১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস, সমগ্র পূর্ব বাংলা জুড়ে চলছে আন্দোলন। কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন পল্টনে এক জনসভায় ঘোষনা দিলেন, “উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে।” তখনকার একমাত্র রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামিলীগ, ছাত্রদের সংগঠন ছাত্রলীগ ও যুবাদের সংগঠন যুবলীগ একসাথে এর তীব্র প্রতিবাদ জানাল।
এদিকে টানা ২৬ মাস জেলে থাকার পর অসুস্থ হয়ে পড়ায় শেখ মুজিবকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। এখানে বসেই তিনি ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতা তোয়াহা, কাজী গোলাম, অলী, শওকত মিয়া সহ বেশ কয়েকজনের সাথে গোপন বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় আগামী ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন ও সভা করে সংগ্রাম পরিষন গঠন করা হবে। পাশাপাশি ১৬ই ডিসেম্বর থেকে কারাগার থেকে মুক্তির জন্যে শেখ মুজিব অনশন ধর্মঘট পালন করবেন বলেও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
এর দুইদিন পরই শেখ মুজিবকে হাসপাতাল থেকে কারাগারে স্থানান্তর করা হয় চিকিৎসা শেষ না করেই। কারাগারে পৌছেই আরেক সহকর্মী মইনুদ্দীনের সাথে আলোচনা করে তিনি কারা কর্তৃপক্ষের কাছে ১৫ তারিখের মধ্যে কারামুক্তি দেয়ার আবেদন করেন, অন্যথায় ১৬ তারিখ থেকে অনশন ধর্মঘট পালন করবেন বলে দরখাস্ত লিখেন। কর্তৃপক্ষ যখন অনশন না করার অনুরোধ করলেন, তিনি তখন সোজাসোজি উত্তর দিলেন, “Either I will go out of the jail, or my deadbody will go out.”
এদিকে কাজী গোলাম মাহমুদকে কনভেনর করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়েছে। ২১শে ফেব্রুয়ারিকেই দিন হিসেবে ধার্য করা হল কারন, ঐদিন পূর্ব বাংলার আইনসভা বসবে। ছাত্রদের পাশাপাশি সাধারন মানুষেরাও রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে একাত্মতা পোষন করছে, কারন মাতৃভাষার অপমান কোন বাঙ্গালীই মেনে নিতে পারবে না। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করলে কারো কোন আপত্তি নেই, কিন্তু সবার একটাই দাবি, “উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা করতে হবে।”
১৫ই ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব ও মইনুদ্দীন যখন অনশনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন হঠাৎ দুইজনকেই ফরিদপুর কারাগারে স্থানান্তরের আদেশ আসে। সেদিন রাত ১১টার সময় নারায়নগঞ্জ থেকে তাদেরকে ফরিদপুর নেয়ার উদ্দেশ্যে জাহাজে তুলা হয়। পরদিন অর্থাৎ ১৬ই ফেব্রুয়ারি অনশন ধর্মঘট করার কথা থাকলেও জাহাজে থাকায় দুজন মিলে সিদ্ধান্ত নিলেই কারাগারে যাবার পর অনশন শুরু করবেন। ১৭ তারিখ কারাগারে পৌছে উভয়েই অসুধ খেয়ে পেট পরিষ্কার করে নিলেন অনশন করার জন্য। এর দুইদিন পর যখন অসুস্থ হয়ে পড়লেন, তখন তাদের দুইজনকেই হাসপাতালে ভর্তি করা হল। তারপরেও অনশন ভঙ্গ না করায় চতুর্থদিনের মাথায় ডাক্তাররা জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা করতে লাগল। নাকের ভেতর নল ঢুকিয়ে পেট পর্যন্ত নিয়ে নলের আরেক প্রান্তে একটা ছোট্ট কাপ বেধে নেয়। সে কাপের মধ্যে দুধের মত করে তরল খাবার তৈরি করে নল দিয়ে পেটের ভেতর ঢেলে দেয়। মুলবিষয়, তাদের কথা হল “মরতে দিব না!”
এভাবে ৪-৫বার খাওয়ানোর পর শেখ মুজিবের নাকের ভেতর ঘা হয় আর রক্ত পড়া শুরু হয়! ফলে যন্ত্রনা হওয়ায় তিনি আপত্তি করতে থাকেন, কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষ হাতে হ্যান্ডক্রাফট পড়িয়ে জোর করেই এভাবে খাওয়াতে থাকে। ওবস্থা যখন একেবারেই খারাপ হয়ে আসছে, তখন তিনি কাপা হাতে ছোট করে চারটা আলাদা চিঠি লিখলেন। একটা বাবার কাছে, একটা স্ত্রী রেনুর কাছে, একটা সৌহরার্দীর কাছে এবং সবশেষেরটা ভাসানীর কাছে... কে জানে, হয়তো এরপর আর কখনো চিঠি লিখতে পারবেন না হয়তো!
২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা সহ সারা দেশেই গোলমাল শুরু হয়। রেডিওতে পুলিশের গুলিতে কয়েকজন মারা যাওয়ার খবর প্রচার হতে থাকে। ফরিদপুরে সেদিন হরতাল চলছিল। ছাত্র-ছাত্রীসহ অনেকেই মিছিল করে জেল গেইটে এসে স্লোগান দিতে থাকে, “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” “বাঙালিদের শোষন করা চলবে না” এবং “শেখ মুজিবের মুক্তি চাই।”
২৭শে ফেব্রুয়ারি রাত আটটা, শেখ মুজিব ও মইনুদ্দীন উভয়েই চুপচাপ শুয়ে আছেন, কথা বলার শক্তিটুকু পর্যন্ত নেই। দুজনেই নামাজ পরে আল্লাহর কাছে মাফ চেয়ে নিয়েছিলেন, হয়তো আজকের রাতটাই জীবনের শেষ রাত হতে যাচ্ছে। বাইরে থেকে ডেপুটি জেলার এসে প্রশ্ন করলেন, আপনাকে যদি মুক্তি দেয়া হয়, তাহলে খাবেন তো?”
শেখ মুজিব বললেন, “মুক্তি দিলে খাব, না হলে খাব না। তবে আমার লাশ মুক্তি পেয়ে যাবে”
হালকা হেসে জেলার সাহেব জানালেন যে তাদের দুইজনেরই মুক্তির অর্ডার এসে গেছে। অর্ডারগুলো যখন পড়িয়ে শোনানো হচ্ছিল, তখন তারা কেউ বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তাদের অবিশ্বাসের চাহুনি দেখে জেলার বললেন, “আমাকে অবিশ্বাস করার কিছুই নাই, কারন এখানে আমার স্বার্থ নাই।” এবার বিশ্বাস করলেন তিনি। মইনুদ্দীন নিজে পাশে বসে ডাবের পানি খাইয়ে শেখ মুজিবের অনশন ভাঙ্গালেন।