রাত তিনটা সাত বাজে। মোবাইলের লক বাটনটা চেপে ধরতেই পুরো রুমটা অন্ধকারে ডুবে গেল। ভারী পর্দা দিয়ে ঢাকা জানালার ফাক দিয়ে হালকা চাদের আলো মেঝেতে পড়ছে। শুয়ে শুয়ে মোবাইলটার ডিসপ্লে অন করছি আর অফ করছি।
ঘুম আসছে না। কতক্ষণ ধরে যে এমন করছি জানি না। ইচ্ছে করছে না এই নরম কম্বলের নিচে শুয়ে থাকতে। মাথায় কত চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। বেশিরভাগই এই মেয়েটাকে ঘিরে।
যদি এই মেয়েটাকে বাবা মার কাছে নিয়ে যাই তো কেমন হবে? হেসে ফেললাম সাথে সাথে। এটা কিভাবে হয়? আমি পারব এই কাজ করতে, কিন্তু মেয়েটা কি রাজি হবে? সেও কি একই রকম ভাববে আমাকে? সেও কি ঘুমাতে পারছে না আমার মত?
দীর্ঘশ্বাঃস ফেলে উঠে দাড়ালাম। গোল্লায় যাক ঘুম! জানালার পাশে দাঁড়িয়ে স্লাইড গ্লাসটা খুলে দিলাম। হুহু করে হিমেল বাতাসে রুমটা ভরে গেল। চাদের আলোতে ঘুমন্ত নগরীটাকে দেখতে থাকলাম অপলক। জানালার গ্রীলে মাথা ঠেস দিয়ে একমনে রাতের আকাশটা দেখছি আর চিন্তা করছি। চাদের পাশে দূরে উজ্জ্বল একটা তারা দেখা যাচ্ছে। নিশ্চই সেটা জুপিটার, সৌরজগতের সবচেয়ে বড় গ্রহ। যতই বড় হোক না কেন, এই অসীম আকাশে তাকে তো ঠিকই একটা নিঃস্ব বিন্দুর মতই দেখা যায়… লালচে এক বিন্দু।
আমার হোটেলেই একটা রুম বুক করে দিলাম তাকে। সারাটা সময় মুখ বন্ধ করে রেখেছিল ইপ্সিতা। কেমন যেন ইতস্তত বোধ করছিল। তার হাতে চাবি তুলে দিলাম তখন শুধুমাত্র বলল তুমি কোথায় থাকছো?
উপরের তলার আমার রুম নাম্বারটা বলতে হেসে একটু ঘাড় কাত করে চলে গেল। হঠাত পিছনে তাকিয়ে হাত নাড়ল। আমিও পালটা হাত নাড়লাম, তার হাত নাড়ানোতে সলজ্জ একটা ভাবছিল যা আমার বড় ভালো লাগল।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়াল ছিল না। ঘুম ভাঙ্গল ফোনের রিংটোনে। রাশিকের ফোন। সানন্দে কেটে দিলাম। তাকিয়ে দেখি আকাশ আজ বেশ পরিষ্কার। কোমোল রোদ জানালার ফাক দিয়ে বেড পর্যন্ত চলে এসেছে।
জানালার কাছে এসে দেখি নিচের লনে ইপ্সিতা এদিক সেদিক হাটছে। পেছন থেকে দেখতে খুব সুন্দর লাগছে তাকে। তার কোকড়া চুল ছন্নছাড়া ভাবে ছড়িয়ে আছে তার পিঠের উপর। ঘুমুবার ফলে হয়তো! আদুরে একটা ভঙ্গিতে ঘাসের উপর হেটে যাচ্ছে! হেসে ফেললাম! জোরে ডাকলাম ‘এই মেয়ে!’
চমকে উপরে তাকালো ইপ্সিতা। আমাকে দেখে হেসে হাত নাড়ালো। তুমি দেখি অনেক বেলা করে ঘুমাও!
হ্যা তা বলতে পারো! চোখ ডলতে ডলতে বললাম। তোমার ঘুম কেমন হলো?
ভালো! একদিকে কাত হয়ে ইপ্সিতা বলল। মুখে একটা লাজুক হাসি। একপা এগুলো আমার দিকে।
তুমি নিচে নামবে নাকি এভাবেই কথা বলবে?
ও নিচে নামতে হবে? হেসে বললাম। ঠিক আছে আসছি দাঁড়াও!
খাচ্ছো না কেন? ভ্রু কুচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
এমনি, খেতে ইচ্ছে করছে না। কাটাচামচ প্লেটের মাঝে নাড়াচ্ছে আনমনে।
আবার শুরু হয়েছে না?
কি?
ওই যে, আমার টাকা যাচ্ছে, তোমার কেমন লাগছে ঐ ব্যাপার!
ও!
এজন্য খারাপ লাগছে? কিছু খাচ্ছো না! অবাক আমি!
ইতস্তত ভঙ্গিতে মাথা ঝাকালো ইপ্সিতা। চোখের দিকে তাকাচ্ছে না।
শোন! তুমি এমন করলে আমারই বরং কেমন লাগে বুঝলে! কাটাচামচ দিয়ে ওমলেটটা কেটে মুখে পুরলাম! বাহ এটাতো ভালো হয়েছে! আচ্ছা ইপ্সিতা, তুমি রান্না করতে পারো?
কি? কেনো? অবাক হয়ে তাকালো ইপ্সিতা।
এমনি! কাধ ঝাকালাম। রুটি আর ওমলেট মুখের ভিতরে তাই কথা বলতে পারছি না।
হ্যা মাঝে মাঝে শখ হলে আর কি। হেসে আমার দিকে তাকালো। আমাদের বাসায় একদিন আসবে, তখন রান্না করে খাওয়াবো!
ঠিক আছে! হেসে বললাম।
তুমি কিন্তু কথা লুকিয়েছ আমার কাছে! একপলক তাকিয়ে বলল ইপ্সিতা।
যেমন? চেয়ারে হেলান দিলাম। স্ট্র দিয়ে কমলার জুস আয়েশ করে টানছি।
তুমি বললে বিজনেস করতে এসেছো! কিন্তু একটা কাপড়ও কি আনো নি! সেই ট্রেনে যেই টি শার্ট পরে ছিলে এখনো! মুখ চেপে হাসতে থাকল ইপ্সিতা।
আর কিছু! আমিও হাসলাম।
আর তোমার গ্রামের বাড়ি মোটেও চট্রগ্রামে নয়! হেসে মাথা নাড়ালো সে। অন্তত লোকাল মানুষের ভাষা তোমার কাছে এলিয়েনের ভাষা মনে হয়!
বাহ! সারারাত ধরে এসবই ভেবেছো নাকি!
না! আদুরে গলায় বলল সে।
আমার হচ্ছে এক বিশাল কাহিনী! দীর্ঘশ্বাঃস ফেললাম। অবশ্য এখন তোমাকে বলতে আপত্তি নেই। প্রথম থেকে সব বলে দিলাম। বাবা মা কে বোকা বানিয়ে এখানে পালিয়ে আসা… পুরো ঘটনা।
এই জন্যে পালালে! অবাক ইপ্সিতা।
হ্যা নাতো করতাম কি! গ্রামে চলে যেতাম?
হা সেটাই করতে!
তাহলে তুমি এখানে একা পরে থাকতে! মুখ টিপে হাসলাম। সবকিছুই হয় একটা কারণের জন্যে!
হ্যা তা অবশ্যি… আনমনে বলল ইপ্সিতা। জানালার বাইরে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে।
আজকের প্ল্যান কি? তার দিকে তাকিয়ে বললাম।
আজকে আমি চলে যাচ্ছি। ফিসফিসিয়ে বলল ইপ্সিতা।
প্রচন্ড আঘাত লাগল যেন বুকে। কখনো মনেও হয় নি তার আলাদা কোন দুনিয়া আছে। সে কোন কাজে এসেছে একবারো মনে হয় নি। মনে হয়েছে… মনে হয়েছে…
কি ভাবছো? কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করল সে।
কতক্ষণ যে খালি গ্লাসটার দিকে তাকিয়েছিলাম মনে ছিল না। ঘোর ভাঙ্গল তার কথা শুনে।
তুমি চলে যাচ্ছো? কাষ্ঠ হাসি দিলাম। ঠিক আছে। সেফ জার্নি করো…
হু। আলতো করে মাথা ঝাকালো সে। অন্য দিকে তাকিয়ে আছে।
কখন যাচ্ছো?
বিকেলের দিকে। আগে আপুকে দেখে আসব একবার। আপুর সাথে কথা বলে…
হসপিটাল? আনমনে জিজ্ঞেস করলাম।
না আপু বাসায় চলে গিয়েছে।
At least তোমাকে তার বাসায় দিয়ে আসি… হালকা স্বরে বললাম।
কিছুক্ষণ ভেবে মাথা কাত করল ইপ্সিতা। ঠিক আছে।
খাওয়া আর জমল না। বেড় হয়ে এলাম হোটেল থেকে। ক্যাশ আউট করছি হোটেলের এমন সময় ইপ্সিতা অবাক হয়ে বলল তুমিও কি চলে যাচ্ছো? তোমার রুমটাও দেখি ছেড়ে দিচ্ছো!
হ্যা দিলাম! হালকা স্বরে বললাম আমি।
কোথায় যাবে? হালকা করে বলল ইপ্সিতা। আমার কাছে ঘেষে দাড়ালো। চোখদুটো করুণ করে তাকিয়ে আছে।
জানি না এখনো। কাধ ঝাকালাম। হয়তো কোন দিকে। জোর করে হাসি ফোটালাম মুখে। তুমি রেডি? চলো তোমাকে দিয়ে আসি তাহলে…
গাড়িতে তেমন কথা হচ্ছিল না। ইপ্সিতা কথা জমাতে চাইছিল কিন্তু তেমন জমছিল না। মনটা বড় ফাকা হয়ে যাচ্ছে। এখনো সে পাশে বসে আছে তারপরেও এত খারাপ লাগছে, চলে গেলে কেমন লাগবে? ভাবতে চাইলাম না। শুধু মনে হতে থাকল, সে আমার কেউ নয়… তার চলে যাওয়া আমি থামাতে পারি না…
ইপ্সিতা মাঝে মাঝেই আমার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছিল, বুঝতে চেষ্টা করছিল আমি কি ভাবছি। তার মুখটাও শুকিয়ে গেছে। একবার উদাস হয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। কোন ভাবনায় ডুবে আছে।
কি ভাবছো? হালকা স্বরে জিজ্ঞেস করলাম।
এই তো কিছু না। শুকনো স্বরে জবাব দিল।
এই গলিটাই মনে হচ্ছে। বায়ে টার্ন নিতে নিতে বললাম। এসে গেছি তাহলে…
হুম! গলা ঠিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে সে।
গাড়ি পার্ক করে বেড় হয়ে এলাম। রাস্তার ওপারে অপেক্ষা করছে ইপ্সিতা। হাত ভাজ করে রেখেছে। লাল সাদা ড্রেসে তাকে খুবই মানাচ্ছে। তার চুলগুলো বাতাসে উড়ে মুখে পরছে আর সে বিরক্তির সাথে মাথা ঝাকাচ্ছে… অদ্ভুত সুন্দর সে দৃশ্য!
ভেতরে আসো একবার, চুলে হাত বুলিয়ে হালকা হাসল ইপ্সিতা। আমার বোন খুশি হবে তোমাকে দেখলে।
নাহ থাক! ভদ্রতার ভান করলাম। আমার মত মানুষের দূরে থাকাই ভালো!
কি বলছো! মুখ কালো হয়ে গেল ইপ্সিতার। তুমি আমার জন্যে এত কিছু করলে। তুমি মোটেও দূরের কেউ না। অহত সুরে বলল সে। আপু তোমাকে দেখলে আসলেই খুশি হবে। আমার আপু অন্যরকম ভালো!
হ্যা আমি তা মানা করছি না! হেসে বললাম। কিন্তু আজ থাক… বলতে বলতে কথা আটকে গেল। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। কি বলব বুঝতে পারলাম না।
ঠিক আছে তাহলে। আলতো করে বলল সে। চোখ চিকচিক করছে। ভালো থেকো রাসেল। ঢাকায় গিয়েই…
ইপ্সিতা…
হু? চোখ তুলে তাকালো মেয়েটা।
পকেট থেকে ওয়ালেটটা বেড় করলাম। আমার ভিজিটিং কার্ডটা তার হাতে দিলাম। যদি কখনো… মনে পড়ে… এখানে আমার ফোন ঠিকানা দেয়া আছে।
হাত বাড়িয়ে নিল সে। কিছু বলছে না। মাথা নিচু করে তাকিয়ে আছে মাটির দিকে।
হালকা তার হাতটা ধরলাম। ভালো থেকো মেয়ে! বিদায়…
ঘুরে চলে এলাম… পেছনের দিকে তাকাবার সাহস হলো না। তাহলে হয়তো দেখতাম এই মায়াবিনী হরিণীর চোখ দিয়ে টলটল করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। সে তা মুছবার চেষ্টাও করল না একবার!
আগের পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ১:৪৮