আমার দেশের বাড়ি পাবনা। আমি জানি এটা শুনে আপনার প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে। ঠোঁটে একটি চিকন হাসি ঝুলিয়ে মিটিমিটি আমার দিকে তাকিয়ে প্রফুল্ল মনে সস্তা রসিকতা করবেন, “পাগলা গারদে সিট আছে নাকি?” অথবা সিরিয়াস ভঙ্গিতে জানতে চাইবেন, “হেমায়েতপুর কত দূর আপনাদের গ্রাম থেকে?” আবার কারো মনে প্রশ্ন জাগবে, আমি কখনো মানসিক হাসপাতালে ঘুরতে গিয়েছিলাম কি না! কেউ কেউ আবার অতি আগ্রহে, প্রফুল্ল চিত্তে বর্ণনা করবেন; তিনি কবে পাগলাগারদে গিয়ে কত রকম পাগল দেখেছেন, কে কেমন করে কথা বলেছে, কে কেমন অঙ্গভঙ্গি করেছে, কাকে দেখে তার ভয় লেগেছে, কাকে দেখে আমোদ পেয়েছেন ইত্যাদি। বাড়ির এত কাছে থাকা স্বত্তেও কেন সেখানে ঘুরতে না গিয়ে রসাত্মক বর্ণনা থেকে আপনাদের বঞ্চিত করেছি এ জন্যে অনেকেই বিরক্তি প্রকাশ করবেন। আপনাদের জন্যেই আমার এ লেখা।
আপনি কখনও ঢামেকের বার্ন ইউনিটে গিয়েছেন? কখনও ৮০% পুড়ে যাওয়া মানুষের চামড়া এবং মাংস দেখেছেন? আমি দেখিনি। কখনও পয়জন ওয়ার্ডে গিয়ে স্টোমাক ওয়াশ করা দেখেছেন? দেখেছেন কি বিষে নীল হয়ে যাওয়া মানুষের আতঙ্কিত দুটি চোখ এবং মুখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া ফেনার প্রবাহ? দেখেননি? আমিও দেখিনি। তাহলে চলুন না একদিন সময় করে দেখে আসা যাক! একটা বিকেল ঢামেকে গিয়ে পোড়া-পচা-আধমরা-রক্তাক্ত মানুষ দেখে চমৎকার বিনোদন হবে। আমরা তাদের সাথে কথা বলবো, ঠাট্টা তামাশা করবো, চোখ ভরে দেখবো যন্ত্রণা, মন ভরে হাসবো, সেলফি তুলে ফেসবুকে আপলোড করবো! দারুণ না প্ল্যানটা?
আমি জানি আমার এমন প্রস্তাব শুনে যে কোন বিবেকবান মানুষ আহত হবেন। অসুস্থ মানুষের ভোগান্তি উপভোগ করার ঘৃণ্য বাসনাকে কড়া ভাষায় তিরস্কার করবেন। অভিসম্পাত করবেন এই বলে যে এই কদর্য চিন্তার পরিপ্রেক্ষিতে আমিও একদিন অসুস্থ এবং মরণাপন্ন হব এবং সবার করুণার পাত্র হয়ে থাকবো। আপনাদের এ ধরণের মনোভাব আমাকে খুব বিস্মিত করবে। আমি বুঝেই উঠতে পারবো না সামান্য একটা সান্ধ্যকালীন বিনোদনের প্রস্তাবকে এভাবে এত সিরিয়াসলি নিয়ে কেন আমাকে দোষারোপ করছেন। তখন আমি যুক্তি হিসেবে দেখাবো যে মেন্টাল হসপিটালে যদি দল বেঁধে পিকনিক করার মুডে আনন্দ নেয়ার জন্যে যাওয়া যায়, তাহলে বার্ন ইউনিটে গিয়ে একই রকম মজা কেন নেয়া যাবে না! আমার যুক্তির অসারতা দেখে আপনারা হতাশ হবেন। বলবেন যে, বিভৎসভাবে আহত হওয়া ব্যক্তিগুলো অসুস্থ, আর পাবনা মেন্টাল হসপিটালের বাসিন্দারা তো পাগল! কিসের সাথে কিসের তুলনা করছি আমি! এ অবস্থায় গলা চড়িয়ে বলতে গিয়ে আপনাদের রক্তচাপ বেড়ে যাবে, গলার রগ ফুলে উঠবে। এক গ্লাস পানির প্রয়োজন হবে খুব। তখন আমি আপনাদের খুব মজার একটা গল্প শোনাবো। গল্প শুনতে কে না ভালোবাসে! সুতরাং, গ্যাঁট হয়ে বসুন।
আমার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, খুব মেধাবী ছিলেন। পড়ালেখা করতেন একটি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সবকিছু খুব ভালোভাবেই চলছিলো। হঠাৎ ভয়াল এক ঘটনা ঘটলো। তার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং রুমমেট খুন হয়ে গেলো। তিনিও খুন হতে পারতেন, ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। এই ঘটনার পর তার মানসিক ভারসাম্য ভীষণ নাড়া খেলো। তিনি প্রায়ই অযথাই সবাইকে গালাগালি করতেন, মারতে যেতেন, অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতেন। ধীরে ধীরে তার অবস্থার অবনতি হতে লাগলো। পরিণত হলেন মানসিক রোগীতে, আপনারা সোহাগ করে যার নাম দিয়েছেন ‘পাগল’। তার জীবন, প্রেম, মেধা, শিক্ষা, উদ্যম সব শেষ হয়ে গেলো নিমিষেই। এক সময়কার ভীষণ তরতাজা সেই মানুষটি গত দুই যুগ ধরে চিকিৎসার অধীনে আছেন। তার মাঝে এখন আর কোন চাঞ্চল্য নেই, সৃজনী শক্তি নেই, চিন্তা-ভাবনা করার ক্ষমতা নেই। তিনি একজন ‘পাগল’। এই পাগলদের দেখতেই আপনারা পাবনা মেন্টাল হসপিটালে যান। আমোদ লাভ করেন। এই অভিজ্ঞতা বয়ান করে আড্ডার শিরোমনি হন। তাহলে আমি যদি মরা-ধরা-পোড়া রোগী দেখে এসে উচ্ছসিত হয়ে আমার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করি, তাহলে আপনারা ক্ষেপে যান কেন?
দাঁড়ান, আমাকে বলতে দিন। মেন্টাল হসপিটাল কোন দর্শনীয় জায়গা না। এটি একটি চিকিৎসালয়। এখানে যারা থাকেন, তারা সবাই অসুস্থ। কেউ খুব বেশি, কেউ কম। এখানে তারা দিনের পর দিন এক ভয়াবহ নিরানন্দ জীবন যাপন করছেন। তাদের অনেকেই আত্মীয় পরিজন দ্বারা প্রত্যাখ্যাত, ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত। আপনারা তাদের ট্রিট করেন চিড়িয়াখানার পশু-পাখিদের মত। ভুলে যান কী অসম্ভব ট্রমার মধ্যে দিয়ে গেলে একজন মানুষের টোটাল মেন্টাল কলাপস হয়। কতটা আঘাত পেলে একজন মানুষ ‘পাগল’ হয়ে যায়।
মানসিক আঘাত বাইরে থেকে দেখা যায় না। তাই বলে এর ভয়াবহতা কোন অংশেই কম নয়। এই যে আপনি হাসছেন, খেলছেন, ভাবছেন, পড়ছেন, লিখছেন; আপনার ব্যক্তিত্বকে উদ্ভাসিত করছেন, যদি কখনও আপনার অতি প্রিয় মানুষটি চলে যায়, অথবা চোখের সামনে যদি কোন ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে দেখেন, হয়তোবা তখন থেকে আপনি হাসবেন বিকারগ্রস্তের মত, কাঁদবেন অকারণে, ভাবতে গেলে মাথা আউলে যাবে, পড়ার নেশা উবে যাবে, তখন যদি এই দুরবস্থায় আগ্রহী হয়ে আমরা দল বেঁধে আপনাকে দেখতে এসে বিমলানন্দ লাভ করি, কেমন হবে ব্যাপারটা? অবশ্য তখন আপনার ভালো-মন্দ বোধটাও কাজ করবে না। আপনি অক্লেশে আমাদের বিনোদন দিয়ে যাবেন।
সে অবস্থায় উপনীত হবার আগে, চলুন না একদিন দল বেঁধে সবাই পাবনা মেন্টাল হসপিটালে পিকনিক করতে যাই!
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মার্চ, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৩১