প্রত্যেক দিন একই নিয়মে কাটতে থাকে জেমসের। প্রায় কয়েক মাস হয়ে গেল সে এই গ্রহে একা একা থাকে। নিজেকে সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না মেশিনের মাঝে। তার শীতল চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে কেউ আর কথা বলতে এগিয়ে আসে না। ছোট্র কুটিরে তার বিশালাকার হাউন্ডটা নিয়ে থাকে সে।
প্রতিদিনের মত ভোরের মাঝে ঘুম থেকে উঠে গেল জেমস। পাওয়ার চার্জ করে হাউন্ডটাকে নিয়ে বের হল রাস্তায়। ধবধবে সাদা লোমের বিশালাকার হাউন্ড সে। যখন তাকে জেমস বাসায় নিয়ে এসেছিল তখনো এত বড় ছিল না, কিছু দিনের মাঝে প্রকান্ড বড় শিকারীতে পরিণত হয়েছে সে। আশেপাশের লোক ভয়ে পথ ছেড়ে দিচ্ছে তাদের জন্যে।
প্রতিদিনের মত বাজারের দিকে এগুচ্ছে জেমস। পুরোনো ইলেক্ট্রনিক অকেজো পার্টস বস্তায় ভরে কিনে সে। বাসায় এসে সেগুলো ঠিক করার চেষ্টা করে। বেশিরভাগই অকেজো হিটারের কয়েল সার্কিট পায় এর মাঝে। এর মাঝের যেগুলো ঠিক করতে পারে সেগুলো বিক্রি করে বাজারে, এভাবেই চলছে তার এখানকার জীবন।
বাজারের দোকানদার তাকে দেখে একটা বস্তা তাকে ধরিয়ে দিল, বিনিময়ে সে কিছু ইউনিট তাকে দিয়ে বস্তাটা হাউন্ডটার উপর চাপালো। প্রচন্ড ঠান্ডা পরেছে আজকে। বেশিরভাগ মানুষই মোটা উলের ওভারকোট পরে রাস্তায় নেমেছে। ভাবনার সাথে সাথে তার ভেতরে হিটিং চিপগুলো কাজ করা শুরু করে দিল। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই যে তার মাথার ভেতরের চিপটা কত ডেটা প্রসেস করে সিদ্ধান্ত নিয়ে চলেছে।
বাসায় পৌছে দেখতে পেল কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে আছে সামনে। হাতে তাদের ব্লাস্টার। তার জন্যেই অপেক্ষা করছে।
কি চাই? খসখসে গলায় প্রশ্ন করলো জেমস।
এটাতেই তুমি থাকো? ভ্রু কুচকে তাকে প্রশ্ন করলো তাদের এক জন। হাউন্ডটার দিকে তাকিয়ে আছে।
মাথা ঝাকালো সে।
এখানে আর থাকতে পারবে না।
ভ্রু কুচকালো জেমস। অপেক্ষা করছে।
আমাদের এলাকাতে থাকতে হলে আমাদের ফি প্রদান করতে হয়, তুমি জোর করে থাকতে পারো না। এত মাস ধরে ফি না দিয়ে থাকছ এটা চলবে না।
একপলক তাকালো তাদের দিকে, তোমরা অফিশিয়াল?
অফিশিয়াল মানে? রেগে গেল তাদের একজন। আমরা আমরাই! টাকা চাইছি দিবি! নাইলে তোরে পিটিয়ে এলাকা থেকে বের করে দিবো!
হাউন্ডটা আর সহ্য করলো না। প্রচন্ড স্বরে ঘেউ ঘেউ করে লোকটার হাত কামড়ে ধরল, তুষাঢ় সাদা মাটিতে টপটপ করে রক্ত পরতে থাকলো লোকটার। চিৎকার করে সরে গেল। ভয়ঙ্কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হাউন্ডটার দিকে।
তোকে দেখে নেবো আমরা! আঙ্গুল তুলে শাশালো লোকটা। জবাবে আরেক পা বাড়ল হাউন্ডটা। উলটো দিকে দৌড়ে পালালো তারা।
মুচকি হাসলো জেমস। এলাকার গুন্ডা বাহিনীর কেউ হবে। হাউন্ডটার ঘাড় চুলকে দিল সে। তার দিকে ঘেষে এল হাউন্ডটা, মিটমিট করছে তার লাল উজ্জ্বল চোখদুটো।
সার্কিট জোড়া দিতে দিতে সন্ধ্যা প্রায় হতে চললো। সময় যে এত তাড়াতাড়ি চলে গেল টেরও পেল না। অবশ্য তার মাথায় বসানো চিপটা সাথে সাথে চোখের সামনে লেখা প্রকাশ করলো, ৬ ঘণ্টা ৩২ মিনিট ধরে টানা কাজ করে গেছে। যেসব যন্ত্র ঠিক করতে পেরেছে সেগুলো একটা প্যাকেটে ভরে আলাদা করে উঠল জেমস। হাউন্ডটাকে বাসায় রেখে বরফে স্তুপ হওয়া জঙ্গলে চলে আসলো। হীমাংকের অনেক নিচে আজকের তাপমাত্রা। ছুড়ির মত বাতাস তার শরীরে বিধছে। সাধারণ মানুষ হলে শুধুমাত্র একটা জ্যাকেট পরে বেড় হবার কথা চিন্তাও করতে পারতো না। কিন্তু সে সাধারণ মানুষ নয়!
কতক্ষণ বনের মাঝে একা একা হাটছিল বলতে পারবে না। হঠাৎ খশখশ শব্দ শুনে আশেপাশে তাকালো। তার সেন্সরগুলো কাউকে ডিটেক্ট করতে পারলো না।
ভারী অদ্ভূত! অবাক হল সে। তার চোখে বসানো সেন্সর অনেক আগে থেকেই মানুষ বা আশেপাশের কিছু ডিটেক্ট করতে পারে। আবারো শব্দটা শুনতে পেল, আরো জোরে।
এগুতে থাকল জেমস, যেন জানে সে কোথায় যেতে হবে। তার পায়ের সংস্পর্শে পাতলা তুষাড় উড়তে লাগল। শব্দটা আরো জোরে শোনা যাচ্ছে, মৃদু খসখসে শব্দ, কেউ যেন ভারি কিছু টেনে নিয়ে যাচ্ছে বরফের মাঝে দিয়ে।
দূরে অন্ধকারে একটা মানুষের মত অবয়ব দেখতে পেল সে। পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। উচ্চ আলোক সংবেদিত সেন্সর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। শুধু সাধারণ মানুষের চোখে সে দেখতে পেল একটা অবয়ব। আস্তে আস্তে কাছে আসছে সে।
ধীরে ধীরে ঘুরে দাড়ালো লোকটা। তার থেকেও অনেক উচু হবে। ধবধবে সাদা একটা স্যুট তার পরনে। সাদা একটা হেড-ক্যাপ মাথায় দেয়া তার। তুষাড়ের সাদা অবয়বের মাঝে তাকে অপার্থিব লাগছে।
কে তুমি? খসখসে গলায় প্রশ্ন করলো জেমস।
হালকা তার দিকে তাকালো লোকটা। ধুসর চোখদুটো যেন তার ভেতর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে। নিষ্ঠুর আবেগহীন দুটো চোখ।
ঠিকই খুজে পেয়েছো আমাকে তাহলে।
অপেক্ষা করল জেমস। তার মাথায় বসানো স্কেনারগুলো লোকটার কোন অস্তিত্বই পাচ্ছে না। আশেপাশে আড়াই মাইলের মাঝে কেউ নেই।
আমাকে খুজে পাবে না, বিদ্রুপ শোনা গেল লোকটার মুখে। আমি জানি তুমি কে…
তুমি তাহলে রড্রিক্সের লোক? জেমসের গলা আরো চড়া হল।
রড্রিক্স? মৃদু হাসল লোকটা। আমি তোমাকে নিশ্চিত করছি আমি প্রজেক্ট’১২ এর কেউ নই। কোন বায়োবট প্রকল্পের সাথেও আমার কোন সংশ্লিষ্টতা নেই।
তারপরও তুমি জানো আমি কে! তিক্ততা প্রকাশ পেল জেমসের কণ্ঠে।
আমি সবকিছু জানি। দুপাশে হাতগুলো হালকা বাড়ালো লোকটা। সব কিছু, কেউ কোন কিছু লুকাতে পারে না আমার কাছ থেকে।
আমার কাছে কি চাই? আরো চড়ল জেমসের গলা।
কিছু না! হাল্কা স্বরে বলল লোকটা। তার সাদা স্যুটের প্রান্ত বাতাসে হালকা উড়ছে। আমি তোমাকে পথ দেখাতে এসেছি।
মাথার ভেতর চাপা গুঞ্জনটা বাড়ছে জেমসের। বুঝতে পারছে নিয়ন্ত্রণ হারাতে চলছে প্রসেসর। আমাকে পথ দেখাতে হবে না, নিজের ভালো চাইলে আমার পেছনে আর কোনদিন আসবে না। ঘুরে দাড়ালো সে।
সারা জীবন তাহলে এখানেই কাটিয়ে দিবে? অজানা এক গ্রহে? যেখানে তোমার মত হাজার হাজার মানুষকে বায়োবট বানানো হচ্ছে, তুমি চুপচাপ উপেক্ষা করে যাবে?
মাথার ভেতর চাপটা বেড়েই চলেছে তার। মাথা ঝাড়া দিয়ে বলল তুমি বুঝবে না। আমি নিজেকেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না… ভালো কিছু করার চেয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষতিই বেশি হবে। মানুষের আমাকে দরকার নেই!
তোমার বোনেরও কি তোমার দরকার নেই?
শাই করে ঘুরে দাড়ালো জেমস। চোখদুটো টকটকে লাল হয়ে গেছে তার। ব্রেইনের সার্কিটগুলো ওভারফ্লো করছে বুঝতে পারছে সে।
খবরদার! আমার বোনের কথা তুলবে না! নিস্তব্ধ বনের মাঝে বহুদূরে ছড়িয়ে গেল তার কণ্ঠ।
কিন্তু তার যে তোমাকে ভীষণ দরকার! তার শত্রুরা তাকে মারতে যাচ্ছে, কয়েকবার বেচে গেছে, আর কতবার বাচবে? তাকে সাহায্য করবে না তুমি?
আমি চাইনা জেনা আমার এই চেহাড়া দেখুক! খিপ্ত ভঙ্গিতে জবাব দিল জেমস। আমি তার ভালোর চেয়ে ক্ষতিই বেশি করবো…
তাহলে সে মারা গেলে, তার জন্যে দায়ী থাকবে তুমি! সাধারণ গলায় বলে চলল লোকটা।
চুপ করো! প্রচন্ড বেগে হাত চালালো সে, কিন্তু কিছুই মিলল না। তাকিয়ে দেখলো কেউ নেই আশেপাশে, নির্জন বনের মাঝে দূরে কোথাও একটানা নাম না জানা পাখি ডেকে চলছে। কোথাও কেউ নেই।
লোকটা হাওয়া হয়ে গেছে।
*****
বাড়ির পথ ধরেছে জেমস। মাথার ভারভারটা কমে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে মস্তিষ্কে বসানো চিপটা সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে ঠিকভাবে। চোখের রঙও স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। ম্যালফাংশন্ড অপারেটিং সিস্টেম তার মাঝে প্রবেশ করানো হয়েছে, তাই উত্তেজিত মুহূর্তে তার উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে না মাইক্রো চিপগুলো। অবশ্য পুরোপুরি ঠিক সিস্টেম ইন্সটল করলে নিজের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারতো না জেমস। উন্মাদ ডক্টরের উপর প্রচন্ড রাগ অনুভব করলো সে।
রড্রিক্স! হাত মুঠো হয়ে গেল তার।
জেনার কথা মনে পরল তার। তার ছোট্র বোন জেনা! স্পেস রেঞ্জারের চাকরী নেবার পর কত কাদত জেনা! কয়েক মাস পর পর ভাইকে দেখতে পাবে ভাবলেই তার চোখ দিয়ে পানি পড়ত! জেমসেরও অনেক খারাপ লাগত তাকে ছেড়ে থাকতে। এখন মনে হয় সেগুলো যেন অন্য কোন মানুষের কাহিনী, সেতো আর আগের জেমস নেই!
বাসার সামনে আসতেই অস্বাভাবিক কিছু আচ করতে পারল জেমস। কোথাও কোন গন্ডগোল হয়েছে। দৌড়ে বাসায় ঢুকল সে। ছোট্র সে কুটির তার। সবকিছুই ঠিকমত আছে। কিন্তু তার হাউন্ডটা পরে আছে মেঝেতে।
পুরো মেঝেতে রক্তের ছোপছোপ দাগ ছড়িয়ে আছে। হাউন্ডটার সাদা লোম রক্তে লাল হয়ে আছে। ঘাড়ের পাশে তাজা ব্লাস্টারের ক্ষতচিহ্ন…
নিজের উপর আর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারলো না জেমস, মাইক্রোচিপগুলো ওভারফ্লো করলো, তার চোখ টকটকে লাল হয়ে গেল। দরজা খুলেই বেরিয়ে এল সে ঘরটা থেকে। দৃঢ় পায়ে ছুটে চলল জঞ্জালে ঘেরা ছোট আইলে, তাকে বাধা দিতে চাইলো কেউ একজন, শুধু হাতটা নড়ালো জেমস আর ছিটকে পরে গেল সে, মুখ দিয়ে রক্তের ফোয়ারা ছুটছে।
ব্লাস্টার নিয়ে এগিয়ে এল আরো কয়েকজন। কিন্তু একটা রশ্মিও বের হলো না, তার আগেই সবগুলো পরে গেল মেঝেতে, কাতরাতে থাকল ব্যাথায়। কোন পরোয়া করল না জেমস, একে একে সবগুলোকে যতক্ষণ পারলো পিটিয়ে চলল। যখন তার মাইক্রোচিপ গুলো নিয়ন্ত্রণ নিতে পারলো তখন শান্ত হলো সে। কিন্তু ততক্ষণে আর কেউ বেচে রইল না। গ্যাংটার সব সদস্য মরে পরে থাকল মাটিতে।
পেছনে ফিরে তাকালো জেমস। এখানে আর থাকা চলবে না। ফিরে যাবে সে।
শান্তির চেয়ে শাস্তির পথই উত্তম
আগের পর্ব