ভ্রমণ পিপাসু তিনজন আমরা। একই বৃন্তে তিনটি ফুল। প্রায় তিন যুগ আগে আমাদের মধ্যে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব কীভাবে গড়ে উঠেছিল আজ তা বিশেষভাবে মনে পড়ছে না। তিনজনের ভেতর দুজন সমবয়সী, অন্যজন প্রায় ছ'বছরের বড়। সুযোগ পেলেই বেড়িয়ে পরি ভ্রমণে আমরা এ তিনজন। আমার বাংলাদেশ ভ্রমণে প্রায় সবগুলো পর্যটক স্পটে বন্ধু চিরদিন এবং বড় ভাই কে সঙ্গী হিসেবে পেয়েছি। আমি ঢাকায় গেলেই শুরু হয়ে যায় আমাদের উড়া-ধরা জীবন স্টাইল। যদিও আমরা প্রত্যেকে কর্মব্যস্ত ও সাংসারিক। তদুপরি কোনো কিছুই ফেরাতে পারেনি আমাদের। আমরা তিনজন ভ্রমণ দলের স্থায়ী সদস্য হলেও মাঝে মধ্যে জুটে যায় অস্থায়ী সুখের পায়রা। সব মিলিয়ে বেড়ানো হয়ে ওঠে আনন্দময়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বন্ধু চিরদিন ও বড় ভাইয়ের দেশের বাড়ি মানিকগঞ্জ জেলায়। দেশে থাকাকালীন এবং বেড়াতে গেলে মানিকগঞ্জ একবারের জন্য হলেও যাওয়া হয়েছে অবশ্যই।
বসন্তের শেষ সময়ে কালবৈশাখী মৌসুমের প্রারম্ভে। মেঘ করুক, ঝড় উঠুক আর বৃষ্টিই নামুক; মাত্র দুটো দিনের পরিকল্পনাকে কিছুতেই ভেস্তে যেতে দেয়া যাবে না। হাতে যে বড্ড সময়ের অভাব। ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল বলতে হবে। নিদ্রা ভঙ্গের পরপরই প্রথম কাজটি ছিল পর্দার ফাঁক গলিয়ে আকাশ পানে তাকানো। মেঘ বৃষ্টির আভাস নেই। বরং রোদ ঝলমলে মিষ্টি শুভ সকাল। প্রফুল্ল চিত্তে পরমকরুনাময়ের নাম নিয়ে বেড়িয়ে পরলাম সাত-সকালে জ্যাম এড়াতে মানিকগঞ্জের উদ্দেশ্যে।
যত গণ্ডগোল গ্যাংটক! গাবতলী পেছনে ফেলে আমিন বাজার পৌঁছাতেই আরম্ভ হয়ে গেল বিড়ম্বনা। মনে পড়ে গেল সত্যজিৎবাবুর গোয়েন্দা বইটির নাম। মনের অগোচরেই মুখ থেকে বেরিয়ে আসল যত গণ্ডগোল আমিন বাজার। আটকে গেলাম জ্যামে। ক'ঘন্টার মামলা কে জানে! উপলব্ধি করলাম প্রভাতের ভাগ্যদেব বা দেবী মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সামনেও যাচ্ছি না, পেছনেও না। এক জায়গায় স্থির। গাড়ির ভেতর আটকে গেছি জ্যামের ঘোরে। সকলেরই মাথা ঝিমঝিম করছে। গাড়ি থেকে নেমে যে একটু হাঁটাহাঁটি করে জ্যাম পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হব সে উপায়ও নেই। গাড়িগুলো একটার সাথে অপরটা গায়ে গায়ে সেঁটে আছে। অগত্যা বসেই থাকতে হলো আর জ্যাম রাস্তার গুষ্টি উদ্ধার করছি। মসৃণ ও স্বচ্ছন্দ যাত্রাপথে বাঁধাই যখন পড়ে গেল, তখন তিনজনে আলোচনা সাপেক্ষে পরিকল্পনা একটু বদলে ফেলি। আমার অনুসন্ধিৎসু মনে অকস্মাৎ ধামরাইয়ের কাঁসা-পিতল শিল্পের দৃশ্য ভেসে ওঠে। বিগত শতাব্দীর আশির দশকে একবার গিয়েছিলাম। তাও রাতের বেলায় বিশেষ একটি জরুরী কাজে। খবরের কাগজে ঐতিহ্যবাহী কাঁসা-পিতল শিল্পের কারুকার্যের কথা পড়ে আর ছবি দেখে যাব যাব ভাবছিলাম। ভাবলাম এটাই তো মোক্ষম সময়। পরবর্তীতে আবার এদিকে আসা হয় কিনা, এই ত্রিকাল বয়সে বলা মুশকিল। বন্ধু চিরদিন আর বড় ভাইয়ের কাছ থেকে প্রস্তাব পাস করিয়ে নিলাম একটু ইনিয়ে বিনিয়ে। বললাম, মানিকগঞ্জ তো নিজের শহরের মত, রাত দুটা-তিনটায় পৌঁছালেও মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। ব্যস্ততা আমাদের কখন কোথায় নিয়ে যায় বলা কঠিন।
ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জ বা আরিচা যাত্রাপথে সাভারে যাত্রা বিরতি দেই নি, এমনটা কখনও হয় নি। আধা ঘন্টার জন্য হলেও থেমেছি। রসগোল্লা, টকদই ধ্বংস এবং বন্দী করে সাথে নিয়ে যাওয়া। এবারেও এর ব্যতিক্রম ঘটলো না। 'বন্দী কারাগারে আছি গো মা বিপদে' গুন গুন করতে করতে গাড়ি থেকে নেমে মেইন রোডের পাশে একটি হোটেলে ঢুকে রসগোল্লা, টকদই, পরোটা আর চায়ের অর্ডার দিলাম। বসে পড়তেই সমস্ত গা ছেড়ে দিল। মনে হলো অনন্তকাল ধরে ভ্রমণ ক্লান্ত পথিক তার নিরাপদ বিশ্রামাগারে শান্তির আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে। খাওয়া-দাওয়া শেষে বন্দী মিষ্টান্ন সমেত পথ আবারও সঙ্গী হতে চায় কিন্তু দেহ চাইছে না। যাহোক গাড়ি বেশ বেগে ছুটে চলেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আর জাতীয় স্মৃতিসৌধ পেছনে ফেলে এগিয়ে যাই। তিনজনে খোশ-গল্প করতে করতে দেখি চলে এসেছি ধামরাই।
আমার অনেক আগে আসা সেই রাতের ধামরাইয়ের সঙ্গে এই দিনের ধামরাইয়ের কোনো মিল খুঁজে পেলাম না। এবার এলাম দিনের বেলা, চিত্র ঠিক বিপরীত। এখানে এসে একটি বটগাছের নিচে ছোট চায়ের দোকানে বসে চা খেয়ে আরো সামনে এগিয়ে যাই। আমাদের পেছনে স্কুল তার পাশে একটি পুরনো বাড়ি। একটি শিশুকে দেখলাম মজা করে কাদা মাটি মাখামাখি করতে। আরো এগিয়ে দেখতে পাই রাস্তার দুধারে লাইন ধরে বাজার বসেছে। শাক-সবজি বিক্রি হচ্ছে। কেউ দুধ নিয়ে বসেছে। এ সব কিছুর সামনে রথ দাঁড়িয়ে।
ধামরাইয়ের রথযাত্রাটি বাংলাদেশের প্রাচীন এবং বৃহত্তম রথযাত্রা। প্রতিবছর রথযাত্রার দিন একটি বিশাল ৬ তালা রথে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা মূর্তি আরূঢ় করে এখানে শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। রথটি হিন্দু দেব-দেবীর নানা রকম মূর্তিতে সজ্জিত থাকে। সারাদেশ থেকে পুণার্থীরা এই রথযাত্রায় অংশগ্রহণ করে থাকেন। এখানে উত্থান একাদশী এবং মাঘী পূর্ণিমাতে মেলা বসে। সে মেলায় সারাদেশ থেকে প্রচুর লোকের আগমন ঘটে। এই মেলা ধামরাইয়ের রথ মেলা নামে বিখ্যাত।
আমরা রথটি পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাই। তারপর একটু এগিয়ে শ্রীশ্রীরাধাশ্যাম জিউর মন্দিরের সামনে আমারা দাঁড়াই। মন্দিরটির নির্মাণ সাল ১৩৪৫ বাংলা। এটি নির্মাণ করেন শ্রীমতী সুরবালা বণিক। আমরা মন্দিরটি ঘুরে পাশের গৌড়ভবনে প্রবেশ করি। গৌড়ভবনে প্রবেশ মুখের ঘরটি বৈঠকখানা। বর্তমানে তামা-কাঁসার তৈরি বিভিন্ন দ্রব্যের প্রদর্শনী ও বিক্রয় কেন্দ্র। আমরা গৌড়ভবনে প্রবেশ করে এর বিক্রয় কেন্দ্রটি ফাঁকা দেখতে পাই। কাউকে না পেয়ে নিজেরাই ঘুরে দেখি, ছবি তুলি। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করি। ভেতরেও কাউকে পাওয়া গেল না। পেলাম ফুলে ফুলে ভরা একটি কাঞ্চন গাছ। এখানে আমরা প্রায় চিৎকার করে ডেকেও কাউকে না পেয়ে গৌড়ভবন ত্যাগ করে চলে যাই পাশেই সুকান্ত বণিকের বাড়িতে।
বিশাল বাড়ি, সুদৃশ্য অট্টালিকা। বাড়িটি যে কাউকে দূর অতীতে ফিরিয়ে নেবে। এর স্থাপত্যশৈলী অসাধারণ। আমরা এর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। শতবর্ষের স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে বাড়িটি। আমরা বাহির বাড়ির বারান্দায় বসে কিছু সময় কাটিয়ে বাড়ির অন্দরে প্রবেশ করি। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই বাড়িটির বিশালতা। সরু একটি গলি দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে পেয়ে যাই বিশাল উঠোন। উঠোনের একপাশে কুয়া, এমন কুয়া সচরাচর চোখে পড়ে না। কুয়াতে টলমলে পানি। আমারা পাশে বাঁধা বালতি ছেড়ে কুয়া থেকে পানি তুলি। হাত-মুখ ধুয়ে নেই। কুয়ার শীতল পানির পরশে নিমেষে আমাদের ভ্রমণজনিত ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।
কুয়ার পাশে যেখানে কারিগর মাটি দিয়ে সাঁচ বানাচ্ছিলেন সে ঘরটাতে প্রবেশ করি। তাদের হাতের কাজ অসাধারণ। এরা আসলে কারিগর নয়, শিল্পী। যারা সব সময় অন্তরালে থেকে যান। এরাই নিখুঁতভাবে কাঁসা, পিতলের তৈরি নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদি আর ভাস্কর্য নির্মাণ করে থাকেন। আমরা কারখানা থেকে বের হয়ে পাশের বারান্দায় একজন কারিগরকে একটি পিতলের বানানো ড্রাগনের ভাস্কর্য ঘষতে দেখে দাঁড়িয়ে দেখি। তারপর মূল বিক্রয় কেন্দ্র ও প্রদর্শনী কক্ষে প্রবেশ করি।
প্রদর্শনীর বিশাল ঘর দুটি ঘুরে দেখি, ছবি তুলি। হিন্দু পৗরাণিকের সব চরিত্র যেন বাস্তব রূপ পেয়েছে রোঙ্গ পিতল ও তামার মধ্যে। হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তি, থালাবাটি, গহনাসহ নিত্যব্যবহার্য কি নেই এখানে। রাধা-কৃষ্ণ, অবতার, নটরাজ, চড়কের নীলপাট, উমা মহেশ্বর, কালিয়া কৃষ্ণ, সর্পছায়ায় বিষ্ণু, তারা, ত্রিনাথ, শিব, পার্বতী, ধুপদানি, পঞ্চপ্রদীপ, ঘণ্টা, নীলকমল আর দুর্গা চলেছেন অসুর বধে। তারপর একটি বিশাল দাবা বোর্ডের সামনে এসে থমকে যাই!
ধাতব শিল্প হিসেবে কাঁসার জিনিস আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। অতীতে বাংলাদেশের সব জায়গাতেই গ্রামগঞ্জের কৃষিনির্ভর বনেদি পরিবার, সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার কাঁসার তৈরি বাসন-কোসন, থালাবাটি, গ্লাস, পাতিল, চামচ, গামলা ইত্যাদি নানা ধরনের জিনিস নানা কাজে ব্যবহার করে আসছিল শত শত বছর ধরে। গ্রামগঞ্জে গেলে হয়তো এখনো এসব কাঁসার জিনিসপত্র চোখে পড়তে পারে।
কাঁসা একটি মিশ্র ধাতব পদার্থ। বাংলাদেশে এই মিশ্র পদার্থের শিল্প কখন, কোথায় শুরু হয়েছিল তা আজও জানা যায়নি। তবে প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, এটি প্রাচীন আমলের সভ্যতায় শুরু, যখন ব্রোঞ্জশিল্প ছিল। আবার অনেকেই এই শিল্পকে পাহাড়পুর-মহাস্থানগড় সভ্যতার সাথে সম্পৃক্ত বলে মনে করেন। অনেক অভিজ্ঞ লোকশিল্পীর ধারণা কাঁসাশিল্প রামায়ণ-মহাভারত যুগের। বংশ পরম্পরায় কাঁসার শিল্পী প্রয়াত যোগেশচন্দ্র কর্মকার মনে করতেন, রামায়ণ-মহাভারতের যুগে জীবনচর্চায়, পূজা-পাবর্ণে কাঁসার তৈরি ঘটি-বাটি ও অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী ব্যবহার হতো।
১৫৭৬-১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে মোঘল আমলে উপমহাদেশে বেশ জোরোসোরে কাঁসা ও পিতলের ব্যবহার শুরু হয়। এসব ধাতু দিয়ে তখন ঢাল, তলোয়ার, তীর-ধনুক, বন্দুক ও কামান তৈরি করত। ব্রিটিশ শাসনের আমলে এ শিল্পের প্রসার ঘটে এবং বাংলার ঘরে ঘরে এর ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সেই সময় কাঁসা-পিতল শিল্পের বেশ কিছু ছোট বড় কারখানা গড়ে ওঠে। জানা যায়, এ শিল্পের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন রাজা প্রদ্যুত্ কুমার ঠাকুর। তিনি প্রথম এই হস্তশিল্পের সামগ্রী নিজে ব্যবহার করেন এবং উপহার হিসেবে অনেককেই পাঠান।
বাঙালির গৃহস্থালি ও সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে তামা, কাঁসা ও পিতল শিল্প। একটা সময় ছিল যখন বিয়ে, খত্না, অন্নপ্রাসন, জন্মদিন, আকিকা ইত্যাদি অনুষ্ঠানে প্রধান উপহারসামগ্রী ছিল কাঁসার গ্লেস, বাটি, ফুলদানি, চামচ, রেকাব শানকে, গামলা, বেলিবগি, পানদানি, থালা, পিতলের টব, কলসি, বালতি, কড়াই, পানের থালা, ধূপদানি, তামার কলস, হাঁড়িপাতিল, পুষ্পপাত্র ইত্যাদি। যেকোনো অনুষ্ঠানে দেয়া হতো নাম খোদাই করা কাঁসার সামগ্রী। এসব উপহারসামগ্রীর জায়গা দখল করে নিয়েছে আধুনিক ডিজাইনের চিনামাটি, পাইরেট, মেলামাইন, কাচ, প্লাস্টিক ও স্টিলের তৈরি জিনিস। কাঁসাশিল্পের কাঁচামাল টিনঙ্গট বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, যা সারা বিশ্বের মধ্যে একমাত্র মালয়েশিয়ায় পাওয়া যায়। সরকারিভাবে উদ্যোগ না নিলে এ শিল্প অচিরেই বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। মূলত কাঁচামালের অভাবেই তামা, কাঁসা ও পিতল শিল্প বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে অক্টোবর, ২০১৩ রাত ৯:২৪