“আপামনি, অংকটার এইখানে আটকাইয়া গেছি—এরপর করে দিয়া যাও।”- একটু দূরে আরেকটা জটলায় বসে থাকা টুম্পা শ্যামলীকে ডেকে বলল।এখানে যারা পড়তে আসে তাদের মধ্যে টুম্পাই সবচেয়ে বড়।কাছের একটি হাইস্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ে-সায়েন্স গ্রুপে।প্রতিদিন স্কুল থেকে বাসায় এসে সামান্য কিছু মুখে দিয়েই ও চট করে চলে আসে এই ভার্সিটির স্কুলে।কারণ, দেরি হয়ে গেলে ভাইয়া-আপুদের তো আর পাওয়া যাবে না।তখন ও ওর এত কঠিন কঠিন পড়া কার কাছ থেকে বুঝবে।বাসায় তো ওর জন্য কোনো প্রাইভেট টিউটর ওর আব্বু রাখতে পারবে না ।
“শ্যামলী আপু- আমার বর্ষাকাল রচনা লেখা শেষ, একটু দেখে যাও”- ক্লাস সিক্সে পড়া আসমা শ্যামলীকে ডাকল।আসমা ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেয়েছিল।
“তোমার বাবা রচনাটা স্কুলের স্যারকে দেখিয়েছ”- শ্যামলী আসমাকে জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ,স্যার খুব খুশি হল।আমাকে দশে দশ দিল।বলল- মা,এই রচনা তুই নিজে লিখেছিস।কেউ লিখে দেয় নাই?আমি যখন বললাম আমি নিজে লিখছি তখন স্যার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক দোয়া করল।আর আমাকে ঠিকঠাকভাবে লেখাপড়া করতে বলল।বলল- মা, আমি দোয়া করি তুই লেখাপড়া কইরা অনেক বড় হ।”
“আমিন, তোমার খবর কি?ঠিকঠাকমত Passage টার বাংলা করতে পারছ?”- শ্যামলী জিজ্ঞেস করল।
-“আপু, forever মানে কি”
-“চিরতরে মানে চিরদিনের জন্য”
এই আমিন হচ্ছে আসমার ছোটভাই-আসমার এক ক্লাস নিচে পড়ে-আসমার মতই ভালো ছাত্র।সেও তার বন্ধুদের নিয়ে স্কুল ছুটির পরেই ভার্সিটিতে চলে আসে- এখানে পড়াশোনা করে সামনের মাঠে খেলে তারপর বাসায় যায়।
আমিন এবং আসমার বাবা রিক্সা চালান- বয়স বেশি হওয়ায় প্রায়ই তাকে অসুস্থ থাকতে হয়।একবার তিনি একটা মাইক্রোবাসের সাথে এক্সিডেন্ট করে প্রায় একমাস ধরে অসুস্থ ছিলেন।সেই সময় আসমা ও আমিনের স্কুলে ভর্তির টাকা জমা দেয়ার শেষ সময় ছিল।তিনি টাকার জোগাড় করতে না পেরে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন-ভেবেছিলেন তার প্রাণের টুকরা দুইটাকে আর বোধ হয় পড়ালেখা করাতে পারলেন না।।ঐ সময় ভার্সিটি স্কুলের ভাইয়া আপুরা মিলে চাঁদা তুলে আসমা ও আমিনকে স্কুলে ভর্তি করে।সেইজন্য তাদের কাছে তার কৃতজ্ঞতার শেষ নাই।
এই বাচ্চারা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশের গ্রামগুলোতে বাস করে।এদের কারও বাবা-মা হয়ত দিনমজুর,কেউ হয়ত রিক্সা চালায়,কেউ হয়ত মানুষের বাসায় কাজ করে,কেউবা ছোট কোন ব্যবসা করে।এদের অনেকেই নিজেদের সন্তানদের হয়ত কোনোভাবে একটু স্কুলে পাঠাতে পারেন।নিজের সন্তানের পড়াশোনার ব্যাপারে এর চেয়ে বেশি কিছু করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই কিছু ছেলেমেয়ে একটি সংগঠন গড়ে তোলে এবং এই সংগঠনের মাধ্যমে এইসব বাচ্চাদের পড়াশোনায় সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেয়।প্রথম দিকে সবার অনেক আগ্রহ থাকে,অনেক কমিটি হয়,কোন টিচার কাদেরকে পড়াবে এসব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়, সপ্তাহে কোন দিন কোন বিষয় পড়ানো হবে, কোনদিন বাচ্চাদের গান আর নাচ শেখানো হবে- এসব ব্যাপারে অনেক সিদ্ধান্ত হয়।কিন্তু কিছুদিন পর বেশিরভাগেরই আগ্রহটুকু মিইয়ে আসে।সব প্ল্যান-প্রোগ্রাম ভেস্তে যায়।তবে স্কুলটি একেবারে থেমে যায় না।কারণ, শ্যামলীর মত কেউ কেউ স্কুলটিতে নিয়মিত আসতে থাকে।স্কুলটির মধ্যে, স্কুলটির দুরন্ত সব বাচ্চা-কাচ্চাদের মধ্যে তারা জীবনের নতুন এক মানে খুঁজে পায়।
ইউনিভার্সিটির স্কুলটিতে যে বাচ্চা-কাচ্চারা পড়তে আসে তারা প্রায় সবাই একদমই পিচ্চি।এদের অনেকেই হয়ত এখনও স্কুলে যেতে শুরু করেনি-বেশিরভাগই হয়ত প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে।এদের শিক্ষাজীবনের প্রারম্ভ যে পরিমাণ যত্ন দাবি করে,সে পরিমাণ যত্ন স্বাভাবিকভাবেই এরা এদের পরিবারের কাছ থেকে পায় না।ভার্সিটির স্কুলটিতে যদি যথেষ্ট সংখ্যক শিক্ষকের যোগান থাকত তাহলে এই যত্নের অভাবটুকু হয়ত কিছু পরিমাণে পূরণ করা যেত।কিন্তু শিক্ষকের সংখ্যা যেহেতু প্রায় সময়ই অনিয়মিত এবং অপ্রতুল থাকে-তাই শ্যামলী,সাকিফ,রেণুকা,জুঁই-যারা মোটামুটি নিয়মিত স্কুলটিতে আসার চেষ্টায় করে- তারা এ সময়টুকু যেসব ছেলেমেয়ে পড়াশোনায় আগ্রহী-তাদের পেছনেই দেয়ার চেষ্টা করে।আর বাকিদের থাকে দুষ্টুমির অখণ্ড অবসর।এখানে যেহেতু কাউকেই মার বা বকুনি দেয়া হয় না-তাই বাচ্চাকাচ্চারা সাধ মিটিয়ে দুষ্টুমি করতে পারে।তাই প্রায়ই দেখা যায় একদিকে ক্লাসে পড়ানো হচ্ছে- আর অন্যদিকে হয়ত অন্যরা ছোটাছুটি করে বরফপানি খেলছে-কেউ কেউ হয়ত জানালার গ্রীল বেয়ে উপরে উঠছে- কেউবা টো টো করে সারা বিল্ডিং ঘুরে বেড়াচ্ছে।এগুলো হয়ত কখনও কখনও সমস্যা তৈরি করে-তবু্ও শ্যামলীরা বাচ্চাকাচ্চাদের খুব বেশি শাসনে আগ্রহী হয় না।শিক্ষা ঠিকঠাকমত দিতে না পারুক-বাচ্চাদের আনন্দে যেন কোনো ঘাটতি না পড়ে।
ঠিক এ রকম সময়ে একটি খুব ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে।।ঐ বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন অত্যন্ত স্বনামধন্য ও জনপ্রিয় শিক্ষক ড: মোজাফ্ফর একটি ছোট নোটিশ দেন-
“এই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের একটি অত্যন্ত অমানবিক এবং হৃদয়বিদারক দৃশ্য হচ্ছে- একটি ছোট কিশোর ছেলে একটি রিক্সা টেনে নিয়ে যাচ্ছে আর তার রিক্সায় চড়ে দুই বা তিনজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষ যাচ্ছে।রিক্সা চালানোর মত এত কঠিন পরিশ্রমের একটি পেশা এই কিশোরদের বর্তমান এবং ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।তাই আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের কাছ থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ যা কিনা এই দুর্ভাগা শিশু-কিশোরদের এই কঠিন বাস্তব খেকে মুক্তি দিয়ে একটি বিকাশমান জীবন নিশ্চিত করবে।প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রাথমিক ব্যয় একটি গবেষণা সংস্থার গবেষণা অনুদান থেকে সরবরাহ করা হবে।”
এই নোটিশটি চোখে পড়ার পর শ্যামলী,রেণুকা,সাকিফ আর জুঁই তাদের আরও কয়েকজন সমমনা বন্ধুবান্ধব ও শিক্ষককে সংগে নিয়ে ব্যাপারটি নিয়ে ভাবতে থাকে এবং অনেক খেটেখুটে একটি প্রকল্প প্রস্তাব জমা দেয়।প্রস্তাবটি ড: মোজাফ্ফরের পছন্দ হয়-তখন সকলে মিলে প্রস্তাবটি বাস্তবায়নের জন্য কাজ করতে থাকে।
প্রস্তাবটির মূল বিষয় ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসে একটি সুবিধাজনক জায়গায় একটি মাল্টিডিসিপ্লিনারী সুপারশপ গড়ে তোলা যেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকেরা তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে পারবে।একজন অত্যন্ত দক্ষ এবং খাঁটি লোককে ঐ সুপারশপের ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় এবং এতে ঐ শিশু-কিশোররা ফ্যাসিলিটেটর বা সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করতে শুরু করে।এই সুপারশপে শিশুদের কাজের সময় এমনভাবে নির্ধারণ করা হয় যাতে তারা এর পাশাপাশি তাদের সাধারণ এবং কারিগরি শিক্ষা চালিয়ে যেতে পারে এবং তাদের জীবনের সুস্থ বিকাশ নিশ্চিত হয়। সুপারশপের পরিচালনা পর্ষদ তৈরির জন্য স্বেচ্ছাসেবক আহ্বান করে ড: মোজাফ্ফর পুনরায় একটি নোটিশ দেন।এবার নোটিশটি লিফলেট আকারে ছাত্রছাত্রীদের মাঝে বিলি করা হয়।নির্দিষ্ট দিনে ইন্টারভিউর মাধ্যমে দশজন ছাত্রছাত্রীকে এক সেমিস্টারের জন্য পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হিসেবে মনোনীত করা হয়।পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হন ড: মোজাফ্ফর।সুপারশপের ম্যানেজার পরিচালনা পর্ষদের অন্যতম সদস্য।সুপারশপের পরিচালনার পাশাপাশি শিশু-কিশোরদের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা পরিচালনা পর্ষদের মূল দায়িত্ব।শ্যামলী,সাকিফরাও পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হওয়ায় ভার্সিটি স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রমকে এই শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে সংযুক্ত করে তারা নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করে। এখন মোটামুটি ১০ জন শিক্ষকের সার্বিক উপস্থিতি থাকাতে শিক্ষা কার্যক্রম আগের চেয়ে অনেক সুন্দরভাবে এগিয়ে যায়।
এরপর অনেকদিন কেটে গেছে।শ্যামলীরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে যার যার জীবন নতুন করে শুরু করেছে।শ্যামলীর বিয়ে হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ শিক্ষকের সাথে।সে নিজেও চাকরি নিয়েছে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায়।তার কোল আলো করে ফুটফুটে দুই কন্যা সন্তান এসেছে।তারা বড় হয়েছে- স্কুল-কলেজ পাশ করে এখন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে।একবার কি একটা কাজে শ্যামলী ইউনিভার্সিটিতে তার মেয়ের ক্লাসের বাইরে অপেক্ষা করছে।ক্লাস শেষ করে ম্যাডাম স্টুডেন্টদের ছুটি দিয়ে দিয়েছেন।ওই তো তার বড় মেয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে।
“আপা,কিছু মনে করবেন না-আপনার নাম কি শ্যামলী?”-তরুণ শিক্ষিকা শ্যামলীর সামনে দাঁড়িয়ে তাকে প্রশ্ন করল।
“ম্যাডাম, আপনি আমার মাকে চেনেন”-বিস্মিত বড় মেয়ে,সোমা যার নাম, পাল্টা প্রশ্ন করল।
“কিন্তু আপনি?”-অবাক শ্যামলী অপরাধী স্বরে জিজ্ঞেস করল।
-আপু, আমি আসমা।
-আসমা?
-ঐ যে আপনারা ভার্সিটিতে থাকতে পড়াতেন।
শ্যামলী এবার আসমাকে প্রবলভাবে জড়িয়ে ধরল।আসমা শ্যামলীদের নিয়ে টিচার্স ক্যান্টিনে বসল।জোর করে কত কি যে খাওয়াল।আর কত কত যে গল্প করল।
-জানো আপা,আমিন না এখন সুনামগঞ্জের ডিস্ট্রিক্ট জাজ্
-তাই নাকি?
-হ্যাঁ,কি সুন্দর একটা মেয়েকে যে বিয়ে করেছে।বউ আবার ডাক্তার
-তো তোমার হাসবেন্ড কি করে?
-আরে উনি তো আমাদের মিথুন স্যার- সোমার চটপট উত্তর।
-আমরা ক্লাসমেট ছিলাম-আসমা যোগ করে।
-আপা বাবুনির কথা মনে আছে?
-মনে থাকবে না আবার-আমার ঘাড়ে উঠে বসে থাকত।
-ও এখন তোমাদের ডিপার্টমেন্টে পড়ে-যা স্মার্ট হয়েছে না!এথন যেসব স্টুডেন্টরা বাচ্চাদের পড়ায় ও তাদের লিডার।প্রতিমাসে আমরা সবাই বাচ্চাদের জন্য ওর কাছে টাকা পাঠাই।
-তাই নাকি?খুব ভালো,খুব ভালো বলতে বলতে টুম্পার চোখে জল চলে আসে।সে তার শাড়ির আঁচল দিয়ে চট করে চোখের কোণা মুছে নিতে নিতে জিজ্ঞেস করে-টুম্পার খবর কিছু জানো?
-জানব না কেন-এক এস.পি-এর সাথে বিয়ে হয়েছে-এখন দিনাজপুর থাকে-ওখানকার কলেজে পড়ায়।
-বাহ্, সব্বাই কত ভালো আছে।
-এ সবই হয়েছে আপু তোমাদের জন্য।তোমরা যদি তখন ঐভাবে আমাদের না পড়াতে, আমাদের পড়াশোনার যত্ন না নিতে-তাহলে কি আমরা আজ এখানে আসতে পারতাম-বলতে বলতে কেঁদে ফেলে আসমা।কাঁদতে কাঁদতে বলে-বাংলাদেশের সব ইউনিভার্সিটিতে যদি স্টুডেন্টরা এই কাজ করে তাহলে আরও কত কত আসমা, আমিন আর বাবুনির ভাগ্য বদলাতে পারে বল।তাই আমি সবসময় আমার ক্লাসে তোমাদের কথা বলি-আমি কোন জায়গা থেকে কাদের কারণে উঠে এসেছি সেই কথা বলি-এমনকি আমার বাবা যে একজন রিক্সাওয়ালা ছিলেন সেই কথা বলতেও ভুলি না। যদি আমার কোন ছাত্র বা ছাত্রী আমার গল্প শুনে একটু অনুপ্রাণিত হয়-নিজের জীবনের সামান্য কিছু অংশ অন্য কারও ভালোর জন্য উত্সর্গ করতে উত্সাহী হয়।
------------------------------------------------------
বি:দ্র: ছবিটি উদাসী স্বপ্নের পোস্ট থেকে সংগৃহীত