somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শুভ জন্মাষ্টমী ।

২৮ শে আগস্ট, ২০১৩ দুপুর ১২:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



জন্মাষ্টমী বা কৃষ্ণজন্মাষ্টমী একটি হিন্দু উৎসব। এটি বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণের জন্মদিন হিসেবে পালিত হয়। এর অপর নাম কৃষ্ণাষ্টমী, গোকুলাষ্টমী, অষ্টমী রোহিণী, শ্রীকৃষ্ণজয়ন্তী ইত্যাদি। হিন্দু পঞ্জিকা মতে, সৌর ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে যখন রোহিণী নক্ষত্রের প্রাধান্য হয়, তখন জন্মাষ্টমী পালিত হয়। উৎসবটি গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্টার অনুসারে, প্রতি বছর মধ্য-আগস্ট থেকে মধ্য-সেপ্টেম্বরের মধ্যে কোনো এক সময়ে পড়ে।

শাস্ত্রীয় বিবরণ ও জ্যোতিষ গণনার ভিত্তিতে লোকবিশ্বাস অনুযায়ী কৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল ৩২২৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ১৮ অথবা ২১ জুলাই। মথুরা নগরীতে অত্যাচারী রাজা কংসের কারাগারে। তিনি বসুদেব ও দেবকীর অষ্টম পুত্র। তাঁর পিতামাতা উভয়ের যাদববংশীয়। দেবকীর দাদা কংস, তাঁদের পিতা উগ্রসেনকে বন্দী করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। একটি দৈববাণীর মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন যে দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তানের হাতে তাঁর মৃত্যু হবে। এই কথা শুনে তিনি দেবকী ও বসুদেবকে কারারুদ্ধ করেন এবং তাঁদের প্রথম ছয় পুত্রকে হত্যা করেন। দেবকী তাঁর সপ্তম গর্ভ রোহিণীকে প্রদান করলে, বলরামের জন্ম হয়। এরপরই কৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করেন। কৃষ্ণের জীবন বিপন্ন জেনে জন্মরাত্রেই দৈবসহায়তায় কারাগার থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে বসুদেব তাঁকে গোকুলে তাঁর পালক মাতাপিতা যশোদা ও নন্দের কাছে রেখে আসেন। কৃষ্ণ ছাড়া বসুদেবের আরও দুই সন্তানের প্রাণরক্ষা হয়েছিল। প্রথমজন বলরাম (যিনি বসুদেবের প্রথমা স্ত্রী রোহিণীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন) এবং সুভদ্রা (বসুদেব ও রোহিণীর কন্যা, যিনি বলরাম ও কৃষ্ণের অনেক পরে জন্মগ্রহণ করেন)।

সমগ্র ভারতবর্ষে যখন হানাহানি, রক্তপাত, সংঘর্ষ, রাজ্যলোভে রাজন্যবর্গের মধ্যে যুদ্ধবগ্রহ তথা পৃথিবী যখন মর্মাহত, পাশে অবনত, ঠিক সেই সৃষ্টি স্থিতি-পলয়ের যুগ সন্ধিক্ষণে তাঁর আবির্ভাব অনিবার্য হয়ে পড়ে। ঘোর অমানিশার অন্ধকারে তাঁর জন্মগ্রহণ করায় কৃষ্ণের গায়ের রং শ্যামল, অন্য অর্থে ধূসর, পীত, কিংবা কালো। সংস্কৃত কৃষ্ণ শব্দটির অর্থ কালো, ঘন বা ঘন-নীল। কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি বোঝাতে এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়। কৃষ্ণের মূর্তিগুলিতে তাঁর গায়ের রং সাধারণত কালো এবং ছবিগুলিতে নীল দেখানো হয়ে থাকে। তাঁর রেশমি ধুতিটি সাধারণত হলুদ রঙের এবং মাথার মুকুটে একটি ময়ূরপুচ্ছ শোভা পায়। কৃষ্ণের প্রচলিত মূর্তিগুলিতে সাধারণত তাঁকে বংশীবাদনরত এক বালক বা যুবকের বেশে দেখা যায়। এই বেশে তাঁর একটি পা অপর পায়ের উপর ঈষৎ বঙ্কিম অবস্থায় থাকে এবং বাঁশিটি তাঁর ঠোঁট পর্যন্ত ওঠানো থাকে। তাঁকে ঘিরে থাকে গোরুর দল; এটি তাঁর দিব্য গোপালক সত্ত্বার প্রতীক। কোনো কোনো চিত্রে তাঁকে গোপী-পরিবৃত অবস্থাতেও দেখা যায়।

জন্মাষ্টমী হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রাচীন ধর্মীয় উৎসব। এক সময় ঢাকাবাসী এ জন্মাষ্টমী উৎসব অথবা জন্মাষ্টমীর মিছিলের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। বর্তমানে এর ছোঁয়া থাকলেও আগের সেই জৌলুস আর নেই। জন্মাষ্টমী এ অঞ্চলের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী উৎসব ছিল, যে উৎসবে অংশগ্রহণ করতেন স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। শুধু তাই নয়, এক সময় ঢাকা শহরে জন্মাষ্টমীর যে মিছিল বের হতো তা সারা উপমহাদেশে বিখ্যাত ছিল। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করে এ দিনে শুধু উপাবাসেও সপ্ত জন্মকৃত পাপ বিনষ্ট হয়। আর তাই এ দিনটিতে তারা উপবাস করে লীলা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করে থাকে। এর সঙ্গে সঙ্গে কালের স্রোতে ধীরে ধীরে যুক্ত হয় মিছিল ও শোভাযাত্রা। ক্রমেই জন্মাষ্টমী পালনের প্রধান অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায় মিছিল ও শোভাযাত্রা। কিন্তু ঠিক কবে থেকে এবং কেন জন্মাষ্টমী উৎসবে মিছিলের শুরু তার নির্দিষ্ট কোনো ইতিহাস জানা যায়নি।

মিছিলের পুরনো ইতিহাস লেখক ভুবন মোহন বসাক এবং যদুনাথ বসাকের দুটি বইয়ের তথ্যানুসারে জন্মাষ্টমী উৎসবে মিছিলের শুরু হয়েছিল ষোড়শ শতকে। ভুবন মোহনের লেখা বই অনুসারে ইসলাম খাঁর ঢাকা নগরের পত্তনের (১৬১০ সাল) আগে বংশালের কাছে এক সাধু বাস করতেন। ১৫৫৫ সালে (ভাদ্র ৯৬২ বাংলা) তিনি শ্রী শ্রী রাধাষ্টমী উপলক্ষে বালক ও ভক্তদের হলুদ পোশাক পরিয়ে একটি মিছিল বের করেছিলেন। এর প্রায় ১০-১২ বছর পর সেই সাধু ও বালকদের উৎসাহে রাধাষ্টমীর কীর্তনের পরিবর্তে শ্রী কৃষ্ণের জন্মোপলক্ষে জন্মাষ্টমীর অপেক্ষাকৃত জাঁকজমকপূর্ণ একটি মিছিল বের করার প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছিল। সে উদ্যোগেই ১৫৬৫ সালে প্রথম জন্মাষ্টমীর মিছিল ও শোভাযাত্রা বের হয়।

পরবর্তীতে এ মিছিলের দায়ভার এসে বর্তায় ঢাকার নবাবপুরের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী কৃষ্ণদাস বসাকের পরিবারের ওপর। কালক্রমে জন্মাষ্টমীর মিছিল একটি সাংগঠনিক রূপ ধারণ করে এবং প্রতি বছর জন্মাষ্টমী উৎসবের নিয়মিত অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। ১০৪৫ বঙ্গাব্দে কৃষ্ণ দাসের মৃত্যুর পর থেকে শ্রী শ্রী লক্ষ্মীনারায়ণ চক্রই এ উৎসবের আয়োজন শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে জন্মাষ্টমীর মিছিলকে উন্নত করে তোলেন। এরপর থেকে নবাবপুরের ধনাঢ্য ব্যক্তিরাও জন্মাষ্টমী উপলক্ষে নিজ নিজ মিছিল বের করতে শুরু করে। কালক্রমে যা পরিচিত হয় উঠে 'নবাবপুরের মিছিল' নামে। অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকে ইসলামপুরের পান্নিটোলার কিছু ব্যবসায়ী ধনাঢ্য হয়ে উঠে এবং ভগবানের অনুসরণে তারা জন্মাষ্টমীর মিছিল বের করতে শুরু করেন।

১৭২৫ সালে জেমস টেলর উল্লেখ করেন যে, ওই সময় জন্মাষ্টমী পালনের জন্য দুটি পক্ষের সৃষ্টি হয়। নবাবপুর পক্ষকে বলা হতো, লক্ষ্মীনারায়ণের দল আর ইসলামপুর পক্ষকে বলা হতো, মুরারি মোহনের দল। সপ্তদশ শতকে মিছিলের শুরু হলেও তা বিকশিত হয়েছিল উনিশ শতকের শেষার্ধে। যে ধারা বলবৎ ছিল বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত।

প্রথমদিকে মিছিলে নন্দঘোষ, রানী যশোদা, শ্রী কৃষ্ণ ও বলরামকে আনা হতো। ক্রমেই এর সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে আরো নানা ধরনের অনুষঙ্গ। তবে মূল কাঠামোটি ছিল প্রথমে নেচে-গেয়ে যাবে কিছু লোক, এরপর দেব-দেবীর মূর্তি, লাঠিসোঁটা, বর্শা, নিশান প্রভৃতি নিয়ে বিচিত্র পোশাক পরিহিত মানুষ, নানা রকমের দৃশ্য। মিছিলের প্রধান আকর্ষণগুলো ছিল সুসজ্জিত হাতি, ঘোড়া, রঙিন কাগজে মোড়ানো বাঁশের টাট্টি, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড মন্দির, মঠ, প্রাসাদ ও প্রাচীন কীর্তির প্রদর্শন। সেসব আয়োজন এখন শুধুই স্মৃতি। কিন্তু হাজার প্রতিকূলতার পরও ঢাকায় এখনো জন্মাষ্টমী উৎসব ও শোভাযাত্রা জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হয়।

শ্রী কৃষ্ণের জীবনী পাঠ ও কর্মকান্ড মানব সমাজকে শিক্ষা দেয় যে, সৌভ্রাতৃত্ব ও স¯প্রীতির বন্ধনে বিশ্ব সমাজকে আবদ্ধ করার ক্ষেত্রে তাঁর দর্শন ও প্রেমের বাণী রাখতে পারে কার্যকরী ভূমিকা। তাইতো শুধু দুষ্টের দর্শনই নয় এক শান্তিময় বিশ্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতি বছর শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন তথা জন্মাষ্টমী আমাদের মাঝে নিয়ে আসে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এক শুভ আনন্দময় বার্তা।
১৪টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×