চট্রগ্রামগামী শুবর্ণ এক্সপ্রেসের এক শোভন চেয়ারে বসে ঢুলছি আমি। চোখ খোলাই রাখতে পারছি না। ট্রেনের ছন্দময় গতিতে দুলতে দুলতে এই নিয়ে ৩ বারের মতন ঘুমিয়ে পরলাম। এই শীতের সময় ট্রেন ভর্তি ট্যুরিস্ট। কক্সবাজার দেখতে যাচ্ছে বোধহয়। আমিও সেদিকেই যাচ্ছি! তবে আমার ঘটনা সম্পূর্ণ ভিন্ন
ইউনিভার্সিটি থেকে বেড় হয়ে আর বাসায় যাওয়া হল কই! সেখান থেকে সোজা বিমানবন্দর রেলস্টেশন! সকালে যদি ভুলেও বুঝতে পারতাম এমন কিছু ঘটবে… তাহলে… অবশ্য তাহলেও এখানেই পালাতে হত!
হুম ঠিক তাই। বাসা থেকে পালিয়েছি আমি! যে প্যাচে পড়েছি পালানো ছাড়া কোন গতি ছিল না। গত রাত বাসায় গিয়ে শুনি আজ গ্রামে যেতে হবে। তখনো বুঝতে পারি নি! কিন্তু আজ দুপুরে যখন গ্রাম থেকে লোকমান কাকা ফোন দিয়ে সব বলল তখন কাহিনী পরিষ্কার হয়ে গেল চোখের সামনেই! বন্ধু রাশিকের সাথে মিলে এই শর্ট প্ল্যান বানানো। বেচারা এসব কাজে যেন বিরাট পারদর্শি! কথা বার্তায় মনে হয় বাসা থেকে পালানোর কাজই যেন সে প্রায়ই করে থাকে! দুর্ভাগ্য যে সে আসতে পারল না। তাহলে একা একা অজানা শহরে ভবঘুরের মত ঘুরে বেড়াতে হত না!
যাই হোক সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত হতে লাগল। ট্রেনের গতিও বাড়তে লাগল। হিমেল হাওয়ার মাঝে গা কাটা দিয়ে উঠছে! ইউনিভার্সিটি যাব বলে এমন ভারী কিছুও পড়ে আসি নি। ঠান্ডায় যেন জমে যেতে থাকলাম। টি শার্টের হাতা টেনে আঙ্গুলগুলো ঢুকিয়ে কাপতে থাকলাম আর দু দিকের দৃশ্য দেখতে থাকলাম। কালো অন্ধকারে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার পাহাড়গুলো আরো জমাট বাধা কালো দেখাচ্ছে! সত্যিই গ্রামের দৃশ্যগুলো অনেক সুন্দর!
এক্সকিউজ মি! একটা সুরেলা গলার আওয়াজ পেলাম ঘাড়ের পেছনে। তাকিয়ে দেখি এক মেয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। এক হাতে টিকিট আরেক হাতে ধরা ট্রাভেল ব্যাগ। এই সিটটা তো আমার!
মনে মনে গোটা দশেক গালি দিলাম রাশিককে! সে যেভাবে বলল এই সিটে কেউ আসবে না নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে চিটাগাং পৌছে যাবি। শালার স্ট্যান্ডিং টিকিটের ফল!
মুখে হাসি ফুটিয়ে সামনের একটি সিটে বসে পড়লাম। আর মেয়েটা বসল মুখোমুখি হয়ে। তার ট্রাভেল ব্যাগটা নিচে পড়ে রইল! তাই পা লম্বা করে বসতেও পারছি না। এই প্রথম নজর দিলাম মেয়েটার দিকে। সাদা লম্বা জাম্পারে দারুণ মানিয়েছে তাকে। লম্বা চুল, কিছুটা কোকড়া, গোলগাল চেহাড়া… মায়াময় একটা লুক! হঠাৎ চোখাচোখি হতেই অন্যদিক তাকিয়ে রইলাম যেন ট্রেনের ঘোলা হলুদ বাতির চেয়ে ইন্টারেস্টিং আর কিছু হতে পারে না!
এক্সকিউজ মি! আবার বলল মেয়েটি।
আপনি কি চিটাগাং থাকেন?
যদিও আমার গ্রামের বাড়ি বাংলাদেশের অন্য প্রান্তে তবুও বললাম হ্যা চিটাগাঙ্গে আমার দাদার বাড়ি।
সেন্টার পয়েন্ট হসপিটালে কিভাবে যাওয়া যাবে, স্ট্যাশন থেকে…? আমতা আমতা করে বলল সে। কোন কারণে অনেক নার্ভাস! বোধহয় অজানা একটা ছেলেকে ঠিক জিজ্ঞেস করা উচিৎ কিনা বুঝতে পারছে না।
সেন্টার পয়েন্ট হসপিটাল? জীবনে নাম শুনিনি কিন্তু এমন ভাবে বললাম যেন প্রতিদিন ঐ গলিতে ক্রিকেট খেলি আমি। জাস্ট একটা সিএনজি কে জিজ্ঞেস করবেন। এখানের সবাই চেনে সেন্টার পয়েন্ট! কোন চিন্তা নেই!
আপনি কি চিটাগাঙ্গের রেসিডেন্ট…
নাহ কাজে এসেছি… অন্যমনস্ক হয়ে বলল মেয়েটা। আপনি…
আমিও কাজে…
কি কাজ…
মানে… এমন প্রশ্ন করতে পারে ভাবি নি। মুখ ফস্কে বলে ফেলেছে দেখে সেও বিব্রত বোধ করছে। আসল কথা তো বলা যাবে না তাই বললাম এই তো বাবা একটা কাজে পাঠিয়েছেন তার বিজনেস দেখার জন্য!
সে একবার চোখ ঘুরে তাকালো! যেন বিজনেস ট্যুরে কেউ কি ইউনিভার্সিটির ব্যাগ নিয়ে আসে নাকি! আমি অন্য দিকে চোখ ঘুরালাম!
নিজের কথা আপন মনে ভাবছি আমি… সকালেও রোজকারের মতন ভার্সিটিতে যাচ্ছিলাম… আর এখন চিটাগাং… মা বাবা গেছে মেয়ে দেখতে আর আমি যাচ্ছি শুবর্নের শোভন চেয়ারে… সামনে একটা মেয়েকে নিয়ে… টেকনিক্যালি নিয়ে নয়… কিন্তু তাও কেমন যেন!
অজান্তেই হেসে ফেললাম।
হাসি শুনে মেয়েটি তাকালো। চোখাচোখি হতে চোখ নামিয়ে নিল। যেন হাসির হেতু জানতে চাচ্ছিল! কেন জানি তাকানোর ভঙ্গিটা ভালো লাগল আমার। নড়ে চড়ে টি শার্ট টেনে জড়সড় হয়ে বসলাম! গালে হাত দিয়ে বাইরে তাকিয়ে হারিয়ে গেলাম অসংখ্য চিন্তার ভিড়ে…
আপনার ফোনে কি নেট আছে? হঠাৎ জানতে চাইল মেয়েটা। আমার ফোনে তো নেটই নেই!
বুঝতে পারলাম কোন কারণে অনেক টেন্সানে আছে মেয়েটি। তাই কথা বলে দুঃচিন্তাগুলো সরিয়ে রাখতে চাইছে।
কি নেট?
হা আছে নাকি?
কিন্তু আমি… কি করে বলি যে ফোন অফ করে রেখে দিয়েছি! আম… মানে আমার ফোনের চার্জ শেষ আরকি! সরিইই!
ওহ! প্যাকেট থেকে বিস্কুট আর পানি বেড় করল সে। ভদ্রতা বসত আমাকেও দিল। মা যদিও বলে বাইরের কিছু যেন ভুলেও না ছুয়ে দেখি কিন্তু এখানে তো ভদ্রতা দেখানোর সময় নয়!
আমিও ভদ্রতা বসত চা নিলাম…তাকেও দিলাম। খুশি মনেই নিল সে।
তা… আপনার নাম কি যেন?
আমি বলেছি কখনো? মুচকি হেসে বলল সে।
ইয়ে… না মানে…
ইপ্সিতা… হালকা হাসল। আপনি?
রাসেল আহমেদ!
রাসেল… ভালো লাগল কথা বলে আপনার সাথে! একা ট্রেন জার্নি আসলে আমার ভালো লাগে না…
আমারো…
তাই নাকি?
হ্যা… এই অবস্থা হবে কে আর জানত?
কোন অবস্থা?
না… মানে… এই তো… হঠাৎ করেই আসতে হল তাই।
ও আচ্ছা! হাসল সে… আবার ফোনের দিকে তাকিয়ে রইল সে। বুঝতে পারলাম না ফোন করা তার জন্য ইম্পর্টেন্ট কি না।
আপনি… চাইলে আমার ফোন ইউজ করতে পারেন… অসস্থির সাথে বললাম। চার্জ কম তবে ইম্পর্টেন্ট কল হলে দেখতে পারেন… মনে হচ্ছে…
বলে পকেট থেকে ফোনটা বেড় করে অন করে দিলাম। তাকিয়ে দেখি ৭৯% চার্জ আছে! এই প্রথম মেজাজ খারাপ হল সাড়ে তিন হাজার মিলি অ্যাম্পেয়ার ব্যাটারির উপর! এত ব্যাটারি থাকিস কেন? আসলেও স্যামসাং একটা জঘন্য ব্র্যান্ড!!!
কথা শুনে বুঝতে পারলাম কোন হসপিটালে যাচ্ছে বোধহয়। তারও হঠাৎ করেই প্ল্যান করা! এবং সেও চেনে না। বাহ! দুজনের অবস্থাই দেখি একি রকম!
ফোনটাতো সুন্দর! মোবাইলটা ফেরত দিতে দিতে বলল ইপ্সিতা। বুঝতে পারলাম ধরা পড়ে গেছি! কিন্তু ভাব ধরলাম কিছুই বুঝি না!
হা আমার প্রিয়!
মুচকি হাসল সে। আর কিছু বলল না। জানালা দিয়ে রাতের আধার আর ঘন কালো অন্ধকারে ঢাকা সবুজ ধানক্ষেতে ঘুরে বেড়ানো জোনাকি দেখতে লাগল এক মনে। আমিও যোগ দিলাম তার সাথে...