অবতরনিকা: বংগবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্বংশকারীদের (আমি নির্বংশই বলবো কারন প্রচলিত ধারায় বংশগতি পুরুষ উত্তরাধিকারীর ওপরেই বর্তায়) শাস্তি প্রদানের পর থেকে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটার পর একটা পোষ্ট আসছে। যার প্রায় সবগুলোই (গুটি কয়েক ব্যতিক্রম ছাড়া) পক্ষপাত দুষ্ট। অনেক ভাবনা চিন্তা করে আমার নিজস্ব ক্ষতির কথা ভুলে/ এড়িয়ে আমি আমার একান্ত ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরছি, শিরোনামে উৎসর্গীকৃত ব্লগারদের জন্যে। ৩ বছরটা উল্লেখ করার কারন হ'ল যে মানুষের কোন স্মৃতি ৩ বছর বয়সের আগে থাকেনা, সাধারনত। এ পোস্টে আমার ব্যাক্তিগত ক্ষতি গুলোঃ
১। এটা প্রকাশিত হবার পর আমার পরিচয় গোপন থাকবেনা, যা আমি এতদিন সযতনে রক্ষা করেছি।
২। ব্যাক্তিগত ঘটনা বয়ান পাঠকদের কাছে মাঝে মধ্যে আত্মপ্রচার ও পারিবারিক প্রচারের মত লাগবে যা আসলেই অশোভন, অরুচিকর এবং বিরক্তিকর। এগুলোও আমি লুকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে এসেছি আজীবন।
৩। কোন পক্ষাবলম্বন না করে লেখাটা অত্যন্ত দুঃসাধ্য। আমার জন্যে আরো কঠিন। কারন যৌবন যখন সদ্য দেহ-মনে ভর করে আমার সমগ্র সত্তাকে ভীষনভাবে নাড়িয়ে দিচ্ছে, যা কিছুই সুন্দর তারই প্রেমে পড়ছি, ঠিক সে সময়ই বংগবন্ধুর সাথে আমার পরিচয়। নিরপেক্ষভাবে তাঁর ব্যাপারে লিখতে আমার খুবই কষ্ট হবে এবং আমাকে অসাধ্য সাধন করতে হব.
৪। শুধুমাত্র স্মৃতি নির্ভর লেখার মূল সমস্যাটা হ'ল ভুল স্মৃতি মনের মধ্যে থাকা। যে কেউ যদি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আমার কোন বক্তব্যে দ্বিমত প্রকাশ করেন, তা'লে তাকে আমি অনুরোধ করবো মন্তব্যে তা তুলে ধরতে। আমার স্মৃতি ঘাটতে সাহায্য করার নেই কেউ আমার হাতের কাছে।
আমি আপ্রাণ চেষ্টা করবো-আমার যে একটা দায় আছে আমার পরের প্রজন্মগুলোর কাছে।
আমার এই দায় শোধ যদি এই প্রজন্মকে আমাদের গৌরবময় আর কলংকলেপিত অতীতকে নিরপেক্ষ ভাবে দেখতে শেখার পথে একপাও এগিয়ে নিয়ে যায়, তা'লেই আমি মনে করবো সেটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন।
অনুগ্রহ করে মনে রাখবেন এটা আমার একান্তই ব্যাক্তিগত সৃতিচারন। পারিবারিক ঘটনাবলীর চর্বণ। সমগ্র দেশের ব্যাপারটা কখনোই প্রধান্য বিস্তার করবেনা, সে সাধ্য বা যোগ্যতা আমার নেই।
পুরোটা পড়ার পর অনেকের কাছেই এটাকে "পর্বতের মূষিক প্রসব" বলে মনে হ'তে পারে। তাদের কাছে আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>
পর্ব-১পর্ব-২পর্ব-৩ পর্ব-৪
পর্ব৫পর্ব-৬পর্ব-৭ পর্ব-৮ পর্ব-৯ পর্ব-১০ পর্ব-১১ পর্ব-১২ পর্ব-১৩ পর্ব-১৪ পর্ব-১৫ পর্ব-১৬পর্ব-১৭ পর্ব-১৮পর্ব ১৯ পর্ব-২০
আগের স্মৃতি পরে আসায়ঃ
রোমান হরফে বাংলা লিখন
মাতৃ ভাষা আছে অনেক জাতির, উপজাতির, আদিবাসীদের এবং বিভিন্ন জনগোষ্ঠির। কিন্তু লিপি আছে কটি ভাষার? আমাদের বাংলার আছে একটি অতি উন্নত লিপি (script)। পাকিরা এই লিপিকেও ধংস করতে চেয়েছিল। বিভিন্ন অন্চলের বিভিন্ন লিপির জায়গায় একটি সর্বগ্রাহ্য লিপি চালু করার অজুহাতে রোমান লিপির প্রচলন করার চেষ্টা চালানো হয়েছিল। পাকিস্তান অবজারভারে রোমান লিপিতে লেখা বাংলায় নিবন্ধ উঠতো। আমি তখন স্কুলের নীচু ক্লাসে পড়ি। আমার খুব মজা লাগতো তা পড়তে। একদিন বাবা দেখে ফেলেন যে আমি ওটা পড়ছি এবং অল্প অল্প হাসছি। অকারনেই উনি রেগে গিয়ে আমাকে গলা চড়িয়ে বল্লেন আর যদি কোন দিন দেখি এগুলো পড়তে তা হ'লে "দাঁতের হালি ফালাইয়া দিমু" । বিনা কারনে বকা খাওয়ায় আমি খুব মন খারাপ করে ছিলাম বেশ ক'দিন। পরে বাবা আমার মন মরা ভাব দেখে তার কারন বের করলেন এবং বুঝিয়ে বল্লেন যে কেন বকা দিয়েছিলেন।
ঘটনার কয়েক দশক পর বিষয়টার সম্মুখিন হই আবার। এম এস এন চ্যাট শুরু হয়েছে মাত্র। একদিন দেখলাম আমার ছোট পুত্র চ্যাট করছে-রোমান হরফে। "স্থান কাল পাত্র"এর মধ্যেরটা ভুলে প্রচন্ড ধমক দিলাম। পরে অবশ্য কাফফারা দিতে হয়েছিল। এখন তো মোবাইলে বাংলা লেখার ওটাই একমাত্র উপায় (নকিয়ার কয়েকটি মডেল ছাড়া)
হায়রে- বিরাট চক্রান্ত করে, লোকবল অর্থবল ব্যয় করে যা পাকিরা সম্ভব করতে পারেনি, তা একটি প্রযুক্তিগত উৎকর্ষে আপনাতেই হয়েছে। গতকাল পেয়েছি আরেকটি চমক, হাতে লেখা আমাকে পাঠানো এই চিঠিটা:
Dear Mohan Mohapurush,
Ami apnake onurodh korchi je ajke lokkhi sonamoni xxxx ke ekti shuayojito program dekhte diben. Ei programti bochore ekbar ashe.
To apni ta-ke 7:30 theke shesh porjonto "Star Screen Award" dekhte dien, please.
- P. C.
লিখেছে আমার কন্যার প্রিয়তম বন্ধুটি। কন্যাটি বাবার আর কিছুই না পেলেও বাঁদরামীর স্বভাবটি পেয়েছে পুরো মাত্রায় । বাঁদরামীর জন্যে তার বাবাকে তিনজন শিক্ষিকার কাছে উপদেশ শুনতে হয়েছে যা বাবার অত্যন্ত অপছন্দ। কন্যাকে বাবা গত পরশু সাতদিনের জন্যে গ্রাউন্ডেড করেছেন। টিভি দেখা কন্যার বন্ধ।
আমার আশংকা। ইন্টারনেটে আর মোবাইলে রোমান লিপিতে বাংলা লিখতে লিখতে কি আমাদের বংশধরেরা কি বাংলা লিপি হারিয়ে ফেলবে চিরদিনের জন্যে?
আমার সোনার বাংলা/আমি তোমায় ভালবাসি
২৩শে মার্চ, ১৯৭১। পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবস ছিল বোধহয়। সে দিন ৩২ নম্বরে চার খলিফা (আমরা তাদের ডাকতাম) মিলে বংগবন্ধুর বাসায় বাংলাদেশের পতাকা ওড়ায়। আমি আমার সদ্য প্রয়াত ফুপাতো বোনকে (আমার ছোট) নিয়ে সকাল বেলায় আগ্রাবাদের রেডিও স্টেশনে গেলাম। আগেই ও পাশ করেছিল অডিশনে। ছোটদের অনুষ্ঠানে গান গাইবে ও, যা সরাসরি সম্প্রচার করা হবে। দু'দিন আগে থেকেই ভীষন উত্তেজিত কোন গানটা গাইবে। পথে আমাকে দু' তিনবার অনুরোধ করলো যে কোন একটা গান ওকে মনে করিয়ে দিতে। রবীন্দ্র সংগীত গাওয়াটা ছিল পাকিদেরকে বিদ্রুপ করার একটি অস্ত্র। আমি প্রস্তাব করলাম '"আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে"। ও রাজী হয়ে গেল। সম্প্রচার/রেকর্ডিং কক্ষে মাউথ পিসের সামনে দাঁড়িয়ে একবার আমার দিকে তাকালো। গাওয়া শুরু করলো:"আমার সোনার বাংলা/আমি তোমায় ভালবাসি"! আমাদের মধ্যে ও ছিল সবচে' ভদ্র। গান গাওয়া শেষে বেরিয়ে এসে থেকে বাসায় পৌঁছানো পর্যন্ত আমাকে বারবার বলেছে "সরি, তোমার গানটা গাইনি। মাউথ পিসটা সামনে নিয়ে গাওয়ার সময় বিশ্বাস কর, আমার সোনার বাংলা মুখে এসে গেল।"
আমার ফুপা ফুপু এবং তাদের আত্মীয়স্বজনেরা শত চেষ্টাও সে সম্প্রচার শুনতে পাননি নরসিন্দী থেকে।
স্বাধীন চিটাগাং
২৫ শে মার্চ রাতে ভাল ঘুম হয় নি। কয়েক মাস ধরেই পাড়ার কুকুর গুলো কাঁদতো। মা শিউরে উঠতেন। আমার নানীর কাছে শোনা তার, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় একটা দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে গিয়েছিল না খেতে পেয়ে। সেই দুর্ভিক্ষ আসার আগে নাকি কুকুর এভাবে কাঁদতো। মা একথা বল্লেই বাবা দেখতাম থমথমে মুখ করে থাকতেন। কুকুরের কান্না খুব বেড়ে গেলেই তিনি রেডিওগ্রামের আওয়াজ বাড়িয়ে দিতেন যাতে কান্না না শোনা যায়। অনেক পরে বাবা বলেছিলেন যে তিনি যখন স্কুলের নীঁচু ক্লাসে পড়তেন তখন তিনিও শুনতেন সেই কুকুরের কান্না। মন্বন্তর তার কিছুদিন পরেই তার কালো থাবা বিস্তার করে। তা ছিল ওলাওঠা বা গুটি বসন্তের চেয়েও ভয়াবহ ও সর্বগ্রাসী। সর্বোপরি তা ছিল মানবতার চরম অবমাননা। মানুষগুলো এক আঁজলা ফ্যানের (ভাতের মাড়) জন্যে রাস্তার সারমেয়র মত কামড়া কামড়ি করতো। বাবাদের আখাউড়া আর আগরতলায় কিছু দোকান পাট ছিল। যুদ্ধের সময় সে দোকান গুলোর ভাড়া ১০/১২ গুন বৃদ্ধি পাওয়ায় পারিবারিক ভাবে সে মন্বন্তরের আঁচ থেকে তারা বেঁচে গিয়েছিলেন।
তো তাজ্জবের ব্যাপার হ'ল সে রাতে (২৫শে মার্চ, ১৯৭১) কোন কুকুরের কান্না শোনা যায়নি। চারিদিকে শুনশান। বোধ হয় কান্নার সুরে এতই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম যে, ওটাই হয়ে উঠেছিল ঘুমপাড়ানি গান।
খুব ভোরে উঠে পড়লাম। আমাদের বাড়িটা ছিল ডুপ্লেক্স (পোষ্টাল এড্রেস: ২২৭ সিডিএ রেসিডেন্সিয়াল এরিয়া, আগ্রাবাদ, চিটাগং। তখন সড়ক নম্বর ছিলনা)। দোতলায় সব ক'টা শোবার ঘর আর নীচ তলায় বসার ঘর, খাবার ঘর, রান্না ঘর আর অতিথি ঘর। মুখ হাত ধুয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছি - সুলতান চাচার ভরাট গলা, একটু উত্তেজিত "চুদানীজঝিরে............" । বসার ঘর দিয়ে চাচার গলা অনুসরন করে লনে বেরিয়ে এলাম। বাবা আর সুলতান চাচা একটা কাগজ দেখছেন। কাগজটার রং হলদেটে। অনেকদিন রেখে দিলে কাগজের যে রং হয়। সুলতান চাচা ছিলেন নিরক্ষর। কাগজটা পেয়েই বাবার কাছে ছুটে এসেছেন, কি লেখা জানতে, যদিও ঘটনা তিনি জেনেই এসেছেন। বাবার হাতের কাগজটির ওপর আমি ঝুঁকে পরলাম। ইংরেজীতে লেখা দু'টি প্যারাগ্রাফ। আজ কিছুই মনে নেই কি লেখা ছিল সে কাগজে তবে একটি বাক্যাংশ স্মৃতিতে এখনো জ্বলজ্বল করে: "Bengalees are fighting the enemy with great courage for an independent Bangladesh". কাগজটার প্রথম বাক্যের বাংলা ছিল সম্ভবত: "আজ বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র"। আমার গায়ের লোম সব খাড়া হয়ে গেল। মাথা বোঁ বোঁ করে ঘুতে লাগলো-সেই করে বাবা মা শিখিয়েছিলেন বাংগালী জাতীয়তাবাদের কথা, আমাদের শোষনের কথা, বন্চনার কথা, অক্ষরজ্ঞান দানের আগে। মনে পড়ে গেল বুয়েটে থাকা কালীন কাক ঢাকা ভোরে বাবার ঘুম থেকে জাগিয়ে দেবার কথা, শীত শীত ভোরে খালি পায়ে শহীদ মিনারে বাবা-মার মাঝখানে থেকে ফুল দেয়া, আপোষ না সংগ্রাম-সংগ্রাম সংগ্রাম, জয় বাংলা বাংলার জয়...............মনে পড়ে গেল অবাংগালীদের করুনার দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকানো- মনে পড়ে গেল আমাদের ফৌজদারহাটের ড্রিল স্টাফের হুংকার: " বাংলা বোলনে সে সাস নিকাল দেগা" ,... অন্তর গেয়ে উঠলো মাত্র পাঁচ দিন আগে স্বজন, সখা, সুহৃদের গাওয়া গানটি' "আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি"। আপনাদের কারো মনে আছে কি প্রথম বড় হয়ে ওঠার প্রমানের সময়কার অনুভূতিটি? আমি তখনো বড় হয়ে উঠিনি কিন্তু সেই অসহ্য সুখ, অপ্রাকৃত ভাললাগা, স্বর্গীয় আনন্দ আমি বড় হয়ে ওঠার আগেই পেয়েছিলাম।
আমার শোনা ভাষাগুলোর মধ্যে পান্জাবীর পরই মনে চাঁটগাইয়্যা ভাষা সবচেয়ে সমৃদ্ধ- মনের ঝাল মেটানোর জন্য। "ওৎতুর মা........" বলতে পারার সংগে সংগে রাগ অর্ধেকটা নেমে যায়। সুলতান চাচার অবিশ্রান্ত গালিগালাজ আমাকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনে। সেটা ছিল বার্তাটির বংগানুবাদ শোনার পর তাঁর তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া। আমার সেটা মুখস্ত আছে কিন্তু এখানে প্রকাশ করলে রাগীমন, দূঃখিত, রাগ ইমন আমাকে খেয়ে ফেলবেন।
চাচার সাথে একাধিকবার জহুর আহমদ চৌধুরী (স্বাধীন বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রক তাঁর অধীনে ছিল। সেটা ছিল একটা বাস্তব কৌতুক। তাঁর বাড়ি ভর্তি ছিল অসংখ্য আত্মজ, আত্মজা দিয়ে), এম আর সিদ্দিকী (আংগুলে গোনা বাংগালী শিল্পপতিদের একজন, বিশিষ্ট শিল্পপতি এ কে খানের মেয়ের জামাই, রেনেঁস ব্যান্ডের বোগীর বাবা) ও হান্নান-মান্নানের কথা হয়েছে। এম আর সিদিকী তাঁকে যেতে অনুরোধ করেছেন। হলদেটে কাগজটা নিয়ে তিনি চলে গেলেন। ঐ কাগজটাই ছিল ইপিআরের মাধ্যমে পাঠানো বংগবন্ধুর ওঅরলেস মেসেজ। তখন বলতাম-টেলিগ্রাম।
সেদিন ছিল শুক্রবার (সম্ভবত। আমার বাবা ছিলেন খাঁটি ওঅর্কোহোলিক (কাজ পাগলা)। পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকাতে (১৯৬৭-৬৮) থাকার সময় রোববার ছাড়া (অতি অল্প সময়ের জন্যে) তাঁকে কোনদিন দেখিনি। আমরা ঘুম থেকে ওঠার আগে চলে যেতেন সাইটে, ঘুমিয়ে পড়বার পর আসতেন বাসায়। আব্বার বন্ধুরা মজা করে বলতো র....কে বাচ্চারা কত বড় হয়েছে জানতে চাইলে হাত দুটি দুদিকে প্রসারিত করে সাইজ দেখায়, কেন জিজ্ঞেস করলে বলে আমি তো ওদের শোয়া অবস্থায় দেখি, কত লম্বা হয়েছে তা কিভাবে বলবো? কে কোন ক্লাসে পড়ে জীবনেও তাকে সঠিক ভাবে বলতে পারতে দেখিনি। তো সেদিন জীবনের প্রথম বাবাকে অফিস কামাই করতে দেখলাম।
আমি বাসা থেকে বেরিয়ে এলাম। এমনিতেই তখন সব মিলিয়ে এগারোটি দালান। তার মধ্যে বেশীরভাগই ওয়ান ইউনিট। বাজে তখন বড় জোর সাতটা। পুরো রাস্তায় কারো সাথে দেখা হ'ল না। বাসায় এসে মুরগীগুলোকে খাবার দিলাম ( আমাদের ২১টি মুরগী ছিল, পাহাড়তলী ফার্ম থেকে আনা। রোড আইল্যান্ড রেড, হোয়াইট লেগ হর্ণ আর নিউ হ্যাম্পশায়ার ব্রিডের। প্রত্যেকটি মুরগীর নাম ছিল, আব্বার রাখা, এ্যালফাবেটিক্যাল অর্ডারে)। একটা স্নাইপ (কাদা খোঁচা, ডানা ভাংগা) ছিল তার জন্যে বাজার থেকে মাছ কিনে এনে খেতে দিলাম ।
সকাল দশটার মধ্যেই বাসা ভরে গেল পাড়ার বড়দের দিয়ে। শুধু অবাংগালীদের কাউকে দেখলাম না। দুপুরের মধ্যে ঢাকার গণহত্যার খবরের বিষদ বিবরন পৌঁছে গেল। আমার চোখের সামনে বিহারীদের ওপর রাগ সমস্ত অবাংগালীদেরকেও গ্রাস করলো।
আমাদের গৌরবগুলো
দুপরের পরই খবর আসতে শুরু করলো প্রতিরোধের। মেজর রফিক(লক্ষ প্রানের বিনিময়ে, Tale of a Million) ইপিআরকে আর মেজর জিয়া ৮ম ইষ্ট বেংগলকে নেতৃত্ব দিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধ চালানো শুরু করলেন। সুলতান চাচা জানালেন যে ইপিআরের খাবার নেই। পাড়ার সব মেয়েরা, (৭ বছর থকে ৭০ বছরের) লেগে গেল রুটি আর ভাজী বানাতে। লতিফ চাচার বাড়ি ছিল খাবার বানানোর আখড়া। পিচ্চি ছেলেরা দুটো করে রুটির মধ্যে ভাজি ভরে রোল করে ঝাকায় সাজিয়ে রাখতে থাকলো, সাথে থাকতো একটুকরা শশা আর আধটা ডিম। অপেক্ষাকৃত বড় ভাইয়েরা সেগুলো যুদ্ধের জায়গায় নিয়ে যেতে লাগলো ওয়াপদার পিক আপে করে ডাঃ আনোয়ার আলীর নেত্বতে। আমাদের এলাকা থেকে কালুর ঘাটেও মেজর জিয়ার ৮ম বেংগলকে খাবার সরবরাহ করা হয়েছে। বিকেলের দিকে আসলো ইপিআরের হতাহতের খবর। তক্ষুনি ডাঃ আনোয়ার আলী (বার্মায় নিযুক্ত পাকিস্তানের এক কালীন রাষ্ট্রদূত সৈয়দ আকবর আলীর বড় ছেলে ) আর তাঁর স্ত্রী ডাঃ মন্জুলা আনোয়ার(সরকার) নিজেদের বাসার লেনের পরের লেনে একটা খালি বাসায় হাসপাতাল খুলে ফেল্লেন। ডাঃ আনোয়ারের বেংগল বে ক্লিনিক নামে একটা অষুধের দোকান ছিল আগ্রাবাদ পেরিয়ে বন্দরে যাবার পথে হাতের বাঁয়ে। সেই দোকান খালি করে সব অষুধপত্র তিনি বাসায় নিয়ে আসলেন। ব্যাংকের সব টাকা তুললেন দুজনের, কি দিয়ে পরদিন খাবার কিনবেন তার তোয়াক্কা না করে। সেই টাকায় অতিরিক্ত অষুধ, ইনজেকশন, ফার্স্ট এইড (যা যা তাঁর দোকানে ছিলনা) কিনে তার ছোট্ট হাসপাতালটা সাজালেন। আহত ইপিআর সৈনিকরা খুব শীগগিরই আসা শুরু করলো। তারা দুজন, তার চার মেয়ে ও দু'ছেলে (বড় দুজন ছাড়া বাকি সবাই ছোট) ও পাড়ার আরো ক'জন (তাদের মনে করতে পারছিনা) মিলে রাত দিন সেবা করেছে আহতদের ৪ঠা এপ্রিল পর্যন্ত। পাকিরা শহরে প্রবেশ করার পর দাঃ আনোয়র আলীকে পাকিরা ধরে নিয়ে বিমান বন্দরে আটকিয়ে রাখে। পরে তাঁর ছোট ভাই সৈয়দ কায়সার আলী ফোন করেন তাঁর পাকিস্তানী ফুপা পাকিস্তান টাইমসএর সম্পাদককে ফোনে ঘটনাটি জানা। তার হস্তক্ষেপে ডাঃ আনোয়ার আলী ছাড়া পান। ক'দিন পরি আবার পাকি আর্মি ওঁর বাসায় তল্লাসী চালায়। বেগতিক দেখে ডঃ আনোয়ার ঢাকায় চলে যান আর তার পরিবারের বাকি সবাই চলে যায় ফিরিংগী বাজার।
৩১শে মার্চ আটা সরবরাহে টান পরে। আমরা কজন (৭ থেকে ১২ বছরের) মিলে সাঁকো পেরিয়ে সিএসডি গো ডাউনে চলে যাই। সেখানকার দারোয়ানকে পাঁচ টাকা বকশিস দিয়ে এক ঠেলা গাড়ি ভর্তি গম নিয়ে আসি। ঠেলাওয়ালা কোন পয়সা নেয়নি।ওগুলো বাজারে বিনে পয়সায় ভাংগিয়ে, ৩রা এপ্রিল পর্যন্ত (খুব সম্ভবত, ঠিক মনে করতে পারছিনা তারিখটা) ই পি আর কে খাবার দেয়া অব্যাহত থাকে।
এদিকে অবাংগালীদের সম্পর্কে নান ধরনের গুজব আসতে থাকে। সবই অত্যন্ত ভয়াবহ। ২৬/২৭ তারিখ রাতে সুলতান চাচা আমাদের বাসায় আরেকটি মিটিং বসান- পাড়ার অবাংগালীদের নিরাপত্তার ব্যাপারে। সেখানে পাড়ার অবাংগালী তিনটি পরিবারের কর্তাও ছিল। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে ১৬ বছরের উপরের ব্য়সের সবাইকে নিয়ে একটা দল করা হবে যারা সিডিএর বাইরের কোন সন্দেহ ভাজন কাউকেই ঢুকতে দেবেন না। আমাদের ঠিক উল্টো দিকে থাকা বাসার পান্জাবী পরিবারের কর্তা (তারার হাসি, অনুগ্রহ করে সাহায্য করুন ওঁর ছেলে মেয়েদের নাম ছিল হারুন, তাহের, আনোয়ার, বেবী) বল্লেনঃ সশস্ত্র লোকজন আসলে তাদেরকে প্রতিহত করা হবে কি ভাবে? এর উত্তর কারো জানা ছিল না। কিছুক্ষন চুপ থেকে সুলতান চাচা বল্লেন "আঁরার বাড়িৎ তাইলে গ্যান অয় (আমাদের বাড়িতে থাকলে কেমন হয়)? বেবীর আব্বা বল্লেন যেহেতু সুলতান চাচা সিডিএর বাইরে থাকেন তাই সেখানে থাকার সাহস তাঁর নেই। চাচা তখন বল্লেন সিডিএর ভেতর কোন বাংগালীর বাড়িতে থাকতে উনি রাজী কিনা?
উনি বাকি দুই পরিবার প্রধানদের সাথে নিভৃতে আলাপ করে জানালেন যে তাঁরা রাজী আছেন। চাচা এবার বাংগালীদের বল্লেন কারা কারা রাজী আছেন? বাবাকে এগিয়ে আসতে দেখে আমি প্রচন্ড খুশী হ'লাম। কি মজা হবে! এ্যাত্তোজন পিচ্চি একসাথে থাকবো! সে রাত থেকে পাকিরা না আসা পর্যন্ত (খুব সম্ভবতঃ) অতিথি কক্ষে বড় প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেরা, আমার বোনদের কক্ষে বড় মেয়েরা আর পিচ্চি ছেলে-মেয়েরা আমাদের (ভাইদের) ঘরে থাকতে লাগলো, ফ্লোরে বিছানা পেতে, দেয়াল থেকে দেয়ালে। প্রথম রাতে হারুন (পান্জাবী, আমার সমবয়সী) ও গুড্ডু (মুলতানী, আমার ছোট) ভয়ে ঘুমুতে পারছিলনা। মধ্য রাত নির্ঘুম পার করার পর আমি ওদেরকে সরাসরি বল্লাম: দেখ, তোমাদেরকে মেরে ফেলাই যদি আমাদের উদ্দেশ্য হ'ত তা'লে তোমাদেরকে বাসায় এনে আশ্রয় দিতাম না। কাজটা তোমাদের বাসা গুলোতেই সারতে পারতাম। আমার কথায় বোধ হয় নির্ভর করার মত কিছু ছিল। ওরা একটু পরই ঘুমিয়ে পড়লো।
বেতারে স্বাধীনতার ঘোষনা (যাদের ইচ্ছে "ঘোষনার" জায়গায় "পাঠ" পড়ার জন্যে সবিনয়ে অনুরোধ করছি)
আশিকুল ভাই (ওয়াপদার ইনজিনিয়ার, ২৬ শে মার্চই তাকে শেষ দেখি) এর সাথে আমার দেখা হয়েছিল আমার স্নাইপটাকে খাবার দেবার পর পরই। উনি যাচ্ছিলেন কালুর ঘাট। ওঁর সাথে ডাঃ আনোয়ার আর ডাঃ মন্জুলা আনোয়ার(সরকারক) আর রেখা আপা (কাজী হোসনে আরা, রেডিও পাকিস্তান চট্টগ্রামের ঘোষিকা)কেও দেখেছি। এব্যাপারে আমি পরে আলাদাভাবে লিখছি।
২৬ তারিখ দুপুর থেকেই রেডিও পাকিস্তান চট্টগ্রাম খুলে রাখা হয়েছিল বাসার রেডিওগ্রামে ফুল ভল্যুমে। সারাদিন কিছু শুনেছি বলে মনে পড়ছেনা। সন্ধ্যার পর শুনতে পাই "স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র...."। কিছুক্ষন পর একটা ভারী গমগমে গলা সকালে দেখা আমার ইংরেজী টেলিগ্রামটির বাংলা অনুবাদ পড়ে শোনায়। কে পড়েছিল মনে নেই। পরদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত কখনো মিহি সুরে, কখনো কাঁপা কাঁপা গলায় আবার কখনো বা "ভাইয়েরা আমার স্টাইলে" স্বাধীনতা ঘোষনার বাংলা অনুবাদ শুনে যেতে থাকি। ২৭ তারিখ সন্ধ্যার পর প্রথম শুনি " I, Major Ziaur Rahman, on behalf of Bangabondhu Sheikh Mujibur Rahman..............." সবাই সেটা শুনেছেন, আগে আর পরে। আমার কাছে, ২৪ ঘন্টার মধ্যে শোনা ৮/১০টি স্বাধীনতা ঘোষনার মধ্যে সেটাই সবচে' ইমপ্রেসিভ লেগেছিল। মেজর জিয়াউর রহমানের ঘোষনা শেষ হবার কিছুক্ষন পর এশার আজান শুনেছিলাম বলে স্পষ্ট মনে পড়ে।
অস্ত্র নিয়ে সমবেত হবার আহবান
২৭শে মার্চ (তারিখ একদিন এদিক ওদিক হতে পারে) রেডিওতে সবাইকে আহবান জানানো হয় যার কাছে যে অস্ত্র আছে তাই নিয়ে লাল দিঘি/নেয়াজ স্টেডিয়ামে হাজির হ'তে। কিছুক্ষন পর সে আহবান বাতিল করা হয়।
-চলবে।
পাদটিকাঃ আগামী কালের কলেবর খুব ছোট্ট হতে পারে