দুপুর বেলাগুলো এই গ্রামে বড্ড নির্জন। সকাল সন্ধ্যায় কৃষক শ্রেণীর মানুষের আনাগোনা টুকুও যেন দুপুর বেলা ঘুমিয়ে পড়ে। বাংলাদেশের যে সব স্থানে এখনো বিদ্যুত আসেনি, এই গ্রামের কথা আপনারা সেখানেই পাবেন। তো, সেরকম এক দুষ্প্রাপ্য গ্রামে বৈশাখী রোদ আর মৃদুমন্দ হাওয়ায় বসে আমি লিখছি।
মানুষের মন আর সদ্য স্বাধীন হওয়া পাখির মাঝে অনেক মিল! সারাজীবন খাঁচায় কাটানো পাখি জানে না কিভাবে খাবার খুঁজতে হয়; মানুষের মন তেমনি আন্দাজ করতে পারে না হঠাৎ সুখ শান্তি বা দুঃখের মুখ দর্শন হলে কি করা উচিত! আমার অবস্থা খানিক সেরকমই। সারা জীবন ঢাকায় বড় হয়েছি, কিন্তু সব সময় মনে হয় আমি এই অজপাড়া গাঁয়ের সন্তান। প্রতিষ্ঠিত প্রকৌশলী হয়ে গ্রামে ফিরে আসলে, প্রানসুধা আর ক'ফোটাও অবশিষ্ট থাকবে না! বিষাক্ত শহর আমার প্রাণশক্তি নিঃশেষ করে দিবে।
দাদী দুবছর হলো নেই। মাঝে মাঝে তাই শূণ্য বাড়িটায় এসে আড্ডা জমাই। বাড়ি যে ঠিক শূণ্য তা নয়, দেখাশোনা করার জন্য আইয়ুব চাচার পরিবার আছেন।
আইয়ুব চাচা জমিজমার হিসেব রাখেন, ধান চালের কারবার দেখেন, সময় মতো পুকুরে মাছ ছাড়েন, আর দুমাস পরপর বাসায় এটা সেটা পাঠান। বাবা মা, আমরা সবাই তাই চাচাকে খুব পছন্দ করি।
.......................................................................................................................
মাঝখানে লেখায় ছেদ পড়েছিলো। আমার আবার চায়ের নেশাটা খুব চড়া। তাই দুপুর বেলা পদ্মকে চা দিতে বলেছিলাম। বেচারি! এই রোদের মাঝেও মাটির চুলায় চা বানাতে ও আপত্তি করে নি। ফর্সা মুখখানি আগুনের তাপে লাল বর্ণ ধারণ করেছে (এটা ভ্রমও হতে পারে!)।পদ্ম আইয়ুব চাচার বড় মেয়ে।
'পদ্ম' নামটা আমার মায়ের দেয়া। নামটা সুন্দর না? পদ্ম ইন্টার পাশ করেছে। কিন্তু নগরের বিচিত্র আধুনিকতা ওকে স্পর্শ করেনি বলে ও অন্য সবার মতো নয়। বলা যায়, আগের দিনের বাংলা সিনেমার নায়িকাদের মতো, যখন তখন যাদের প্রেমে পড়া যায়। কিজে ছাই পাশ ভাবছি! আসলে নানান মানসিক অশান্তিতে আমার মাথা ঠিক নেই।।
২.
বিকেলে আমি দিঘির পাড়ে বসে কিছু সুখটান দেবার আয়োজন করছি, এমন সময় পদ্ম হাজির। একজন পুরুষ যখন বিক্ষিপ্ত মনে উদ্দ্যেশ্যবিহীন সময় কাটায় তখন নারী সঙ্গ বর্জনীয়।
-"কিছু বলবে?"
-"না, মানে...চা খাবেন?"
আমি এরূপ আচরণের অর্থ বুঝলাম না, তবে লাইটারটা লুকিয়ে বললাম,
-"মন্দ কি?"
নীল কাপটায় করে পদ্ম চা নিয়ে এসেছে। দিঘি থেকে উড়ে আসা একরাশ শীতল বাতাস আমায় ভিজিয়ে দিলো।পদ্ম পিছনে দাড়িয়ে আছে।
-"রাতে ঠিক মতো ঘুমাও না মনে হয়।"
-"কই, নাতো।"
(নিরবতা)
-"তোমার প্রিয় রঙ কি?"
-"নীল।"
আশ্চর্য রিয়ার প্রিয় রঙও নীল! সেজন্যই আমাকে ও নীল কাপটা উপহার দিয়েছে।
_____________________________________________________
সকালে বাজারে গিয়ে দু ডজন নীল কাচেঁর চুড়ি কিনলাম। বাড়ি ফেরার আগে মোবাইলটা চালু করলাম। এদিকে নেটওয়ার্ক আছে।
এমন কিছুর জন্যই প্রস্তুত ছিলাম। রিয়া ম্যাসেজ পাঠিয়েছে, আংকেল স্ট্রোক করেছেন। ঢাকা গিয়েই বিয়ে করতে হবে।
এখন আমি দুইটা জিনিসের একটা করতে পারি- ঢাকা গিয়ে বাবার বড়লোক বন্ধুর মেয়ে রিয়াকে বিয়ে করা, নয়তো পদ্মকে নিয়ে বাসায় গিয়ে আম্মার হাতে পায়ে পড়ে কান্নাকাটি করা।
বাংলা সিনেমায় তো সব হয়। কিন্তু জীবনতো আর সিনেমা না। ভাবছি, এই কাহিনীর নায়ক অনেক বছর নিরুদ্দেশ থাকবে।
© প্রান্ত
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৫:৩৫