somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইউটোপিয়া

১৪ ই মে, ২০১৩ রাত ৯:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আজকের মত এমন অসম্ভব সুন্দর দিন আর কখনও আসেনি আমার জীবনে। পৃথিবীর সুন্দরতম প্রজাপতিটির ডানার রঙের কারুকার্যও এই রঙের উৎসবের কাছে ম্লান। ম্লানমুখ করে তারা উৎসবের দর্শক হয়ে ছিল। কিন্তু এ এমনই এক উচ্ছল পরিবেশ, যেখানে কেউ মুখ গোমড়া করে থাকতে পারে না। প্রজাপতিরা উড়ছে বুকে বকুলফুলের ঘ্রাণ নিয়ে। পানীয় পরিবেশনকারী যুবকদের জামার হাতা থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে সোনালী আভা। অস্তগামী সূর্যটা বাড়ি ফেরার তাড়া রহিত করে এখানে ছুড়ে দেয় কিছু লালচে আনন্দরশ্মি। রঙের সাথে মিশে যায় আলো, শিরা-উপশিরা-ধমনীর ট্র্যাক ধরে ছুটে যায় রক্তকণিকারা বেপরোয়া উল্লাসে। উৎসবস্থলে যোগ দেবার আগ্রহ প্রকাশ করে বাতাসযান জরুরী বার্তা পাঠালে খুলে দেয়া হয় ছাদ, জানালা এবং দরজা। হুহু করে ঢুকে পড়ে হাওয়া। উড়তে থাকে পানীয়ের বোতল, পরিবেশনকারী, প্রজাপতি, পাখি, নারী, নাকফুল, হৃৎকলম, দেবশিশু, আলোর বল, টুকরো চাঁদ, জোছনার জাল, এবং অপঠিত জললিপি। আলোয় ভাসে ছোট্ট শহর, বাতাস তাকে নিয়ে যায় নতুন ঠিকানায়, ছোট্ট উৎসবস্থলটি কলেবরে বৃদ্ধি পেয়ে শহরের রূপ ধারণ করে। মানুষ বাড়তে থাকে। আলোর সঞ্চারপথ ধরে মোহগ্রস্থের মত ছুটে আসে তারা। অবশেষে সেই স্থানটির দেখা পেয়েছে যেখানে "দুঃখ নেই, কষ্ট নেই, ঝলমল করে আলো, রোদ্দুর"।
আর আমি? আমি নিশ্চিত হই এমন সুন্দর, এমন অদ্ভুত,অবিশ্বাস্য সুন্দর দিন আমারর জীবনে কখনও আসেনি, এবং আসবেও না। এই শহরেই পাকাপাকিভাবে থেকে গেলে কেমন হয়? চেয়ারটায় আয়েশ করে গা ঝুলিয়ে দিয়ে ভাবি। আমার তো কোথাও যাবার কোন তাড়া নেই। কেউ আমার জন্যে পথ চেয়ে বসে থাকবে না। কারো কাছে জবাবদিহির কোন ব্যাপারও নেই। তাহলে? কেন যাবে আমি? ভাগ্যক্রমে একটা ইউটোপিয়ান জগতের সন্ধান পেয়ে গেছি। এখান থেকে প্রস্থানের মূর্খতা দেখাতে পারলে পৃথিবীর মূর্খতম মানুষটির কাছেও হাস্যস্পদ হতে হবে।
-এই, এটা কি আলসে বুড়োদের মত চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে মাতবরি করে চারদিক তদারক করার জায়গা? ওঠো! নাচো!
নৃত্যে আমি খুব পটু ছিলাম না কখনই। কীভাবে পা এবং হাতের সঞ্চালনে একেকটি সুন্দর নৃত্যমুদ্রা গঠিত হয় সে সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই আমার। কিন্তু আমাকে আহবানকারী নৃত্যরতা মেয়েটির কথা শুনে মনে হল, না পারার কিছু নেই! তার মুখনিঃসৃত শব্দ যেন নৃত্যতরঙ্গ হয়ে ঢেউ খেলিয়ে দিতে লাগলো শরীরের সর্বস্তরে। স্বাভাবিকভাবে উঠে দাঁড়ানো এখন অসম্ভব। দেহের কোষে কোষে বাজনা বাজছে, অঙ্গকে চালিত করছে যেন নৃত্যের ঈশ্বর! যে নাচ জানেনা ফিঙে পাখি, জানেনা ঘাসফড়িঙ। আকাশে মেঘের টিকলি পরিয়ে দিলে ময়ূরের আনন্দনৃত্যও একটা গতে বাঁধা। নৃত্যরতা মেয়েটির সংস্পর্শে এসে আমি নৃত্যবিষয়ক যাবতীয় শারীরিক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে তার হাত ধরে নাচতে থাকি। আমাদের সাথে সঙ্গত করে গলা ফুলিয়ে ব্যাগপাইপ বাজায় শহুরে ডোবাপৌরে জীবনে বিরক্ত একজন মাঝবয়েসি কোলাব্যাং, পারকিউশনের দায়িত্বটা থাকে চকমকি পাথরের কাছে। নৃত্যরতার সাথে নাচতে গিয়ে আমার হাঁফ ধরে না মোটেও। যদিও জানি আমার এই শরীরটা নানারকম অনিয়ম এবং অযাচিত আরামের ফলে শক্তি হারিয়েছে অনেকটাই। যদিও নারীসঙ্গহীন জীবনে মাঝেমধ্যে কামনার অনল আমাকে ধর্ষক হতে প্রলুদ্ধ করে, তবুও নৃত্যরতার শরীরের এত কাছাকাছি থাকার পরেও আমার মধ্যে কোন যৌন অনুভূতি জাগে না। নৃত্যের একটা আলাদা সৌরভ আছে। যার স্পর্শ পেলে ওৎ পেতে থাকা শিকারী কামনার দল পালিয়ে যায় সন্ধ্যায় বাড়ির আঙিনায় ধুঁপ জ্বালানোর ফলে পলায়নপর মশাদের মত। নৃত্যরতা মেয়েটির কোমর জড়িয়ে ধরে নতুন এক ভঙ্গিমায় অঙ্গ সঞ্চালন করতে গিয়ে জিজ্ঞেস করি,
-নাম কী তোমার?
-নাম কিছু একটা ছিলো একসময়! "রাবেয়া কী রোখসানা ঠিক তো মনে পড়ে না!"
-হু, শুনেছি গানটা। মহীনের ঘোড়াগুলির "সেই ফুলের দল"। তারপর কি হল? অস্থির ভাবনা ঠিকমত মনে করতে দিচ্ছে না।
নাচের তালে গুনগুন করে গাইলো সে,
-"অস্থির এ ভাবনা শুধু করে আনাগোনা
ফেলে আসা দিন তার মিছে মনে হয়"
আসলে অস্থির ভাবনাগুলো মনে করতে দিচ্ছে না কথাটা ভুল! মনে করতে চাইছি না। কিছুক্ষণ পর মনে করতে পারবোও না। তার আগেই তোমাকে যা বলার বলে নিই। আর আমার নামটা মনে কর "নৃত্যরতা" ঠিক আছে?
-খুব ঠিক আছে। এখন তোমার কাহিনী বল।
নৃত্যরতা তার কাহিনী বলা শুরু করে।
-আমি যখন ঐ পৃথিবীতে ছিলাম, কিছুতেই সবার সাথে মানিয়ে নিতে পারছিলাম না। আমাকে পরিচালিত করতেন নৃত্যের ঈশ্বর। তোমরা অনেকেই আটপৌরে বাস্তবকে ঘৃণা করে সৃষ্টি কর অধিবাস্তব, অপরবাস্তব, জাদুবাস্তব নামক বিমূর্ত শিল্প। আমি তৈরি করেছিলাম নৃত্যবাস্তব। ইংরেজিটাও বেশ জবরদস্ত "ডান্সরিয়ালিজম"! কেমন লাগছে শুনতে?
-দারুণ! অনুভব করতে পারছি। বলে যাও!
-কেমন একটা বেখাপ্পা মেয়ে ছিলাম আমি ভাবতেই অবাক লাগে এখন! যেমন ধর বৃষ্টি নামলো হঠাৎ শহরজুড়ে। সবাই দৌড়ে নিরাপদ আশ্রয় বেঁছে নিল। আর আমি একলা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে শরীর দোলাতে দোলাতে পদব্রজে বাড়ির পথে রওনা দিলাম। তখন অবশ্য শরীর দোলানোর বেশি তেমন কিছু পারতামও না। তখন তো আমি রাবেয়া কি রুখসানা ছিলাম, এখনকার মত নৃত্যরতা না!
-তারপরেও তুমি অসাধারণ ছিলে।
-ছাই ছিলাম! হয়তোবা বৃষ্টির মধ্যে আমার নৃত্যরতা অবয়ব দেখে দূর থেকে তুমিই তখন লোলূপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে! যাহ, এসব কী বলছি! এসব কথা এই অসম্ভব সুন্দর ইউটোপিয়ান জগতে বলতে মানা। এখন সেইসব পঙ্কিলতাকে কি ভীষণ ছেলেমানুষী আর খেলো মনে হচ্ছে! আচ্ছা বাদ দাও, কাহিনী শোন। জানো, আমি বাসের রড ধরে ঝুলে থাকার সময়ও নাচতাম। মানে ঐ অবস্থায় যতটুকু পারা সম্ভব আর কী! অফিস থেকে সন্ধ্যায় বেরুনোর সময় কানে যখন হেডফোন গুঁজে দিতাম এবং আমার ফেভারিট ডান্সমিউজিক গুলো বাজতো, তখন মনে হত পুরো শহর নাচছে! নাচছে বিলবোর্ডের হাস্যময়ী মেয়েটা, নাচছে গাড়ির হেডলাইট, নিয়ন সাইন। আলোকনৃত্য যে কত সুন্দর তোমরা কেউ অনুধাবন করতে পারতে না। আমার সাথে নাচতো শহর, নাচতো ছাদের ফুলের টব, নাচতো বিষাদ সন্ধ্যেবেলা, নাচতো পুষ্পসব।
-বাহ! তুমি দেখি নৃত্যের পাশাপাশি ছন্দেও বেশ পটু!
-দুটো তো সম্পর্কযুক্ত। একটার সাথে আরেকটা থাকবেই। ছন্দ, নৃত্য সব মিলিয়ে বেশ আনন্দেই ছিলাম। কিন্তু নৃত্যবাস্তবের ধারণাটা সবাইকে বোঝাতে গিয়ে বেশ বিপত্তির মাঝে পড়তে হয়েছিলো। কেউ বুঝতে চায়না। কেউ বোঝেই নি! নৃত্য মানে তাদের কাছে যেন শুধুমাত্র বিটিভির সেই আদ্যিকালের "নৃত্যের তালে তালে" অথবা কনসার্টে গিয়ে উদ্দাম লাফালাফি। নাচকেও যে শরীর, মন এবং কর্মের সাথে যুক্ত করে এক অন্য বাস্তবতার অসাধারণ স্বাদ আস্বাদন করা যায়, কেউ বোঝেই নি! খামোখা বোঝাতে গিয়ে কতসব ঝঞ্ঝাট, ওসব কথা অবশ্য এখানে বলা বারণ।
নৃত্যরতাকে এবার আমি জড়িয়ে ধরে চুম্বন করি। কিছুক্ষণের জন্যে থেমে যায় নাচ। নতুন ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বেজে ওঠে। আমার অফিসের বুড়ো পিওন স্যাক্সোফোনে কেনিজির "জয় অফ লাইফ" এর সুর ধরে। নৃত্যরতা এই সুরের তাৎপর্য বুঝতে পারে। আমাদের ঠোঁটের ঘর্ষণে বেজে ওঠে হারমোনিকা। বিশুদ্ধ প্রেমে কাম আসবেই। সে পিউরিটান ইউটোপিয়ান জগৎ হলেও। তবে তা আসতে সময় দরকার। আমি এবং নৃত্যরতা সে সময়টাটুকু অতিক্রম করেছি। এখন এই চুম্বনে কোন অপবিত্রতা নেই। দেহজ বিস্ফোরণের জন্যে আরো অপেক্ষা করতে আমাদের বিন্দুমাত্র অসহিষ্ণুতা নেই।

আমরা জানি কখন দোয়েল ডাকে
কখন যেন কে চিনে নেয় কাকে!

দোয়েলের ডাকের জন্যে অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই আর। নাতিদীর্ঘ চুম্বনপর্ব শেষে একে অপরকে আসন্ন প্রেমসংক্রান্তির স্যুভনির উপহার দিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করতে বেরিয়ে পড়ি। আমরা ভালোবাসার বৃহত্তর অর্থ জেনেছি। ভালোবাসা মানে আমাদের এই নশ্বর শরীরকে শুধুমাত্র ভোগের উপকরণ বানানো না, সীমাবদ্ধ করে ফেলা না। প্রাণ ভরে শ্বাস নেয়া, চোখ ভরে রঙ দেখা, সমস্ত সুন্দরকে স্পর্শ করা। নৃত্যরতা এবং আমি এই অনুসন্ধানে আকুল হয়ে ছুটে যাই নিঃশ্বঙ্ক চিত্তে। যেহেতু আমরা জানি, আবার দেখা হবে, যেহেতু আমরা জেনে গেছি ইউটোপিয়ান জগতে কোন বিচ্ছেদের বেদনা নেই!

শহরটা যে হারে বৃদ্ধি পাওয়ার কথা তা পায়নি। এখন আর সেটা বাড়ছেও না। তবে উৎসব, আল্পনা, গান, নাচ সবই চলছে ঠিকঠাক। নবনির্মিত বাগানে প্রাক্তন জীবনে প্রত্যাখ্যাত অথবা ব্যর্থ প্রেমিক প্রেমিকেরা নতুন কাউকে খুঁজে নিয়ে গাছের ছায়ায়, ঘাসের গালিচায়, ফুলের সুবাসে, এক মনোহর পরিবেশে নব আবিস্কারের সন্ধান পেয়ে উদ্বেলিত চিত্তে নিজেদেরকে সঁপে দিচ্ছে। তবে শহরের বর্ধিত না হবার বিষয়টা আমাকে চিন্তিত করে। আমাকে চিন্তাক্লিষ্ট দেখে উপযাচক হয়েই একজন স্বেচ্ছাসেবক ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করে,
"দেখুন, আমরা সবাই এই স্বপ্নে বিভোর, একটা চিরসুখময়, আনন্দময় জগতের। কিন্তু সবার কি এখানে প্রবেশাধিকার আছে? থাকা উচিত? হ্যাঁ, এখানে যারা এসেছে তাদের কেউই শূদ্ধ ভালো মানুষ না। কিন্তু তারা কষ্ট করে উপার্জন করে, খেটে খেয়ে বাঁচে। বিলাসিতা বিবর্জিত জীবন তাদের। তারচেয়েও বড় কথা, স্বপ্ন দেখাটা এখনও ভুলে যায়নি তারা।"
বলতে বলতে হঠাৎ সে অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে কারো ডাকে। আমি তাদের কথা অস্পষ্ট শুনতে পাই দূর থেকে।
-আল্পনাগুলো কি মুছে ফেলব?
-হ্যাঁ, কিছুতো মুছতেই হবে।
-দেয়াল, আয়না, নাচঘর, ঝাড়বাতি?
-নামিয়ে ফেল, ভেঙে ফেল কিছু। এত দরকার নেই।
এক ভয়ংকর আশঙ্কা আমাকে পেয়ে বসে। আমি ছুটে যাই তাদের কাছে।
-শহরটা বাড়াবেন না, ভালো কথা। সংকুচিত করছেন কেন?
-প্লিজ, এসব ব্যাপার আমাদের হ্যান্ডল করতে দিন। আপনার তো কোন সমস্যা হচ্ছে না!
অন্য একজন মিটমিটিয়ে হেসে যোগ করে,
-আপাতত!
-আপাতত মানে কী! মানে ভবিষ্যতে সমস্যা হতে পারে?
-চুপ! ইউটোপিয়ান জগতে ঝগড়া-বিবাদ-তর্ক-শঙ্কা এসবের কোন স্থান নেই।
বেশ মোলায়েম এবং হৃদ্যতাপূর্ণ গলায়ই আমাকে সান্ত্বনা দেয় সে।
-যান, ঘুরে দেখুন না শহরটা! এখনও তো পুরোটা দেখেনই নি। আরো অনেক কিছু আছে দেখার। অনুভব করার। ভালো লাগবে আপনার। যান।
এখানকার পরিবেশটা আসলেই অন্যরকম। কোনরকম শঙ্কা বা ভীতি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। আমি আবারও নিরুদ্বেগ চিত্তে ঘুরে বেড়াতে শুরু করলাম। পকেটভর্তি জোনাকপোকা মানিব্যাগের বদলে। তারা আমাকে পথ দেখায়। নৃত্যরতা কি করছে এখন? কি করছে আমার ছটফটে প্রজাপতিটা? ক্লান্তির মাস্তুল ধরে শহর যখন ভুলপথে ভুলজলে নৌকা ভাসিয়ে দেয় তখন একটা চঞ্চল কম্পাস যেন সবাইকে দিক নির্দেশিকা দেখায়। আমার নৃত্যবালিকা! খুব শিগগিরই তার সাথে দেখা হবে শহরটা প্রদক্ষিণ শেষ হলে। তখন আমরা ভালোবাসবো তার প্রবর্তিত নৃত্যবাস্তব বা ডান্সরিয়ালিজমের নিয়ম মেনে। এখানে এখন দেবশিশুরা মেঘেদের ভেলায় উড়ে চলেছে, কিছুক্ষণ আগে হয়ে যাওয়া বৃষ্টির ফোঁটা কচুরিপানার বনে স্বচ্ছ স্ফটিকবিন্দুর মত জড়িয়ে ধরে আছে, যেন আজীবন থাকবে! রঙধনু থেকে ধনুকবার্তা এসে গেঁথে যাচ্ছে সবার গায়ে। আরো রঙ! আরো আনন্দ! আরো উচ্ছলতা! জীবনের পরম সৌন্দর্য নিখুঁত তুলির আঁচড়ে এঁকে দিচ্ছে কেউ এই শহরের ক্যানভাসে। এই জীবনকে ফেলে কোথায় ছিলাম এতদিন! শহর প্রদক্ষিণ প্রায় শেষ। বেশ ক্লান্ত লাগছে। কোন একটা পানশালা থেকে গলাটা ভিজিয়ে, একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার ফিরে যাব নৃত্যকন্যার কাছে। আমার নিয়তির কাছে। বেশি খুঁজতে হল না। পাশেই একটা পানশালা দেখতে পেলাম। ওখান থেকে ভেসে আসছে মহান স্বপ্নচারী জন লেননের সেই অমর কথামালা যেন কোন সুরপ্রপাত থেকে,
"Imagine there's no heaven
It's easy if you try
No hell below us
Above us only sky
Imagine all the people living for today

Imagine there's no countries
It isn't hard to do
Nothing to kill or die for
And no religion too
Imagine all the people living life in peace

You, you may say
I'm a dreamer, but I'm not the only one
I hope some day you'll join us
And the world will be as one"

স্বর্গের লোভ নেই, নরকের আতঙ্ক নেই, দেশের সীমারেখা নেই, ধর্মের নামে হানাহানি নেই, সম্পত্তির লোভ নেই। সবাই সবার জন্যে। সবাই এক আকাশের নীচে গাইবে শান্তির সঙ্গীত। জন লেনন ছাড়া এমন সার্থকভাবে ইউটোপিয়ান কনসেপ্টকে অনুদিত করতে পেরেছেন আর কে! তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে আমি একটা চেয়ার দখল করে বসি। প্রচুর পরিমাণ সোডা মিশিয়ে দু পেগ রাম খাব। নিমিষেই দূর হয়ে যাবে ক্লান্তি।
-দু পেগ রাম দাও তো, সাথে সোডা এক বোতল। আর জন লেননের গানটা থামালে কেন? বাজাও ওটা?
-আপনারে আর দেওন যাইবো না। প্রচ্চুর খাইসেন। এখন ওঠেন। বমি করলে পরিস্কার করব কেডা? আফনে?
কী বলছে! আমাদের এই চিরশান্তির জগতে কেউ এমন রূঢ় ব্যবহার করতে পারে! আমি রেগে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে খেয়াল করি, আমার হেডফোনটা কান থেকে বিচ্যুত হয়ে পকেট সংলগ্ন হয়ে ঝুলছে। ওহ, তাহলে জন লেননের গানটা আমিই চালাচ্ছিলাম! কিন্তু তারপরেও এই বারটেন্ডারটার বাজে আচরণ মেনে নেয়া যায় না। তাকে কষে ধমক দিলে সে গজগজ করতে করতে আরো দু পেগ আনতে যায়। আর তখন আমি টিভিতে দেখি নৃত্যরতাকে। কোন একটা রিয়ালিটি শোতে খুব শরীর ঝাঁকিয়ে নাচছে। এই নাচ ফিঙের না, ফড়িঙের না, কাশবনের না, জারুল ফুলের না, মেঘদলের না, আবেগী বালিকার না। এটা নৃত্যবাস্তব না! এটাই নিত্যবাস্তব! এটা কুৎসিত একটা মাংসল নাচ। যে মাংসের পরতে পরতে মিশে আছে লোভ আর ক্ষুধা! নৃত্যরতা এমনটা করতে পারলো! আমাকে শাস্বত জীবনের প্রতিশ্রূতি দিয়ে শেষ পর্যন্ত একটা টেলিভিশনের ভেতর সেঁধিয়ে গেল? আবার দেখ, কিছু বখাটে ছোকরা শিষ দিচ্ছে!
-এই লন আপনার দুই পেগ রাম। ভাইগ্নারে কিছু বকশিশ দিয়েন। তয় বস, এইডাই কিন্তু লাস্ট।
-লাস্ট মাস্ট পরে, আগে টেলিভিশনটা বন্ধ করতে ক। আর ঐ টেবিলের ছ্যামড়াগুলারে উইঠা যাইতে ক।
-দেহেন মামা, আগেই কইছিলাম হুজ্জত হাঙ্গামা কইরেন না। এইখানে ডেয়ারিং সব পাবলিক আসে। পরে সমস্যায় পড়বেন।
-ঐ কি হৈছে রে? কোন মাদারচোতের খাউজানি উঠসে?
পাশের টেবিলের দল থেকে একজন শাসাল গলায় জানতে চায়।
আমি আর বাগাড়ম্বর না করে বিল চুকিয়ে দিয়ে নির্জলা রাম গলার ভেতর ঢেলে দিই।

শহর থেকে...থুক্কু বার থেকে ফেরার পথে আমার ভীষণ পেচ্ছাপের বেগ পায়। একটা ল্যাম্পপোস্টের ধারে কুকুরের শৌচকর্মের সঙ্গী হয়ে দাঁড়াই। ছ্যাড়ছ্যাড় করে বিসর্জন করি ইউটোপিয়ান মুত্র। শরীরটা বেশ হালকা লাগে এতে। মাথাটাও হালকা হয়ে আসে। বাসস্টপে পোঁছুতে হলে আরো বেশ কিছুদুর হাঁটতে হবে। হাঁটার সময় আমি অবাক হয়ে খেয়াল করি, আমার শরীর নৃত্যাকারে দুলছে। নৃত্যরতা চলে গেলেও আমার মাঝে দিয়ে গেছে নৃত্যবাস্তবতা! আরো কিছু টাকা জমলে দামী পানীয়ের কোলাবোরেশনে নৃত্যবাস্তবতা এবং ইউটোপিয়া আবারও এক হবে। ততদিন না হয় আমি আয়রনযুক্ত পানি আনফিল্টারড অবস্থায় পান করে পেটের অসুখে ভুগলাম!

ইউটোপিয়া, তুমি থাক বা না থাক, নৃত্যরতা, তুমি দেখা দাও বা না দাও, আমি আসবো। আমি আমার মত করে গড়ে নেব শান্তি-সুখের জগত আর ডান্সরিয়ালিজম, মাসে ঘন্টাখানেকের জন্যে প্রচুর অর্থ এবং স্বাস্থ্যের বিনিময়ে হলেও...
৫৮টি মন্তব্য ৫৮টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×