সন্ধ্যার একটু আগে হাঁটব বলে বেরোলাম। গলির মোড়ের মার্কেটটায় একটু কাজ ছিল। ঢুকতেই চোখে পড়ল এক পিতা তার তিন কি চার বছরের সন্তানকে কয়েকটা খেলনা পিস্তল থেকে একটা বাছাই করার জন্য বলছেন। দৃশ্যটা নতুন কিছু নয়। এই দোকানে আমি প্রায়ই আসি এবং অন্যান্য অনেক কিছুর সাথে খেলনা পিস্তল, নানা ধরণের বন্দুক, ট্যাংক, কামান ইত্যাদি আকর্ষণীয়ভাবে সাজিয়ে রাখতে দেখি। আজকালকার খেলনা মারণাস্ত্রগুলো দেখতে প্রায় হুবহু আসল অস্ত্রের মতই। এগুলো বাচ্চাদেরকে খুব সহজেই টানে এবং সেই টানের অপর প্রান্ত তাদের অভিভাবকের হাতে অতি শিথিলভাবে ধরা। এই শিথিলতার সুযোগে ফসকে যাচ্ছে প্রত্যাশিত মূল্যবোধের সুতো।
শুধু অভিভাবক কেন? এই বিষয়ে স্বয়ং রাষ্ট্র নিষ্ক্রিয়। অবশ্য এত অস্বাভাবিক সংখ্যক যান্ত্রিক গোলযোগপূর্ণ একটি রাষ্ট্রযন্ত্রের সক্রিয়তা প্রায়শই বিভ্রান্তি বাড়িয়ে থাকে; এমনটিই আমরা দেখে থাকি। আমরা যখন স্কুল-বয়সী, শুনে খুবই খুশি হয়েছিলাম যে পলিথিন নিষিদ্ধ হচ্ছে। আমরা যখন কলেজ-পড়ুয়া, জানলাম টু-স্ট্রোক থ্রিহুইলার রাস্তা থেকে উঠে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠে দেখি পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধ। প্রতিটি সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রযন্ত্রটির সক্রিয় অবস্থা ঘোষণা করেছিল এবং আমরা আশান্বিত হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু যান্ত্রিক গোলযোগ যখন ক্রমেই অধিক সক্রিয়তা প্রকাশ করল এবং একসময় এটাও আঁচ করা অসম্ভব রইল না যে এই গোলযোগ প্রায় সময়ই ইচ্ছাকৃত, তখন সমসাময়িক রাষ্ট্রীয় সক্রিয়তায় আশান্বিত হব কিনা তা নিয়ে সংশয় কাজ করা শুরু করেছিল। সেই সংশয়ের দোলায় এখনো দোদুল্যমান আশা বেশিরভাগ সময়ই যন্ত্রটি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাখে তার কিম্ভূত আচরণ দেখার আশংকায়। তাই আজ সন্ধ্যায় যখন পিতা-পুত্রের বন্ধনের সুপার গ্লু হিসেবে খেলনা পিস্তলের সস্নেহ আবদার, তখন এই প্রশ্ন অবান্তর মনে হয়- কেন আমার নির্বাচিত সাংসদ্গণের কাছে খেলনা মারণাস্ত্রের উৎপাদন, বিক্রয় এবং ক্রয় নিষিদ্ধ করে আইন প্রণয়নের চেয়ে নিজেদের সন্তানের ভর্তি কোটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
তারপর ধরা যাক মিডিয়ার কথা। বাংলার উপর দিয়ে দেশ-বিভাগের দাগ পড়ার পর যেহেতু পশ্চিমবাংলা হয়ে গেল আরেক দেশ, এদেশীয় মানুষ এবং সংস্কৃতি থেকে নিজেদেরকে মুক্ত রাখা বোধ হয় তাদের হকের মধ্যেই পড়ে; তা না হলে পশ্চিম বাংলার আকাশ বাংলাদেশের স্যাটেলাইট চ্যানেল মুক্ত থাকার কথা নয়। জানিনা এর পেছনে কী যুক্তি, তবে এটা জানি আমাদের আকাশ যে বলিউড-মুক্ত নয় এটি একটি সত্যিকার থ্রেট। বলিউড এই মুহূর্তে বিশ্বের হাইব্রিড কালচার এর রিপ্রেজেন্টেটিভগুলোর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। এই হযবরল অবস্থা বলিউডের কাম্য কিনা জানিনা, এটা জানি এটা আমাদের কাম্য নয়। আমরা সবেই আমাদের ঔপনিবেশিক সম্মোহন কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছি। এই সময়টা আমাদের এক ক্রান্তিকাল চলছে। নিবিড়ভাবে নিজেকে নিয়ে থাকার সময় এটা। যাক, সেটা আরেক অধ্যায়। এখানে প্রাসঙ্গিক মনে করছি বলিউডের সেই পর্ব যেখানে ‘নেতিবাচক’ বিষয়কে গ্লোরফিফাই করে উপস্থাপন করা হচ্ছে। নায়ক চোর, ডাকাত বা পকেটমার; এবং নায়কের এই অবস্থাটিকেই তার বীরত্বের-মহত্বের ভিত্তিভূমি হিসেবে দেখানো হচ্ছে- হোয়াট দ্যা হেল। ‘ধুম’ সিনেমা’র শেষে গাড়িচোর নায়ক পুলিশের হাতে ধরা পড়বে না বলে আত্মহত্যা করে এবং পুলিশ শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারণ করে যে সে যদি চোর না হত তাহলে তারা নিশ্চয়ই বন্ধু হত। এটা মাত্র একটা সিনেমার একটা দৃশ্য। এরকম শত শত সিনেমার হাজার হাজার দৃশ্য উদাহরণ হিসেবে দেখানো যাবে যেখানে পুরো সিনেমাতে নেতিবাচক মূল্যবোধকেই উৎসাহিত করা হয়েছে। হলিউডের দেখাদেখি বলিউডে সেক্স এবং ভায়োলেন্সকে যেভাবে গ্লোরিফাই করা হয়, তা কোন ভাবেই আমাদের মূল্যবোধের অনুগামী নয়। আমাদের আকাশ বলিউড-মুক্ত হলে এই অবাঞ্ছিত মূল্যবোধের আগ্রাসন অনেকাংশেই কমার কথা। আবারো সেই রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত-রাষ্ট্রযন্ত্র-যান্ত্রিক গোলযোগ।
এসব কথা এমনিই বললাম। এগুলো কথার কথা।