*
অনেক তো হলো! এবার আমাদের নিজেদের একটা ঘর দরকার। কি বলো প্রিয়তমা? তোমার বাবার পরিত্যাক্ত গ্যারেজটা ঘর হিসেবে ব্যবহার করার কথা বলেছিলাম। মন্দ হয় না কিন্তু! যদিও সেখানটায় ডিজেল, পেট্রোল এবং আরো নানারকম জঞ্জাল ও পোড়া তরলে ভর্তি, তাতে কী! যদিও আমার সাথে সম্পর্ক রাখার জন্যে তোমার বাবা তোমাকে ত্যাজ্যকন্যা করার হুমকি দিয়েছে, তাতে কী? বাবারা ওরকম বলেই থাকে। আরে আমরা তো আর তার কাছ থেকে ফ্ল্যাটবাড়ি চাচ্ছি না, একটা পোড়া তেলের গন্ধঅলা গ্যারেজই কেবল চাইছি। গ্যারেজটা পরিষ্কার করে আমরা একেবারে ইন্দ্রপুরী বানিয়ে ফেলবো দেখো!
ইন্দ্রপুরী নির্মাণের কথা শুনে খুব এক্সাইটেড হয়ে গেছো দেখি! চমৎকার! তবে মুখের কথায় তো আর সব হয় না! তোমার বাবা যেমন তোমাকে ত্যায্যকন্যা বলার পরেও বেশ আয়েশে আমার কথা ভেবে সিনেমার নায়িকাদের মতো বালিশের ওপর উপগত হয়ে অশ্রূসিক্ত করছো আর দিব্যি ডেইলি চুলে ডিমের কুসুম আর মুখে রূপটান মাখছো, ব্যাপারটা অনেকটা সেরকমই। আমি ভুল করে ইন্দ্রপুরী বানাবার কথা বলে ফেলেছি। ওটা ভুলে যাও। গ্যারেজের মধ্যে ইন্দ্রপূরী, কে শুনেছে এমন কথা! ও কী! আবার কাঁদছো কেনো? কোন আক্কেলে যে তোমাকে আবেগাপ্লুত হয়ে বড় বড় কথা বলতে গিয়েছিলাম! আচ্ছা যাও, হবে, আরে বললাম তো হবে! তবে তার আগে গ্যারেজটা পরিষ্কার করতে হবে তো! আমি একা একা পারবো নাকি? তুমিও এসো। দুইয়ে মিলি করি কাজ। তোমার বন্ধুবান্ধব আনবে? বেশ তো নিয়ে এসো! যত জনবল বাড়বে, তত দ্রুত কাজ শেষ হবে। তারা অবশ্য গ্যারেজের করুণ দশা দেখে নাক সিঁটকাতে পারে! অমন বন্ধুদের এনো না। তাহলে কাল থেকে কাজ শুরু করি, কি বলো? ওকে, ডান!
তবে একটা সমস্যা, তোমাকে বলতে ভুলেই গেছি। আমি না পেট্রল, ডিজেল আর গ্রিজের গন্ধ একদম সহ্য করতে পারি না। তাহলে গ্যারেজ পরিস্কার করবো কীভাবে? মানে ইয়ে...দূর থেকে আমি নির্দেশনা দেবো, তোমরা কাজ করবে, কেমন? আরে এত রাগছো কেন? ভুল হতে পারে না মানুষের? বলতে না হয় ভুলেই গেছি আমার শূচিবায়ূর কথা, তাতে কি আমাদের ভালোবাসার ইমারত ভেঙে পড়বে? অনেক হয়েছে, আর না। সেক্সবিহীন জীবন কাটাতে কাটাতে জোম্বি হয়ে যাচ্ছি। তোমাকে আমার চাই...ই চাই। আরে না, শুধু সেক্সের জন্যে না। তাহলে তো ব্রথেলেই যেতে পারতাম, তাই না? কেন এত তাড়া তাই বলছো? ভরসা নেই তোমার জল্লাদ বাপের ওপর। তাড়া না করলে দেখা যাবে কোনদিন তাড়িয়েই দিলো! এদিকে আমার পকেটে নাই ফুটো পয়সা। বেকার। ওহ স্যরি স্যরি চাকরিটা না আমি পাই নি। পাওয়ার কথা ছিলো। একদম কনফার্ম ছিলাম আমি। তাই তোমাকে আগেভাগেই বলে ফেলেছিলাম। কী করবো বলো, ভাইভায় সব প্রশ্নের জবাব স্মার্টলি দিলাম, কানেকশনও লাগালাম ঠিকমতো। এরপরেও চাকরি না হলে কী করবো বলো। মানছি, আমি মিথ্যাবাদী। তাই বলে তুমি নিশ্চয়ই ফেলে দেবে না আমাকে? আমাদের এতদিনের সম্পর্ক...আচ্ছা গ্যারেজটা যেহেতু আমি পরিষ্কার করছি না, তাহলে এর সজ্জাকরণ নিয়ে বলি বরঙ। চুপ করোতো! চুপ চুপ চুপ অনামিকা চুপ! যে কাজের জন্যে আমি পারদর্শী না, তা কেন করতে যাবো? এর চেয়ে শোনোই না আমার আইডিয়াগুলো...অনন্ত জলিলের একটা পোস্টার লাগাবো। যতই তোমরা তার নিন্দা করো, আমার কিন্তু খুব ফেভারিট। আমার কাছে অনেক পুরোনো পোস্টার আছে। যদিও সেগুলো দেয়ালে সাঁটা, তবে ওগুলো খুলে নেয়ার পদ্ধতি আমার জানা আছে। আর্কের হাসানের কথা মনে পড়ে? আরে হ্যাঁ, সুইটি গানের হাসান। হাসান, বাচ্চু, জেমস, সবার পোস্টার আছে আমার কাছে। সুবর্না মোস্তফার খুব বিরল একটা ছবি আছে। টিভি গাইড থেকে কেটেছিলাম। আগে প্রতিবছরের জন্যে টিভিগাইড বের হতো। তুমি হয়তো জানবে না সেটা। তোমাদের বাসা থেকেও তো কিছু আনতে পারো। একটা ঝাড়বাতি, কিংবা ফুলদানি। তোমার বাবার চোখ এড়াতে পারবে না?
*
এতক্ষণ একটানা তোমার কথা শুনে গেছি। ইদানিং বড্ড বাজে বকা শুরু করেছো তুমি। তোমার মাথায় তো আগেই প্রবলেম ছিলো। এখন সেটা আরো জোরদার হয়েছে। নইলে কেউ গ্যারেজে বাসা বাঁধার কথা বলে? তবে মজার ব্যাপার কি জানো? আই লাভ দিস উইয়ার্ডনেস অফ ইউ। আমি নিজেও উইয়ার্ড। তোমার চেয়ে বেশিই। তাই এখন তোমাকে যেসব কথা বলবো, আশা করি তাতে অবাক হবে না, এবং আমার কথা বলার সময় বাধা দেবে না। গ্যারেজের আবর্জনাগুলো সরানোর বদলে সেগুলো রাখার পক্ষপাতী আমি। সেখানে অনেক কিছু পড়ে আছে। জারিকেন, টিনের ক্যান, স্টিল, রড, সেগুলো আমরা ফেলে দেয়ার বদলে সাজিয়ে রাখবো। আমাদের এই পৃথিবীটাই তো একটা বিশাল আস্তাবল। কেএফসির সুরম্য দোকানের ভাজা মুরগী, সুপারশপগুলোর দ্রব্যাদি, প্লাস্টিক বর্জ্য,সিডি প্লেয়ার, লন মোয়ার, এয়ার কন্ডিশনার সবকিছু আঁতাত করে গ্রিনহাউজ এফেক্ট বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমরাই বা বাদ থাকবো কেন? গ্যারেজের টিন আর প্লাস্টিকজাতীয় দ্রব্যগুলো একসাথে করে সাজিয়ে রাখবো। শীতকালে ওগুলো দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে তাপ পোহাবো। আমার মুখে তুমি গ্রিজ মাখিয়ে দিবে, আমি তোমার মুখে। অতঃপর আমরা চুম্বন করবো। এমন ভালোবাসাবাসি বেসেছে কেউ কোনদিন? আমরা কিছু শিয়াল পুষবো। ওরা আমাদের জন্যে মুরগী এনে দেবে। ওরকম মুখ করছো কেন শুনে? খবরদার! মুখ ঠিক করো! এই তো হয়েছে। তোমারও কিছু কথা বলার বাকি আছে। সময় হলে বলবে। এখন একদম চুপ! আমার কাছে প্রচুর ফ্যাশন ম্যাগাজিন আছে। ওগুলো দেখে উৎকটভাবে সাজবো। মেরুন রঙের লিপস্টিক কেমন লাগে তোমার? খুব তো বাচ্চু আর হাসানের গান শুনেছো বলে বড়াই করলে। আদনান বাবুর গান শুনেছো? "রঙ নাম্বার টেলিফোনে/ নাম না জানা কে বললো হ্যালো/দেয়া নেয়া শত কথার মাঝে লাইনটা হঠাৎ কেটে গেলো"। শুনেছো? এখন আর লাইন কাটে না। কেটে গেলেও কল ড্রপের জন্যে এক মিনিট ফেরত দেয়। কোথায় যাবে তুমি, কোথায় পালাবে এই প্লাস্টিক সভ্যতা আর সিলিকন প্রযুক্তির মুখমেহন থেকে? সবাই ওঁৎ পেতে আছে। একবার যদি আমাদের ধরতে পারে, তবেই হয়েছে। গুড ওল্ড নাইনটিজের রোমান্টিসিজম বাদ দাও। ব্যাড গোল্ড মিলেনিয়ামের কথাও ভুলে যাও। আমাদের গন্তব্য এইখানে না। অন্যকোন খানে। তুমিই না বলেছিলে এমন ভালোবাসবে যে তার কোন তুলনা থাকবে না? গ্যারেজের কথা উল্লেখ করে পরে তুমি নিজেই সটকে পড়ছো কামচোরা ধেড়ে শয়তান! আবার আমার বাবার কাছ থেকে জিনিস নিয়ে আসতে বলো! কত্ত বড় হারামী রে তুই! তোমার কপালে দুঃখ আছে, এই গ্যারেজে বসবাসের চিন্তাটা আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। আমার কথা শেষ হয় নি এখনও। তবে এবার তোমার সাথে আলাপ করা যেতে পারে। শ্যুট!
**
-ওহে গ্যারেজিনী, তোমার উদ্দীপ্ত ভাষণ শুনে তো আমার এখন থেকেই কাজ শুরু করতে ইচ্ছে হচ্ছে! আদনান বাবুর গান আমিও শুনেছি। লাইন আর কাটবে না বুঝলে? এই মধ্য ত্রিশে এসে সেই সুযোগটাই বা কোথায়? যতই আমাদের চেপে ধরুক সভ্যতার করাল হাত, যতই তারা গোপনে দেখার চেষ্টা করুক আমাদের ভালোবাসার বাসর, লাভ উইল ফাইন্ড আ ওয়ে।
-এই মধ্য তিরিশ, এই ক্লান্ত মধ্যতিরিশে এসেও তোমার এ্যাডভেঞ্চারাস মনোভাব অটুট আছে দেখ আমার খুব ভালো লাগলো। আমিও তো মধ্য তিরিশ, আমারও তো ক্লান্ত লাগে! প্রকাশ করতে দেই না যদিও। তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না। গ্যারেজের প্রসঙ্গ তোলার পর কতগুলো অজুহাত দেখালে কাজ না করার! আসলে দ্যা আলটিমেট লুজার ববি, সেখানে হারাটাই তোমার নিয়তি। আরো একবার হারো তুমি ববি। তবে আমার বিরুদ্ধে এই পরাজয়ে আমি কিন্তু জয়ী হবো না। দুইজন লুজার একসাথে থাকলে কেউ জেতে না।
-জেনি, তোমার বাবা আসছে, আমি এখন কোথায় লুকোবো বলোতো? কুইক!
-হাহাহা! ববি! ইউ মেড মাই ডে। প্রেমিকার কাছে প্রত্যাখ্যাত হবার পরমুহূর্তেই তার বাবার ভয়ে লুকোনো একমাত্র তোমাকেই মানায়!
ববি একটা কদম গাছের পেছনে আড়াল নিয়ে ভাবে, খুব বাঁচা গেলো! আর জেনি অশ্রুসিক্ত নয়নে ভাবে, ববি হারতেই থাকুক সারাজীবন। সে যদি কখনও ভুল করে জিতেও যায়, তবে এইসব প্লাস্টিক সভ্যতা, উত্তরাধুনিক উজবুকতা, আর বর্জ্যময় পৃথিবীর নশ্বরতার কথা বলে, গ্যারেজে বাসরের মত উদ্ভট আইডিয়া দিয়ে আবার সেটাকে হাস্যকর বলে পিছিয়ে আসবে জেনি। অপেক্ষার সেতু বড় ভঙ্গুর। পার হতে গিয়ে ভেঙে পড়ে যদি!
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ১০:৪৬