চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় সমকালকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। শক্তিশালী কোনো সাংগঠনিক কাঠামো না থাকলেও শনিবার ঢাকায় বিপুলসংখ্যক লোক নিয়ে লংমার্চ ও মহাসমাবেশ করেছেন তিনি। কেন তার ডাকে এত মানুষ সাড়া দিল, সরকার থেকে কীভাবে অনুমতি আদায় করলেন, জামায়াতের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগসহ বিভিন্ন বিষয়ে খোলামেলা উত্তর দিলেন আল্লামা শফী। হেফাজতের ঘাঁটি চট্টগ্রামের হাটহাজারী দারুল উলুম মাদ্রাসার মহাপরিচালক তিনি। বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের (বেফাক) চেয়ারম্যান আল্লামা শফী। বর্ষীয়ান এই আলেম সম্প্রতি শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসেন।
সাক্ষাৎকারে আল্লামা শফী দাবি করেন, ধর্ম নিয়ে যারা মূর্খ, তারাই তাদের দাবিতে বিভ্রান্ত। সরকার ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে দেশকে ধর্মহীনতা, নাস্তিকতার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সরকারকে অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। তারা কি দেশের ৯০ ভাগ মানুষের ধর্মের পক্ষে থাকবে, নাকি গুটি কয়েক নাস্তিকের কথায় উঠবে-বসবে? হেফাজতের সমাবেশ থেকে শাহবাগে হামলার ঘটনাকে 'নাটক' সাজানোর অভিযোগ করে তিনি বলেন, তারা হামলা করলে শাহবাগে কয়েক হাজার লাশ পড়ত। আসলে জামায়াতে ইসলাম কিংবা বিএনপি নাশকতার চেষ্টা করছে বলে প্রমাণ করতেই সরকার এটা করেছে।
সমকাল :লংমার্চে এত ব্যাপক লোকের জনসমাগম সম্ভব করলেন কীভাবে?
আল্লামা শফী :ইসলাম ধর্মে লুকিয়ে থাকা শক্তির বলেই লাখ লাখ লোকের সমাগম হয়েছে ঢাকায়। ইসলামপ্রিয় তৌহিদি জনতা আল্লাহ ও তার রাসূলের (সা.) প্রতি তাদের ভালোবাসার প্রমাণ দিয়েছে। নাস্তিক-মুরতাদদের দেখিয়ে দিয়েছে ইসলামের শক্তি ও সামর্থ্য। আসলে হেফাজতে ইসলাম অরাজনৈতিক সংগঠন হওয়াতেই ধর্মপ্রিয় মানুষ বেশি সাড়া দিয়েছে। এটি জামায়াত কিংবা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের লংমার্চ হলে এভাবে সাড়া দিত না সাধারণ মানুষ।

ইসলামপ্রিয় জনতার মহাসমুদ্র (ফাইল ছবি)
সমকাল :এই লংমার্চ থেকে অর্জন কী?
আল্লামা শফী :ইহকালের কোনো লাভের আশায় লংমার্চ করিনি আমরা। ৬ এপ্রিলের লংমার্চে যারা অংশ নিয়েছে, পরকালে আল্লাহ ও তার রাসূলকে (সা.) এখন অন্তত একটা জবাব দিতে পারবে তারা। বলতে পারবে, তোমাকে ও তোমার প্রিয় রাসূলকে (সা.) যারা অপমান করতে চেয়েছে, তাদের জবাব দিতে জীবনের একটি দিন ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম আমরা। সমবেত কণ্ঠে প্রতিবাদ করে দেখিয়েছি ইসলামের প্রতি আমাদের ভালোবাসা।
সমকাল :ইসলামকে আসলে কীভাবে অপমান করেছে ব্লগাররা? সব ব্লগারেরই কি ফাঁসি চাচ্ছেন আপনারা?
আল্লামা শফী :আমাদের এ আন্দোলন ঢালাওভাবে সব ব্লগ বা ব্লগারের বিরুদ্ধে নয়। আমরা জানি, ব্লগ ব্যবহার করে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। আলেম ও মাদ্রাসার ছাত্রদের মধ্যেও উল্লেখযোগ্য ব্লগার রয়েছেন। আমাদের আন্দোলন কেবল সেই সব ব্লগারের বিরুদ্ধে, যারা মুক্তচিন্তা ও বাকস্বাধীনতার আড়ালে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে জঘন্য কুৎসা ও অবমাননায় জড়িত।
সমকাল :ধর্ম অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে তো সরকার পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। তদন্ত কমিটি হয়েছে। বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে রিমান্ডেও নিয়েছে। তার পরও কেন আন্দোলনে আছেন আপনারা?
আল্লামা শফী :সরকারের এ কর্মকাণ্ড লোক দেখানো। কারণ, শুরু থেকেই আমরা ইসলামবিরোধী নারীনীতি, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও ধর্মহীন শিক্ষানীতির বিরোধিতা করে আসছি। অথচ কয়েক বছর যেতে না-যেতেই বর্তমান সরকার এসব নীতি চূড়ান্ত করেছে। যার ভয়াবহ কুফলও পেতে শুরু করেছে দেশ। ধর্ম অবমাননার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে কঠোর আইন পাসসহ আমরা ১৩ দফা দাবি উত্থাপন করেছি।
সমকাল : আপনাদের দাবি নিয়েও তো বিভ্রান্ত বিভিন্ন মহল?
আল্লামা শফী :ধর্মের ব্যাপারে যারা মূর্খ, তারাই আমাদের দাবিতে বিভ্রান্ত। এক মাস ধরে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় আমাদের প্রধান দাবি আমরা তুলে ধরেছি। আমাদের দাবির মধ্যে প্রধান কয়েকটি হচ্ছে_ সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপন, দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সুরক্ষা ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে ধর্ম অবমাননার বিরুদ্ধে অবিলম্বে কঠোর আইন পাস, বিভিন্ন ব্লগ ও সাইটে ধর্ম অবমাননার সঙ্গে জড়িতদের বস্তুনিষ্ঠ তদন্তের মাধ্যমে আইনের আওতায় আনা। পাশাপাশি পাঠ্যবইয়ে সব ধর্ম অবমাননাকর মন্তব্য ও উদ্ধৃতির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে অবিলম্বে সংশোধনীও প্রকাশ করতে বলেছি আমরা সরকারকে। আমাদের ন্যায্য এ দাবিগুলো সরকার মেনে নিলেই চলমান আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে যায়। সরকার ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে মূলত এ দেশকে ধর্মহীন তথা নাস্তিকতার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
সমকাল :সরকার তো আপনাদের লংমার্চ করার অনুমতি দিল। পর্যাপ্ত পুলিশ ফোর্স দিয়ে নিরাপত্তাও নিশ্চিত করেছে। এ জন্য প্রগতিশীল সংগঠনগুলো দোষও চাপাচ্ছে সরকারের ঘাড়ে। আবার আপনারাও সরকারের ঘাড়ে দায় চাপাচ্ছেন। ঘোষণা করলেন হরতালও...
আল্লামা শফী :দুই নৌকায় পা রাখতে চাইলে অবস্থা এমনই হয়। সরকারকে অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। দেশের ৯০ ভাগ লোকের যে ধর্ম, সরকার কি তার পক্ষে থাকবে, নাকি গুটি কয়েক নাস্তিকের কথায় উঠবে-বসবে? সেটা ঠিক করতে হবে সরকারকেই। আর লংমার্চ করতে যে অনুমতির কথা বলছেন, সেটি না দিয়ে কোনো উপায় ছিল না সরকারের। গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে সরকার আগেই টের পেয়েছে, অনুমতি না দেওয়ার পরিণাম কী হতে পারে। লংমার্চের অনুমতি দেওয়া না হলে সেদিন সারাদেশে শহীদ হতো কয়েক হাজার মানুষ।
সমকাল :হেফাজতের সমাবেশ থেকে কেন হামলা হলো গণজাগরণ মঞ্চে?
আল্লামা শফী :হেফাজতের সমাবেশ থেকে হামলা হলে সেদিন কয়েক হাজার লাশ পড়ত শাহবাগে। আসলে সরকারই তার বাহিনীকে দিয়ে হামলার একটা নাটক সাজিয়েছে। জামায়াতে ইসলামী কিংবা বিএনপির নাশকতার চেষ্টা প্রমাণ করতেই সরকার এটা করেছে। তৌহিদি জনতাকে ঢাকায় আসতেও বাধা দেওয়া হয়েছে। এটি করে আসলে ইসলামী গণজাগরণ আরও জমিয়ে দিয়েছে সরকার।
সমকাল :আপনারা তো জামায়াতকে ইসলামী দল মনে করেন না। তার পরও কেন এখন জামায়াতের সঙ্গে আপনাদের সখ্যের অভিযোগ উঠল?
আল্লামা শফী :হেফাজতে ইসলাম একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এ পর্যন্ত কখনও কোনো রাজনৈতিক বা কোনো দলের পক্ষে বা বিপক্ষে যায়, এমন কোনো দাবি বা কর্মসূচি দিইনি আমরা। আমাদের এখনকার ১৩টি দাবিও ইমান-আকিদা, ইসলাম ও নৈতিকতা সংশ্লিষ্ট। আসলে মানুষকে বিভ্রান্ত করতেই একটি মহল হেফাজতে ইসলাম ও আমার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ও জঙ্গিবাদের কল্পনাটক সাজিয়ে বিষোদ্গার করছে। জামায়াত থেকে টাকা নেওয়ার কল্পকাহিনীও বলছে কিছু কিছু মিডিয়া। আসলে যত মিথ্যাচার ও অপপ্রচারই করা হোক না কেন, দেশের ইসলামপ্রিয় জনতা এতে মোটেও বিভ্রান্ত হবে না। তবু জামায়াতের সঙ্গে আমাদের সম্পৃক্ততা প্রমাণের চ্যালেঞ্জ দিলাম সরকারকে।
সমকাল :১৩ দফা দাবি মেনে নেওয়া হলে কি যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি সামনে আনবেন আপনারা?
আল্লামা শফী :হেফাজতে ইসলাম প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী বিভিন্ন পদক্ষেপের জোরালো প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। সংবিধান থেকে আল্লাহ্র ওপর আস্থা ও বিশ্বাসের নীতি তুলে দেওয়া, নতুন প্রবর্তিত ধর্মহীন শিক্ষানীতি, হিজাব পালনে নারীদের বাধ্য করা যাবে না বলে হাইকোর্টের রায়, রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি প্রতিষ্ঠা, ফতোয়াবিরোধী হাইকোর্টের রায়, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও বিসমিল্লাহ বাদ দেওয়ার চেষ্টা, ঢালাওভাবে আলেম-ওলামা ও কওমি মাদ্রাসার সঙ্গে জঙ্গিবাদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে অপপ্রচার, হাইকোর্টে কোরআন সংশোধনের জন্য মামলা এবং ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধের চেষ্টার বিরুদ্ধে আগেও আন্দোলন করেছি আমরা। এখন আন্দোলন করছি আল্লাহ ও তার রাসূলের (সা.) অবমাননাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে। খেয়াল করলে দেখবেন, হেফাজতের কোনো আন্দোলনেই নেই রাজনীতির বীজ। হেফাজতে ইসলাম তার এই অরাজনৈতিক ভূমিকা ভবিষ্যতেও অব্যাহত রাখবে।
প্রশ্ন :মানুষের যে গণজাগরণ দেখালেন, তাতে তো রাজনীতির প্রতি একটু-আধটু আগ্রহ জন্মানো স্বাভাবিক...
আল্লামা শফী :সাধারণের কাছে যা স্বাভাবিক, আমাদের কাছে তা নয়। এ জন্যই আমাদের সংগঠনের নাম হেফাজতে ইসলাম। ইসলামের হেফাজত করতেই আমাদের জন্ম। আবার ইসলামের হেফাজত করতে করতেই আমরা মরতে চাই। অরাজনৈতিক সংগঠনের যে ইমেজ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে হেফাজতে ইসলাম, সেটি কোনো প্রলোভনে বা কোনো মোহে বিক্রি হবে না কখনোই। হেফাজতে ইসলাম মৌলিক অরাজনৈতিক নীতিমালা তথা ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদির বাইরে কোনো রাজনৈতিক ভূমিকায় জড়াবে না। (সুত্র, সমকাল, ০৮/০৪/২০১৩)