তো… ইপ্সিতার কাছে পরে জানতে পারলাম কি হয়েছিল। রাস্তার মাঝে তার রিক্সা থামিয়ে কিছু ছিন্তাইকারি তার ব্যাগ, ফোন টাকা সবকিছুই নিয়ে গেছে। তাকে তারা টেনে ঝোপের আড়ালে নেবার চেষ্টা করছিল। আমার গাড়ি হঠাৎ আসতে দেখে তাকে ফেলে তারা পালিয়ে গেছে। প্রচন্ড ভয়ে কাপছিল তখন ব্যাচারী। টপ টপ করে চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল তার। আমার খুব খারাপ লাগছিল তার জন্যে। একটা মেয়ে অচেনা শহরে এভাবে এটাকড হলে অবশ্যই আত্মা উড়ে যাবে। খুব রাগ উঠল ছিন্তাইকারিদের উপর। স্টিয়ারিঙ্গের উপর আঙ্গুলগুলো বসে গেল শক্ত হয়ে।
পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত। রাত প্রায় দশটা বাজে। এখনো কিছু ট্যুরিস্টের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। সমুদ্রের তীরে বসে চাদের রূপালী আলোর প্রতিফলন দেখছে বোধহয়। অবিরাম সাগরের শো শো আওয়াজটা কানের মাঝে আর তেমন বাজছে না। বরং ঢেউগুলোর স্রান্তহীন গর্জন আলাদা করে কিছু মনে হচ্ছে না। যেন সবই প্রকৃতির কোন অংশ। সামনের ক্যাম্প ফায়ার দাউ দাউ করে জ্বলছে। মাঝে মাঝে কাঠ থেকে আগুনের ফুলকি আকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছে, মাটিতে নেমে আসার আগেই নিভে যাচ্ছে। আমার চোখ আগুনের স্ফুলিঙ্গের দিকে আটকে রইল! সব কিছু অপার্থিব লাগছে। কিসের মোহে যেন চোখ সরাতেও দিচ্ছে না…
আমি আর ইপ্সিতা পাশাপাশি বসে আছি। হাটু দু হাতে জরিয়ে মাথা কাত করে রেখেছে ইপ্সিতা। মাঝে মাঝে কেপে উঠছে তার পিঠ। একটু আগেও হিস্টেরিয়াগ্রস্থদের মত কাপছিল, এখন অনেকটা কমে এসেছে।
সব ঠিক হয়ে যাবে, আলতো করে বললাম। আর কেদ না!
কিছু বলল না সে। আবার কেপে উঠল।
প্লিজ এমন করো না! তার দিকে ফিরলাম। তোমার এমন দশা দেখে আমার খুব খারাপ লাগছে বুঝছো?
চোখ তুলে তাকালো সে। এখনো লাল হয়ে আছে তার চোখগুলো। কি করবো আমি? তার গলা কেপে উঠল।
ইপ্সিতার মায়াকাড়া সুন্দর মুখটা এখন অনেক করুণ দেখাচ্ছে। চোখগুলোর দিকে তাকিয়ে আমার নিজের মনটাও কেমন করে উঠল। আসতে করে বললাম, আমি তো এখনো আছি তাই না? এত ভয় পেও না।
তো…তোমার ফোনটা একটু দেবে… কাদোকাদো গলায় বলল সে। একটা ফোন করতাম…
সিউর! আর এখন ব্যাটারি ফুল চার্জ দিয়ে এসেছি! হেসে পকেট থেকে ফোনটা বের করলাম। দেখি মাত্র ১৮% চার্জ আছে!!
ধুর ……!
এই প্রথম ইপ্সিতার মুখে হালকা হাসি ফুটে উঠল। ফোনটা নিয়ে ধীর পায়ে উঠে চলে গেল।
আর আমি উঠে দাড়ালাম। দুটো কফি নিয়ে এসে দেখি ইপ্সিতা আগের জায়গায় বসে আছে। কাছে এসে বসলাম। সব ভালো?
মাথা কাত করল সে।
নাও!
থাক…
কি থাক? নাওতো! বলে তার হাতে কাপটা ধরিয়ে দিলাম। তার পাশাপাশি বসে সামনের সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কর্ণফুলীর চ্যানেলে মাঝে জাহাজগুলো ঢুকছে ধীরে ধীরে… দূর থেকে তাদের সাইরেন মাঝে মাঝে ভেসে আসছে। কর্কস গম্ভীর বেদনাময় সে ডাক… ভাবছি, ইপ্সিতার কাছেও কি সব বেদনাময় লাগছে?
ঠিক আছে, একটা প্রস্তাব দেই কেমন? হালকা তার দিকে তাকিয়ে বললাম। সারা রাতই কি বাইরে কাটাবে? চলো কোন হোটেলে তোমার রূম বুক করে দেই।
না! তীব্র গলায় প্রতিবাদ করল ইপ্সিতা। এখনো হাটুতে মাথা দিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে, হালকা আলোয় সাদা ঢেওগুলো ভেঙ্গে পড়ছে বালুতীরে… একদৃষ্টিতে তা দেখছে।
বারে! এখানে থাকবে নাকি সারারাত? শোন তুমি পরে আমাকে টাকা ফেরত দিও, কোন প্রব্লেম নাই…
একবার তাকালো আমার দিকে, কিছু বলল না।
দেখো আমি নিজেও বিশাল এক ঝামেলায় পরেই এখানে আসতে হয়েছে। তাই ভাবলাম তোমার দরকারে হেল্প করি… এখন তুমি যদি না চাও এটা totally understandable.
আমার… গলা পরিষ্কার করে আবার শুরু করল ইপ্সিতা, আমার কেমন লাগছে তোমার কাছ থেকে এভাবে সাহায্য নিতে। করুণ চোখে তাকালো সে।
তার করুণ চোখ দেখে আমার মনও কষ্টে ভরে গেল। আহারে ব্যাচারী। ইচ্ছে করছে তার হাতটা ধরে বলি, আমি তো আছি তোমার পাশে… তোমার কোন ভয় নেই, আমি তোমাকে আগলে রাখব…
চলো, গাড়িতে উঠি। বলে সামনে এগিয়ে চললাম। একটু ইতস্তত করে ইপ্সিতাও আসতে শুরু করল আমার পিছু পিছু…
আচ্ছা তুমি এর মাঝে কোন হোটেল বুক করো নি? সাবধানে একটা বাক পার করতে করতে ইপ্সিতাকে জিজ্ঞেস করলাম।
না। আলতো করে মাথা নাড়ল সে। চিটাগাং এ এসেই হসপিটালে চলে গিয়েছিলাম। ওখানেই ছিলাম সারাক্ষণ। আনমনে একবার তাকালো আমার দিকে। সে বুঝতে পারছে না আমাকে বিশ্বাস করা যায় কি না।
হসপিটাল? একবার মনে করলাম জিজ্ঞেস করবো, তারপর বাদ দিলাম।
হ্যা… একটা নিঃশ্বাস ফেলল সে। আমার বোন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে হসপিটালে ভর্তি হয়েছিল, মা চাচ্ছিল আমি আপুকে দেখে আসি… আপু আসতে যদিও মানা করছিল, সে নাকি ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু তারপরও চলে এলাম… বলতে বলতে থেমে গেল সে। ভাবছে বেশি কথা বলে ফেলল নাকি। হাত দিয়ে চুল ঠিক করল।
তো?
কি?
তোমার বোন কেমন আছে?
হ্যা ভালো আছে এখন। মিষ্টি হাসল সে। ধন্যবাদ তোমাকে। অনেক… তুমি অনেক করছ আমার জন্যে। আসলেই আমি অনেক কৃতজ্ঞ! শেষের দিকে গলাটা একটু ভেঙ্গে গেল তার।
ডোন্ট ওরি, প্রত্তুত্যরে বললাম। দুনিয়ার সবাই তো আর খারাপ না! আমাকে দেখো! হেসে বললাম।
সেও হাসি ফেরত দিল। আসতে আসতে স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। হাতের নখের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবতে থাকল।
রেডিওটা হালকা করে ছেড়ে দিলাম। শুন্যের বেদনা গানটা হালকা বেজে চলল স্পীকারে। আনমনে স্টিয়ারিঙ্গে হাত রেখে ভাবনায় ডুবে গেলাম। কি হচ্ছে আমার সাথে, বাবা মা হঠাৎ মেয়ে দেখার জন্য উঠে পরে লাগল… আর আমি বাড়ি থেকে এতদূর এসে এক মেয়ের সাথে পড়লাম… এবং তার চিন্তা কেন যেন আমার ভাবনা ঘিরে রয়ে গেছে সারাটিক্ষণ। আমি হিসেব মিলাতে পারছিলাম না। উফ মেয়েটা বেশি কিউট! হঠাৎ পাশে তাকিয়ে দেখলাম জড়োসড়ো হয়ে সীটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে ইপ্সিতা। গালে হাত দিয়ে ঘুমুচ্ছে আর তার চুলগুলো বাধনছাড়া হয়ে তার মুখের উপর দিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে।
মৃদু হেসে গানের ভলিউমটা কমিয়ে দিলাম। ব্যাচারী সারা দিন অনেক কষ্ট করেছে, একটু ঘুমাক তাহলে। ডীপার দিয়ে রোডটা দেখে ড্রাইভিং এ মনযোগ দিলাম…
আগের পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ১২:৩৬