তখন আমি পল্টনে একটি আই.এস.পি কোম্পানিতে সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে জয়েন করেছি । নতুন চাকরী । তাই উৎসাহ উদ্দীপনার কোন কমতি ছিল না । দুই শিফটে অফিস করতাম ।
সপ্তাহে তিনদিন নাইট তো চারদিন ডে শিফটে কাজ করতে হতো । তখন তো আর এখনকার মতো এতো আই.এস.পি কোম্পানির ছড়াছড়ি ছিল না ।
হাতে ঘোনা কয়েকটা কোম্পানি ছড়ি ঘুরাত । তাই এসব কোম্পানিতে কাজ করার জন্য নতুন নতুন ছেলে,মেয়েরা ব্যাঙের মতো এসে ভিড় করতো ।
কিন্তু সবার ভাগ্যে চাকরী জুটত না । তার জন্য বিশেষ ভাগ্যের ও প্রয়োজন ছিল । অথবা মামা,কাকা, খালুর জোড় লাগত। আমাদের অফিসে রাত দিন বলে কিছু ছিল না । সব সময় ই ভিড় লেগে থাকতো । এক দল কাজ শেষ করে যাচ্ছে তো অন্য দল হই হই করে কাজে ঢুকে পরত । আমি যখনকার কথা বলছি তখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি হঠাত করেই খুব খারাপ হয়ে যায় ।
টানা কয়েকদিনের হরতালে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠে । আমাদের অফিসের হই হই ভাবটাও কমে আসে । তিনটে শিফটের জায়গায় দুটো শিফট করা হয় । বেলা বারোটা থেকে রাত বারোটা ।
আবার রাত বারোটা থেকে দুপুর বারোটা । মেয়েরা অনেক দেন, দরবার করে ডে শিফটে কাজ করতো । আমরা মানে ছেলেরা করতাম রাতের শিফটে ।
অনেক ভাগ্যের কল্যাণে একদিন ডে শিফটের দেখা পেলাম । কতো দিন বাড়িতে রাতের ঘুম আরাম করে ঘুমাই না । সেদিন খুব মুডে মুডে সময় কেটে যেতে লাগল ।
সার্ভারে কিছু প্রবলেম দেখা দেওয়ায় অফিস থেকে বের হতে আমার একটু দেরি হয়ে গেল । অফিস থেকে রাত পৌনে ১টায় বের হলাম । আমাদের বিল্ডিংটা ১৯ তলা ।
তের আর চৌদ্দ তলার দু'টো ফ্লোর নিয়ে আমাদের অফিস ।
রাত্রি দশটার পর লিফট বন্ধ করে দেওয়া হয় । সিঁড়ি বেয়ে উঠা নামা করতে হয় । আমি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে তরতর করে নেমে যেতে লাগলাম ।
দশ তলায় নামতেই দেখতে পেলাম ব্যাগ কাঁধে নিয়ে একটা মেয়ে এক পা, দুই পা করে নামছে । দেখে মনে হল যেন এক্কা, ধোঁকা খেলছে । আমার নামার গতি কমে গেল । মাথায় চিন্তা পাশ কাটিয়ে নেমে যাবো ।
আমার পায়ের শব্দ পেয়ে মেয়েটা ঘুরে তাকাল পেছনের দিকে । সিঁড়িতে বাতির আলো কম হলেও মেয়েটার মুখ স্পষ্ট দেখতে পেলাম । কাজল কালো চোখ , তীক্ষ্ণ খাড়া নাক । একটু লম্বাটে মুখাকৃতি । কাঁধ পর্যন্ত ছাটা চুল । কিছু চুল বাম গালের উপর এসে পরেছে । এক কথায় অসাধারণ রূপসী । এতো কিছু তখন খেয়াল করিনি পরে একটু একটু করে মনে পরেছে । কল্পনায় মেয়েটার মুখ এখনও চোখের সামনে ভাসে ।
প্রতিদিন একটু একটু করে আরো রূপবতী হয়ে উঠে মেয়টি । মেয়েটি আমার দিকে তাকাতে আমিও ওর মুখের দিকে তাকালাম । চোখাচোখি হতেই মেয়েটি হেসে পরিচিতের ন্যায় জিজ্ঞাসা করলো, ভাল আছেন ? এতো সুন্দর হাসি আর কণ্ঠ আমি আগে কোনদিন শুনিনি ।
আমি থতমত খেয়ে গেলাম । আমতা আমতা করে বললাম, জি, আমি ভালো আছি । আপনি ভালো তো ? কেউ কুশল জানতে চাইলে প্রতি উত্তরে তার কুশল জানতে চাওয়াও ভদ্রতা । আমি ভদ্রতা রক্ষা করলাম। আমার চোখে মুখে রাজ্যের বিস্ময়। মেয়েটিকে পাশ কাটিয়ে দু'টো সিঁড়ি নেমে যেতেই মেয়েটি
আবার বলে উঠলো,"আপনি তো চৌদ্দ তলার সাভার রুমে বসেন, তাই না ?" আমি এবার অবাক হয়ে ঘুরে তাকিয়ে বললাম, ' আপনি ? আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না । "
আমার নাম "পরি" আমি আপনাদের অফিসেই কাজ করি । তেরোতে ছিলাম আজ সারাদিন। ডে শিফট ছিল আমার ।
"আপনি এখানে কাজ করেন ? কই দেখিনি তো কখনও ?" আমার বিস্ময় যেন কাটছে না । অফিসের মোটা মুটি সবাইকেই চিনি । সবার সঙ্গে কথাবার্তা না হলেও মুখ চেনা আছে সবার ।
"বারে , আমাকে দেখেননি সেটা কি আমার দোষ ?" মেয়েটি হেসে বলল ।
না, না দোষ হবে কেন । আমি বলতে চাইছি ....
নতুন জয়েন করছি । এই তো দিন পনেরো হল । রাব্বি ভাইয়া আমার কাজিন হ'ন ।
'রাব্বি মানে, জাহাঙ্গীর সুমন রাব্বি, ভাই ?' মানে, 'হেড অফ এইচ,আর ?'
হ্যাঁ, বলে মেয়েটি মাথা নেড়ল ।
ও, আই.সি । ভাল, বেশ ভাল । আমিও ক্যাবলা কান্তের মতো মাথা নেড়ে বললাম ।
মনে মনে ভাবলাম এতো সুন্দর একটা মেয়ে কোম্পানিতে জয়েন করেছে আর আমি জানি না । দিন দিন মফিজ হয়ে যাচ্ছি নাকি । কালই খোজ নিতে হবে তো ।
"আপনি রাতের শিফটে বেশি কাজ করেন, তাই না ?"
হ্যাঁ , তবে সেটা ইচ্ছে করে করি না । করতে হয় পেটের দায়ে । কথাটা বলেই ক্যামন হাসি পেয়ে গেল আমি হি হি করে হেসে উঠলাম ।
মজা করছেন তাই না ?
কিছুটা করছি ।
আমার কিন্তু রাতে শিফটে কাজ করার অনেক ইচ্ছে । চাকরীটা পার্মানেন্ট হলে আমিও রাতের শিফটে কাজ করবো আপনাদের মতো।
অবশ্যই করবেন । আমি উৎসাহ দিয়ে বললাম । রাব্বি ভাইকে বললেই ব্যবস্থা করে দিবেন । উনি বস্ মানুষ ।
কচুর বস । হাজারবার বলার পরে চাকরীটা দিলো । বস হলে সেই কবে ব্যবস্থা করে দিতো ।
আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না । কি বলতে কি বলে ফেলি পরে চাকরী নিয়ে টানা টানি পরুক আর কি । তার চেয়ে চুপ থাকা বুদ্ধিমানের কাজ । আমি বুদ্ধিমানের মতো হেসে গেলাম ।
দু'টো সিঁড়ি নেমে মেয়েটা আবার বলে উঠল,"আপনাদের অফিসটা আমার অনেক ভাল লেগেছে । বিশেষ করে এতো উপরে বলে । ছাদ গিয়ে দাড়ালে পুরো ঢাকা শহর দেখা যায় । মনে হয় হাত বাড়ালেই আকাশ ছোয়া যাবে ।
আপনি ছাদেও গিয়েছেন নাকি ? আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম । কেননা ছাদ সব সময় তালামারা থাকে । বিল্ডিং কতৃপক্ষ ছাড়া অন্য কেউ যেতে পারে না ।
হুম, গিয়েছি তো; অনেকবার । কি বিশাল আর কি সুন্দর ছাদটা । আমার খুব ভাল লেগেছে । ইচ্ছে আছে বৃষ্টির সময় একদিন ছাদে উঠে ভিজবো । ছাদে ভেজার মজাই আলাদা, তাই না ?
আমি কখনও ছাদে উঠে বৃষ্টিতে ভিজি নি তবুও মাথা নেড়ে বললাম , হ্যাঁ খুব মজা । তবে ভয়ও আছে ইদানীং যে হারে বিদ্যুৎ চমকায় মাথায় পরলে পুড়ে কাঠ কয়লা হতে হবে ।
আপনি ঠিক ই বলেছেন । তবে আমার মা কি বলেন জানেন ?
আমি ওনার মা কি বলেন তা জানার জন্য আগ্রহ নিয়ে তাকালাম ।
মা সব সময় বলেন, ভাল মানুষ নাকি বজ্রপাতে মারা যায় না । শুধু খারাপ মানুষই বজ্রপাতে মারা যায় । আমি ঠিক করেছি একবার সেটা পরীক্ষা করে দেখবো ।
এই মেয়ে বলে কি ? মাথা খারাপ নাকি ? কি সব আবোল তাবল বলছে ।
আমি কিন্তু সত্যি সত্যি বলছি । ব্যাপারটা পরীক্ষা করে দেখবো একবার । যদি বজ্রপাতে মরে যাই তা হলে আমি খারাপ মেয়ে আর বেচে থাকলে ভাল মেয়ে । বলেই মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠল । তারপর হাসি থামিয়ে বলল, চলুন আপনাকে ছাদটা দেখিয়ে আনি । কথাটা এমন ভাবে বলল যেন, ছাদের মালিক উনি নিজে। যখন ইচ্ছে তখন ছাদে চলে যেতে পারেন ।
ছাদে যাবেন ! এতো রাতে ? আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম । রাত পৌনে দু'টো বাজে । এক ঘণ্টা হয়ে গেল ? সেটা কি করে সম্ভব। সব যেন তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল । মাথা কাজ করছে না । বরো জোড় পাচ মিনিট কথা বলেছি মেয়েটির সাথে এর মধ্যে এক ঘন্টা কাটল কি করে ? ঘড়ি নষ্ট হলো না তো ? আমি ঘড়িটা ঝাকাতে লাগলাম ।
রাত হয়েছে তো কি হয়েছে ? চলুন ছাদটা দেখে আসি । খুব সুন্দর জোছনা উঠেছে আজ । আপনি জোছনা পছন্দ করেন না ?
করি । কিন্তু এতো রাতে ছাদে যাওয়া ঠিক হবে না মিস ......আমি মেয়েটার নাম মনে করতে পারলাম না । তাই কথা শেষ করতে পারলাম না আটকে গেলাম।
বলুন, বলুন আমার নাম কি বলুন?
আমি কিছুতেই মেয়েটির নাম মনে করতে পারলাম না । আমার মন পড়ে আছে ঘড়ির কাটার দিকে । ভাবছি কি করে এক ঘন্টা কেটে গেল ?
আমি কিন্তু আমার নাম আপনাকে বলেছি ।
হ্যাঁ বলেছেন । কিন্তু আমি সেটা মনে করতে পারছি না কেন ?
ছাদের ঠাণ্ডা বাতাস খেলে আমার নাম মনে পরবে আপনার । চলুন ছাদে যাই ।
সত্যি বলতে কি আমি একটু দূরে থাকি । এমনিতেই অনেক রাত হয়ে গেছে , আরো দেরি করলে বাসায় যেতে পারবো না । যাওয়ার জন্য কোন হয়তো কোন যান বাহন পাওয়া যাবে না ।
আপনি তো, মিরপুর শেওড়া পাড়া থাকেন । তাই না ?
আমি অবাক হয়ে মাথা নাড়লাম । অবাক হলাম এই কারণে যে, মেয়েটা কি করে জানল যে আমি শেওড়া পাড়া থাকি ?
আমাকে অবাক হতে দেখে , পরি নামের মেয়েটা বলে উঠলো । আপনি তো অনেক ঘন ঘন অবাক হন দেখছি । আরে বাবা, আমি এইচ.আর এ কাজ করি তাই সবার বাসার ঠিকানা আর ফোন নম্বর আমি জানি । এ কয়দিনে সব মুখস্ত করে ফেলেছি । বুঝেছেন মশায়?
আমি মাথা নাড়লাম, হ্যাঁ বুঝেছি ।
চিন্তা করবেন না । আমার সাথে গাড়ী আছে । আপনাকে পৌঁছে দেবো । চলুন তো এখন ছাদে যাই । মেয়েটি ঘুরে সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠতে লাগল ।
আমি যেখানে ছিলাম সেখানেই বোকার মতো দাড়িয়ে রইলাম । বুঝতে পারছি না কি করবো ।
কি হলো আসছেন না কেন ? ভয় পাচ্ছেন নাকি ? মেয়েটি হাসছে ।
আপনি কি সিরিয়াস ছাদে যাবেন ?
হ্যাঁ, সিরিয়াসই তো । আসুন আসুন । মেয়েটা আবার উঠতে লাগল।
কিন্তু ছাদ তো সব সময় তালা মারা থাকে । চাবি পাবেন কোথায় ? আমি খুব জ্ঞানীর মতো কথাটা বললাম । সত্যি বলতে এতো রাতে সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা মেয়ের সাথে ছাদে যেতে আমার একেবারে ইচ্ছে করছে না । মনটাও যেন ঠিক সায় দিচ্ছে না ।
https://www.facebook.com/permalink.php?story_fbid=1862848263960490&id=1539433096302010
চলবে ..............
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জানুয়ারি, ২০১৭ দুপুর ১২:৩১