একটি জাতির বিশেষ জনগোষ্ঠী কে বুদ্ধিজীবী বলা হয় এক কথায় । যারা শিক্ষা-সংস্কৃতি ,বিচার
বুদ্ধি,জ্ঞান ,বিবেক দিয়ে সমাজ পরিবর্তনের ক্ষমতা রাখেন । পৃথিবীতে যত বিপ্লবী/সংস্কারপন্থী অান্দোলন হয়েছে ,সেগুলোর পেছনে পানি ঢেলেছেন; সে সমাজের বুদ্ধিজীবীরা ।রুশো কে ফরাসি বিপ্লবের মূল কারিগর ভাবা হয় । তিনি সক্ষম হয়েছিলেন তাঁর লেখার মাধ্যমে ফরাসি সমাজ পরিবর্তনের বার্তা পৌঁছে দিতে । ভলতেয়ারও যথেষ্ট অবদান রেখেছিলেন।
ছবিতে রুশো
এভাবে সমাজ বা রাষ্ট্রের প্রত্যকটি পরিবর্তন,সংস্কার বা বিপ্লবে বৃদ্ধিজীবীদের অবদান অনস্বীকার্য । আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক মুহূর্তেও একটি বৃহৎ সংখ্যার বৃদ্ধিজীবীরা বেঁজা বিড়ালে ভূমিকা পালন করেছে । এই সংখ্যা এখন ও কোন অংশে কম নয় ।রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের চাপে,লোভে এসব বুদ্ধিজীবীরা বেশ নিষ্ক্রিয় । ট্যাগ পেয়েছেন চাটুকার,সুবিধাবাদী । আপনাদের বর্তমান অবস্থান ইতিহাস তাঁর ঘৃণিত পাতায় স্থান দিবে । একাত্তরে এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী ছিলেন খুব প্রক্রিয়াশীল ও ধর্মান্ধ । তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা কে ঠিক ভাবে মেনে নিতে পারেন নি । এদের মধ্যে কেউ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন ,মৌন সমর্থন বা ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানির মত’ অবস্থান নিয়ে ছিলেন । এখনও সে সবের ডালপালার সংখ্যাই বেশি । সত্যটা তাদের মুখ থেকে উচ্চারণ খুব কম হয় ,পাছে ভয় যে ।
এ রকম পা চাটাদের ইতিহাস নতুন নয় । একাত্তরে এরা বেশ সক্রিয় ছিল । মহান মুক্তিযোদ্ধের অংশ গ্রহণ না করে ,প্রাণের ভয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল । সেখানে কেউ আবার নিজের সুনাম অক্ষুন্ন রাখার জন্য নিজের নতুন নাম -পদবী নিয়েছেন। কলকাতার বুদ্ধিজীবীরা তাদের প্রকাশ্যে লজ্জা দিছেছে তবু তারা লজ্জিত হয় নি । দেশে যুদ্ধ চলছে ,জীবন সংকটাপন্ন ,কই যুদ্ধ করবে বা কোন গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে !সেখানে তারা নিরাপদ আশ্রয়ের খুঁজে । চেষ্টা করেছে বিদেশী ত্রাণে ভাগ বসাতে ,এমন কি বিদেশী সাহায্যে টাকা আত্মসাৎ ও করেছে । ছি ,ধিক্কার জানায় । আমি স্বীকার করছি না যে,সব বুদ্ধিজীবীরা এমন ;সংখ্যায় অল্প হলেও তাদের অবদান জাতি ভুলতে পারবে না; কোন দিন। আইয়ুব শাসনালে অনেক বুদ্ধিজীবীরা বিদেশে সফর করছেন ,নানান বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছে ; সরকারি খরচে নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়ে ।এসব চাটুকার বুদ্ধিজীবীরা আবার পুরষ্ককৃত হয়েছিল পাকিস্তানী সরকার দ্বারা(আদমজী পুরষ্কার ,দাউদ পুরষ্কার ) ।দিল্লি গিয়ে আমিরিকানদের টাকায় ফুর্তি করছেন। যেখানে একজন শিক্ষক সে সময় নুন আনতে পানতা পুরায় অবস্থা; তখন তারা সরকারি বাস ভবনে থাকতো , এক কথায় বিলাসবহুল জীবন । সুবিধাবাদী ,চাটুকার হয়েছিল বলেই সম্ভব হয়েছে । এখন কি এরা লেজ গুটিয়ে নিয়েছে ?
হালের জনপ্রিয় লেখক আহমেদ ছফা সাহেব ও ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল । অবশ্য; তখন তিনি চেষ্টা করেছেন ‘‘জাগ্রত বাংলাদেশ’’ শিরোনামে লেখালেখি করার । জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক স্যার তো মুসলিম লীগের জন্য প্রকাশ্যে গর্ব করতেন ।তিনি অধ্যাপক হেরল্ড লাস্কির ছাত্র ছিলেন (পিএইচডি করার সময়) । মসলিম লীগ করার জন্য ,একটু খুচা দিয়ে কিছু কথা বলেছিলেন,অবাক করার বিষয় জাতীয় অধ্যাপক লাস্কির কথার ডিপেন্স করেছিলেন(বিঃদ্র-তাঁদের মধ্যে ঠিক কি কথা হয়েছিল সে দিন ,সেটা সংরক্ষণে আছে, আমার কাছে ,কিন্তু খোঁজাখুঁজি,সময়ের অভাবে লিখতে পারছি না বলে,ক্ষমাপ্রার্থী প্রিয় সহ ব্লগারবৃন্দ)। ব্যক্তিগত ভাবে আমি এমন দুজন গুণি ব্যক্তির অবস্থান দেখে আমি খুব মর্মাহত। তাঁদের অবস্থান আরও ইতিবাচক হলে ,খুশি হতাম ,জাতি উপকৃত হত । এ রকম উদাহরণের অভাব নেই । সেই পলাশীর মীর জাঁফর যেন মুজিবনগর সরকারের ভিতরে ঢুকে পড়ছিলো ,সে সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করার কৃতত্ব দিতে হবে শহীদ তাজ উদ্দিন আহম্মেদ কে ।
আমি ব্যক্তিগত ভাবে যে কয়টা মুক্তিযোদ্ধ বিষয়ক বই পড়েছি ,সেগুলোর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা এবং তিনি লেখক বা বুদ্ধিজীবী ছিলেন এমন বই পাইনি । পেয়ে থাকলে জানাবেন অবশ্যই । আমরা দেখেছি বিশ্বের বেশ কিছু দেশে বুদ্ধিজীবীদের সরাসরি অংশগ্রহণ করতে । তখন তাদের অভিজ্ঞলব্ধ জ্ঞান দিয়ে লিখেন বিখ্যাত বিখ্যাত বই অথচ আজ পর্যন্তু কেউ বলেতে পারবে না ,মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ আলোড়ন সৃষ্টিকারী বই রচনা হয়েছে ।স্পেনের গৃহযুদ্ধে হাজার হাজার বিদেশী স্বেচ্ছাসেবী যোগ দিয়েছিল । সেসব গুণি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ও শ্রমিক নেতা এটলী ,নোবেল বিজয়ী আর্নেস্ট হেমিংওয়ে অন্যতম । এই গুণি লেখক তার অভিজ্ঞতার আলোকে লিখেছিলেন বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ফর হোম দি বেল টলস’ । আমাদের বুদ্ধিজীবীরা সক্রিয় অবস্থান নিলে আমরাও পেতাম কিছ না কিছু ।
মাঝে দেখতে পাচ্ছেন;নোবেল বিজয়ী লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে কে;স্পেনের গৃহযুদ্ধে ।
মুক্তিযোদ্ধ নিয়ে লিখিত বেশ কিছু বইয়ে গরমিল লক্ষ্য করেছি ,এমন কি সুষ্ঠ গভেষণা সেখানে অনুপস্থিত । তখন তাদের অবস্থান ইতিবাচক হলে কিছূ পেলেও পেতে পারতাম ।
অথচ মুদ্রার উল্টো পিট দেখিয়েছে বেশ কিছূ বিদেশী বুদ্ধিজীবী । লিয়ার লেভিন ;এক সময়কার পৃথিবীর সেরা ১০ জনের একজন বিজ্ঞাপন নির্মাতা ছিলেন । কলকাতায় বিজ্ঞাপনের শুটিং করতে এসে থেকেছেন মাসের পর মাস শরণার্থী শিবিরে ।ক্যামারা বন্ধি করেছেন দারুণ কিছু মুহূর্ত । একাত্তরের ২০ সেপ্টাম্বরে; নয়াদিল্লিতে ‘ আন্তর্জাতিক বুদ্ধিজীবী সম্মেলন’ করা হয়েছিল ।সেখানে ২৪ টি দেশের ১৫০ জন বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশের পক্ষে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালান । মজার ব্যাপার হলো প্রখ্যাত ফরাসি মনীষী আঁন্দ্রে মালরোকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল । তাঁর জবাব টি পড়েই দেখি
‘‘আমার বয়স সত্তরের উর্ধ্বে । এমন সময় যদি প্যারিস থেকে দিল্লি যাওয়ার ধকল সহ্য করার মত সামর্থ্য থাকতো ,তাহলে আমি আরও কিছু দূর এগিয়ে ,অস্ত্র হাতে বাংলাদেশের রণাঙ্গনে ,বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কাঁধ মিলিয়ে পাকিস্থান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই -এ অংশ গ্রহণ করতাম। এতে অনন্ত এই বয়সে একটা নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হতো’’ তিনি আরও অবদান রেখেছেন ;;বাংলাদেশের পক্ষে সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন । কিছু বিদেশী বুদ্ধিজীবীদের উদাহরণ টানলাম,ভিনদেশী হয়ে তাঁদের আমাদের প্রতি সহমর্মিতা দেখে আমি আপ্লুত ।
কিছু পোষা, লেজুড় ও সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে আলোকপাত করা যাক
তখন সিপাহী বিদ্রোহ চরমে । উপমহাদেশের গৌরী শংকর সম্মাদিত ‘‘সংবাদ ভয়ংকর’’ নামক পত্রিকা ইংরেজদের প্রতিরোধের প্রশংসা করে শিরোনাম করে । যখন তিতুমীরের লড়াই ,ওয়াহাবী আন্দোলনে,ফকির বিদ্রোহ,কৃষক বিদ্রোহ ,হাজং বিদ্রোহ সহ বেশ কিছু সাড়া জাগানো আন্দোলনে আমরা বুদ্ধিজীবীদের কোন ভূমিকা খুঁজে পাইনি । সমর্থন পর্যন্ত তাদের নেই । এ প্রসঙ্গে শ্রদ্ধেয় সুপ্রকাশ রায়ের ভারতেই ‘কৃষক বিদ্রোহ’ নামক বই থেকে এই পোস্টের বিষয়বস্তুর সাথে সাদৃশ্য পূর্ণ তথ্য পাই ।
তিনি তাঁর বইয়ে লিখেছেন ‘‘ উনবিংশ শতাব্দিতে যখন বিহার ও বঙ্গদেশের উপর দিয়া কৃষক বিদ্রোহের ঝড় বহিতে ছিল ,তখন এই মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণি গনসংগ্রামের দিক থেকে মুখ ফিরাইয়া ,বিদেশী ইংরেজ প্রভুদের শাসন কে ‘ভগবানের আর্শীবাদ’ রুপ বরণ করিয়া ইংরেজী শিক্ষা দানের ভিত্তিতে নিজেদের নতুন ভাবে গড়িয়া তুলিতে ব্যস্ত হইয়া ছিলেন’’
ভাষা আন্দোলনে আমরা অল্প কিছু বুদ্ধিজীবীদের দেখা পাই । পরেও ছিল ;তবে এঁদের অধিকাংশের মুখ্য পরিচয় ছিল ছাত্র । ভাসানী-মুজিবের নেতৃৃত্বে যে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন হয়েছিল সেখানেও বুদ্ধিজীবীদের অবস্থান ন্যাক্কার জনক । ১৯৬২ সালে যে রক্তাত্ব ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল;সেখানেও বুদ্ধিজীবীরা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত বলে লাব্বায়িক বলেছে ।১৯৬৪ সালে ঢাকা ও খুলনায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় এই সব চেতনা বিক্রির ফেরিওয়ালাদের আমরা পাইনি । বঙ্গবন্ধু বিক্ষুদ্ধ হয়ে প্রেসক্লাবে হাজির হয়েছিলেন ‘পূর্ব পাকিস্থান রুখে দাঁড়াও’ প্রচারপত্র নিয়ে । ছয় দফায় আমরা খুব বেশি সংখ্যক বুদ্ধিজীবীদের পাশে পাইনি । হাতেগনা কয়েকজন ছাড়া । তবে স্রোতের বিপরীতে চলা বুদ্ধিজীবীরা আজ বরণীয় ,স্বরণীয় । তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন শিল্পী জয়নুল আবেদীন,কবি সুফিয়া কামাল,সিকান্দার আবু জাফর, সাংবাদিক জে কে মুস্তাফা,রণেশ দাশগুপ্ত,অধ্যাপক আহমেদ শরীফ,শহীদুল্লাহ্ কায়সার সহ প্রমুখ ব্যক্তিত্ব । মুজিব নগর সরকারের বেশ কিছু বুদ্ধিজীবীরা প্রশংসা করেছেন কিন্তু তারা সরাসরি রণাঙ্গণে অংশগ্রহন করেনি,দেখেনি নরপশুদের হত্যা কাণ্ড,মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখার মত সৌভাগ্য তাদের হয়নি ।
এসব চেতনাধারীরা সরাসরি আন্দোলনে অংশগ্রহন,মিছিলে স্লোগানে আকাশভারী করার প্রয়োজন নেই । তাদের জ্ঞান বুদ্ধি,বিশ্লেষণ,দিক নির্দেশনা,সুচিন্তিত মতামতে যে কোন আন্দোলন বা সংস্কার কে ভিষণভাবে প্রভাবিত করবে । করেছেও ,রুশ বিপ্লব,ফরাসি বিপ্লব,শিল্প বিপ্লবে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা প্রশংনীয় । ন্যায় সত্য কথা বলতে এত দ্বিধা কেন ! আপনাদের কোন বিশেষ পক্ষকে খুশি করার দরকার নেই ;শুধু মাত্র সত্য টা বলুন,চাটুকারীতা আর কত ?
সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে দারুণ একটি কবিতা লিখেছেন ন্যাৎসি বিরোধী কবি মার্টিন নিমোল্যার । কবিতার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য নিখরচা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি গুণি ব্লগার পদ্ম পুকুরের কাছে । তাহলে আসুন কিছু লাইন পড়েই দেখি -
যখন ওরা প্রথমে কমিউনিস্টদের জন্য এসেছিল, আমি কোনো কথা বলিনি,
কারণ আমি কমিউনিস্ট নই।
তারপর যখন ওরা ট্রেড ইউনিয়নের লোকগুলোকে ধরে নিয়ে গেল, আমি নীরব ছিলাম,
কারণ আমি শ্রমিক নই।
তারপর ওরা যখন ফিরে এলো ইহুদিদের গ্যাস চেম্বারে ভরে মারতে,আমি তখনও চুপ করে ছিলাম,
কারণ আমি ইহুদি নই।
আবারও আসল ওরা ক্যাথলিকদের ধরে নিয়ে যেতে,আমি টুঁ শব্দটিও উচ্চারণ করিনি,
কারণ আমি ক্যাথলিক নই।
শেষবার ওরা ফিরে এলো আমাকে ধরে নিয়ে যেতে,
আমার পক্ষে কেউ কোন কথা বলল না, কারণ, কথা বলার মত তখন আর কেউ বেঁচে ছিল না।
কবিতার মত আমাদের চেতনাধারীরা এমন ভাবনায় বিভোর ?
তথ্যসূত্র:গুগল,বিবিসি বাংলা,ইউকি,
মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা-আখতার মকুল,
যদ্যপি আমার গুরু-আহমেদ ছফা,কিছু অনলাইন পত্র পত্রিকা ।
দৃষ্টি আকর্ষণ
সবাইকে ঈদের অগ্রিম শুভেচ্ছা জানাচ্ছি । সবার ঈদ ভাল কাটুক । ত্যাগের মহিমায় শান্তি ভয়ে আসুক আমাদের মাঝে ।
ঈদের ছটির পর আাবার দেখা হবে সবার সাথে সেই প্রত্যাশা । ইনশাআল্লাহ্ ।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ২:১১