবে।
৫. পার্বত্যভূমিতে আদিবাসীদের অবস্থান পরিবর্তন করছে সেনাবাহিনী অথচ নিয়ম অনুযায়ী এ ধরনের কোনো কাজে সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ত থাকার সুযোগ নেই। সুতরাং এলাকায় এ ধরনের উন্নয়নমূলক কাজের ক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা জনপ্রশাসনের ভূমিকা নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি ভূমি বিষয়ক বিরোধে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ কমানো, সড়ক, পানিপথ ও বনে সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট কমাতে হবে এবং অন্যান্য স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ দিতে হবে।
৬. সমঝোতা হয়ে গেছে- এমন সব বিষয় সরকারকে হস্তান্তর করতে হবে। এছাড়াও চুক্তি নির্দিষ্টকরণ, পাহাড়ি জেলা পরিষদ, পার্বত্যবাসীদের সকল কার্যক্রম সমন্বয়করণ ও তত্ত্বাবধানে সকল প্রকারের সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও তাদের উন্নয়নে সরকারকে আইন প্রণয়ন করতে হবে।
৭. সরকারকে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণকারী বাহিনীকে এসব অপরাধের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ নিশ্চিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
৮. পাহাড়িদের আইনি সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। পাবলিক ইনফরমেশন সিস্টেম আরও জোরদার করা ছাড়াও নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করতে হবে।
১০. পার্বত্যভূমিতে তথ্য অনুসন্ধানের জন্য জাতিসংঘ, দেশীয় বা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা এবং সরকারি-বেসরকারি মিডিয়ার প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
১১. পার্বত্যভূমির বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ এবং পর্যবেক্ষণের জন্য জাতিসংঘ থেকে আদিবাসী বিশেষজ্ঞদের আহ্বান করতে হবে।
১
১. ০২ রা মে, ২০১১ দুপুর ১২:৪৯ ০