somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্মৃতি ১৯৭১ (২)

০৮ ই মার্চ, ২০১১ বিকাল ৪:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সেই কবে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষনা করা হয়েছে।কবে যে খুলবে কে যানে। ভালো লাগেনা। নরওয়েজিয়ান মিশন, আর সিএনবি কলোনীতে আমার বন্ধুরা থাকে তাদের সাথে কত দিন দেখা হয়না। আস্তে আস্তে কারফিউ শিথিলের সময় বাড়ানো হচ্ছে, কিন্তু মানুষের আতঙ্ক তো কাটছে না। মানুষই বা কয় ঘর আছে এই শহরে? আমাদের এই শান্তিপাড়াতেই তো মাত্র ক’টি পরিবার। সুন্দর ভাই, মাখন ভাই ও পাড়ার আরও অনেক যুবকদের দেখিনা এখন। শুধু মিসিরউল্লার বড় ছেলে “লিয়াকত” ফিরে এসেছে সিলেট থেকে। কলেজ বন্ধ তাই।

আমার ছোট বোনটি দুধের শিশু, আব্বা, আম্মার চিন্তা ছিলো তার দুধের জন্য। অনেক খুঁজেপেতে আব্বা কয়েকটা দুধের কৌ্টা এনে আম্মার হাতে দিয়ে বললেন, এই দিয়ে যে কয়দিন যায় তাই চালাও। “তারপর”? আম্মার প্রশ্নে আব্বা কেমন রেগে গিয়ে বললেন, “তারপর চালের গুড়ি করে খাওয়াবে”। বাজারে দোকান পাট বলতে গেলে কিছুই নেই, সব পুড়ে ছাই হয়ে আছে। একদিন বড় রাস্তা পার হয়ে দেখতে গেলাম, কালো কালো কঙ্কালের মত কিছু পাকা পিলার, আর আগুনে বেঁকে যাওয়া লোহার পিলার যেন দাঁত ভেংচি দিচ্ছিলো। কালো ছাই গুলো ছড়িয়ে আছে চারিদিকে। আমাদের পাশের পাড়ায় কিছু ঘরবাড়ি এমনি পুড়ে ছাই হয়ে আছে।
গ্রাম থেকে কিছু মানুষ মাছ, মুরগি শাক-সব্জি নিয়ে আসত, তাদের থেকেই কেনা হত। তাও প্রয়জনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। ঘরে চাল, ডাল, আলু বস্তা ভরে কিনে রাখা হলো। আম্মা বললেন, বাসাতেই কিছু শাক-সব্জি লাগাতে হবে, আমি তো একপায়ে খাড়া। রান্না ঘরের পাশে মরিচ গাছ লাগালাম সারি করে, উঠোনে মাটি কুপিয়ে ঢেড়শ, বেগুন, ডাটা এসব লাগালাম, কিছু একটা কাজ করতে পেরে আমি মহা-খুশী।

রাত হলেই চারিদিক নিঝুম হয়ে যেত। আব্বা অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে আটটা বেজে যেত। কারফিউএর মাঝেও আব্বাকে কাজ করতে হত, দুঃখ করে আব্বা বলতেন, “আমি তো সরকারের চাকুরি করি। চাকুরি মানেই “চাকর”। তারউপর সন্ধ্যা থেকেই লাইট নিভিয়ে হেরিক্যান জালাতে হতো। সেই হেরিক্যানের আলোও যেন ভেন্টিলেটার দিয়ে কোনমতেই বাইরে না যায় তার জন্য চিমনীর গায়ে চারকোনা করে কাগজ সেটে দেয়া হয়েছে। কাগজের ফাঁক দিয়ে যেটুকু আলো আসে তাতেই কাজ চালাতে হবে। মাঝে মাঝে রাতের নিরবতা ভেঙ্গে মেইন রোডের গাড়ির শব্দ শোনা যায়। আর মিছিরউল্লাহ’র বাড়িতে মানুষের কলরব। আগে ঐ বাসায় যেতে দিতে আম্মা কোন আপত্তি করেন নি, কিন্তু এখন কেনো জানিনা যেতে মানা করেন।

একদিন সন্ধ্যায় আম্মা আমাকে মাদুরের উপর বসে পড়াচ্ছিলেন। ভাইয়া বসার ঘরে পড়ছিল, ওর পাশে ছোট কাজের ছেলেটা। ছোট বোনটি মশারীর নিচে ঘুমিয়ে। এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ, আব্বা এসেছে মনে করে ভাইয়া দরজা খুলে দেয়। তিনজন পাক-সেনা এসে ঘরে ঢুকে, একজন ভাইয়াকে ঐ ঘরে ধরে রাখে, বাকি দুজন সোজা আমাদের ঘরে। ফোনা তোলা গোখরো সাপের মত আম্মা ফুসে উঠে বললেন, “কার অনুমতি নিয়ে আপনারা বাসায় ঢুকেছেন”? সে কথার উত্তর না দিয়ে তাদের একজন নিজেকে ক্যপ্টেন ( নাম মনে নেই) পরিচয় দিয়ে বল্ল, রাত আটটা থেকে ব্ল্যাক আউট, বাতি জ্বালাবেন না”। আম্মা বললেন, “দেখছেন না আমরা হেরিক্যান জ্বালিয়েছি”। বিছানার দিকে ইঙ্গিত করে জিজ্ঞাসা করে “ওখানে কে”? আম্মা বললেন, “আমার মেয়ে”। একজন গিয়ে মশারী তুলে দেখলো। আমি মুখে পেন্সিল পুরে সব দেখছিলাম, দরজার সামনাটা একটু ফাকা হতেই আম্মা আমায় ঠেলে দিয়ে বললেন, যাতো, পিস-কমিটির চেয়ারম্যান মিছিরউল্লাহ সাহেব কে ডেকে নিয়ে আয়। তখন ওরা বলে উঠল, “ ঠিক আছে ঠিক আছে, আমরা যাচ্ছি, কিন্তু খবরদার লাইট জ্বালাবেন না। ওরা চলে যেতেই আম্মা রক্তশুন্য মুখে ধপ করে বিছানায় বসে পড়োলেন। আমায় বললেন, ঐ বাসায় যেয়ে আব্বাকে ফোন করে তাড়াতাড়ি আসতে বলতে।আমি অবাক হয়ে আম্মাকে দেখছিলাম। এই আর্মি দেখে আম্মা কেন এতো ভয় পেলেন তা আমার বোধগম্য হচ্ছিলোনা। ৬৯ এ এই আম্মার দেখেছি আগুন ঝরা রুপ। মিছিলে গুলিবিদ্ধ দুজন ছেলে আর্মির তাড়া খেয়ে আমাদের বাসায় ঢুকেছিলো।
আম্মা নিজের হাতে তাদের ব্যান্ডেজ করে দিয়েছেন। তখন দরজায় মিলিটারি মুহুর্মুহু করাঘাত আর লাথি চালাচ্ছিলো। আম্মার কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিলোনা। চেয়ার দিয়ে দেয়ালে উঠে ওদেরকে বাসার পিছন দিকে পালাতে সাহায্য করেছেন। দরজা ভেঙ্গে যখন আর্মি ঘরে ঢুকেছিলো, তখনও আম্মা কত শক্ত ভাবে তাদের সাথে কথা বলেছেন। আম্মার সে আচরনে আব্বার সরকারী চাকরীতে জবাবদিহি করতে হয়েছিলো। আর এখন আম্মা আর্মি দেখে এত ভয় পেলেন? তখন বুঝিনি, বড় হয়ে বুঝেছি আমার ২৭ বছরের তরুনি মায়ের ভয়ের কারন।

স্মৃতি ১৯৭১ (১)
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মার্চ, ২০১১ বিকাল ৪:২৩
৪৪টি মন্তব্য ৪৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগ লিখেছি: কথাটার পরে ভাসছে ১১ বছর ১১ মাস... কথাটা

লিখেছেন আবু ছােলহ, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৮

ব্লগ লিখেছি: কথাটার পরে ভাসছে ১১ বছর ১১ মাস... কথাটা

গুগল থেকে নেয়া ছবি।

সামুতে মাল্টি নিক নিয়ে অনেকেই কথা বলেন। অনেকের কাছে মাল্টি যন্ত্রণারও কারণ। শুধু যন্ত্রণা নয়, নরক যন্ত্রণাও... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×