লেখক : 'জরাসন্ধ' (ছদ্মনাম) আসল নাম- চারুচন্দ্র চক্রবর্তী
প্রথমেই 'লৌহকপাট' সম্পর্কে একটা মুখরোচক খবর দেই। দেশ পত্রিকার এককালের সম্পাদক সাগরময় ঘোষ তাঁর 'হীরের নাকছাবি' বইয়ে এটির উল্লেখ করেছেন। সাগরময় ঘোষের স্কুলের এক বন্ধু তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তার একটি পাণ্ডুলিপি এক সময়ে দেশ পত্রিকার অফিসে এসে জমা দিয়ে যান। এক্সারসাইজ বুক বাঁধানো মোটায় রচনার নাম 'লৌহযবনিকা' লেখক 'বিশ্ববন্ধু’। লেখা বা লেখকের নাম কোনটাই সাগরময়বাবুর কৌতূহল জাগায়নি, তাই পাণ্ডুলিপিটিকে তিনি ড্রয়ারে চালান করে দেন। এর চার-পাঁচ মাস বাদে বন্ধুর একটা চিঠি পান। একটু কাতরভাবেই বন্ধু লিখেছেন যে, যদি লেখাটা ছাপার অযোগ্য মনে হয়, তাহলে সেটা যেন রেজিস্ট্রিযোগে তার কাছে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এদিকে লেখাটার কথা সাগরময়বাবু বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন। বন্ধুর চিঠি পেয়ে একটু লজ্জিত হয়েই খাতা খুঁজে বের করলেন। ফেরত পাঠানোর আগে দুয়েকপাতা পড়তে গিয়ে কখন একঘণ্টা সময় কেটে গেছে খেয়ালও হয় নি। খাতাটা সেদিন বাড়ি নিয়ে রাত একটা পর্যন্ত পড়ে শেষ করলেন। তার ঠিক ১৫ দিন পরেই 'লৌহযবনিকা' 'লৌহকপাট' নামে আর 'বিশ্ববন্ধু'র বদলে 'জরাসন্ধ' নাম দিয়ে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে আরম্ভ করে। তারপর কয়েক বছর পরে লৌহকপাটের প্রথম খণ্ড গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত হয়। এভাবে চার চারটি কারাজীবনের বন্দিত্ব নিয়ে রচে ওঠে লৌহকপাট।
চারখণ্ডের লৌহকপাটের তিনটি খণ্ডই লেখকের চাকুরিজীবনে লেখা। চতুর্থ খণ্ডটি লেখেন অবসর নেওয়ার পরে এবং কারো কারো মতে সেটিই সর্বশ্রেষ্ঠ খণ্ড। বর্তমানে এটির অখণ্ড সংস্করণও পাওয়া যায়। লেখকের লেখার বৃহত্তর অংশ জেলের বন্দীদের জীবন থেকে অনুপ্রাণিত। তাঁর এই লৌহকপাট আঞ্চলিক ও বিদেশিসহ প্রায় ৬টি বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে।
'লৌহকপাট' এর কাহিনী এই রকম- বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্ব শেষ করে এক তরুণ যুবক চাকরির সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে শেষপর্যন্ত যে কাজটি পেলেন, সেটি হল কারা বিভাগে। ছোটখাটো একটি জেলের ডেপুটি জেলারের পদ। সম্পূর্ণ একটা নতুন জগতের সঙ্গে পরিচয় ঘটল সেখানে।
পরিচয় হলো বদর মুন্সীর মত ভয়ঙ্কর ডাকাতের সঙ্গে- খুন,জখম, নারীধর্ষণ যার কাছে ছেলেখেলা। কিন্তু সেই লোকটিই একবার ডাকাতি করার সময়ে গৃহস্বামীকে কথা দিয়েছিল, শুধু টাকা-গয়নাই নেবে - নারীর সম্মান নষ্ট করবে না। কিন্তু দলের একজন সেই হুকুম মানে নি বুঝতে পেরে, নিজেই ধরা দিল সেই অপবাদের বোঝা নিজের মাথায় নিয়ে।
আলাপ হলো মৃত্যু দণ্ডাদেশ প্রাপ্ত পঞ্চাশোর্ধ্ব আসামী কাশিম ফকিরের সঙ্গে। কাশিম ফকির নাকি টাকা ডবল করে দিতে পারে। সেই লোভে লোকে তার নির্জন কুঠিতে যেত। কাশিম আর তার যুবতী বিবি কুটী টাকাটা নিয়ে তাদের বিষ মাখানো খাবার দিত। তারপর মৃতদেহটা টিলার ধারে গর্ত খুঁড়ে কবর দিত। একদিন এলো এক স্বাস্থ্যবান যুবক। মুগ্ধ হল সে কাশিম ফকিরের সুন্দরী যৌবনবতী বিবির সৌন্দর্যে। কুটীবিবিরও মনে লাগলো দোলা। একে মেরো না, বলল সে কাশিম ফকিরকে। কাশিমের রোখ চেপে গেলো। কুটীকে না জানিয়ে গভীর রাত্রে বিষ খাইয়ে মারল সেই যুবককে। সকালে উঠে জানতে পেরে কুটীই ধরিয়ে দিল কাশিম ফকিরকে।
এভাবেই তরুণ যুবক বিভিন্ন সময় চাকরি সূত্রে বদলি হতে হয়েছে নানান জেলে। জেল-জীবনকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন খুবই কাছ থেকে। কয়েদিদের কাছে শুনেছেন তাদের কাহিনী। সহকর্মীরাও শুনিয়েছেন নানা বিচিত্র ঘটনা।। সেইসব খণ্ড-কাহিনী সুনিপুণভাবে জোড়া দিয়ে লেখা হয়েছে 'লৌহকপাট'।
লৌহকপাটের অবতরণিকাতে লেখক লিখেছেন, 'জীবনে এমন একটা পথে চলতে হয়েছে, যেটা প্রকাশ্য রাজপথ নয়। সে এক নিষিদ্ধ জগত। সেখানে যাদের বাস, তাদের ও আমাদের এই দৃশ্যমান জগতের দাঁড়িয়ে আছে লৌহদণ্ডের যবনিকা। তার ওপরে পাষাণ-ঘেরা রহস্যলোক। কিন্তু তারাও মানুষ। তাদেরও আছে বৈচিত্র্যময় জীবনকাহিনী- সুখে সমুজ্জ্বল, দুঃখে পরিম্লান, হিংসায় ভয়ঙ্কর, প্রেমে জ্যোতির্ময়! সেই পাষাণ পুরীর দীর্ঘ প্রকোষ্ঠের স্তব্ধ বাতাসে জমে আছে অলিখিত ইতিহাস, সভ্য পৃথিবী তার কতটুকু জানে? আমি যে সেখানে বিচরণ করেছি, এই দীর্ঘ জীবন ধরে, প্রভাতে, সন্ধ্যায়, নিভৃত রাত্রির অন্ধকারে- আমিই বা কতটুকে দেখেছি, কতখানিই বা শুনেছি। আহরণ যা করেছি, তোলা আছে স্মৃতির মণিকোঠায়। এখানে যেটুকু দিলাম, সে শুধু আভাস কিংবা তার ব্যর্থ প্রয়াস।’
পিডিএফ ডাউনলোড করতে ক্লিক করুন : লৌহকপাট (অখণ্ড সংস্করণ)