ভা-ল-বা-সা চার বর্ণের এক ম্যাজিক শব্দ। যার অর্থ হতে পারে অনুভূতি, আকর্ষণ, হৃদয়ের টান; যা মানুষের অন্তরে আল্লাহপাক সৃষ্টিগতভাবে দিয়ে দেন। ভালবাসা অতি প্রাকৃতিক দুর্বোধ্য এক উপলব্দি। ভালবাসা হল এক প্রকার সঞ্জিবনী সুধা যা পান করে নর-নারী জীবনকে বিচিত্র অভিধায় উদ্ভুদ্ধ ও অভিসিক্ত করে এবং জীবনকে করে তোলে অগ্রগামী ও অর্থময়। নর-নারীর প্রথম জিজ্ঞাসা প্রেম এবং প্রতিনিয়তই তা অভুতপূর্ব এক অনির্বচনীয় সত্য। বলা হয়ে থাকে যে, ভালবাসাই হলো সৃস্টির সেরা কারণ (Love is the final cause of creation)।
পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন, রোমাঞ্চকর, স্বপ্নীল এবং ঘোর লাগানো বিষয় হলো ভালবাসা। এর চেয়ে কমন কোন বিষয় জগতে বোধকরি দ্বিতীয়টি নেই। সুনীল বাবু বিশ্ব সংসার তন্নতন্ন করে ১০৮টা নীলপদ্ম খুঁজে পেলেও আমরা কিন্তু এই বিশ্ব দুনিয়ায় হয়ত এমন একজন লোকও খুঁজে পাব না যিনি প্রেমে মজেননি বা ভালবাসেননি। পাশের দোকানের চা বিক্রেতা থেকে শুরু করে খোদ সরকারপ্রধান পর্যন্ত সবাই ভালবাসার কাঙ্গাল। ভালবাসাই দুনিয়ার একমাত্র প্লাটফরম যেখানে ধণী-গরীব, ছোট-বড়, ধর্ম-বর্ণ,-গোত্র নির্বিশেষে সবাই এক কাতারে শামিল হয়। ভালবাসার এমনই মাহাত্ব্য! কি আশ্চর্য ক্ষমতা এই ভালবাসার! অথচ মজার ব্যাপার হলো সবাইকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় ‘ভালবাসা কি’ তাহলে ক্ষণিকের জন্য হলেও তারা কিছুটা হকচকিয়ে যাবেন এবং পরক্ষণেই একটু বোকা বোকা হাসি দিয়ে যে যার মতো করে বলে যাবেন। কিন্তু আমরা জানি ভালবাসার কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞাকে আজোও প্রতিষ্ঠিত সত্য হিসাবে গণ্য করা হয়নি।
আসলে ভালবাসা হলো সম্পুর্ণটাই অনুভূতির ব্যাপার। মনের এক দুর্বোধ্য কোণে এর বসবাস। সাজানো কিছু কথা, কোন ছক, ব্যাখা, ব্যাকরণ দিয়ে এর পরিপুর্ণ প্রকাশ ঘটানো সম্ভব নয়। বাংলাদেশের ‘আধুনিক কবি’ বলে খ্যাত কবি শামসুর রাহমান যথার্থই বলেছেন, “প্রেম কি, এই প্রশ্ন যদি কেউ আমাকে করেন তাহলে আমি সবিনয়ে নিরুত্তর থাকব। কেউ পীড়াপীড়ি করলে সেইন্ট অগাস্টিনের ধরণে বলব, আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমি জানিনা, জিজ্ঞেস না করলে জানি”।
ভালবাসার ক্ষেত্রে রুপ-সৌন্দর্য একটি বড় ব্যাপার। অসুন্দর কোন পুরুষের জন্য কোন রমণীর মন আনচান করে না। আবার অসুন্দর কোন রমণীর জন্য পুরুষের মনও ব্যাকুল হয়না। কাজেই ভালবাসায় সুন্দর চেহারা একটি বিশাল ফ্যাক্টর। সুন্দরের প্রতি মানুষের আকর্ষণ সহজাত। তাইতো, কবি-সাহিত্যিকগণ অকৃপণভাবে সুন্দরের বন্দনা করে গেছেন। ইংরেজ কবি কিটস বলেছেন, “Truth is beauty, beauty is truth”. তিনি আরও বলেছেন, “A thing of beauty is a joy forever.” মহামতি এরিস্টটল এর কথা শুনে অনেকেরই মাথায় বাজ পরতে পারে। তিনি বলেছেন, “Beauty is better than all the letters of recommendation in the world”. সত্যি সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র। তবে বিপরীতেও কিছু কথা আছে। যেমন- ইংরেজীতে একটা কথা আছে, “Handsome is as the handsome does”. এর সাথে সুর মিলিয়ে ভারতীয়দের বাপুজী ভালোই বলেছেন, “অন্তরের বিশুদ্ধতার মধ্যেই প্রকৃত সৌন্দর্য বিদ্যমান”। এ কারণেই কিন্তু বলা হয়ে থাকে যে, শারীরিক সৌন্দর্য হচ্ছে ‘skin deep’ তথা চামড়া সর্বস্ব। অবশ্য এটা শুনে এক মহারথী কিছুটা তেড়ে এসে বলেছিলেন, “কথাটা শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত। স্কিন ডিপ বলতে ওরা কি বোঝায়? ওরা কি চায় সুন্দর একটা প্যানক্রিয়াস (pancreas)। কি সাংঘাতিক কথা!
যাক, রথী-মহারথীদের এমন প্রানবন্ত তর্কে আমরা যাদের চেহারা-সুরত খারাপ তারা নিশ্চয়ই অজানা আশংকায় কাঁপছি। কি ভয়ের কথা! চলুন খুব দ্রুত এর একটা বিহিত করতে সচেস্ট হই।
বাইবেলে একটা কথা আছে, কাউকে কেবল চেহারা দেখেই বিচার করো না। শুধু বাইবেল কেন সকল ধর্মগ্রন্থেই ভেতরের মানুষটাকে খুঁজে বের করবার জোড় তাগিদ দেয়া হয়েছে। এখানে মহামতি আব্রাহাম লিংকন এর ঘটনাটি আমাদের মনে আশার আলো জাগাতে পারে। আমরা জানি আব্রাহাম লিংকন এর চেহারা ছিল খুবই সাদামাটা। তো, এক জনসভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে তার কানে এলো ভিড়ের মধ্যে কে যেন বলছে, “আরে এনার চেহারা তো দেখছি একেবারে সাদামাটা”। লিংকন পাশ ফিরে লোকটির উদ্দেশ্য বললেন, “বন্ধু! ঈশ্বর সাদামাটা চেহারার লোকদের বেশি পছন্দ করেন, সেজন্য অধিকসংখ্যক লোকদেরকেই তিনি সাদামাটা চেহারা দিয়ে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন”।
কাজেই ভালবাসার ক্ষেত্রে চেহারা important হলেও কোনক্রমেই তা অপরিহার্য নয়। ভালবাসার ক্ষেত্রে অপরিহার্য ব্যাপার হল সুন্দর একটি প্রেমিক মন। আপনার মনটা সুন্দর হলেই আপনি ভালবাসতে পারবেন। মনে রাখবেন ভালবাসা যেখানে যত গভীর হয় চেহারা সেখানে ততই গৌণ হয়ে পড়ে। এখানে বহুল প্রচলিত একটি গল্পের অবতারণা করা যেতে পারে। এক সুন্দর ছেলে প্রেমে পড়ে যায় এক অসুন্দর মেয়ের। তাদের ভালবাসা এতই গভীর ছিল যে লোকজন এ নিয়ে বিস্তর হাসাহাসি করত। এমতাবস্থায় ছেলেটি তাদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিল, “আমার চোখ দুটো দিয়ে ঐ মেয়েকে দেখেন, তখন বুঝবেন ও কত সুন্দর”। এ কারণেই বোধকরি পারস্যদেশীয় প্রবাদে আছেঃ “ভালবাসার মুখগুলোকে চন্দ্রালোকিত রাতে দেখতে হয়, যখন প্রেমিক-প্রেমিকা তার মনের মানুষকে দেখে অর্ধেক দৃস্টি আর অর্ধেক কল্পনা দিয়ে”। মহাকবি শেক্সপিয়েরের একটি কথায় এর প্রমাণ মেলে, “love looks not with eyes but with the mind”.
এখন আমরা আর একটু এগিয়ে যাব। বুঝতে চেস্টা করব ভালবাসলে মানুষের প্রতিদিনকার চালচিত্র কেমন হয়। ব্যাপারটা কিন্তু সহজেই অনুমেয়। ভালবাসার মানুষ ছাড়া সারা দুনিয়াটাকে রুপহীন, রসহীন, বৈচিত্র-বিবর্জিত মনে হয়। যাযাবরের 'দৃষ্টিপাত' থেকে কিছু দারুণ উদ্ধৃতি শেয়ার করা যায়। “এসময় প্রতিটা প্রভাত আনে নতুন দিনের প্রত্যাশা, প্রতিটা সন্ধ্যায় ঘটে প্রার্থিত সান্নিধ্য। রাত্রিতে থাকে পরবর্তী দিবসের প্রগাঢ় প্রতীক্ষা। কর্মহীন সময়ে নির্জনে ভাবতে ভাল লাগে যে স্মৃতি, তা প্রিয়জনের। রাত্রির তিমির স্তব্দ প্রহরে অকস্মাত ঘুম ভেঙ্গে মনে পড়ে যে প্রসংগ, তা প্রিয়জনের। প্রভাতে প্রথম স্মরণে আসে যে মুখ, তা প্রিয়জনের। এ এক রহস্য, এক বিস্ময়। আনন্দ-বেদনা বিজরিত এ এক অনির্বচনীয় অনুভূতি”। মোটকথা, সমস্ত কমে-চিন্তায়, ধ্যান-ধারনায়, আলোচনায়-সমালোচনায়, স্বপনে-জাগরণে শুধই প্রিয়জনের একচ্ছত্র আনাগোনা।
এখন প্রশ্ন হলো নিস্কাম প্রেম নাকি কামজ প্রেম? কোনটা বেশি কাম্য? নিস্কাম প্রেমের জয়গান মূলত মধ্যযুগীয় সাহিত্যে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। যেমন- মধ্যযুগীয় কবি চন্ডিদাস একটি পদ রচনা করেছিলেন, “রজকিনী প্রেম নিকষিত হেম, কাম গন্ধ নাহি তায়”। সাধক গায়ক লালন শাহ’র একটি গানে আমরা নিস্কাম প্রেমের প্রমাণ পেতে পারি, “প্রেম করো আত্ত্বার সনে, দেহের সঙ্গে নহে”। তেমনি পাশ্চাত্য দেশে ‘Platonic Love’ বলে একটি কথা বহুলভাবে প্রচলিত আছে। তবে এর বিপরীতপন্থিরাও কম যান না । যেমন- আমাদের দেশের ব্যাতিক্রমধর্মী লেখক হুমায়ুন আজাদ কামজ প্রেমের ঘোর সমর্থক। তিনি তার এক লেখায় বলেছেন, “কোটি বছরের বিশুদ্ধ প্রেমের থেকে একবার একটি পরিপুর্ণ সংগম অনেক বেশি সুখকর”। এদিকে নির্মলেন্দু গুনও কম যান না। তিনি ‘Platonic Love’ প্রসংগে বলতে গিয়ে বলেছেন, “এটি হচ্ছে সুযোগের অভাবে চরিত্রবান ও চরিত্রবতীদের মানসিক ক্রিয়াকান্ডের ফসল”। যাক, আর কোন তর্ক নয়। কারণ তর্কে তর্ক বাড়ে। আসলে কাম প্রেমের একটি সম্পুরক বিষয়মাত্র। কাম চৈতন্য দেহ সর্বস্ব এবং আদি ভোগবাদি। কামের সাথে দেহের সম্পর্ক আর দেহের সঙ্গে আত্ত্বার, অস্তিত্তের, প্রগতির। প্রেম সততই একটি দার্শনিক উপলব্দি যা মানুষকে দাঁড় করিয়ে দেয় মহাকালের অনির্বচনীয় সব মহাবিস্ময়ের। কামের সাথে প্রেমের সম্পর্ক এক আনা। বাকী পনের আনাই হলো প্রেম। এই প্রসঙ্গে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের শরণাপন্ন হতে পারি। তিনি বলেছেন, ‘কামনা আর প্রেম দুটি হচ্ছে সম্পুর্ণ আলাদা। কামনা একটা প্রবল সাময়িক উত্তেজনা মাত্র আর প্রেম হচ্ছে ধীর প্রশান্ত ও চিরন্তন’।
প্রেমের পরিণতি বেশ উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্তপূর্ণ একটি বিষয়। প্রেম, ভালবাসা মানেই প্রিয়জনকে একান্ত করে কাছে পাওয়ার ইচ্ছা; প্রিয়জনকে নিয়ে স্বর্গসুখ রচনা করা। প্রেম মানেই প্রিয় মানুষটিকে চিরদিনের মত ধরে রাখার প্রাণান্তকর প্রচেস্টা। এতে কেউ সফল হয় কেউবা ব্যর্থতার দংশনে নীল কস্টে ভুগতে থাকে। আসলে প্রেম ও বিরহ মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। প্রেম যখন আসে তখন বুঝতে হবে বিরহও সমাগত। সফলতা মানেই প্রেমের চুড়ান্ত বিজয় একথা যেমন সর্বাংশে সত্য নয় তেমনি সংশয় আছে এ কথাটিতেও যে, প্রেমের ক্ষেত্রে ব্যর্থতাই অমরত্ত্ব লাভের উপায়। তবে দ্বিতীয় মতটির পক্ষে যে যে ভোট বেশী পড়বে তা সহজেই অনুমেয়। কেননা প্রেমের সফলতা নিয়ে যে কয়টি কথা খরচ হয়েছে তারচেয়ে বিস্তর কাগজ-কলম গচ্চা গেছে প্রেমের ব্যর্থতার ফিরিস্তি বয়ানে। তাকিয়ে দেখুন ইতিহাসের দিকে। আপনি চোখ বুজেই বলে দিতে পারবেন লাইলি-মজনু, শিরী-ফরহাদ, রোমিও-জুলিয়েট, কিংবা দেবদাস-পার্বতীদের মত অমর জুটিগুলোর কথা। এদের ভালবাসার কথা, এদের বিরহের কথা আজও লোক মুখে ঘুরে বেড়চ্ছে। প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছে ঐ অমর নামগুলো। অথচ এরা কেউই সফল নন। কিন্তু প্রেম করে সফল হয়েছেন এমন একটি যুগলবদ্ধ নামও আমাদের হৃদয়ে নেই। আসলে প্রেমের ক্ষেত্রে ব্যর্থতাই বুঝি সত্যিকারের সফলতার পরিচায়ক। এ ক্ষেত্রে অসংখ্য উদ্ধৃতি দেয়া যায়। আমার কাছে সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য দু’টো শের বঙ্গানুবাদসহ শোনাচ্ছিঃ
মেরে রোনেকো জিসমে কিসসা হ্যায়
উমর কা বেহতারিন হিস্যা হ্যায়।। (অজ্ঞাত)
বাংলাঃ আমার কান্নার ভাগ যে অংশে রয়েছে, জীবনের সে অংশটাই শ্রেষ্ঠ ।।
জিসনে দিল খোয়া উসী কো কুছ মিলা
ফায়দা দেখো উসী লোকসান মে। (সারসার সালানী)
বাংলাঃ যে হৃদয় হারিয়েছে সেই কিছু পেয়েছে। এটাই পৃথিবীর একমাত্র লোকসান যাতে আসলে লাভই ভাগ্যে জুটে যায়।।
দুনিয়াটা বিশাল এক প্রেমের ক্ষেত্র। এখানে সবাই প্রেমের অদশ্য ফাঁদে আটকা পড়ে যায়। সত্যিই প্রেমের ভুবনে আমরা সবাই একাকার। নিজ বাসভূমে আমরা সবাই প্রেমিক। কেউ জেনে, কেউ না জেনে। কেউ ভেবে, কেউ না ভেবে। আমরা সবাই প্রেমে পড়ি, ভালবাসি। আমরা প্রেমে পড়তে, ভালবাসতে ভালবাসি।
যাহোক, এখন আলোচনা শেষ করব। এর আগে দুনিয়ার সকল প্রেমিক-প্রেমিকাদের উদ্দেশ্যে ‘আধুনিক কবিদের কবি এজরা পাউন্ড’র The Spirit of Romance’ গ্রন্থের দু’টি চরণ দিয়েই আমার নিবেদন শেষ করছিঃ
“Let whoever never loved, love tomorrow
Let whoever has loved, love tomorrow”.
কাজেই আসুন আমরা সবাই ভালবাসি। ভালবেসে পৃথিবী সরিয়ে ফেলি শত জঞ্জাল। একমাত্র ভালবাসাই পারে পৃথিবীটাকে বাসযোগ্য করতে।
Happy Valentine's Day!
বিঃদ্রঃ বেশ কয়েক বছর আগের লেখা এটি। নানা ধরণের বই, কলামিস্ট আতাউর রহমান স্যারের ‘দুই দুগুণে পাঁচ’ সিরিজ লেখাসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে সাহায্য নিয়ে লেখাটি সাজিয়েছি। এটিই ছিল সামুতে দেয়া আমার প্রথম পোস্ট। বিশ্বভালোবাসা দিবস’ উপলক্ষে লেখাটি আবারো দিলাম। ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ সকাল ১০:১৬