অলিম্পাসের ল্যান্ডিং ডকে প্রতিদিনের মত ব্যস্ততা বাড়ছে। চারিদিকের লোক সমাগমে আর বিভিন্ন ধরনের শীপের আসা যাওয়ায় শীপ মেইনটেইনেন্স অফিসারের বাড়তি সময় বের করার ফুরসত নেই। এর মাঝে ভাইসরয়ের বিশেষ দূতকে গোপন মিশনে পাঠাতে হবে। হাপিয়ে উঠল রানা। একটা অত্যাধুনিক শীপ তৈরি করা হচ্ছে ভিআইপির জন্যে।
ভিআইপি লাউঞ্জে বসে আছে জশোনি। অপেক্ষা করছে জেড ক্লাসের শীপটা তৈরি হবার। মাথার ভেতরে হাজারো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে তার। প্রধান চিন্তা হচ্ছে ভাইসরয় তাকে যে মিশনটা দিলেন।
ভাইসরয়ের রেসিডেন্সিয়াল কক্ষ থেকে বের হবার সময় ভ্লাদিমির সিরভ তাকে একটা ব্লু কার্ড দিয়েছেন। তার মত উঠতি এক কাউন্সিলম্যান ব্লু কার্ড পাবে তা বেশিরভাগ মানুষেরও ধারণার বাইরে! ব্লু কার্ড থাকা মানে বিজ্ঞান একাডেমির ভাইসরয়কে রিপ্রেসেন্ট করা। সে উচ্চভিলাষী হলেও এতটা আশা করে নি।
কিন্তু ভাইসরয় তাকে এই কার্ডবলে কর্ণেলিয়াসকে ধরার জন্যে দেয় নি, বরং কাউন্সিলম্যান রাসানকে পাঠিয়েছেন কর্নেলিয়াসকে গ্রেফতার করে আনতে। তাকে ব্লু কার্ড দিয়েছে অন্য এক মিশনের জন্যে।
স্যার কাউন্সিলম্যান, আপনার মহাকাশযান প্রস্তুত! হাপাতে হাপাতে এসে বলল মেইন্টেইনেন্স অফিসার রানা। তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল শীপের কাছে। জ্বলন্ত স্বর্গের সব কো-অর্ডিনেশন শীপে ইনপুট করা আছে। আপনি উঠলেই চলে গন্তব্যের দিকে সেন্ট্রাল কম্পিউটার নিয়ে যাবে। আপনার যাত্রা শুভ হোক, স্যার! হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেল সে।
আড়চোখে ছেলেটাকে একবার দেখল জশোনি, কোথাও কি দেখেছিল তাকে? যাহোক শীপে উঠতেই গন্তব্যের দিকে যাত্রা শুরু করল অত্যাধুনিক মহাকাশযানটা। দেখতে দেখতে জুপিটারের পেছনে অন্ধকারে ঢাকা পরে গেল অলিম্পাস। কিছুক্ষণের মাঝেই হাইপারডাইভ দিয়ে চতুর্থমাত্রায় প্রবেশ করল সে। জ্বলন্ত স্বর্গে পৌছতে আরো বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগবে।
যোগাযোগ মডিউলটার দিকে তাকালো জশোনি, কেন্দ্রিয় কম্পিউটারকে নির্দেশ দিল সংযোগ স্থাপনের জন্যে।
কার সাথে কানেকশন নিতে চান মহামান্য?
মুচকি হাসল জশোনি। নিরিগিস স্টেশন ইনচার্জ কর্নেলিয়াস আহটামাস।
****
নিরিগীস স্টেশনের প্রধান সুপ্রিম কমান্ডার কর্নেলিয়াস আহটামাস তার নির্দিষ্ট কক্ষে বসে আছেন। চোখ তার ইউরোপার ধুসর প্রান্তের দিকে। আজ ইউরোপার পৃষ্ঠ তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে ২১৪ ড্রিগ্রী। তাই মানুষের বদলে কয়েকটি রোবটিক বাহু ইউরোপার পৃষ্ঠ থেকে বরফ কেটে থাকে থাকে সাজিয়ে রাখছে, যথা সময়ে প্রয়োজন অনুসারে বিভিন্ন কন্টেইনারে ভরা হবে। ইউডির গতিপথ দেখে নিলেন একবার তার পারসোনাল কম্পিউটারে। সোলারেক্সের কাছাকাছি পৌছে গেছে সে। বলা চলে সোলারেক্সের ধ্বংসাবশেষের।
লাকি রোটার্ডস! বিড়বিড় করলেন তিনি। এত কষ্ট করে মিশনটা সাজিয়েছিলেন তিনি কিন্তু তার ফলাফল শুন্য। বিশেষ করে লিও… বায়োবট প্রকল্পের কাচামালের প্ল্যানটা বানচাল করে দিল সে সিন্ড্রাতে নামামাত্রই! তাকে এত সহজে ছেড়ে দেওয়া উচিৎ হয় নি! জোর করে ভাবনা সরালেন। তার কিছু করা উচিৎ, এবং সময় থাকতেই।
বিজ্ঞান একাডেমির নিয়োজিত কম্পিউটারটা এসময়ে বিপ করে উঠল, মহামান্য আপনার জন্য একটি বার্তা এসেছে।
কে পাঠিয়েছে? নিরাসক্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
কাউন্সিলম্যান জশোনি, মহামান্য।
সামান্য মাথা কাত করলেন কর্নেলিয়াস, কম্পিউটারটা হলোগ্রাফিক ডিসপ্লেটা অন করে দিল।
কাউন্সিলম্যান জশোনি, মাথা ঝাকালেন কর্নেলিয়াস।
সুপ্রিম কমান্ডার, পালটা মাথা ঝাকালো জশোনি।
কোথাও কি যাচ্ছেন নাকি? হলোগ্রাফিক ডিসপ্লেতে দেখতে পেলেন জশোনি এক মহাকাশযানে।
না তেমন দরকারি কোন কাজে নয়, তবে আপনাকে যা বলতে চাইছি সেটা অবশ্যই অতি জরুরী বিষয়।
বিজ্ঞান একাডেমিতে ভাইসরয় আমাকে ডেকেছিলেন, ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে চলল জশোনি। কাউন্সিল মিটিং ডেকেছেন তিনি। আপনার বিরুদ্ধে গুরুত্বর প্রমাণ আছে তার হাতে… কিছুক্ষণ চুপ থাকল সে।
বলুন, আশ্চর্যরকমের শান্ত কর্নেলিয়াসের গলা।
তো উনি জেনে গেছেন যে জ্বলন্ত স্বর্গে আপনি tx-9 ভাইরাস বানিয়েছেন, সেটা আবার সিন্ড্রা গ্রহে পরীক্ষা করার চেষ্টা করেছেন, সেটা বিফলে যাওয়ার জন্যে লিও ও জিম মিশনের অভিযাত্রিদের নিউট্রালাইজ করতে পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং আপনি বিজ্ঞান একাডেমির প্রোটোকলের বাইরে থেকে অনৈতিক কার্যকলাপ করেই যাচ্ছেন… তাই তিনি আপনাকে গ্রেফতার করে অলিম্পাসে নিয়ে আসার নির্দেশ দিয়েছেন।
তাই আপনি আসছেন শীপে করে আমাকে গ্রেফতার করতে? তাচ্ছিল্য ভঙ্গিতে বললেন কর্নেলিয়াস।
কমান্ডার আপনি আমাকে অবিশ্বাস করলেন! বাহুল্যতা দেখালো জশোনি। আমাদের একটি চুক্তি হয়েছে, আমরা একসাথে কাজ করছি সুপ্রিম কমান্ডার, আমি আপনার শত্রু নই!
তো এখানে কে আসছে।
কাউন্সিলমেন রাসান, বিজ্ঞান একাডেমির নিজেস্ব ফোর্স নিয়ে আসছেন তিনি।
কাউন্সিলম্যান রাসান, মনে করার চেষ্টা করলেন তিনি। এই সেই লোক যে তার ট্রায়ালের সময় সবাইকে তার বিপক্ষে দাড় করিয়েছিল। তার আসার তাহলে যথেষ্ঠ কারণ আছে! হয়তো সে নিজেই এখানে গ্রেফতার করার জন্যে আসছে।
আপনার পরবর্তি পদক্ষেপ কি? জানতে চাইল জশোনি।
মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল কর্নেলিয়াসের মুখে, আপনি অলিম্পাস থেকে দূরে থাকুন কাউন্সিলম্যান জশোনি। যোগাযোগ মডিউলটা বন্ধ করে দিলেন কর্নেলিয়াস।
হাসিতে একান ওকান হয়ে উঠল জশোনির। তার উদ্দেশ্য সার্থক! এখন দুই মহাশক্তিধর মানুষ নিজেদের বিরুদ্ধে মহাজাগতিক আক্রমণ করুক! আপাতত ব্লু কার্ডটার সৎ ব্যবহার করতে হবে।
শীপটার কেন্দ্রিয় কম্পিউটারকে নির্দেশ দিল জ্বলন্ত স্বর্গের দূরত্ব দেখানোর জন্যে।
ওদিকে মুচকি হাসলেন কর্নেলিয়াস। নিজেস্ব কম্পিউটারকে নতুন নির্দেশ দিলেন।
নতুন একটি বার্তা পাঠাও…
কাকে মহামান্য সুপ্রিম কমান্ডার?
হাসি বাড়ল তার মুখে, আনমনে আঙ্গুলের আংটিটা মোচড়াতে মোচড়াতে বললেন, রড্রিক্স।
***
মহামান্য ভাইস চ্যান্সেলর, আপনার জন্যে একটি জরুরী বার্তা আছে। নিজের দফতরে ঢুকতেই তার নিজেস্ব অষ্টম প্রজাতির রোবটটা বলে উঠল।
পৃথিবীর ভাইস চ্যান্সেলর ওরিয়ন মাত্র চ্যান্সেলরের সাথে মিটিং থেকে বের হয়ে নিজের কক্ষে ঢুকেছে। তুষাঢ় শুভ্র আকাশছোয়া ভবনটার সবচেয়ে উচু ফ্লোরে তার প্রশাসনিক কার্যালয়।
কি হয়েছে, হাটতে হাটতেই জিজ্ঞেস করল সে। সামনের বিশাল দরজাটা মৃদু গুঞ্জন করে খুলে যেতে শুরু করল।
অলিম্পাস থেকে ট্রাটো আপনার জন্যে হলো পাঠাচ্ছে, ব্যপারটা নাকি খুবই জরুরী।
অলিম্পাস, ভ্রুকুচকালো ওরিয়ন। চোখ জ্বলে উঠল তার। নিশ্চয় কিছু হয়েছে। স্টেজের উপর বিশালাকার চেয়ারটায় বসে পরল সে। সাথে সাথেই নিজেস্ব কম্পিউটারকে নির্দেশ দিল ট্রাটোর সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্যে।
ট্রাটোর চেহারা সেখানে দেখা গেল পরক্ষণেই। হাটু গেড়ে সম্মান দেখালো দশম প্রজাতির রোবট।
মাস্টার!
চোখে মুখে বিরক্তি নিয়ে তার দিকে তাকালো ওরিয়ন। শেষ পর্যন্ত খবর যা দিয়েছিলে ভাইসরয়ের নিজেস্ব স্কয়ারকে এরিস কন্সটেলেশনে যেতে দেখেছিলে এক ট্রান্সপোর্ট শিপ করে, কিন্তু সে এখনো সেখানে পৌছে নি… ঘোত ঘোত করল সে। চতুর ভাইসরয় কিসের জন্যে সেখানে নিজের স্কয়ারকে পাঠাল, উলটো তাদের ট্রেসও হারিয়ে ফেলেছ তোমরা! রাগের চোটে হাতের বীপারটা আছড়ে ফেলল মাটিতে।
মাস্টার, ওদিকে খবর নেওয়া হচ্ছে। একেবারে শান্ত স্বর মানুষের সমপর্যায়ে ক্ষমতা দেওয়া রোবটটির। কিন্তু এদিকের ঘটনা আরো ভয়াবহ! ভাইসরয়ের স্কয়ার ফ্লেন যাওয়ার পর তার কাজের জন্যে আমাদের এক রোবটকে নিয়োগ করা হয়, সপ্তম শ্রেণীর ড্রয়েড, কিন্তু নেক্সট-জেনের প্রোগ্রাম করা। সে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ কিছু খবর জানিয়েছে মাস্টার। সে দেখেছে মহামান্য ভাইসরয় আর কাউন্সিলম্যান জশোনি গোপনে মিটিং করছেন সুপ্রিম কমান্ডার কর্নেলিয়াস আহটামাসের বিষয়ে। এর মাঝে এক পর্যায়ে তিনি রুমটা এয়ারটাইট করে ফেলায় আর শোনা সম্ভব হয় নি।
হুম বলে যাও… আর কি পেলে? আনমনে আলো নিয়ন্ত্রণের একটা ডায়াল মুচড়ে যাচ্ছে ওরিয়ন।
জশোনি কক্ষ থেকে বের হতেই আমরা জানতে পারি তিনি ভাইসরয়ের নিজেস্ব মিশনে জ্বলন্ত স্বর্গে যাচ্ছেন, বোঝা যাচ্ছে সেখানে কর্নেলিয়াসের বিরুদ্ধে কিছু প্রমাণ আছে তাকে ধরার জন্যে তারা তা ব্যবহার করবেন। ভাইসরয় তাকে একটি ব্লু কার্ড দিয়েছেন যেন ভাইসরয়কে তিনি রিপ্রেজেন্ট করতে পারেন বিজ্ঞান একাডেমির আওতার বাইরের এক গবেষণাগার, জ্বলন্ত স্বর্গের মত যায়গায়।
ব্লু কার্ড! বিড়বিড় করল ওরিয়ন। তারও বহুকালের ইচ্ছা একটা ব্লু কার্ড নিজের জন্যে পাওয়ার। ক্রমেই তার মেজাজ খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছে। পৃথিবীর চ্যান্সেলরের সাথের মিটিংটা মোটেও ফলপ্রসু হয়নি, উলটো তাকে হুমকি দিয়েছেন যে তার সংস্থা নেক্সট-জেন এ নতুন করে তদন্ত শুরু করবেন। এখন দেখা যাচ্ছে অলিম্পাসেও কিছু একটা ঘটে গেছে।
তো কি বলতে চাচ্ছো? খেপা গলায় চেচালো ওরিয়ন। কর্নেলিয়াসকে ধরতে প্রমাণ খুজতে লোক পাঠিয়েছেন ভাইসরয়? পাঠাক না? কর্নেলিয়াস ধরা খেলে আমাদের কি আসে যায়? ওর সাথে কাজ করাটা বিশাল ভুল হয়ে গেছে। কিরু২ রোবট নিয়ে এখন নতুন তদন্ত শুরু হতে যাচ্ছে। বিজ্ঞান একাডেমি তাকে নিয়ে জেলে পুরে রাখুক! তারা আমাদের কথা না জানতে পারলেই হলো!
কিন্তু মহামান্য, কাহিনী এখানেই শেষ নয়! জশোনি জ্বলন্ত স্বর্গের যাত্রাপথেই নিরিগিস স্টেশনের সুপ্রিম কমান্ডারকে হলো প্রেরণ করে সব জানিয়ে দেয়, যে ভাইসরয় তাকে গ্রেফতার করতে আসছে।
বোমা ফাটালো যেন ট্রাটো, মিষ্টি একটা পানীয়তে চুমুক দিচ্ছিল ওরিয়ন কিন্তু তার কথা শুনে গলায় আটকে গেল। কাশতে কাশতে হলোগ্রামটায় ট্রাটোকে ভালো করে দেখল সে।
জশোনি কর্নেলিয়াসকে বলে ফেলেছে যে ভাইসরয় তাকে গ্রেফতার করছে? চোখ চকচক করতে লাগল তার। কিন্তু তাই যদি করে তাহলে সে প্রথমে ভাইসরয়কে কর্নেলিয়াসের বিরুদ্ধে বলতে গেল কেন?
এটা এখনো বোঝা যাচ্ছে না মহামান্য। আমার কপোট্রন এই ডাটা তরঙ্গ বিশ্লেষণ করে ৮৫% নিশ্চয়তার সাথে বলছে যে জশোনি দুই পক্ষের মাঝে যুদ্ধ বাধিয়ে নিজের কোন স্বার্থ উদ্ধার করতে চাইছেন। ভিআইপি ডকের শিপ মেইন্টেইনেন্স অফিসার রানাকে বেশ কিছু ইউনিট খরচ করে জশোনির প্রেরণ করা বার্তাটা আমরা ট্রেস করতে পেরেছি। সে আমাদের জানিয়েছে জশোনি আর কর্নেলিয়াসের কথোপকথন…
তারা কি বলেছে? উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠল ওরিয়ন। কর্নেলিয়াস এখন কি করবে?
কর্নেলিয়াস খুব সম্ভবত বায়োবটদের দিয়ে অলিম্পাস আক্রমণ করে বসবে। আর কর্নেলিয়াস যদি একবার অলিম্পাস দখল করতে পারে…
তাহলে তার কুকীর্তি যারা জানে তাদের পেছনে সে আসবে। ট্রাটোর কথা নিজেই শেষ করে দিল ওরিয়ন। চোখ তার বড় বড় হয়ে গেছে, কপাল বেয়ে ঘামের ফোটা পড়ছে। এরকম কিছু হবে সেটা সে চিন্তা করে নি।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকল ওরিয়ন। তারপর মনে মনে ভাবল, কর্নেলিয়াস মনে হয় জানে না যে তার আরো একটা চাল এখনো বাকি আছে। ক্ররভাবে হাসল সে। মনে মনে স্বীদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে। সবাই যখন বড় ঘুটির খেলোয়াড় হয়ে দাড়িয়েছে, সে কেন শুধু শুধু এখানে একটা দালানের ভেতর বসে তাদের খেলা দেখে যাবে?
আগের পর্ব