তবু যাও তুমি কোথায় চলে...
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
এই গ্রীস্মে, এই নিষ্ঠুর এপ্রিলের গ্রীস্মে দুই কিলোমিটার পথ হেঁটে এসে বাসে সিট না পেলে শরীরের ক্লান্তিকে ঘুচিয়ে দিতে চায় মনের কর্কশতা। ভীষণ তেজে আমরা তখন বাসের কন্ডাক্টরের সাথে ভাড়া নিয়ে বচসা করি, যাত্রী ওঠানো নামানো নিয়ে নিজেদের সুবিধামত অবস্থান বেছে নিই, মন মেজাজ বেশি খারাপ থাকলে মহিলাদের আসনে গেড়ে বসা চামুন্ডাগুলোকে দু ঘা দিয়ে উঠিয়ে দিই। তবে আমার শ্রান্ত দেহ আজ ক্ষেপে থাকা মনের প্ররোচণা স্বত্ত্বেও কোন কিছুতেই উৎসাহ না পেয়ে অগত্যা একটা রডের ওপর দুহাত নিপুন ভারসাম্যে রেখে চারিপাশের আসনগুলোতে ভরপুর মানববিন্যাস দেখে হতাশ হচ্ছিল। হতাশার পরিমাণটা মনে হয় বেশিই ছিল, তাই আমার ঠিক সামনেই বসা দুটি মেয়ের দিকে অনাগ্রহে মাত্র একবার তাকিয়ে পেছনের সিটের বৃদ্ধের গন্তব্য দ্রুত এসে পড়বে এবং সে নেমে যাবে এমন সম্ভাবনা সম্পর্কে অবগত হয়ে সেদিকে গভীর মনোযোগে দৃষ্টি প্রক্ষেপন করি। ভাগ্য বেশ সুপ্রসন্ন আমার, সামনের সিটের দুটি মেয়ের মধ্যে একজনের গন্তব্য এসে পড়ে এবং আমি বসার জায়গা পেয়ে যাই। বসতে গিয়ে আরেক ঝামেলা! আমার লম্বা লম্বা পা দুটি সংকীর্ণ পরিসরে কোনভাবেই সাচ্ছন্দ্য বোধ করছিলো না, আঁটানোই যাচ্ছিলো না! নানারকম কসরৎ করে বসার একটা উপযুক্ত অবস্থান করে নেবার পর আমার সুখানুভূতিকে আরো বাড়িয়ে দিল সহযাত্রীর সহানুভূতিময় আলাপ প্রয়াস,
-এদের সিটগুলো এমনভাবে বানায়, এমন কনজাস্টেড! বসা কষ্টকর রীতিমত।
-হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। আর আমার মত লম্বা মানুষের জন্যে আরো বিপত্তিকর।
বাক্যের দ্বিতীয়ার্ধে আমার প্রশান্তিময় মুখ কিছুটা ম্লান করি।
-না, শুধু আপনার জন্যেই না, সবারই অসুবিধে হয়।
বাসে আসন পাওয়া, সাথে মহিলা সহযাত্রী, যে আবার শরীরের ছোঁয়াচ বাঁচাতে সিঁটিয়ে না থেকে আলাপ জুড়ে দেয়! নাহ, গরমের দিনের জনাকীর্ণ লোকাল বাস সবসময় খুব খারাপ বস্তু না অবস্থানের জন্যে! মেয়েটিকে এবার আমি চোরাচোখে, পূর্ণদৃষ্টিতে, নানাভাবে, নানা কোণ থেকে পরখ করি।
সে শ্যামলা। মুখে মেছতার দাগ। রুক্ষ চুল। সারাদিন মনে হয় কোন কাজে খুব দৌড়োদৌড়ি করতে হয়েছে। প্রসাধনহীন মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। এক কথায় তাকে অনাকর্ষণীয়া বলা যায়, তবে বাতিল করা যায়না কোনভাবেই। অন্তত এই মুহূর্তে, আমার কাছে না।
-আচ্ছা আজকে রাস্তার এই অবস্থা কেন বলতে পারেন? গাড়ি-ঘোড়া নেই একদম। এত জ্যাম!
-ঠিক জানি না। সকালে রওনা দেবার সময় তো আমি কোন বাসই পাচ্ছিলাম না। শেষে অন্যরুটের একটা বাসে করে দুবার বাসবদল করে তারপর অফিসে এসেছি।
-হু। আবার কোথাও মারামারি হয়েছে হয়তো।
মেয়েটির হয়তোবা আরো কথা চালিয়ে যাবার ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু আমার মাঝে হঠাৎ করেই একটা অবজ্ঞার ভাব গেড়ে বসে। আমি ব্যাগ থেকে হেডফোন বের করে কানে গুঁজে দিয়ে লালমিয়ার র্যাসপ শুনতে থাকি। কিছুক্ষণ গান শোনার পর আমি বুঝতে পারি যে, এটা তাকে অবজ্ঞা করার জন্যে না। তবে কী? তার কাছে নিজের উদাসীনতা দেখিয়ে কি প্রমাণ করতে চেয়েছি? মেয়েদের দেখলেই আমি কথা বলার জন্যে অতি উৎসাহী হয়ে পড়ি না, তাই? যদিও আমার প্রেমিকা আছে, মেয়েবন্ধুও আছে ঢের, তবুও আমি চলতিপথে একজন আধা আকর্ষণীয়া নারীর কাছে নিজের ব্যক্তিত্ব জাহির করার এই ছেলেমানুষী প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকতে পারি নি! আসলে এইসব ভীড়বাসে নিজ থেকে আলাপ শুরু করার মত মেয়ে বড় একটা পাওয়া যায় না তো, তাই এই অস্বাভাবিক মনোরিফ্লেক্স। কন্ডাক্টর ভাড়া চাইতে এলে হেডফোনটা কানের থেকে খোলার পর বেশ একটা বাকবিতন্ডার আওয়াজ কানে আসে। একটু উচ্চকিত লয়ে, তবে অস্বাভাবিক কিছু না। তাই সেটা আমার কাছে কোন গুরুত্ব বহন করেনি। কিন্তু সহযাত্রীনির কথায় আমাকে ব্যাপারটা নিয়ে আবার ভাবতে হল।
-কন্ডাক্টরটা বদমাইশ!
কন্ডাক্টরদের প্রতি বেশিরভাগ যাত্রীর মনোভাবই এমন হয়। তার কারণ হয়ে থাকে সাধারণত ভাড়া নিয়ে বনিবনা না হওয়া, অথবা অধিক যাত্রী তোলা নিয়ে অসন্তোষ, এরকম। আমার পাশের মেয়েটিও হয়তো এরকম কোন কারণেই ক্ষিপ্ত। নাকি অন্য কোন কারণ রয়েছে? কন্ডাক্টরটা কি তার গায়ে হাত দিয়েছিল মওকা পেয়ে? বদমাইশ কন্ডাক্টরটা কি এই বিবর্ণ লাল কামিজ পরিহিতা, লিপস্টিক এবং যাবতীয় প্রসাধনবিহীন সংকোচমুক্ত খোলা মনের অধিকারী মেয়েটির শরীর স্পর্শ করেছিলো? কোথায়? কীভাবে? কেন সে এমন বীতশ্রদ্ধ তার ওপর? এসব কথা তো আর মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করা যায়না, আমি তার কন্ডাক্টরের দিকে হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকাকে জরীপ করতে থাকি। এরকম আরো কিছু যদি ঘটায় সে, আমার কাছ থেকে রেহাই পাবে না। কেন যেন আমার মনে হতে থাকে সে এমন কিছুই করেছে আমার পাশে বসা সুকন্ঠীকন্যার সাথে। কেন এমন মনে হয় জানি না, তবে তার কন্ঠের মাধুর্য আমি এতক্ষণে উপভোগ করতে পারি। কিছু বিষাদ আর অনুযোগও চুরি করে নিয়ে প্রলেপ মেখে দেই আমার মনের ওপর। কন্ডাক্টরের দিকে রোষদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দৃশ্যপটে এসে উপস্থিত হয় একজন বেশ গাট্টাগোট্টা দেহের প্রৌঢ়া মহিলা। আমার ঠিক সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকার জন্যে একটা রড হাঁতড়ে বেড়াচ্ছে। আমার ভেতর এক দুর্বিষহ ভালোমানুষী কাজ করে পাশে বসে থাকা সঙ্গীনির প্রভাবেই হয়তো! একটু আগে তার সাথে কথা বলতে গিয়ে একটু কাছে ঘেঁষেছিলাম।
শরীরের সাথে শরীর কী যেন ফিসফাস করেছিলো শুনতে পাইনি।
আমি আরো কাছে ঘেঁষতে ভয় পাই! তাহলে হয়তোবা আমি সেই বদমাশ কন্ডাক্টরের মত হয়ে যাব। তবে কথা হল, কোথায় সেই কন্ডাক্টর আর কোথায় আমি! কন্ডাক্টরের সেই একই বাজে আচরণ আমি যদি চতুরতার খাপে মুড়িয়ে তার সাথে করি, তার প্রতিক্রিয়া নিশ্চয়ই একরকম হবে না! মেয়েটি কেমনভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করত তা জানার জন্যে আমি সময় এবংপরিস্থিতির শরনাপন্ন হতে পারতাম, কিন্তু বললাম না, সেই দুর্বিষহ ভালোমানুষীর বোধ আমাকে টানছিল আর খোঁচাচ্ছিল শুধু। তা সহ্য করতে না পেরে আমি গাট্টাগোট্টা মহিলাটিকে বসার জায়গা করে দিই তার পাশে।
-এইখানে বসেন।
মহিলাদের সাথে ভীড়বাসে এই সৌজন্যটা আমি প্রায়ই করে থাকি। তবে সবসময় না। যদি দেখি যে তিনি অশক্ত এবং দুর্বল, অথবা এমন ভীড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে অভ্যস্ত না, তবেই কেবল। এই মহিলার সেটা প্রয়োজন ছিলো না। আমার পাশে বসা যাত্রাসঙ্গীও হয়তো সেটা চাচ্ছিলো না। হয়তো, হয়তো না। তাকে আর দেখা হয়নি। আমার জানা হয়নি তার মনের ভেতরটা। শুধু উঠে আসার সময় তার কাঁধের ওপর কালচে ব্রায়ের স্ট্র্যারপ দেখে বাকিপথটা মানুষের ভীড়ে দৃষ্টির অগোচরে চলে গিয়ে নিজের দুর্বিষহ ভালোমানুষীর ছদ্মবেশী মুখোশটা টেনে খুলে ছিবড়ে হেঁচড়ে মনের পঙ্কিল যৌনাশয়ের কালো পানির ভেতর ডুবিয়ে ধ্বংস করে নির্বাণ লাভের চেষ্টা করেছিলাম বৃথাই। আমার স্টপেজে এসে গেলে নেমে গিয়ে পিছু ফিরে তাকিয়ে তাকে আর দেখতে পাই নি...
বাসায় ফেরার পথে কিছু কেনাকাটা করলাম। একটা এ্যালার্ম ঘড়ি, পাড়াতুতো আশৈশব প্রেমিকার সাথে রাস্তায় দেখা হয়ে যাওয়াতে একটা চুম্বন। চুম্বনকে কখনও ক্রয়যোগ্য ভাবিনি আমি। অন্তত প্রেমিকার কাছ থেকে তো অবশ্যই না! হয়তো বা সে সেঁধেই দিতো, কিন্তু নির্জন গলিতে আমার জোরাজুরিতে সে বাধ্য হয়ে নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছেকে আমার কাছে সমর্পণ করে অথবা বিকিয়ে দিয়ে গোমড়ামুখে উল্টোপথে রওনা দেয়।
-এই কোথায় যাচ্ছ?
-দর্জির কাছে। কিছু জামা বানাতে দেব।
-আমিও যাচ্ছি তোমার সাথে।
-অনেক সময় লাগবে। তুমি অধৈর্য্য হয়ে পড়বে।
-নাহ আমারও কিছু ফরমায়েশ আছে...
-কী বললে? লেডিস টেইলর্সে আবার তোমার কীসের ফরমায়েশ? হিহিহি!
তার হাসিকে পাত্তা না দিয়ে আমার বেমক্কা বলে ফেলা অন্যশব্দকে অন্যকিছু দিয়ে বুঝিয়ে আমিও তার সাথে রওনা দিই।
দর্জির দোকান। মেয়েদের কাপড়। রঙের মেলা। লাল, নীল, সবুজ। আমার পছন্দ সবুজ। লালও ভালো লাগে মেয়েদের পোষাক হিসেবে। বাসের ভেতর সেই মেয়েটা লাল কামিজ পড়ে ছিলো। ফ্যাকাশে রঙের কামিজ। ক্যাটক্যাটে লাল ওড়না। সে সাজতে পারেনা মোটেই। অথবা সে ওসবের তোয়াক্কাই করে না! আমার প্রেমিকা বেশ কিছু কাপড়ের সাথে একটি শাড়ীও নিয়ে এসেছে। রিপু না ফলস পাড় কিসব যেন করবে। শাড়িটা সুন্দর। আকর্ষণীয়। লাল শাড়ি। সে দর্জিকে কী সব নির্দেশনা দিতে থাকে, আমি বুঝিনা। আমি শুধু বুঝি যে, রুক্ষ ত্বকের, সাজে অনাগ্রহী কোন মেয়েও প্রতিমার মত সুন্দর হয়ে উঠতে পারে, যৌনাবেদনময়ী হতে পারে ঠিকমত সাজলে, আর এমন একটা শাড়ি পরলে। এমন একটা টকটকে লাল শাড়ি পরলে । দর্জির দোকানের কাজ শেষ হলে আমার প্রেমিকা কিছুক্ষণ তার সাথে গল্প করার আহবান জানায়। কিন্তু আমার বড্ড অনাগ্রহ জাগে। অবসন্ন বোধ হয়।
অনেক গল্প হয়েছে আজকে।
আজ আমি তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করি। কাল সকালে উঠতে হবে। অনেক কাজ পড়ে রয়েছে। চন্দ্রগ্রস্থ রাতে প্রেমিকার সাথে ফোনে রুটিন ভালোবাসাবাসির পালা শেষ করে শরীর এলিয়ে দিই বিছানায়। আমার প্রেমিকা। আশৈশব বন্ধু, বাকি জীবনের জন্যে প্রতিশ্রূতিবদ্ধ। তার কথা ভেবে ভবিষ্যতের পথ চলার শক্তি পাই, রাত্রিকালীন অস্থিরতা এবং দুশ্চিন্তার জন্যে সে যেন এক কৌটো ভ্যালিয়াম! তার মুখটা ভাবতে ভাবতে কামের আবেগ সরিয়ে ঘুমের আবেশে জড়িয়ে বিছানায় এলিয়ে দিই নিজেকে। এ্যালার্মঘড়িতে সময় নির্ধারণ করে রাখি সকাল সাতটা।
হঠাৎ যেন চারিদিক থেকে পাগলাঘন্টী বেজে ওঠে। অশরীরী স্বরেরা ফিসফিস করে হিসহিস করে। আমাকে জাগিয়ে তোলে। সকাল হয়নি তখনও। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এ্যালার্মঘড়ি ঘুমোচ্ছে, তার টিকটিক শব্দে কিসের মাদকতা, কিসের আয়োজন, কিসের ষড়যন্ত্র, আমি খুব আঁচ করতে পারি। আমার বাড়ির পাশের বৃক্ষরাজির পাতাসমূহ ধ্বংসের বিউগল বাজাতে থাকে, বাতাসে গোপন কুমন্ত্রণা, ঘরে অসহনীয় উত্তাপ। এই উত্তাপে গলে পড়তে থাকে বাসার কড়িবর্গা, কঙক্রিট, পিলার, আসবাব। কিসের যেন একটা তাড়া, কে যেন আমাকে তাড়িত করছে, ভয় দেখাচ্ছে এখান থেকে চলে যাবার জন্যে। আমি ভয় না পেয়ে ধীরেসুস্থে সবচেয়ে ভালো কাপড় বেছে নিয়ে পরতে থাকি, যত্ন নিয়ে চুল আঁচড়াই। প্যান্টের পকেটে মানিব্যাগ খুঁজতে গিয়ে দেখি নেই, তার বদলে একটা টিকেট। একটা লোকাল বাসের টিকেট। সময় রাত দুটো। হ্যাঁ! এইতো আমার দরকার ছিলো!
বাসস্টপে কেউ নেই। শুনশান পাড়া, নিশ্চুপ রাস্তা। সবাইকে আজ মরণঘুমে পেয়েছে। আমি নিরুত্তাপ ভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে থাকি, আর পুড়তে থাকি ক্রমাগত। অসহনীয় উত্তাপটা আবারও ভীতিপ্রদ হয়ে উঠেছে। এসময় হুশ করে বাসটা এসে থামলো আমার সামনে। সেই জরাজীর্ণ লক্করঝক্কর লোকাল বাস। ড্রাইভার আর কন্ডাক্টর ছাড়া ভেতরে কেবল একজনই আছে। আমি জানি সে কে! আমি জানি সে কী পরিধান করে আছে!
হ্যাঁ!
সে এখন প্রসাধনসজ্জিতা। রুক্ষ ত্বককে যথাসম্ভব কোমল করে তুলেছে। তার পরনে সেই লাল শাড়িটা, যা আজ আমার প্রেমিকা দর্জির দোকানে দিয়েছিলো। উফ! তার কি আর কোন শাড়ি ছিলো না! আমার শৈশবসংলগ্ন ভালোবাসার চিহ্নকে সরিয়ে তার কাছে যেতে কুন্ঠাবোধ হয়। যেন জুতোয় বিঁধে আছে পেড়েক। সত্যিই তাই ঘটে! তার পাশে বসতে গিয়ে আমার জুতোয় ধাতব কী যেন একটা আঁটকে যায়। ভীষণ ব্যথায় জর্জরিত হয়ে আমি ভাবি তার কাছে বসব নাকি আগে পায়ের একটা সুবন্দবস্থ করব। লাল শাড়িটা থেকে ঝাঁকেঝাঁকে আরো ব্যথারশ্মি নির্গত হয়ে আমাকে কাবু করে ফেলে। ঠিক তখনই তার কাঁধের ওপর গোখরো সাপের জিভের মত ব্রায়ের স্ট্র্যাপটা দেখে আমি সামলে উঠি। সব সংকোচ সোল্লাসে ছুড়ে ফেলে পাশে গিয়ে বসি।
-এখানে বসাটা খুব সমস্যা, না? সিটগুলো এমন কনজাস্টেড!
-হু, তার ওপর আবার পায়ে কাঁটা না পেড়েক কী যেন বিঁধেছে!
-তুলবেন না রাখবেন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?
-অবশ্যই তুলে ফেলব! এসব রাখার কোন মানেই হয়না! খামোখা ঝামেলা বয়ে বেড়ান। আমি এক্ষুণি তুলে ফেলছি।
-কন্ডাক্টরটা খুব বদমাশ। দেখেন সে আবার কোন বাগড়া দেয় কী না।
-কন্ডাক্টর আবার কী ঝামেলা করবে!
-ওর দিকে তাকান।
বদমাশ কন্ডাক্টর হাস্যকর একটা মেয়েলী চাহনি দিয়ে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। এবং তার চেয়েও হাস্যকর ব্যাপার, তাকে আমার প্রেমিকার মত লাগছে দেখতে। আমি হেসেই উড়িয়ে দিই তার কাছ থেকে কোন রকম প্রতিবন্ধকতা আসার সম্ভাবনা।
আমি আরেকটু কাছ ঘেঁষে বসি আমার সঙ্গীনির।
-আজকে রাস্তায় কি হয়েছে জানেন? এত ফাঁকা ফাঁকা সব। কোথাও কেও নেই। এখানে আসতে আমার কত কষ্ট হয়েছে জানেন!
সে বলে।
-আমারও! আমিও অনেক কষ্ট করে উঠেছি এই বাসে। আর রাস্তা কেন এত ফাঁকা...কেন কোথাও কেও নেই... জানি না, জানি না আমি এসব কিচ্ছুই। জানার দরকারও নেই...সবকিছু জানতে নেই...
হঠাৎ ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল ড্রাইভার।
-ঐ কি হইল, বাস থামাইলা কেন?
-যাত্রী উঠবো।
-যাত্রী উঠবো মানে! টিকিট ছাড়া যাত্রী উঠাও, ফাইজলামি কর মিয়া?
ড্রাইভারকে আমার সাথে তর্কে আগ্রহী মনে হয় না। বিকেলের সেই গাট্টাগোট্টা প্রৌঢ়া মহিলা হুড়মুড় করে উঠে পড়ে বাসে। সে আমার সামনে এসে টিকেটটা ঘড়ির পেন্ডুলামের মত দুলোতে থাকে মুখে একটা বদখত হাসি নিয়ে।
-এটা আমার সিট। সরেন!
আমি নাম্বার মিলিয়ে দেখি। তার দাবীর সত্যতা যাচাই করে উঠে পড়ি বিরস বদনে। উঠে যাবার আগে একবার অনুরোধ করি,
-আরো তো সিট আছে ওখানে গিয়ে বসেন না!
-নাহ! আমি এইখানেই বসুম! এইখানে অনেক বাতাস।
মহিলা আমাকে জোর করে উঠিয়ে দিয়ে তার পাশে বসে। হয়তোবা আমাদের আরো উশকে দেবার জন্যে ইচ্ছে করেই নাক ডাকতে থাকে বিশ্রীভাবে।
-তুমি উঠে আসো, আমরা অন্য কোথাও বসব।
আমার যাত্রাসঙ্গীনিকে আমি আহবান করি। কিন্তু প্রৌঢ়া মহিলা আয়তনে এমন প্রকান্ড, আগে বুঝিনি। তাকে ঠেলেঠুলে বের হয়ে আসাটা অসম্ভব ব্যাপার। আর যেভাবে নাক ডাকছে, এই ঘুম এই রাতে আর ভাঙবে বলে মনে হয় না। অথচ এই রাতটাই আমাদের দরকার! এমন রাত হয়তো আর কখনও আসবে না। এমন বাস আর কখনও আসবে না। বাস চলছে দুর্বার গতিতে। এখনও অন্ধকার কাটেনি, বরঙ আরো গাঢ় হয়েছে। তবে যে গতিতে বাস চলছে অন্ধকারকে অতিক্রম করে, যেকোন মুহূর্তে আলোকরশ্মি এসে আমাদের ভস্মীভূত করে ফেলতে পারে। উফ! পায়ের ব্যথাটা আরো বাড়ছে। প্রথমে ভেবেছিলাম একটা পেড়েক ঢুকেছে হয়তো, এখন মনে হচ্ছে শাবলসদৃশ্য বস্তু হবে। সেই ভালো! এখন এটাই আমার দরকার! জুতো থেকে শাবলটা বের করে আমার সঙ্গীনিকে দেখাই,
-এটা দিয়ে চাড় দিয়ে তুলবো শয়তানীকে!
-আমিও একটা শাবল পেয়ে গেছি ডার্লিং! তবে আর দেরী না। তাড়াতাড়ি কাজ শুরু কর।
আমরা দুজন দুদিক থেকে মহিলার কোমরে, নিতম্বে, পেটে চাড় দিয়ে ওঠানোর চেষ্টা করতে থাকি। ভীষণ ভারি। ক্রমশ সে যেন আরো ভারি হয়ে উঠছে। আমাদের শক্তি ফুরিয়ে যেতে থাকে। ঘেমে স্নান করে ফেলি।
-তোমার এইটুকু শক্তি নাই, কি কামের পুরুষ হইছ তুমি?
তীব্র অতৃপ্তি আর আকাঙ্খা নিয়ে সে আমার দিকে বাক্যবাণ ছুড়ে দেয়। অবিরাম শাপশাপান্ত করতে থাকে আমাকে।
-আর একটু, আর একটু হয়ে যাবে, হয়ে যাচ্ছে! তুমিও একটু হেল্প কর না! একা কী করে আমি এই জগদ্দল পাথরকে ওঠাবো?
-আমি করতেসি না? উফ! আর তো পারছি না! মারা যাবো!
সে তার শাড়ি খুলে ফেলে ভয়ংকর উত্তাপ সহ্য করতে না পেরে। শেষবারের মত দুজন মিলে সর্বশক্তিতে চাড় দিয়ে মহিলাকে জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলতে সক্ষম হই।
-এবার! এবার তোমার পাশে বসব। তারপর অনেক দূরে চলে যাব দুজন মিলে।
আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বলি।
-কী যা তা বলছেন?
তার শরীর পুনরায় আবৃত করছে শাড়ি। মলিন লাল রঙের শাড়ি। রাতের আঁধার কেটে যাচ্ছে। ঘামে ভিজে তার প্রসাধন উবে গেছে কখন! ক্লান্তিতে চোয়ালের হাড় বেরিয়ে পড়েছে। অনাকর্ষনীয়া। অগ্রাহ্য করার মতই। কন্ডাক্টরটি আমার পরম বন্ধুর মত মোলায়েম কন্ঠে কাঁধে হাত রেখে বলে,
-আপনার স্টপেজ আইসা পড়ছে। নাইমা যান। আমি নেমে যাই অনাকর্ষনীয়া মেয়েটির দিকে দ্বিতীয়বার না তাকিয়ে। ড্রাইভারটার সাথে কিছু কথা বলার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সে মনে হয় তার রাতের ট্রিপে লাভ করতে পারেনি বলে রুষ্ট। আমাকে পাত্তাই দিলো না! সে যাকগে।
বাসায় পৌঁছোনোর পথে আমার প্রেমিকাকে দেখি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভোরের শুভ্রতার সাথে সখ্য করছে। আমাকে দেখে আদুরে কন্ঠে জিজ্ঞাসা করে,
-কোথায় গিয়েছিলে এই সক্কালবেলা?
-কোথায় আর যাব? যাবার আর কোন জায়গা আছে বল? একটু মর্নিংওয়াক করতে বেড়িয়েছিলাম!
পাশের কোন এক বাড়ি থেকে তখন নচিকেতার গান বাজছে,
"সকাল থেকে লুকোচুরি
খেলা শুরু করি
আমরা চোর,
আর সূর্য সেপাই..."
৬৭টি মন্তব্য ৬৭টি উত্তর
পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন
আলোচিত ব্লগ
ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।
ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!
সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন
কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?
জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী
ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)
সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)
সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন
জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা
বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন