ছুটির দিনে আরাম করে ঘুমাচ্ছিলাম। একটা অচেনা নম্বর থেকে বার কয়েক ফোন আসলো। কিছুটা বিরক্তি নিয়ে ফোন ধরলাম, ওপাশ থেকে কুহক ভাই জানালেন আমার গল্পগ্রন্থ "আনন্দভ্রম" মেলায় এসেছে। শুনে বেশ আনন্দ পেলাম (আবার এটাও ভাবলাম, এ ভ্রম নয় তো!)। অনুপ্রাণন প্রকাশনকে অনেক ধন্যবাদ দেরী করে যোগাযোগ করার পরেও যথাসময়ে বইটি প্রকাশ করতে পারার জন্যে। বইটি পাওয়া যাচ্ছে লিটল ম্যাগ চত্বরের অনুপ্রাণনের স্টলে (৩৫) এবং স্টল নং ২৬৮ তে। আজ তো আরা মেলায় যাওয়া হচ্ছে না, কাল যচ্ছি দলবলসহ, মানে আমার স্ত্রী তিথি,এবং কন্যা ও পুত্র মিতিন এবং রুহিনকে নিয়ে। আনুষ্ঠানিকভাবে মোড়ক উন্মোচন মনে হয় হবে না। যদি হয় ও, সেটা করবেন আমার পুত্র-কন্যা দ্বয়।
কখনও কোথাও প্রকাশ না হওয়া এবং ব্লগে পূর্বে প্রকাশিত মোট ১৭টি গল্প থাকছে। সবাইকে আমন্ত্রণ জানাই আমার এই অনুর্ধ-১৮(যেহেতু ১৭টি গল্প) বইটিকে প্রাপ্তবয়স্ক অর্থাৎ ১৮+ করে তুলবেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আমার এক বন্ধু রিভিউ লিখেছেন। সেটা এখানে সংযুক্ত করলাম।
বুক রিভিউ জীবনে লিখেছি মাত্র দুটা। দুটাই পছন্দের এক মানুষের জন্য। এর বাইরে বুক রিভিউতে বিশেষ আগ্রহ ছিল না কখনই, মাঝে মাঝে পড়তে ভালোলাগে। রিভিউ পড়ে অন্যের পঠন অভিজ্ঞতার সাথে নিজেরটা মিলিয়ে নেয়া, এর বাইরে কিছু নয়…
বুক রিভিউর স্পেসিফিক কোন ফরম্যাট আছে নাকি তাও জানি না। এটাকে রিভিউও বলছি না। অভিজ্ঞতা শেয়ার করবার মত কিছু একটা হবে। থাকবে কিছু সরাসরি না বলা কথা।
গল্পকার হিসেবে হাসান মাহবুব বেশ জনপ্রিয় এই ব্লগে। ব্লগের বাইরে পরিচিতি কেমন তা ঠিক জানি না। আর প্রথমেই বলে নেই গল্পের জন্য হাসান মাহবুবের বেছে নেয়া কিংবা ট্রেডমার্ক ধারাটা আমার ঠিক পছন্দও না। জীবনের অন্ধকার দিক, প্রতিটা মানুষের ভেতরের অবদমিত ইচ্ছাগুলো উনাকে বেশি টানে। এই দিকগুলো ফুটিয়ে তুলতেও উনি বেশ পারদর্শী। এক ধরণের অলস সাবলীলতাও কাজ করে উনার এ ব্যাপারে। এ বইটার বাকী গল্পগুলো পড়ার ব্যাপারেও আমার তেমন আগ্রহ ছিল না। আগ্রহের প্রধান কারণ এই বইয়ের শিরোণাম এর গল্পটা, “আনন্দভ্রম”! প্রতিটা মানুষ জন্মের পর যখন বুঝতে শেখে, তখন থেকেই সত্যি সত্যি মানুষের আনন্দভ্রমের সূচনা হয়। পুরো জীবনটাই কেটে যায় আনন্দভ্রমে। এই গল্পে ঠিক কি আছে সেটা জানবার একটা আগ্রহ ছিল।
যাইহোক, এই বইটার তিনটা কপি এখন আমার হাতে। একটা নিজে সংগ্রহ করেছি। বাকী দুটো অন্যভাবে হাতে চলে আসে। মাসের শুরুতেই দুজন আমাকে জিজ্ঞেস করে আমার কি কি বই কেনার ইচ্ছা আছে বইমেলা থেকে। আমি প্রায় ৮-১০ টা বইয়ের একটা লিস্ট বলি। ওরা প্রায় সবগুলোই জন্মদিনের উপহার হিসেবে হাজির করেছে। যদিও প্রথম কপিটা নিজেই সংগ্রহ করে ফেলেছিলাম। একটা আমার বোন দিয়েছে আর আরেকটা আমার সবচেয়ে ভালো বান্ধবী যার সাথে ছোটবেলায় যে দ্বিমুখী ভালোলাগার টান ছিল কেউ বুঝিনি। প্রায় একযুগ পর গল্পে গল্পে দুজনেই স্বীকার করি কিছু একটা সত্যি ছিল। এ এক অন্য ধরণের অনুভূতি। বন্ধুত্বটা এখনো আছে, ভালোলাগাও আছে, সেগুলো তো আর ছুড়ে ফেলা যায় না। আর এতো বছর পরেও যে কেবল একটা মুখের কথায় বইমেলায় চলে গিয়ে বই খুঁজে নিয়ে আসছে, এটাও তো সেই সম্পর্ক কিংবা বোধের মায়ার কারণে। মানবিক সম্পর্কের আসল ব্যাপার স্যাপারগুলো এই সামান্য বিষয়গুলোতেই। মানবিক সম্পর্কগুলো দেনা পাওনা, স্বার্থের হিসেবের অনেক বাইরের হয়। আনন্দভ্রম সংগ্রহ করতে গিয়েও তেমন আনন্দভ্রমের মধ্যে দিয়েই গিয়েছি…
আনন্দভ্রম কিনতে গিয়ে আমার বান্ধবী তার অভিজ্ঞতার কথাও বলে আমাকে। আমার কাছে ইন্টারেস্টিং লাগছিলো শুনতে। বইটা সংগ্রহের সময় নাকি “আনন্দভ্রমের” লেখক তাকে জিজ্ঞেস করেছিল কেন সে বইটা কিনছে। তার উত্তর ছিল সম্ভবত, “এমনি”। এরপরেও নাকি কয়েকজন জিজ্ঞেস করেছিলো কেন কিনছে। তার উত্তর ছিল, “বই নিলে কি বলতে হবে কেন নেই?”। আমার নিজেরও কিছু অভিজ্ঞতা এমন, আমার বোনেরও তাই।
এ তুচ্ছ ঘটনাটা বলা অন্য কারণে। এ থেকে আমার ব্লগ থেকে উঠে আসা লেখকদের সম্পর্কে একটা ধারণার কথা বলতে চাই। আমার মনে হয় ব্লগাররা বই প্রকাশের পর কেউ নিজের বই সংগ্রহ করতে দেখলে প্রথমেই ধরে নেয় ব্লগেরই কেউ হবে। তার পরিচয় জানতে চায়। পরিচয় জানতে পেলে আপ্লুত হয়। ব্লগের রেশারেশি মুহূর্তে ভুলে গিয়ে শুরু হয় নতুন উষ্ণ সম্পর্কের। নোমান নমির প্রথম বই সংগ্রহের সময়ও আমার একইরকম অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সে অভিজ্ঞতা যেমনই হোক, ব্লগের কল্যাণে এমন বেশ কয়েকজন লেখক উঠে আসছে যাদের সম্ভাবনা অনেক, প্রমানও করেছে নিজেদের। সেটা এই আনন্দভ্রমের লেখকই হোক, অথবা নোমান কিংবা গভঃ ল্যাবের সেই জিকো। স্কুল কলেজের দিনগুলোতে কে জানতো জিকো একদিন জিকসেস হয়ে যাবে? যদিও তখন থেকেই জিকোর সেন্স অফ হিউমার এবং অন্যান্য বোধ অসাধারণ ছিল, তবে সেগুলোর পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটিয়েছে ব্লগ...
এবার আসি “আনন্দভ্রম” সংক্রান্ত কথায়। প্রথম ধরে আমার বইটাকে অল্প ঢিলেঢালা মনে হয়েছে। প্রচ্ছদ ভালো লেগেছে। কিন্তু বাধাই কেমন যেন মসৃণ নয়, ছাপার অক্ষরগুলো আরেকটু গভীর কালো হলে আর অল্প একটু পুরু হলে আমার মত দুর্বল চোখের মানুষেরা আমারে পড়তে পারতো। প্রথমেই পড়ি ভুমিকার কথাগুলো। সেখানে প্যারার মাঝে কোন গ্যাপ নেই। প্যারাগুলো একটু আলগা হলে ভাল হত। পুরো বইয়েই কিছু প্যারা জড়ালাগা অবস্থায় থাকাটা পাঠের সাবলীল আনন্দ কিছুটা হলেও নষ্ট করেছে। গল্পক্রমটাও তাড়াহুড়ায় দায়সারা ভাবে করা বলে মনে হয়েছে। প্রকাশনার ব্যাপারে পর্যবেক্ষণ এটুকুই।
এই বইয়ে মোট গল্প আছে ১৫টি। একে একে সবগুলো নিয়েই বলার ইচ্ছা আছে। যদিও গল্পকার গতমাসে সম্ভবত বলেছিলেন মোট গল্প দিয়েছিলেন ১৭টি। এর মধ্যে দুটা বাদ দিয়েছে না জানিয়েই, একটা নাকি ছিলো একুশ নিয়ে, গল্পকারের খুব প্রিয় একটা লেখা ছিল সেটা। বাদ দেয়ার তালিকায় সেটাও পরে গেছে। এ ব্যাপারে আমি বলবো, শিট হ্যাপেন্স। এটাও একটা অভিজ্ঞতা, পরবতীতে গল্প কিংবা লেখা দেবার সময় এগুলো সম্পর্কে বিশেষ ইন্সট্রাকশন আগে থেকেই দিয়ে রাখলে ভাল হবে সবার জন্যই।
প্রথম গল্পঃ শিহাব এর পকেট
পড়তে পড়তে শিহাবের প্রতি বিরক্ত হয়েছি। কেন যে খুলে দেখছে না। এই বিরক্তিটাই হয়তো গল্পের সাফল্য অথবা ব্যর্থতা, সেটা পাঠকই ঠিক করবে। তবে শেষটা আমি ভাবিনি, আনএক্সপেক্টেড কিছু ভাবছিলাম, কিন্তু পরিণতি তেমন হবে ভাবিনি।
দ্বিতীয় গল্পঃ আনন্দভ্রম
গল্পটা আমি বুঝিনি। কিন্তু ব্যক্তিগত কারণে পড়তে ভালো লেগেছে। পরে লেখককে জিজ্ঞেস করে কাহিনীর কিছুটা ধারণা পাই। আর এই গল্পের শিরোণামটা অন্যতম প্রধান একটা কারণ এই রিভিউ লিখবার। আনন্দভ্রম একটা সাধারণ শব্দ, একটা শব্দের মধ্যেই লুকোনো অনেক বড় একটা গল্প। এটা পড়ে তাৎক্ষণিক একটা কবিতাও লিখে ফেই এই একটামাত্র শব্দকে পুজি করে। এটাই এই গল্পগ্রন্থ থেকে মূল প্রাপ্তি আমার জন্য।
তৃতীয় গল্পঃ আপনাদের কাছে কি চাবুক আছে?
বেশ ভালো লেগেছে। অন্ধকারের বাইরেও কোথাও না কোথাও এটা আলোর গল্প, মায়ার গল্পও।
চতুর্থ গল্পঃ আশ্চর্য হাস্যদৃশ্য
স্যাটায়ার এটাকেই বলে নাকি জানি না। তবে প্লট হিসেবে চমৎকার। ভাবনাগুলো দারুন ছিল। গল্প হিসেবে মোটামুটি লেগেছে।
পঞ্চম গল্পঃ এক পাতা সিভিট
এটাও আসলে মানুষের চরিত্রের একটা বিশেষ দিকের কথা বলে। একটা বিশেষ অনুভূতির কথা বলে। আমরা তাকে মায়া নাম দেই, তার উৎপত্তি ঠিক কোন কারণে হয় আমরা কেউ জানি না। গল্পটার শেষটা আমার বিশেষ ভালোলেগেছে...
ষষ্ঠ গল্পঃ গল্প যদি শুনতে চাও আমার কাছে এসো
ব্লগাররা ভালো উপলব্ধি করবেন। তবে সাধারণের জন্য আমার কাছে ছুঁয়ে যাওয়ার মত কিছু মনে হয়নি।
সপ্তম গল্পঃ মীরার গভির গোপন
ভালো গল্প। বিশেষ কিছু যদিও বলার নেই।
অষ্টম গল্পঃ নিখিল বাংলাদেশ সাইকো সমিতি
বেশ ভালো। গণমাধ্যম এবং সংবাদ সচেতন পাঠক মাত্রই আরো বেশ কিছু ব্যাপার উপভোগ করবেন। এই যেমন, সুন্নী মাহার ব্যাপারটা। এর বাইরে চরিত্রগুলোর কাজকারবার আমাদের সাধারোন মানুষের চিন্তার সাথেও মিলে যেতে পারে। এক অর্থে আমরা সকলেই তো হালকা অথবা অস্ফুট সাইকো। কেউ একটা মশাকে এক থাপ্পরে মারবে, কেউ ধরতে পারলে একটা একটা পাখনা আর হাত পা ছিড়ে অথবা কয়েলের আগুনে পুড়িয়ে মারবে। এই দুনিয়ায় কে অল্প হলেও সাইকো নয়? গল্পটা আমাদের কথাই বলে, অন্যভাবে...
নবম গল্পঃ অচিন পাখির ডাক
এই গল্পটা আমার বিশেষ পছন্দ হয়নি। গল্পের চেয়ে প্রেক্ষাপট বেশি মনে হয়েছে। অন্য পাঠকের অন্যরকম মনে হতেও পারে।
দশম গল্পঃ অনেক বিল উঠে গেছে
দারুন একটা গল্প।
গল্প এগার-পনেরোঃ
শুণ্যমাত্রিক আর সারপ্রাইজ আমার কাছে বেশ ভালো লেগেছে। রিভিউ বড় হয়ে যাচ্ছে দেখে বাকীগুলো নাই বলি।
সবশেষে একটা কথাই বলবো বইয়ের তেমন কোন গল্প নেই যেটাকে মাস্টারপিস বলবো অথবা অভিভুত হয়ে যাচ্ছিলাম পড়তে গিয়ে। তবে বেশকিছু গল্প আছে, যা মনে থাকবে। অন্তত আনন্দভ্রম্ নামটা মনে থাকবে। আর সেই গল্পটা এখনো পুরোপুরি না বুঝে উঠতে পারলেও চরিত্র আর বিশেষ কিছু দৃশ্যপট মনে থাকবে। যেমন থাকবে আরো কিছু গল্পেরও। হয়তো বহুদিন পর আবার পড়তে বসলে আবার মনে পরবে, ভাববো, “আরে, এই গল্পটা তো আমি জানি।“ ভেতরে থেকে যাবে।
আর এখানেই গল্পগ্রন্থ হিসেবে আনন্দভ্রমের সার্থকতা কিংবা ব্যর্থতা। ছোটগল্প তো এমন বোধই দেয়। আশা করবো একদিন গল্পকার হাসান মাহবুব উপন্যাসেও হাত দেবেন গভীর মমতা নিয়ে। উনার হাত দিয়ে অথবা কিবোর্ডে আঙ্গুল চালনায় লেখা হবে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কোন সাহিত্যকর্মের। এমন কোন উপন্যাসের, যা জীবনের চরম অন্ধকার, সবচেয়ে উজ্জ্বলতম দিক এবং মানব জীবনের সুক্ষ সুক্ষ তুচ্ছ তুচ্ছ কিন্তু অনন্য কিছু ব্যাপার গল্পের ছলে তুলে এনে পাঠকের মাথায় গেঁথে দেবেন। সেইদিন হয়তো আমি কাউকে না কাউকে গল্পচ্ছলে আবার বলবো, “আমি উনার বইয়ের প্রথম পুর্ণাঙ্গ রিভিউ কিংবা সমালোচনা লিখেছিলাম।“ অথবা বছর পাচেক পর কোন আড্ডায় আমার এই স্মৃতিচারণ হবে ব্লগে উনার সাথে ভয়াবহ নানা ক্যাচালের স্মৃতিচারণের বাইরে। তখন হাসতে হাসতে ভুলে যাবো ব্লগ শত্রু হাসান মাহবুবকে, বাস্তবের সাদাসিধা হাসান মাহবুবকে চিনবো বলে...
আনন্দভ্রম পাঠ আনন্দময় হোক!
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ৯:৪৮